হঠা তুমি এলে পর্ব-২৮ এবং শেষ পর্ব

0
1110

#হঠা_তুমি_এলে
#লেখিকা-শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব-২৮/অন্তিম পর্ব

কারণ অরন্য খেয়াল করল তুলি নীচে পড়ে আছে। অরন্য দৌঁড়ে গিয়ে তুলির পাশে গেল। গিয়ে খেয়াল করল তুলির শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। তাই তুলিকে কোলে নিয়ে খাটে তুলল। এর মধ্যে তুলি টের পেল কেউ একজন তাকে ধরেছে সে ভালোই বুঝতে পেরেছিল এটা অরন্য।তুলি চোখ মেলে তাকাতে পারছে না।জ্বরের তীব্রতা এতই ছিল যে তুলির হুঁশ তেমন ছিল না।অরন্য তুলির মাথায় জল পট্টি দিতে লাগল।তুলিকে কোনরকমে মুখে তুলে একটা ঔষধ খাওয়ালো।অরন্য সারারাত তুলির মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে কখন যে তুলির পাশে ঘুমিয়ে গেল টেরেই পেল না।ভোর চারটায় তুলির হুঁশ ফিরল।তুলি চোখ খুলে দেখল অরন্য তুলির পাশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে।তুলির মাথায় জলপট্টি দেওয়া।তুলির বুঝতে বাকি রইল না অরন্য তুলির মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে ঘুমিয়ে গিয়েছে।তুলি নিজেকে সামলে একটু উঠতে নিল।এমন সময় অরন্যের ঘুম ভেঙ্গে গেল।ঘুম থেকে উঠতেই তুলি বলে ফেলল
– আমার জন্য আপনি সারারাত কষ্ট করেছেন।
অরন্য মুচকি হেসে বলল
– রাতে যে আবোল,তাবোল করেছেন সেটা কি সত্যি ছিল নাকি জ্বরের ঘোরে করেছেন?
তুলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল
– অরন্য আমি…
আরও কিছু বলতে নিবে এমন সময় অরন্য তুলির মুখটা আটকে দিয়ে বলল-
– আমি কি কিছু বলব?
– কি বলতে চান?
অরন্য তুলির হাতটা শক্ত করে ধরে তুলির চোখে চোখ রেখে বলল
– তোমার ঐ চোখে কেন জানি না রূপাকে খুঁজে পাই।কেন জানি না তোমার মাঝে রূপার অস্তিত্ব টের পাই।কেন জানি না বারবার তোমার মাঝে রূপাকে হারিয়েও ফিরে পাই।তোমার চাহুনির মায়ায় যেন রূপার প্রতিচ্ছবি আটকে আছে।আমার হারিয়া যাওয়া রূপা কি হবে?আমার হারিয়ে যাওয়ার রূপাকে তোমার মাঝে ফিরে পেতে চাই।

তুলির বিশ্বাসেই হচ্ছিল না যে অরন্য তুলিকে এভাবে বলছে।নিমিষেই তুলির চোখে ভালোবাসার অশ্রু বিন্দু জমে গেল।অরেকটু ভালোবাসা পেলেই হয়ত সে অশ্রু বিন্দুটা বৃষ্টি হয়ে নেমে যাবে।তুলি প্রতিক্ষায় আছে কখন অরন্য ভালোবেসে বুকে টেনে নিবে আর তুলি তার চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুবিন্দু বৃষ্টি হয়ে নামাবে।

খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না তুলির।খানিকক্ষণের মধ্যেই অরন্য তুলিকে জড়িয়ে ধরল।আর তুলির চোখের জল শ্রাবণের মেঘের মত ঝরতে লাগল।অরন্যকে চেপে ধরে বলল-
– জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম।তখন তোমার সাথে দেখা। নিজের হারিয়ে যাওয়া অস্তিত্বটাকে আবার ফিরে পেলাম। বাঁচার একটা আশা খুঁজে পেলাম। আমি যে তোমাকে বড্ড ভালোবাসি, বলতে চেয়েও আটকে গিয়েছি বারবার।কখন যে জ্বরের ঘোরে বলে ফেলেছি খেয়ালেই করে নি।আমি তো ভালোবাসার চাতক পাখি হয়ে তোমার ভালোবসা পাবার জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিলাম।কাউকে যে এত অল্প সময়ে আপন করা যায় সেটা তোমাকে না দেখলে জানতাম না।বড্ড ভালোবাসি তোমায়।

