হঠাৎ তুমি এলে পর্ব-২৩

0
651

#হঠাৎ_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২৩

গন্ধটাকে পাত্তা না দিয়ে রুপার সাথে কথা বলতে লাগলাম।অল্প সময় পর গন্ধটা আরও তীব্র হলো।কিসের গন্ধ বুঝতে না পেরে রূপাকে বললাম
– আপনি কি একটু লাইনে থাকবেন।কিসের একটা গন্ধ আসতেছে একটু দেখব।
– আচ্ছা, ঠিক আছে।আপনি দেখুন আমি লাইনেই আছি।

আমি গন্ধটার দিকে এগুতে লাগলাম৷ খেয়াল করলাম গন্ধটা রান্না ঘর থেকে আসতেছে।তাই দেড়ি না করেই রান্না ঘরে গেলাম।রান্না ঘরে গিয়ে আমার মাথায় হাত পড়ল।কারণ রুপার সাথে কথা বলতে বলতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম চুলায় ভাত বসিয়েছি ।এজন্য ভাত পুড়ে পুড়া গন্ধ বের হচ্ছিল।তখন কি করব বুঝতে না পেরে তাড়তাড়ি চুলা বন্ধ করে রুপাকে বললাম-
– সত্যি বলতে কি, একটা আকাম করে ফেলেছি।

খেয়াল করলাম ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ আসছে না।বুঝতে পারলাম রূপা কলটা আগেই কেটে দিয়েছে।তাই রুপাকে পুনরায় কল দিলাম।রূপা কলটা ধরে বলল-
– কিসের গন্ধ ছিল বের করতে পেরেছেন কি?আপনি কথা বলছিলেন না তাই ভাবলাম ফোনে টাকা নষ্ট করে লাভ কি। তাই কেটে দিয়েছিলাম।মনে কষ্ট নিবেন না।

ভাত পুড়ে যাওয়ায় মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল।কারণ এখন নতুন করে ভাত রান্না করে খাওয়ার মত রুচি বা শক্তি আমার নাই।আমি কষ্টভরা গলায় বললাম-
– নাহ, মনে কষ্ট নিই নি।আমি ভাত বসিয়েছিলাম তো কিন্তু আপনার সাথে কথা বলতে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।তাই কখন যে ভাত পুড়ে গিয়েছে খেয়ালেই করে নি। গন্ধটা ভাত পুড়ার ছিল।
– হায় আল্লাহ্ কি বলেন!এখন খাবেন কি?তাহলে আবার ভাত রান্না করুন।
– এখন নতুন করে ভাত রান্না করে খাওয়ার রুচি নেই।রান্না করা বহুৎ ঝামেলা।আর ঝামেলা করতে পারব না।একেবারে কালকে সকালে খাব।(হতাশা গলায়)
– তাহলে আর কি করবেন।না খেয়েই থাকুন।
– হ্যাঁ তাই তো করতে হবে।(অসহায় গলায়)
রূপা হুট করে বলে বসল-
– এখন রাত নয়টা বাজে।একটা কাজ করুন আমার বাসার সামনে একটু আসুন।আমি বাইরে বের হয়ে আপনাকে নিয়ে একটু ঘুরতে যাব নে।তখন না হয় বাইরে থেকে কিছু খেয়ে নিবেন।

এত রাতে অকারণে যদিও এর আগে কখনও বের হই নি তবে রূপার কথা ফেলে দেওয়ার মত কোন উপায় ছিল না।তাই রূপাকে বললাম-
– আপনি একটু অপেক্ষা করুন।আমি তৈরী হয়ে বিশ মিনিটের মধ্যেই আসছি।
– আচ্ছা ঠিক আছে।

