হাতে রেখো হাত পর্ব-২১+২২ এবং শেষ পর্ব

0
517

#হাতে_রেখো_হাত (২১)

সেনাবাহিনীতে সিলেক্ট হয়ে যেন পৃথিবীর সমস্ত সুখ হাতে পেয়ে গেছে সীরাত, আবরাজ। দুজনের চোখেই পানি। পূর্ণ ভাবে দেশকে রক্ষা করার মর্যাদা পেল ওরা। এর থেকে ভালো খবর আর কিই বা হতে পারে? সব থেকে বেশি খুশি হয়েছেন অফিসার আবুল। আবরাজ কে সন্তানের মতো সমীহ করেন তিনি। ছেলে মেয়ের এই সফলতা যেন ওনার বুক ফুলিয়ে তুলে। দুজন কে জড়িয়ে ধরেন তিনি। অশ্রু ভেজা পল্লব ফেলেন। গলার স্বর ইষৎ ভাঙা। “আমি গর্বিত বাচ্চারা। এই বাবাকে এত বড় পাওয়া এনে দিয়েছ তোমরা।”

সীরাতের চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠল। আবরাজ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। সীরাতের মাথায় এখন দুষ্টুমি। বাবার বুকে মাথা রাখা অবস্থাতেই আবরাজকে চোখ মেরে দিল। ছেলেটা সামান্য বিব্রত হয়। পরক্ষণেই মৃদু হাসির রেখা ফুটে।

বিকেলে বেশ জমকালো আয়োজন করা হলো। প্রেগনেন্ট অবস্থাতেই কাজ করে চলেছে রাই। যাঁর ফলে বকে যাচ্ছে রকি। ছেলেটার এমন ধারার পাগলামি দেখে হেসে কুটি কুটি সীরাত আর আবরাজ। লজ্জায় পরে হয় রাই। ইদানিং মেয়েটির মাঝে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। নম্রতা দেখা যায় প্রতি সেকেন্ডে।
“থাকবোই না আমি। তুমি বাচ্চাদের মত করছ রকি।”

“আরে রাগ করলে কেন? শোনো আমার কথা। আমার বাচ্চার মা তুমি। একটু তো খেয়াল রাখতে হবে।”

কোনো কথাই কানে নিল না রাই। এগিয়ে গেল। পিছু নিয়েছে রকি। আবরাজ আর সীরাতের দৃষ্টিতে রয়ে গেল সুন্দর এই মুহুর্তটি। এতক্ষণ দূরে দূরে থাকলে ও এখন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে আবরাজ। মেয়েটিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই ক্ষীন কেঁপে উঠে। গলার স্বরে লজ্জা এসে জটলা পাকায়। ছেলেটির চোখে মুখে মাদকতা ছড়িয়ে আছে। যাঁর নেশায় মত্ত হয় সীরাতের চিত্ত। কিছু বোঝার পূর্বেই মেয়েটির ওষ্ঠাধরে নিজের ওষ্ঠাধর ছুঁয়ে দিল। উষ্ণতায় ভরে উঠে মুখাশ্রী। লজ্জায় যা তা অবস্থা সীরাতের। আজ যেন লাজ লজ্জার মাথা খেয়েছে আবরাজ। সীরাতের থুতনির ধরে উঁচু করে বলে। “তুমি একা নয় আমি ও ভালোবাসতে পারি। প্রচন্ড রকমের ভালোবাসা জমিয়েছি। কিছু দিন পর সব ভালোবাসায় জড়িয়ে নিব তোমায়। এই যে ধরেছি হাত রেখেছি অন্তরে। বুক চিরে দেখ যাও কতখানি পুড়েছে।”

সীরাতের ঘন শ্বাস আবরাজের কানে পৌছাতেই কিছু টা দুরুত্ব নিয়ে নিল। সেই সুযোগেই পালিয়ে গেল সীরাত। হো হো করে হেসে উঠল আবরাজ। মেয়েটা আস্ত এক পাগলী। ভালোবাসলে ও সহ্য হয় না, না বাসলে ও চলে না। মোট কথা সহ্য হয় না কোনো কিছুই।

রাতের খাবার শেষ হতেই আবুল বললেন “তোমাদের সকলের মতামত চাচ্ছি।”

“কোন বিষয়ে বাবা?”

