হাতে রেখো হাত পর্ব-১৫+১৬

0
147

#হাতে_রেখো_হাত (১৫)

নিজের সমস্ত অনুভূতিকে মাটি চা’পা দিয়ে রুস্মি আজ কেবল আবরাজের বন্ধু। বোন শব্দটি মেনে নিতে কষ্ট হয় বিধায় মেয়েটি শুধু বন্ধু হয়ে থাকতে চায়। গত কয়েকটা দিন এত বেশি য’ন্ত্রণায় গত হয়েছে যে রুস্মির মনে হয়েছে এ জীবনে পাওয়া না পাওয়া সব সমান। মেয়েটি এখন তুমুল গতিতে পড়াশোনা করছে। রুবি আগের মত স্বাভাবিক। অথচ বাবা জেলে আর মা মস্তিষ্কের আন্দোলনে। মেয়েটা যেন একটু বেশিই স্বার্থপর। অবশ্য এতে ভুল নেই। এ পৃথিবী জুড়ে এত এত স্বার্থ যে মাঝে মাঝে নিজের জন্য স্বার্থপর তো হওয়াই যায়। সুজিত এখন কিছুটা সুস্থ। ইরা বেগম ইদানিং খুব যন্ত্রণায় থাকেন। ওনার মনে হয়েছে এত গুলো বছর নিজের সুখের কথা ভেবে ছেলেটার সুখ সেক্রিফাইজ করেছেন। সুজিত অনেকবার চেষ্টা করেছে সুফিয়ান কামালের সেকেন্ড চেহারা উন্মোচন করতে। কিন্তু বার বার ছেলেকে অবিশ্বাস করেছেন ইরা। একাকিত্ব ওকে করে তুলেছিল পাথর। তবে রুবির প্রতি একটা সফটকর্নার ছিল। তাই মেয়েটির সাথে মেশার চেষ্টা করত। মেয়েটার সান্নিধ্য ওকে সুখ দিত। তবে রুবির মনে ছিল ভিন্ন আয়োজন। সুজিতের প্রতি ওর নরম আচারণ,মায়া কিংবা বন্ধুত্ব থেকে নয় বরং টাকা আর পাওয়ারের জন্য ছিল। এসব জেনেও মেয়েটির সঙ্গ নিত সুজিত। কিন্তু এখন আর নিবে না। গত কয়েকদিনে রুবি সম্পর্কে একটি উপলব্দি হয়েছে। মেয়েটা ওর মানসিক শান্তির থেকে দিয়েছে অধিক অবসাদ। সেই অবসাদকে শান্তিতে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করত সুজিত। নিজের রুমের ব্যলকনিতে বসে আছে। তখনি ঘরে এলো সৌমিত্র, রুস্মি, সীরাত আর আবরাজ।

“কেমন আছ সুজিত?”

“ভালো আছি আপু। আপনারা দাঁড়িয়ে কেন, বসেন প্লিজ।”

“বসব নিশ্চয়ই তার পূর্বে বলো কবে থেকে জয়েন করবে গোয়েন্দায়।”

সৌমিত্রের প্রশ্নে হেসে ফেলে সুজিত। একটু এগিয়ে এসে দেয়ালের সাথে ভর দেয়। “এই ভা ঙা চো রা দেহে গোয়েন্দা হওয়া যায় নাকি!”

“ভা ঙা চো রা দেহ! অদ্ভুত বললে তো। আমি তো বলব তোমার মত শক্তিশালী, সুঠাম দেহ আর বুদ্ধিমান ব্যক্তি খুব কমই আছে।”

সৌমিত্রকে ভীষণ পছন্দ সুজিতের। এই তো মাস কয়েক আগের কথা। সৌমিত্রের সাথে পরিচয় হলো এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। কনের গলা থেকে গহনা চুরি হয়েছিল। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই গহনা উদ্ধার করে দেয় সৌমিত্র। সব থেকে মজার ঘটনা হলো কনের গহনা কনে নিজেই চুরি করেছিল। অন্য একজনের সাথে সম্পর্ক ছিল কনের। সে চায় নি বিয়েটা হোক। পালিয়ে যাবে যে সেই টাকাও নেই। তাই এত তামাসা। শেষমেশ সব রহস্যের উদঘাটন হয়। ছেলেটার প্রতি আগ্রহ হয়। তারপর অল্পবিস্তর যোগাযোগ। একটা ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠে অসম বয়সের দুটি মানুষের মাঝে। সুজিত বলেছিল তার বাবা নাকি ভালো নয়। কিছু প্রমান ও দেখিয়েছিল। আর তারপর ই ঘটে ঘটনাটা। সৌমিত্র যখন হসপিটালের বেডে সুজিতকে দেখতে পায় তখনি আঁচ করে ফেলে, কার কাজ। সেই ধারণা আর পূর্বের কিছু প্রমান মিলিয়েই গড়ে তুলে বেশ শক্তপোক্ত অভিযোগ। ধীরে ধীরে সমস্তটা উন্মোচিত হয়। পুরো ঘটনাটা স্মরণ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌমিত্র। সুজিতের শরীর বিশেষ ভালো নেই। ছোট ভাইয়ের ন্যায় স্নেহ করে। ছেলেটার সহ্য ক্ষমতা অনেক দৃঢ়! তা না হলে এত ব্যান্ডেজ নিয়ে হাঁটা চলা তো বহু দূর কথা অবধি বলা মুশকিল।

সুজিতের বাসা থেকে বের হয়ে সৌমিত্র বলল “কিছু মাসের জন্য ইন্ডিয়া যাচ্ছি। নিজের খেয়াল রাখবে সীরাত। তুমি নিজের ব্যাপরে বড্ড নির্বোধ।”