কলটা কেটে তৈরী হতে নিয়ে বেশ দ্বিধায় পড়ে গেলাম কিভাবে গেলে ভালো হবে এটা ভেবে।বেশ চিন্তা করে নিজেকে পরিপাটি করে বের হলাম গন্তব্য রূপার বাসা।রূপার বাসার সামনে গিয়ে রূপাকে কল দেওয়ার আগেই একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল।রূপার বাসায় কুকুর আছে রূপাতো বলে নি।অপরদিকে আমি কুকুরকে অনেক ভয় পাই।কোন গতি না পেয়ে রূপাকে কল দিলাম।কল দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম-
– আপনার বাসায় যে কুকুর আছে বললেন না তো।কুকুরের দৌঁড়ানি খাব না তো?
রূপা এক গাল হাসি দিয়ে বলল –
– কি যে বলেন না।এ কুকুর আপনাকে কিছুই করবে না।এটা আমাদের পোষা কুকুর।
– কিছু করবে না মানে?যে হারে ঘেউ ঘেউ করতেছে মনে হচ্ছে তো এখনেই কামড় দিয়ে বসবে। কুকুরের কামড় কিন্তু অনেক মারাত্মক।
– ভালো করে দেখুন কুকুরটা বাঁধা।আপনাকে কিছুই করতে পারবে না।আপনাকে আমি জানালা দিয়ে দেখতে পারতেছি।আপনি একটু ডান দিকে এসে উপরের দিকে তাকান।

কুকুরটাকে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম সত্যিই কুকুরটা বাঁধা।কুকুরটাকে বাঁধা দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম এবং দেড়ি না করেই রূপার কথা মত ডানদিকে এসে উপরের দিকে তাকালাম।রূপা জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে বলল –
– এই যে আমি দেখতে পারছেন?একটা দঁড়ি দিয়ে ব্যাগ ফেলব একটু ব্যাগটা ধরবেন ঠিক আছে।
আমি বুঝতে পারছিলাম না রূপা ঠিক কি করতে চাচ্ছে।রূপার মাঝে যে একটা পাগলামির অভ্যাস আছে সেটা বেশ ভালো বুঝতে পেরেছিলাম।তাই এতশত না ভেবে জানালার নীচে দাঁড়ালাম।তারপর উপর থেকে খেয়াল করলাম একটা ব্যাগ নীচের দিকে পড়ছে।আমি দঁড়ি থেকে ব্যাগটা খুলে রূপাকে কল দিয়ে বললাম-
– ব্যাগাটা দঁড়ি থেকে খুলেছি।দঁড়িটা উপরে তুলে ফেলুন এবার।কিন্তু এ ব্যাগে কি?আপনি কি নীচে নামবেন না।
রূপা কথাটা একটু টান দিয়ে বলল-
– মাথা খারাপ আপনার? এত রাতে বের হব?বাবা জানলে হাড় ভাঙ্গবে আমার।সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে বের হওয়া নিষেধ।আপনি এবার চলে যান।
রূপার কথা শুনে হালকা অভিমান জমল মনে।ও বের হবে বলেই আমি তখন বের হয়েছিলাম তা না হলে বের হতাম না।অভিমানী গলায় বললাম-
– তাহলে আসতে বললেন কেন?আমি তো শুধু আপনার সাথে দেখা করব বলে বের হয়েছিলাম।
রূপা একটা অট্ট হাসি দিয়ে বলল-
– আপনার মনে হয় বেশ রাগ হচ্ছে।রাগ হওয়ার মত কিছু হয় নি।ব্যাগটা দেওয়ার জন্যই আসতে বলেছিলাম।
অমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
– এ ব্যাগে কি আছে?বলা যাবে কি?
– আছে কিছু একটা।আপনি বাসায় গিয়ে ব্যাগটা খুলে দেখুন কি আছে।বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে না।

আমি মন ভাঙ্গা নিয়ে বাসায় গেলাম।মনে মনে একটু রাগ ও হল রূপার উপর।ভাবতে লাগলাম একটা অপরিচিত মেয়ের জন্য আমার এত রাগ অভিমান আসছে কেন?রাগ অভিমান তো তাদের জন্য আসে যারা অনেক পরিচিত এবং আপন হয়।অথচ এ মেয়েটার সাথে পরিচয় মাত্র দুইদিনের তাহলে এত রাগ অভিমান মায়া কেন কাজ করছে।এসব ভাবতে ভাবতে বাসায় গেলাম।বাসায় গিয়ে ব্যাগটা খুলে বিস্মিত হয়ে গেলাম।এ মেয়েটার মধ্যে পাগলামির গুণ আছে সেটা বুঝতে পেরেছিলাম কিন্তু মায়াও আছে সেটা বুঝতে পারিনি।ব্যাগে দুইটা বাটি ছিল এক বাটিতে চিংড়ি মাছের তরকারি ছিল আরেক বাটিতে ভাত।একটা অপরিচিত মেয়ে আমার জন্য এমন করেছে ব্যাপারটা বেশ আনন্দদয়ক লাগল।সত্যিই মেয়েটার মাঝে অদ্ভুত ভালোলাগার একটা বিষয় আছে।