“সীরাত আর আবরাজের বিয়ের ব্যপারে। দুজনকে আলাদা দেখতে ইচ্ছে হয় না। যেহেতু সিলেকশন হয়ে গেছে তাই ভাবছি চার হাত এক করে দিব।”

সামান্য লজ্জায় পরল আবরাজ আর সীরাত। সেই সুযোগ টাই গ্রহন করল রাই। “আমার বাবু আসার আগে আরেকটা বাবু আসার খবর শুনতে চাই আমরা। তাই দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করা হোক।”

মেয়েটির কথা শুনে সীরাত কিংবা আবরাজ কেউ ই থাকতে পারল না। দুজনেই যেন মুখ লুকিয়ে বাঁচল। চাঁপা হাসির আওয়াজে মেতে উঠল পুরো বাড়ি। আর ওদিকে প্রেমময় অনুভূতির জোয়ারে ভাসতে লাগল দুই কপোত কপোতি।

ছাঁদের কাছে আসতেই খপ করে হাত ধরে ফেলল আবরাজ। একদম কাছে নিয়ে আসল ওকে। চোখে লেগে আছে তীব্র নেশা। মনের অনুভূতি যেন তড় সইছে না আর। শুকনো ঢোক গিলল সীরাত। “এত ভালোবাসা দেখিও না। আমি শেষ হয়ে যাব।”

“আর আমি তো শেষ হয়েই গেছি। তোমার প্রেমের আগুনে এ বুক পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কতটা ভালোবাসি জানো কি?”

“উহু জানতে চাই ও না, আর না ম’রতে চাই। এই ভালোবাসাতেই আমি ঝলছে যাচ্ছি। অধিক প্রেমে
ম ‘রে না যাই।”

মেয়েটার মুখে হাত দিয়ে দিলো আবরাজ। চাঁপা রাগ দেখিয়ে বলল “ম ‘রার কথা বলবে না একদম। এ বুকে পিষে রাখব তোমায়। হাতে রেখেছি হাত ছাড়ার জন্য নয়। আমার অন্তরে তুমি সর্বদা থাকবে সীরাত। তুমি না থাকলে আমিও যেন না থাকি।”

কথা গুলো বলার সময় চোখ দুটো হালকা ভেজা অনুভব হলো। সীরাতকে জড়িয়ে কেঁদে উঠে আবরাজ। হতভম্ব সীরাত বলল “কি হলো তোমার?”

“আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বল না প্লিজ। আমি মরে যাব। খুব ভালোবাসি, অনেক বেশি ভালোবাসি। থেকে যাও প্লিজ। হাতে রেখো হাত। কথা দিচ্ছি কোনো দিন কষ্ট দিব না। আমার তো কেউ নেই।”

.

বিয়েটা সম্পূর্ন হয়ে গেল কিছুক্ষণ পূর্বে। দুজন কে ঘরে রেখে চলে আসলো সবাই। লজ্জা যেন রাঙিয়ে তুলেছে সীরাতকে। ছেলেটা চাঁপা হাসিতে মত্ত। মেয়েটার অবস্থা বেশ ইনজয় করছে। ওর হাসি দেখে রেগে গেল সীরাত। বেডে চেপে ধরে বলল “এত হাসি কেন হু? বউ পছন্দ নয়। আরও বিয়ে করবে?”