অরন্য তুলিকে আরও শক্ত করে ধরল।সম্বোধনটাও যে আপনি থেকে তুমিতে কিভাবে চলে আসল তাদের বুঝার অন্তরায় রয়ে গেল।এর মধ্যেই সকালের সূর্যটা লাল হয়ে আকাশে উঠতে লাগল।ক্রমশেই আধার গুচিয়ে চারদিক আলোকিত হতে লাগল।অরন্য তুলির কাছ থেকে তুলির পরিবারের নম্বর নিয়ে কল দিয়ে তুলিকে বলল কথা বলতে।তুলি হ্যালো বলতেই তুলির মা তুলির কন্ঠ শুনে কেঁদে দিয়ে বলল-
– মারে কোথায় ছিলি এতদিন?আমাদের উপর এত কিসের রাগ যে একটা কল ও করিস নি।আগের বাসায় কত খুঁজ নিয়েছি পেলাম না।নিলয় কেমন আছে?

নিলয়ের কথা বলতেই তুলি কেঁদে দিয়ে মাকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল।তুলি ভেবেছিল তার মা হয়ত তাকে বলবে যে এরকম কাজ করলে এরকমেই হবে।বাবা মাকে না বলে কিছু করলে এর ফল এমনেই হয় ।কিন্তু না তুলির মা উল্টা তুলিকে সাহস দিল তুলির পাশে দাঁড়াল।তুলির বুকটা তখন আরও ফেটে গেল।তুলি ভাবল বিয়ের রাতে যদি তুলি, তুলির মাকে সবটা বলতে পারত তাহলে হয়ত আজকের এ দিনটা দেখতে হত না।অপরদিকে তুলি এটা ভেবেও খুশি হচ্ছে যে যদি তার জীবনে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় না ঘটত তাহলে এত, এত মেয়ের সংগ্রাম করে টিকে থাকার লড়াইটা দেখতে পারত না।আর অরন্যের মত এমন মানুষকে কাছে পেত না।মায়ের সাথে কথা বলা শেষে কলটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে রইল তুলি।
খানিকক্ষণ পর অরন্য তুলির বাবা, মাকে কল দিয়ে সবকিছু বুঝাল।আর বলল কালকে তুলি থানায় গিয়ে সব বলবে তারাও যেন সেখানে থাকে।তারপর কথাশেষে কলটা কেটে দিল।

সারাটাদিন একে অপরকে আরও কাছ থেকে আগলে নিল।পরদিন মিস অধরা কল দিয়ে অরন্যকে বলল-
– অরন্য সাহেব তুলিকে নিয়ে থানায় আসুন।

অরন্য তুলিকে নিয়ে থানায় গেল।তুলির বাবা,মা ও সেদিন থানায় গেল।একবছর পর বাবা,মাকে দেখে তুলি দৌঁড়ে গিয়ে তাদের ঝাপটে ধরে কাঁদতে লাগল।
অরন্য তুলিকে সামলে থানার ভেতর নিয়ে গেল।তুলি সমস্ত ঘটনা পুলিশকে খুলে বলল।পুলিশ বিষয়টা তদন্ত করে।ঐ মৃত ব্যক্তির কল লিস্ট থেকে নিলয় আর ঐ মহিলার নম্বর ট্র্যাক করে নিলয় আর ঐ মহিলাকে আটক করল।ঐখান থেকে আরও অনেক অসহায় মেয়েকে উদ্ধার করা হয়।আর ঐসব মেয়েদের ঠাঁই হয় অরন্যের গড়া আশ্রমে।নিলয় আর খবিশ মহিলার শাস্তির ব্যবস্থা করা হল। এর মধ্যে নিলয়ের সাথে তুলির ডিভোর্স করানো হয়।আইন হাতে তোলে নেওয়ার জন্য তুলির যে শাস্তি হওয়ার কথা ছিল সেটা সার্বিক দিক বিবেচনা করে তুলির শাস্তি মওকুফ করে দেওয়া হয়।
তুলির পরিবারের সাথে কথা বলে, অরন্য আর তুলির বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়।প্রায় তিনমাস পর তাদের ঘরোয়াভাবে বিয়ে হয়।আশ্রম থেকে তুলির জন্য অনেক উপহার পাঠায় সবাই।আর নিরাও বিয়েতে উপস্থিত ছিল ।