হাতে বাটিটা নিয়েই রূপাকে কল দিলাম।রূপা কলটা ধরে বলল-
– বাটিতে কি আছে দেখেছেন?এজন্যই আসতে বলেছিলাম।আমার জন্য আপনার ভাত পুড়ে নষ্ট হয়ে গিয়েছে।রাতে না খেয়ে থাকলে মোটেও ভালো লাগত না।তাই বাসায় যা ছিল তাই দিলাম।
– আরে কি যে বলেন না আপনার জন্য কেন নষ্ট হবে।এতকিছু না করলেও পারতেন।রাতে না খেয়ে থাকার অভ্যাস আছে আমার।
– আরে ইয়ার এটা তেমন কিছু না।খেয়ে নিন।

রূপার আরে ইয়ার কথাটার সাথে সেদিন প্রথম পরিচিত হই।এটা তার চিরাচায়িত ডায়লগ ছিল।সেদিন রূপার হাতের রান্না খেয়ে দ্বিতীয়বারের মত রূপার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম।সেদিনের পর থেকে রূপার সাথে আমার পথচলা শুরু।তবে রূপার কিছু অদ্ভুত পাগলামি ছিল।সবসময় সে কোন না কোন পাগলামি করত।যদিও তার পাগলামিগুলো আমার বেশ ভালো লাগত।কারণ তার পাগলামির মাঝেও অন্যরকম ভালোবাসা লুকিয়ে থাকত।রূপা খুব মিশুক ছিল অল্প দিনের মধ্যে সে খুব আপন করে নিল আমাকে।নিজের অজান্তেই তাকে আমি অনেক ভালোবেসে ফেললাম।এক বছরের একটা সম্পর্কটাকে মনে হয়েছিল একশ বছরের একটা সম্পর্ক। এর মধ্যে আমি ডাক্তার হয়ে বের হয়ে গেলাম।সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে চলে আসলো।

রূপার পাগলামির দিকগুলো তাহলে বলি আপনাকে।একদিন রূপা রাত তিনটায় শীতের কনকনে রাতে ফোন দিয়ে বলল-
– আরে ইয়ার আমার তোমাকে অনেক দেখতে মন চাচ্ছে তুমি একটু আসো তো।একদম ভালো লাগছে না।

আমি রূপার এমন আবদার শুনে মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলাম রাত তিনটা বাজে।এসময় বাইরে বের হতে বলছে কেন?মনে মনে ভাবলাম রূপার কি কোন কিছু হয়েছে।আমার মধ্যে নিমিষেই অস্থিরতা চলে আসলো।অস্থির হয়ে বললাম-
– তোমার কি কিছু হয়েছে?এত রাতে আসতে বলতেছ যে।কোন ঝামেলায় পড়েছ নাকি?
– আরে ইয়ার কিছু হয় নি।তোমাকে দেখতে মন চাচ্ছে।তাই আসতে বলতেছি। একটু আসো ।একটু দেখা হলেই চলে যেও।
ঘুম ঘুম গলায় বললাম-
– রূপা এত রাতে আসতে পারব না।কত ঠান্ডা বাইরে।ঘুমাও তুমি সাকালে দেখা হবে।