“আরও বিয়ে করাতে চাইলে করব বিয়ে। আমার অসুবিধা নেই। বরং বেশ সুবিধা হবে তখন।”

জ্বলন্ত আগুনের মতো তেঁতে উঠে সীরাত। মেয়েটার রাগ দেখে ভয় পায় আবরাজ। তাই এক হাতে জড়িয়ে ধরে। বুকে সাথে মিশিয়ে ফেলে। সীরাত নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে “চাই না এমন ভালোবাসা।”

“কিন্তু আমার যে চাই। খুব করে চাই তোমায়।”

“আরেকটা বিয়ে কর।”

“এক অভিমানীকে নিয়েই পারছি না। আরও বিয়ে করব? বাপ্রে এত কলিজা নেই।”

ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটি। মেয়েটির চোখের পানি টুকু ঠোঁটের সাহায্যে শুষে নিল আবরাজ। সময়টুকু কে অনুভূতিরা জড়িয়ে নিল। এ পৃথিবীকে স্বাক্ষী করে ধরার বুকে প্রহরটা হয়ে গেল প্রেমময়।

চার বছর পর

বি এস সি পাস করেছে আবরাজ আর সীরাত। দুজনেই বেশ ভালো মার্ক পেয়েছে। সেনাবাহিনীর বিশেষ পদ পেয়েছে দুজনে। আবরাজকে সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্স এর প্রধান পদ দেওয়া হয়েছে। আর ওর সহধর্মিনী কে ওর সহকারী করা হয়েছে। দুজনের সফলতা যেন পুরো দেশে ছেয়ে গেল। ইতিহাসের পাতায় ছেপে গেলে এই খবর। স্বামী স্ত্রী দুজনেই সেনাবাহিনীর বড় কর্মকর্তা সেটা ও সেইম ডিপার্টমেন্টে!

রকি আর রাই এর ছেলে বেবি হয়েছে। কিছু দিন পর ই চার বছর পূর্ণ হবে। দুজনের ভালোবাসার অংশ টি যেন এক নিমিষেই চারটি বছর পার করে ফেলল! বেডে বসে ফোন ঘাটছিল সীরাত। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ করল রাই। “আসব সীরাত?”

“আরে ভাবী আসো তো। এত অনুমতি নেওয়ার কি প্রয়োজন?”

“প্রয়োজন আছে গো ননদিনী। তা তোমার আশিক কোথায়?”

“এতিম খানায় গেছে। কাল একটা আয়োজন করবে।”

“ওহ আচ্ছা। ছেলেটা বড় ভালো। নিজের পরিবারের শেষ স্মৃতির জমিটুকু তে এতিম খানা করল। কত গুলো বাচ্চা এখন থাকতে পারছে বলো তো।”

মৃদু হাসল সীরাত। রাই বলল “আমাদের নতুন সদস্যের খবর কবে দিবে সীরাত?”

মাথাটা নিচু করে ফেলল সীরাত। হাসতে হাসতে রাই বলল “সামনেই রিদুর জন্মদিন। আশা রাখছি খুব দ্রুত আরেকটা খুশির সংবাদ পাব।”

“উফ ভাবী তুমি ও না।”

বালিশে মুখ লুকায় সীরাত। সন্ধ্যায় আবরাজ আসতেই সীরাত বায়না ধরল। “আমার বেবি চাই।”

“মানে?”

“একটা বেবি চাই আমার। প্লিজ, প্লিজ একটা বেবি।ছোট ছোট হাত পা নিয়ে খেলব। পড়াশোনার ধাপ তো শেষ বাবা।”

প্রফুল্লতা ছড়িয়ে পরল ঘরময়। স্মিত হাসে আবরাজ। লজ্জায় লাল টুক টুকে হলো সীরাত।

দুই বছর পর
সীরাত আর আবরাজের ঘর আলো করে এসেছে মিষ্টি এক কন্যা সন্তান। পুরো বছরটা বেড রেস্ট করে করেই পার করল সীরাত। আবরাজ নিজে ও ছুটি নিয়েছে। তবে ঘরে বসে নতুনদের জন্য মোটিভেট সেশন করে যাচ্ছে। সীরাত বলল “এখন তো জয়েন হতে পারি আমরা?”

“তোমার শরীর পুরোপুরি সুস্থ নয় সীরাত।”

“প্লিজ আবরাজ।”

“আচ্ছা জয়েন হবো আমরা। তবে নেক্সট ইয়ার।”

“ওকে।”

খুশি মনে বেরিয়ে পরল সীরাত। মিষ্টি মেয়ে তিহুনকে নিয়ে খেলছে রিদু। আর বাচ্চাটা ও খিল খিল করে হেসে চলেছে। স্বস্তির শ্বাস ফেললো সীরাত। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আবরাজ সে দিকে খেয়াল ই নেই। ফিস ফিস করে আবরাজ বলল “সুন্দর তাই না?”