তারপর বাবা মাকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে করে নতুন গন্তব্যে যাচ্ছে তুলি, নতুন জীবন শুরু করতে।তুলি মনে মনে ভাবতে লাগল, আল্লাহ্ যা করেন ভালোর জন্য।এতসব ঘটনা না ঘটলে আজকে তুলি অরন্যের মত বীরপুরুষ পেত না।এসব ভেবেই তুলির চোখে আনন্দের অশ্রুবিন্দু জমা হল হালকা।মাঝপথে নিরা নেমে গেল। কারণ নিরাকে আশ্রমে যেতে হবে।তখন পশ্চিম আকাশে সূর্য ডুবতে লাগল।আকাশটা রক্তবর্ণ হয়ে লাল হল।নিমিষেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামল।ব্যাস্ত শহরের রাস্তার দুপাশে সোডিয়াম বাতি জ্বলে উঠল।অরন্য তুলিকে নিয়ে বিয়ের রাতে বাসায় না গিয়ে সেই ব্রিজের কাছে গেল।ব্রিজের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল।ব্রিজের উপর দিয়ে তখন জোনাকি পোকার মত হেডলাইড জ্বালিয়ে গাড়ি চলতে লাগল।

“ব্যস্ত শহরে গাড়ির হেড লাইডগুলো দেখতে অনেকটা জোনাকি পোকার মতো।এ জ্বলে এ নিভে। বলা যায় হরেক রঙয়ের জোনাকি পোকা।এ ব্যস্ত শহরের রাতটাও যেন দিনের মত প্রাণচঞ্চল। ”

তুলি অরন্যের হাতটা চেপে ধরে বলে-
– রূপাকে মনে পড়ছে বেশি?তাই কি এখানে এসেছ যে?
– নাহ তুলি, রূপাকে খু্ঁজতে আর প্রতিদিন এখানে আসতে হবে না।কারণ আমার রূপা তো তোমার চোখে ডুবে আছে।এখানে তোমার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল তাই এখানে আসলাম।ভাবলাম এখানে কয়েক ঘন্টা কাটাব।বৃষ্টিত এখন পড়ছে না তাই উড়তে থাকা ধূলিগুলোকে না হয় ধরার চেষ্টা করব।

অরন্যের কথা শুনে তুলি ভাবতে লাগল এ দুনিয়ার প্রতিটা ছেলে যদি অরন্য হত তাহলে মেয়েদের এত কষ্ট হত না।প্রতিটা মেয়েই চাই এরকম একজন পুরুষ তার স্বপ্ন পূরণের সাথী হোক।তুলি অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল-
– আমার স্বপ্ন পূরণের সাথী হবে?
– সারা জীবনের সাথী হব।তোমাকে আবার ভর্তি করাব।পড়া শুরু করবে।জীবনটাকে এখানে থামিয়ে দিলে হবে না।নিজের অবস্থান গড়ে তুলবে।প্রতিটা মেয়েরেই উচিত নিজের অবস্থা গড়ে তোলা।তোমাকেও আরও সামনে এগিয়ে যেতে হবে।মনে রাখবে জীবনটা একটা যুদ্ধক্ষেত্র সে যুদ্ধক্ষেত্রে সবসময় জিতার চেষ্টা করবে।তাহলেই জীবনে উন্নতি করতে পারবে।
অরন্যের এ কথাগুলো তুলিকে যেন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দেয়।তিনটা ঘন্টা ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে বাসায় গেল অরন্য আর তুলি।বাসায় গিয়েই তুলি বেলকনিতে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।পূর্ণিমার চাঁদটা আজকে তার সমস্ত বিস্তৃতি নিয়ে উঠেছে।অপলক দৃষ্টিতে চাঁদের সৌন্দর্য অবলোকন করছে তুলি।
ঠিক কিছুক্ষণ পর অরন্য হাতে কফি নিয়ে তুলির দিকে বাড়িয়ে বলল
– আজকেই শেষ বারের মত বানিয়ে খাওয়াচ্ছি।এরপর আর বানিয়ে খাওয়াব না।এরপর থেকে এ দায়িত্বগুলো তোমাকে নিতে হবে।
তুলি চট করে কফির মগটা হাতে নিয়ে বলল-
– আরে ইয়ার কি যে বলো না।এক কাপ কফিই তো।এখন থেকে তোমাকে তুলির স্পেশাল কফি খাওয়াব।