কিন্তু কে শুনে কার কথা।একরোখা ছিল অনেক, তার একরোখামিতে কখনও পেরে উঠতাম না।সেই রাতেই বের হয়ে গেলাম রূপার বাসার সামনে যাওয়ার জন্য।কনকনে শীতের রাতে রূপার বাসার সামনে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে কল দিলাম রূপাকে।চার, পাঁচবার কল দেওয়ার পর রূপা ঘুম ঘুম গলায় বলল-
– অরন্য আমি ঘুমিয়ে পড়েছি।এখন কম্বলের নীচে থেকে বের হতে মন চাচ্ছে না তুমি চলে যাও।তার উপর এত শীতে বের হয়ে জানালার পাশে আসতে পারব না।কষ্ট করে এসেছ এতেই খুশি।যাও গিয়ে ঘুমাও।
মেজাজটা চড়ে গেল খুব, বকতে যাব এর মধ্যেই ফোনটা কেটে বন্ধ করে ফেলল।

রাগ নিয়ে বাসায় গেলাম।মনে মনে ভাবলাম কালকে এর জন্য বকব।এসব ভেবে আবার ঘুমালাম।সকাল বেলা কলিং বেলের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গল।ঘঁড়ির কাটায় খেয়াল করলাম ছয় টা ত্রিশ বাজে।এত সকালে আমার বাসায় কে আসবে বুঝে উঠতে পারছিলাম না।ঘুমঘুম চোখ নিয়ে দরজা খুলে বেশ অবাক হলাম।কারণ দেখলাম দরজার সামনে রূপা দাঁড়ানো।রূপাকে দেখেই রূপার প্রতি থাকা সব অভিমান চলে গিয়েছিল।কারণ রূপার ঐ চোখে তাকিয়ে যেন সবকিছু বেমালুম ভুলে যাওয়া যায়।রূপা এ প্রথম এ বাসায় এসেছে।না জানি দারোয়ানকে কি বলে ঢুকেছে।রূপার পাগলামির উপর আমার একদম ভরসা নেই।রূপা আমার দিকে তেড়ে এসে বলল-
– আরে ইয়ার এখনও এত ঘুম কিসের? উঠো।সাড়ে ছয়টা বাজে।এত সকাল পর্যন্ত ঘুমাচ্ছ কেন।
আমি মুখে হাই তুলতে তুলতে বললাম-
– শীতের সকালে এটাকে এত সকাল বলে না।আবার মাথায় কি ভূত চাপল একদম বাসায় চলে আসলে যে।এত সকাল সকাল আসলে কি করে?
রূপা আমার মাথার চুল টেনে ধরে বলল-
– এত কিছু তোমাকে জানতে হবে না।আমার কাছে সব কাজেই সহজ।আমি সব পারি।এবার উঠো।ঘরে কি কি আছে বলো রান্না করে নাস্তা করব।
– তা না হয় রান্না করলে সমস্যা নেই।তবে এখানে এত সকালে আসলে যে তোমার বাবা কিছু বলবে না?
(এরপর রূপা যা বলল তা শুনে আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।সত্যিই মেয়েটা বড্ড পাগল)
– বাবাকে রাতে দুধের গ্লাসে ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দিয়েছি। চিন্তা করো না মরবে না।একদম অল্প পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ দিয়েছি।শুধু কড়া ঘুম হবে।সকাল দশটার আগে ঘুম ভাঙ্গবে না বাবার।তখন আমাকে না দেখলেও সমস্যা নেই, কারণ তখন আমি কলেজে যাওয়ার জন্য বের হই।আর বাসায় অটো লক আছে। আমি লক করে আসি একটা চাবি আমার কাছে আরেকটা চাবি বাবার কাছে থাকে। কোন সমস্যা হবে না।
আমি মথায় হাত দিয়ে বললাম
– তোমার কি পাগলামি অভ্যাস যাবে না।এমন করার কি কোন দরকার ছিল।নিজের বাবাকে ঘুমের ঔষধ দিয়েছ লুকিয়ে।কি যে করো না তুমি।তোমাকে নিয়ে আর পারতেছি না।কবে এসব পাগলামি যাবে তোমার।
রূপা আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল-
– ব্যাগে করে কফি আর গুড়ো দুধ নিয়ে এসেছি।আমি কফি বানিয়ে দিচ্ছি।আমার কফি খেলে তোমার সব ঘুম চলে যাবে, দেখবে একদম চাঙ্গা হয়ে গিয়েছ।
– থাক রূপা আর পাগলামি করতে হবে না।তুমি ঐ চেয়ারটাই বসে বিশ্রাম করো আর আমি একটু ঘুমাই।বেশ ঠান্ডা পড়েছে, শীত শীত লাগছে অনেক।এ বলে আমি একটু এগিয়ে যেতে নিলাম।রূপা আমার গেন্জি টেনে ধরে বলল-
– আরে ইয়ার কোথায় যাচ্ছ।আমি এত কষ্ট করে দেখা করতে আসলাম তোমার সাথে কফি খাব বলে আর তুমি চলে যাচ্ছ।একদম যাবে না এখানে বসো।