“হু।”

হেসে উঠল আবরাজ আর সীরাত। দুজনেই এখন সেনাবাহিনীতে জয়েন হবে। অবশ্য এর জন্য ত্যাগ স্বীকার করল দুজনেই। বাচ্চাটির বয়স মাত্র এক বছর।

এক বছর পর
বাসা থেকে বের হচ্ছিল সীরাত আর আবরাজ। পূর্ন ভাবে জয়েন হচ্ছে দুজনে। তিহু কেঁদে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। সীরাত যেন কেঁদেই দিবে। আবরাজ হালকা হাতে মেয়েটির মাথায় স্পর্শ করে বলল “আমরা দেশের অংশ বিশেষ সীরাত।”

“মনে আছে আমার।”

তিহুনকে কোলে তুলে নিল আবরাজ। দুই বছর বয়স, কতটুকুই বা বয়স হলো ওর। তিহুন এর হাতে চুমু একে সীরাত বলল “মাই ডিয়ার গার্ল। আমার ব্রেভ বাচ্চাটা। এভাবে কাঁদে কেন মা? তোমাকে তো মনে রাখতে হবে তোমার মাম্মা পাপা দেশের সাথে জড়িত। তোমাকে এই ছোট বয়সেই অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে সোনা।”

“মাম্মা। আমি আমি ”

মাম্মা মাম্মা করে কেঁদে চলেছে মেয়েটি। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ওরা। রিদু এসে আবরাজ কে বলল “আঙ্কেল আমাকে কোলে তোলে।”

রিদু কে ও কোলে তুলল আবরাজ। তিহুন এর দিকে তাকিয়ে বলল “আমি আছি তো তিহুন। তোকে আমি দেখে রাখব। আমার সাথে থাকবি না?”

রিদুর কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেল সকলে। তিহুন কি বুঝল কে জানে। তবে কান্না থামিয়ে দিল। স্বস্তির শ্বাস ফেলে সকলকে বিদায় জানালো দুজনে। বুকের ভেতর চাঁপা কষ্ট কাজ করছে। তবে ভুলে গেলে চলবে না এদেশের জন্য নিজের জীবনকে বহু আগেই উস্বর্গ করেছে ওরা।

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

#হাতে_রেখো_হাত (২২) সমাপ্তি পর্ব

‘মিশনটায় ব্যর্থ হলে দেশের ক্ষতি হয়ে যাবে। এটা খুব ই হৃদয়বিদারক হবে আবরাজ। আমার বিশ্বাস আছে আমাদের দেশকে রক্ষার্থে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে তুমি।’

প্রাইম মিনিস্টার রকিব হোসেনের কথায় থমকে গেল আবরাজ। সামান্য ব্যথিত হয়ে বলল “আপনারা আমাকে আগে খবর পাঠান নি কেন স্যার?”

“ভেবেছিলাম সব সামলে নিবে সকলে। কিন্তু আবারো হামলা হবে ভাবতে ও পারি নি। সীমান্তবর্তী আক্রমন চালাচ্ছে ওরা। তুমি গত মাসে আবার নতুন করে জয়েন হয়েছ তাই ভেবেছিলাম পরে জানাব। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে না জানিয়ে উপায় নেই। তুমি তোমার ফোর্স রেডি কর।

“ইয়েস স্যার।”

স্যালুট প্রদান করল আবরাজ। ছেলেটির চোখে মুখে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে। বুকে রয়েছে দেশকে রক্ষা করার তীব্র শক্তি। তবে অনুভূতি বলে ও কিছু আছে। এ মিশনে প্রান সংশয় হতে পারে। সীরাতকে এ বিপদে কি করে নিবে?
ছোট্ট মেয়েটার কথা ভীষন মনে পরছে ওর। দু চোখের কোণে পানে জমে উঠল। বাসায় ফিরে আসতেই সীরাত বলল “প্রাইম মিনিস্টার স্যারের সাথে কথা হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“কি বললেন?”