তুলি রূপার পুরোপুরি কপি করাতে অরন্য তুলির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে একটু হেসে বলল-
– থাক আর স্পেশাল কফি খাওয়াতে হবে না।

কথাটা বলার সাথে সাথে দুজনেই জোরে অট্ট হাসি দিয়ে উঠল।
এভাবেই সুখে শান্তিতে কেটে গেল দুইটা বছর।এর মধ্যে তুলি আর অরন্যের কোল জোরে আসল একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে সন্তান।আজকে দুবছর পর সে ব্রিজটার সামনে এসে দাঁড়াল তুলি আর অরন্য।এ দু বছরে ব্যস্ততার কারণে এখানে আসতে পারে নি দুজনের কেউ।অরন্য আর তুলি পাশাপাশি দাঁড়াল যখন তখন সূর্যটা ডুবতে লাগল।কিছুক্ষণ এর মধ্যেই হালকা অন্ধকার হল।সোডিয়াম বাতিগুলোও আগের নিয়মে জ্বলে উঠল।সে সাথে গাড়ির হেডলাইট গুলোও জোনাকি পোকার মত গতিয়মান হতে লাগল।ঠিক তখনেই অরন্য বলল-
– এখানেই তো দুবছর আগে ঝাঁপ দিতে এসেছিলে।আজকে একটু ঝাঁপ দেওয়ার ইচ্ছা জাগছে না।
– একদম না।
– কেন?
তুলি উৎসুক চোখে অরন্যের দিকে তাকিয়ে বলল
– যখন জীবনের গতি হারিয়ে একদম হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম।নিজের অস্তিত্বকে বিশাদময় করেছিলাম।তখন নিজের চলার গতি আবার ফিরে পেয়েছি।নিজের অস্তিত্ব আবার খুঁজে পেয়েছি।কারণ আমার জীবনে

“হঠাৎ তুমি এলে”।

এ গল্পটা থেকে আমি যেদিকগুলো তুলে ধরতে চেয়েছি নীচে দেওয়া হলো
১)নিলয় আর তুলির ঘটনা থেকে বুঝাতে চেয়েছি যে ফেসবুকের অল্প পরিচয়ে কাউকে বিশ্বাস করা উচিত না। জীবনে যাই হোক বাবা মাকে আগে জানানো উচিত।
২)নিরা আর তুর্জের ঘটনা থেকে বুঝাতে চেয়েছি যে নিজের অপূর্ণতাকে দুর্বলতা ভাবা উচিত না। বিয়ে খুব সেন্সসিটিভ বিষয় সেটা ভালো করে খুঁজ নিয়ে দেওয়া উচিত।
৩)রূপা আর অরন্যের কাহিনি থেকে বুঝাতে চেয়েছি যে কোনোকিছু পেলেই আমরা যাচাই না করেই ভাইরালে মেতে উঠি তবে সেটা একদম ঠিক না। এতে কারও জীবন চলে যেতে পারে।
৪)অধরার কাহিনী থেকে বুঝাতে চেয়েছি যে মেয়ে মানুষ মানেই নিজের পরিবার থেকে শুরু করে সবজায়গায় বৈষম্য। তাই নিজের অবস্থানটা নিজেকেই বদলাতে হবে।
৫)সব শেষে তুলি আর অরন্যের কাহিনি থেকে বুঝাতে চেয়েছি জীবনে অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় আমাদের সবটা কাটিয়ে উঠতে হবে তাহলে আধার গুঁচিয়ে আলোর মুখ দেখব।

এটা একটা রোমান্টিক গল্প হলেও এ গল্পটায় আমি নারীদের অবস্থান তুলে ধরেছি যাতে করে নারীরা একটু সাহসী হয়ে উঠতে পারে। সবাইকে ধন্যবাদ গল্পটা পড়ার জন্য। কেমন লেগেছে জানাবেন। আবার দেখা হবে নতুন কোনো কাহিনি/নতুন কোনো গল্প নিয়ে।

…………………….সমাপ্ত…………..