আমি বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলাম রূপা যে একরোখা আমাকে যেতে দিবে না।তাই ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে বসলাম রূপার পাশে।রূপা বকবক করে যাচ্ছিল আর কফি বানাচ্ছিল।তখন ওর চাঞ্চলতা দেখে আমার চোখ থেকে নিমিষেই ঘুম চলে গেল।রূপার দিকে তাকিয়ে রূপার কথায় মনোযোগ দিলাম রূপা তখন কফি বানানোর রেসিপিটা শিখিয়েছিল।ঐ যে আপনাকে বানিয়ে খাওয়ালাম আজকে, সেটা রূপার কাছ থেকেই শিখা।সেদিন রূপা রেসিপিটা বলতেছিল আর তার দিকে আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম।রূপা সমপরিমাণ কফি, চিনি আর পানি নিয়ে বলল –
– এবার এটাকে ঘুটতে হবে।

এই বলে কাটা চামচ দিয়ে ঘুটতে লাগল আর মুখের বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে লাগল।আমি রূপার অঙ্গভঙ্গি দেখে ভিতরে ভিতরে হাসিতে লুটোপুটি খাচ্ছিলাম।রূপার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কোন যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেমেছে।এত হাসি পাওয়ার পরও নিজেকে বেশ দমিয়ে রাখলাম।কারণ ভুলক্রমে হেসে দিলে রূপার যে রাগ আর পাগলামির স্বভাব আমার বারোটা বাজাবে।তাই নিজের হাসি দমিয়ে রূপাকে দেখতে লাগলাম।এর মধ্যে রূপা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নাড়ানো বন্ধ করল।খেয়াল করলাম মিশ্রণ গুলো ফোমের মত হয়েছে।তারপর গরম পানিতে পরিমাণমত গুড়ো দুধ নিয়ে ফোমটা ঢেলে দিয়ে মিশিয়ে নিল।আর আমার দিকে বাড়িয়ে দিল খেতে।খাওয়ার পর বেশ ভালোই লেগেছিল।তার উপর যে যুদ্ধ করে বানিয়েছে ভালো না হলেও ভালো বলাটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে গেল।তবে কফিটা সত্যিই অসাধারণ হয়েছিল।সেই যে কফির রেসিপিটা শিখেছিলাম আজও ভুলে নি।

রূপার কথা অণুযায়ী সত্যি সত্যি কফিটা খাওয়ার পর ঘুম চোখ থেকে পুরোপুরি উড়ে গেল।কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে বললাম-
– সত্যিই রূপা তোমার কফিতে যাদু আছে।কফিটা খাওয়ার পর শরীরটা একদম চাঙ্গা হয়ে গিয়েছে।
– আরে ইয়ার বলেছিলাম না একদম চাঙ্গা হয়ে যাবে।আচ্ছা আর কি খাওয়া যাই বলতো।তোমার ঘরে কি কি আছে।
– এখানেই আছে সব।এর বাইরে কিছু নেই।ব্যাচেলর মানুষ কোনরকমে রান্না করে খাই আর কি।
রূপা ভালো করে খেয়াল করে হাতে আলু নিয়ে বলল-
– আলু পুড়া খাবে।অনেক মজা।একবার খেলে এর স্বাদ জীবনে ভুলবে না।
– আলু পুড়া কি?এরকম তরকারির নাম তো আগে শুনি নি।(বিস্ময়ের সুরে)
– দাড়াঁও দেখাচ্ছি।গ্রামে গেলে ঐখানে মাটির চুলায় গরম ছাই এর মধ্যে পুড়িয়ে খেতাম, শহরে তো আর মাটির চুলা নেই। তাই গ্যাসের চুলাতে পুড়িয়ে খাই।বেশ মজা লাগে।এই যে গ্যাসের আঁচটা কমিয়ে এবার আলুগুলো দিয়ে দিব। এ হালকা আঁচে আলুগুলো সিদ্ধ হয়ে যাবে।