“এমনি এতদিন পর জয়েন করায় শুভেচ্ছা বার্তা জানালেন।”

“ওহ আচ্ছা শোনো না। সীমান্তের অবস্থা কেমন দেখাচ্ছে। আমি কিছু ফোর্স লাগিয়েছি।”

ছেলেটার কপালে কয়েকটা ভাঁজ পরল। সীরাতের দিকে সুচালো দৃষ্টি দিয়ে বলল “কেমন দেখাচ্ছে বলতে?”

“আজ ও দুজন লোক দেশে প্রবেশ করার চেষ্টায় ধরা পরল। সুবিধা মনে হলো না।”

“আচ্ছা। সীরাত শোনো একটা কথা বলার ছিল।”

“হ্যাঁ বল না।”

আবরাজের পাশে বসতে বসতে কথাটা বলল সীরাত। আবরাজ মিনমিনে কণ্ঠে বলল “আমার মনে হয় বাবু বড় হওয়া অবধি তোমার বাসায় থাকা উচিত।”

“আবরাজ! আমাদের তিহুন ব্রেভ গার্ল। দেশের জন্য ত্যাগ করতেই হবে।”

“কিন্তু সীরাত বোঝার ট্রাই কর।”

ছেলেটা কথা শেষ করতে পারল না তাঁর আগেই কয়েক টা গোলার আওয়াজ শুনতে পেল। সীরাত আর আবরাজ এক পলক নিজেদের দেখে বেরিয়ে পরল। সীমান্তে বোমা আঘা*ত করা হয়েছে। আবরাজের কপালে বিন্দু বিন্দু পানি কনা। চেঁচিয়ে উঠল সীরাত। সব সৈন্যরা প্রস্তুত হতেই বলল “সবাই চেকিং লাগাও। আমাদের মধ্যেই রয়েছে সেই দুষ্কৃতী। টাকা খেয়ে আমার দেশকে অপমান করেছে সেই জা’নো’য়ার।”

সীরাতের উদ্দীপনা দেখে আবরাজের গা ঝটকা দিয়ে উঠল। শিরায় শিরায় র’ক্ত চলাচল থেমে গেল। কাছে আসল সীরাত। মেয়েটার চোখে পানি চিক চিক করছে। ভাঙা তার কণ্ঠস্বর। “এই কারনে প্রাইম মিনিস্টার তোমাকে ডেকেছে তাই না? আর তুমি আমাকে বাসায় ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছ?”

কথাটা বলে এক মুহূর্ত থাকল না মেয়েটি। ছুটে গেল সীমান্তের দিকে। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আবরাজ। স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিল ক্ষণিকের জন্য। দেশের প্রতি প্রেম ভুলে শুধুমাত্র নিজ পরিবার কে নিয়ে ভাবা শুরু করেছিল। নিজে ও ছুটে গেল সীমান্তের দিকে। বোমা আ’ঘা’তে তিনজন সৈন্য প্রান হারিয়েছে ইতোমধ্যেই। তবে কে বা কারা আ’ঘা’ত করেছে তা ধরতে পারে নি কেউ। তিনজন সৈন্যকেই নিয়ে যাওয়া হলো। সম্মান দিয়ে এদের দাফন করা হবে।

সীরাতের চোখে পানি। আবরাজ এর আচারন মেনে নিতে পারছে না কোনোক্রমেই।

ছয়টা দিন গরু খাটুনির পর সেই রাজাকারকে শনাক্ত করেছে সীরাত। এই ছয় দিনে একটি বারের জন্য ও আবরাজের সাথে কথা বলে নি। আবরাজ হতাশাগ্রস্ত। উক্ত রাজাকার রূপী সৈন্য কে মৃ’ত্যু দেওয়া হয়েছে।

সৈন্যদের নির্দেশনা দেওয়ার পর সীরাতের কাছে এলো আবরাজ। মেয়েটির হাত ধরে অনুনয় করল, “আমাকে ক্ষমা কর সীরাত।”