এ বলে রূপা একটার পর একটা কথা বলতে লাগল।রূপার কথাগুলো শুনে বেশ মজা পেতাম।কারণ সে দুনিয়ার সবচেয়ে বেরসিক কথাটাকেও সবচেয়ে রসিকভাবে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে উপস্থাপন করত। আর কতক্ষণ পর পর হি হি করে হাসি দিয়ে উঠত।আমার দিক থেকে কথা হোক আর না হোক ও আপন মনে কথা বলে যেত।আমি শুধু ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতাম।কথার ফাঁকে গ্যাসের চুলাটা নিভিয়ে বলল-
– আলুপুড়া হয়ে গিয়েছে। দাঁড়াও আমি তুলে আলুর খোসা ছাড়িয়ে দিচ্ছি।

এ বলে আলুটা তুলে খোসা ছাড়ানোর শেষে আমাকে দিল।আমি গরম গরম মুখে নিলাম।সত্যি বলতে এটার স্বাদ ছিল অসাধারণ।
রূপার হাতের রান্না অনেক মজা ছিল। যা রান্না করত তাই হাত চেটে খাওয়ার মত ছিল। কিন্তু রূপার বিশেষ চা খেয়ে আমার বারোটা বেজে যেত।

রিলেশনের সাতমাস পার করার পর রূপা তার বাবার সাথে আমাকে বন্ধু হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়।রূপার বাবার সাথে বেশ ভালোই ভাব জমে গিয়েছিল।প্রতিদিন একবার যেতে বলত।আমিও সময় পেলেই ছুটে যেতাম।তবে সেখাইনেই ঘটে বড় বিপত্তি। প্রতিদিন রূপার স্পেশাল চা খেয়ে আমার যাই যাই অবস্থা।অপরদিকে রূপার রাগের কাছে হার মেনে আমাকে এসব স্পেশাল চা প্রতিদিন হজম করতে হত।না পারতাম বলতে না পারতাম খেতে।তাহলে কয়েকটা স্পেশাল চায়ের বর্ণনা বলেই ফেলি।
সেদিন রূপার বাসায় প্রথম গিয়েছিলাম ওর বাবার সাথে পরিচিত হতে।দরজা খুলেই আঙ্কেলকে প্রথম দেখে সালাম দিলাম।আঙ্কেল সালাম গ্রহণ করে বসতে বললেন।আমিও বাধ্য ছেলের মত বসে পড়লাম। তারপর আঙ্কেল আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করল।আমি বাধ্য ছেলের মত সবকিছুর জবাব দিলাম।অতঃপর আঙ্কেলের আমাকে বেশ ভালো লেগে গেল।সেই খুশিতে আমার প্রিয়তমা রূপা আমার জন্য একটা স্পেশাল চা বানিয়ে আনল। আমি চা টা খেয়ে কি করব বুঝতে পারছিলাম না।মনে মনে ভাবছিলাম চায়ের স্বাদাটা এমন কেন?চায়ে কি এমন দিল যে আমার গলা এমন জ্বলে গেল। আঙ্কেলের সামনে তেমন কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না।অসহায় দৃষ্টিতে রূপার দিকে তাকালম।রূপা আমাকে ইশারা দিল চা টা যেন পুরো খাই।কিন্তু এ চা আমি কিভাবে খাব বুঝতে পারছিলাম না।কিন্তু এ চা না খেলে পাগলিটা আবার ক্ষেপে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে চা টা খেলাম।সেদিন চা টা খেয়ে বাসায় ফিরার পর আমার পেটের বারোটা বাজল।কোনরমে ঔষধ সেবন করে পেটটাকে বারোটা বাজার হাত থেকে রক্ষা করলাম।অতঃপর রূপাকে কল দিলাম।রূপা কল ধরার সাথে সাথে বলে উঠল-
– আরে ইয়ার আমার চা টা কেমন হয়েছিল বলো তো।তোমার জন্য একদম স্পেশাল রেসিপি প্রয়োগ করে বানিয়েছি।
– ভালো হয়েছে।কিন্তু তুমি চা তে কি দিয়েছিলে?চা টা একটু অন্যরকম স্বাদের মনে হয়েছিল।
রপা হাসতে হাসতে যা বলল তা শুনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। কেউ চা এ এমন কিছু দেয় জানা ছিল না।আমার মাথা কিছুক্ষণ এর জন্য স্থির হয়ে গিয়েছিল রূপার কথা শুনে।তার উপর নাম দিয়েছে স্পেশাল রেসিপি।কারণ রূপা বলল-
– শুনো আজকে তোমাকে মরিচের চা বানিয়ে দিয়েছি।মরিচের গুড়ো আর কাঁচা মরিচ হালকা বেটে দিয়েছিলাম ভালো হয় নি চা টা।ভেবেছি তোমাকে এরকম স্পেশাল চা আরও বানিয়ে খাওয়াব আর তুমি আমাকে কেমন হয় বলবে।যদি রিভিউ ভালো পাই তাহলে একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলে ফেলব।আর নাম দিব রূপার রান্নাবান্না।কেমন হবে বলো তো।

আমি অসহায় হয়ে ভিতরে ভিতরে বলে উঠলাম তোমার দিল কি দয়া হয় না।এমন চা খাইয়ে আমাকে মারার প্ল্যান করতেছ নাকি। তবুও মনের কথাটা মনে রেখে মুখে একটা হাসি দিয়ে অসহায় গলায় বললাম-
– তুমি বানিয়েছ তো অনেক মজা হয়েছে।তোমার স্পেশাল চা বলে কথা।তোমার ইউটিউব চ্যানেল একদিনেই ফেমাস হয়ে যাবে এমন চায়ের রেসিপি পেয়ে।রূপার রান্নাবান্না বলে কথা।

এটুকু প্রশংসা না করলে ঝড় বয়ে যেত আমার উপর।কারণ রূপার মাথায় কখন কি চড়ে বসে আর কিসে রেগে বসে বুঝা যায় না। তবে কেন জানি না, এ পাগলিটার এগুলোর জন্যই ওকে বেশি স্পেশাল মনে হয়।কেন জানি না পাগলিটার পাগলামিগুলো আমার ভীষণ ভালো লাগত।বলা যায় একটা মিষ্টি যন্ত্রণা।
তবে স্পেশাল চায়ের কাহিনী আরও কিছুদিন বহাল ছিল। সেদিন দ্বিতীয় বারের জন্য রূপার বাসায় গিয়েছিলাম তার বাবার সাথে দেখা করতে। সত্যি বলতে তার বাবার সাথে দেখা করাটা মুখ্য বিষয় ছিল না।মুখ্য বিষয় ছিল রূপাকে একটু ভালোভাবে দেখা।রূপার বাসায় গিয়ে রূপার বাবার সাথে কথা বলতে লাগলাম।এক পর্যায়ে রূপার স্পেশাল চা হাজির হল।রূপার এ চায়ের রঙটা জানি কেমন ছিল।ভয়ে ভয়ে রূপার দিকে তাকালাম।রূপা আমার চাহুনি দেখে বলল-
– অরন্য চা টা খেয়ে নাও পুরো।
আমি অসহায় গলায় বললাম
– আঙ্কেলকে এক কাপ চা দাও।
– বাবা দুধ চা ছাড়া অন্য চা খায় না।আর বাবা একটু আগে চা খেয়েছে।এটা শুধু তোমার জন্য স্পেশাল করে বানিয়েছি।খাও।(রাগী গলায়)
আমি মনে মনে ভাবলাম আল্লাহ্ই জানে কি স্পেশাল চা আমাকে দিয়েছে।ভয়ে ভয়ে স্পেশাল চা মুখে দেওয়ার পর চায়ের স্বাদের বাহারে আমার গলা থেকে মাথা পর্যন্ত ঝিম ধরে গেল।

চলবে?