“তোমার মধ্যে দেশ প্রেম নেই আবরাজ। চলে যাও তুমি।আমি একাই রক্ষা করব আমার দেশকে।”

“তুমি ভুল ভাবছ। আমি তো তিহুনের কথা ভেবে তোমাকে সেইফ রাখতে চেয়েছি।”

“থামো আবরাজ। এ কথা মাথায় ও নিবে না। আমার মেয়ে একা বড় হবে এই পৃথিবীতে। তবে গর্বের সহিত বলতে পারবে আমার মা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে।”

“সীরাত আমি দুঃখিত।”

মাথাটা নিচু করে ফেলে আবরাজ। ছেলেটা কাঁদছে। শুকনো ঢোক গিলল সীরাত। আশে পাশে অনেক সৈন্য রয়েছে। যদি দেখে প্রধান নিজেই দূর্বল, তাহলে তাঁদের মাঝে ও ভয় কাজ করবে। আবরাজের পিঠে হাত বুলায় মেয়েটি। ” অতীত ভুলে যাও। এখন আমাদের লক্ষ্য একটাই, দেশ কে রক্ষা করা। সীমান্ত দখল হলে আমাদের দেশ দূর্বল হয়ে যাবে।”

“হ্যাঁ।”

দুজনেই শটান হয়ে দাঁড়ালো। সৃষ্টি কর্তার কাছে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করে সেনাবাহিনীর নীতিবাক্য পাঠ করল
“সমরে আমরা শান্তিতে, আমরা সর্বত্র, আমরা দেশের তরে।”

বুক থেকে হাত নামিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সীরাত ও আবরাজ। সৈন্য দের উদ্দেশ্য করে বলল ‘জয় বাংলা।’

বো’মা আঘা’তে বিধ্বস্ত হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থান। সব থেকে বিপর্যয়ে রয়েছে আবরাজের আন্ডারে থাকা সীমান্ত। কারণ এই পথ জয় করলেই দেশ দূর্বল হয়ে পরবে। খবরটা দেখেই আঁতকে উঠল রাই আর রকি।

আবরাজ আর সীরাতের সঙ্গে কথা বলল। মনের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে সকলের। আবুল অচিরেই চোখ মুছলেন। গত মাসেই রিটায়ার্ড হয়েছেন তিনি। তবে মুখে হাসি ফুঁটিয়ে বললেন ‘আমার দুই সন্তানের প্রাণ যাক তবু ও আমার দেশ শান্তিতে থাক।’

আবুলের মুখে এমন অনুপ্রেরণা মূলক কথা শুনে সীরাত ও আবরাজ দুজনেই কেঁদে উঠল। হাত নাড়িয়ে বেস্ট অফ লাক জানালেন তিনি। তিহুনকে ভাসা চোখে এক পলক দেখল সীরাত ও আবরাজ। মেয়েটি আধো আধো বুলিতে বলছে ‘বেত অব লাক মাম্মা পাপা।’

মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে হেসে উঠল দুজনেই। ল্যাপটপটা অফ করে সীরাত কে বুকে চেপে ধরেছে অবরাজ। ক্ষীন তার কণ্ঠস্বর। “আমাদের মেয়েটা অনেক বড় হবে দেখ। এই ছোট বয়সে স্বীকার করা ত্যাগ যেন ধরে রাখতে পারে। এভাবেই সারাজীবন দেশের জন্য নিজের স্বার্থকে উস্বর্গ করে।”

“হ্যাঁ সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই প্রার্থনা।”

আবরাজ আর সীরাত বেরিয়ে পরল নিজের দেশকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে। সীমান্তে আসতেই গো লাগু লির শব্দ কানে আসল। প্রাণ ঘা তী রা কাছাকাছি এসে পরেছে তবে।

তীব্র গু লির হামলা চলল। আ ক্রম ন কারীরা বুঝতে পারে নি এতটা শক্তিশালী হয়ে গেছে বাংলা মায়ের সন্তানেরা! নানান যন্ত্রপাতির সাহায্যে পরাস্ত করে ফেলল শত্রুদলকে।

সকলে এক যুগে জয় বাংলা ধ্বনিতে মেতে উঠল। সীরাতের চোখে পানি চিক চিক করছে। আবরাজের গলাটা ভার হয়ে আছে। দুজনে দুই প্রান্তে ছিল। ছুটে এলো দুজনেই। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বলল “আমরা পেরছি।”

“হ্যাঁ সীরাত আমরা পেরেছি আমাদের দেশকে রক্ষা করতে।”

সমস্ত খবর লাইভ টেলিকাস্ট হয়েছে। রকি রাই আর আবুল ও এসে গেছেন। সাথে করে নিয়ে এসেছেন তিহুন আর রিদুকে। তিহুন বার বার জয় বাংলা জয় বাংলা কথাটি বলে যাচ্ছে। ফোনের এপাশ থেকে কথা টা শুনে হেসে উঠল সীরাত ও আবরাজ। এখনো স্পর্টে রয়েছে সকলে। সবাই মিলে নিজেদের বিজয় উল্লাসে ব্যস্ত।

সবাই যখন চলে যাবে তখনি চোখ যায় নদী পথে আসা জলদস্যুদের। এরা এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল! আপাতত সব কিছু অন্য স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। চেঁচিয়ে উঠল আবরাজ। “রাইফেল নিয়ে আ ক্রম ণ চালাও সকলে।”

সবাই রাইফেল চালাতে থাকল। জলদস্যুদের দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। যাহ স্বচক্ষে দেখল তিহুন আর রিদু।এই প্রথম রাইফেল চালাতে দেখল ওরা। সব সময় টিভিতে দেখেছে। দুজনেই এগিয়ে আসতে লাগল।

স্বস্তির দম ফেলেছে আবরাজ। তখনি পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠে সীরাত। শেষ কয়েক জন শত্রু এখনো রয়েছে। দুটো গু লি এসে লাগল আবরাজের বুকে! সীরাত যেন থমকে গেল। তবে নিজ হাতে শেষ করল সেই দুজন শত্রুকে। আবরাজের কাছে আসতেই কোথা থেকে দুটো গু লি এসে লাগল সীরাতের গাঁয়ে। কাঁপা হাতে সেই শত্রুর দিকে গু লি ছুঁড়ে দিল আবরাজ। শেষ শত্রুটিও মাটিতে লুটিয়ে পরল। সীরাত আর আবরাজ দুজনেই আঘা ত প্রাপ্ত। মেয়েটা পড়ে গেল মাটিতে। একটু একটু করে এগিয়ে আসে আবরাজ। সীরাতের হাত ধরতেই যেন অপরিমেয় শান্তি মিলে। পৃথিবীর সমস্ত যন্ত্রনাকে হার মানায় মৃ ত্যু যন্ত্রনা। তবু ও যেন স্বস্তি পেল দুটি আত্মা। মুখ থেকে র ‘ক্ত ঝরতে লাগল। সীরাতের হাতে আলগোছে চুমু খায় অবরাজ। তীব্র ব্যথা নিয়েও হাসছে সীরাত। ইশারায় সামনে তাকাতে বলল। অবরাজ আর সীরাত দেখতে পেল আগামীর যোদ্ধাকে। রিদু আর তিহুন একে অপরের হাত ধরে ছুটে আসছে এ দিকে। দুজনের চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরল। আগামীর দেশ প্রেমিকদের দিকে তাকিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল দুজনে। মৃত্যুর পূর্বে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে কালিমা পাঠ করল। তারপর সেনাবাহিনীর নীতিবাক্য পাঠ করেই একে অপরের হাতে রেখে হাত, হারিয়ে গেল চিরতরে এই পৃথিবীর বুক থেকে। পথিমধ্যে হঠাৎ করেই রিদু আর তিহুন থেমে গেল। শুনতে পেল নীতিবাক্য
‘সমরে আমরা শান্তিতে, আমরা সর্বত্র, আমরা দেশের তরে।’

~সমাপ্ত~
কলমে ~ ফাতেমা তুজ