চোখ হাসে সীরাতের। সৌমিত্র বরাবরই তাকে নির্বোধ বলে থাকে। সৌমিত্রের ধারণা নিজের প্রতি ভ্রুক্ষেপ নেই মেয়েটির। তাছাড়া রোগা পাতলা দেহ। নিজের প্রতি যত্নশীল হলে নিশ্চয়ই স্বাস্থ্যের উন্নতি হত। সৌমিত্র চলে যায়। আবরাজের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে রুস্মি। সেসব খেয়াল করলেও তোয়াক্কা দিচ্ছে না ছেলেটা। রুস্মির অনুভূতি সম্পর্কে অবগত আবরাজ। শুরুর দিকে আবরাজের মনে হয়েছিল রুস্মিও বুঝি এসবের সাথে জড়িয়। কিন্তু রুস্মির দু চোখে কিছু একটা ছিল। যা আবরাজকে বার বার ভুল প্রমাণ করতে চাইত। মনের সাথে দ্বন্দ্ব করে যখন একদমই হাপিয়ে এলো তখন সীরাত আশ্বস্ত করল। বলল একটি কাঁটা যুক্ত গাছের সব থেকে সুন্দর ফুল রুস্মি। ভরসা করা যায় চোখ বুজে। পাপী নয় বরং পূর্ণ্য।সময়ের সাথে সাথে আবরাজ নিজেও সেটা উপলব্ধি করেছে। সব মিলিয়ে ঘটনা গুলো ওর হৃদয়ে বিষাদ তৈরি করল। এই যে রুস্মি ওকে পছন্দ করে এসব মানতে বেশ কষ্ট হয়। মেয়েটি ওর নিজের আপন বোন না হলেও তো বোন হয়। এর বাইরে অন্য কোনো নজরে দেখা আদৌ কি সম্ভব?
.

এক মাস পরের ঘটনা। রুবি, রুস্মি বাগানে বসে। ছোট বাগানটায় কিছু ফুল ফুটেছে। তার মধ্যে সব থেকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় বেলিফুল। ফুলের গন্ধে ম ম করছে চারপাশ। রুবি প্রথমে দেখল আবরাজকে।
“হাই ভাইয়া।”

“কি করছো রুবি?”

“আমি তো ম্যাগাজিন দেখছিলাম। দেখ কি দারুণ একটা কনটেস্ট হচ্ছে।”

ম্যাগাজিন আর রুবির আগ্রহ দেখে আবরাজ শুধায়। “তুমি কি অংশগ্রহণ করবে?”

“আমি তো চাই কিন্তু গার্ডিয়ান লাগবে। আপুর আঠারো হয় নি। আর মা, এখন তো।”

“আমি গার্ডিয়ান হলে তোমার সমস্যা নেই তো?”

চকচক করে উঠল রুবির দুটি চোখ। রুস্মি ততক্ষণে কাছে চলে এসেছে।
“আজকাল আসো না যে।”

“এই তো আসলাম।”

“যাক, তবে মনে এলো আমাদের।”

“তোমাদের সব সময় স্মরণে রাখি আমি। কিন্তু এটাও সত্য সময়ের সাথে সাথে শারীরিক দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছে। তাই বলে এমন নয় তোমাদের ভুলে বসেছি। মানসিক দূরত্ব তৈরি হয় নি কখনোই।”

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে রুস্মি। রুবি ঘরে গিয়ে কফি নিয়ে এলো। “খেয়ে বলো কেমন হয়েছে। আমি বানিয়েছি।”

কফির স্বাদ খুব ভালো না হলেও মোটামুটি ভালো। তবু কিছুটা বাড়িয়ে বলল আবরাজ। রুবি বেশ খুশি। বস্তুত কিছু মাসে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। রুস্মি সব দিক সামাল দিচ্ছে। আর রেবেকা ঘরবন্দী। নির্জনতায় থেকে বাকশক্তি হারিয়েছেন। কষ্টে কেবল দু চোখ বেয়ে নামে নোনা জলের ফোয়ারা। একটা অন্যায়ের কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত পরিবারটা। এখন সবাই ব্যস্ত যে যার স্বার্থ উদ্ধারে।

রেবেকা বেগমের দুটি চোখ স্থির। প্রাণহীন দুটি নয়নের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে আবরাজ। তিনি খেয়াল করেন নি। আবরাজ এবার পায়ের কাছে বসল। এটা সত্য রেবেকার কোলে কোলে বড় হয়েছে আবরাজ। রুস্মি হওয়ার আগ অবধি নিজের সন্তানের মতই বড় করেছে। রুস্মি যখন হলো তখন ওদের পরিবারটা ছিল ভীষণ সুন্দর। যৌথ পরিবারে থাকা সংসারটা হুট করেই বদলে গেল। ভে ঙে চুরে গেল সম্পর্ক গুলো। চারপাশে এত এত অভিনয়ের ইমারত যে আজকাল আবরাজ ভয়ে থাকে। কখন কে আবার ভে ঙে দেয়।
“চাচি শুনতে পারছেন আমার কথা?”

রেবেকা শুনে নি কথাটা। রুস্মি পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। “কারো ডাকে সাড়া দেয় না।”

“চিকিৎসা করাতে চাই। কি বল?”

সম্মতি জানায় রুস্মি। সেদিনই রেবেকা কে হসপিটালে নেওয়া হয়। ডাক্তার জানায় মানসিক অবসাদ কাটাতে পারেন নি রেবেকা। ধীরে ধীরে এর প্রভাব খারাপ হতে পারে। এমনকি কোমায় চলে যাওয়ার সম্ভবনাও আছে। এখন থেকেই চিকিংসা আর হাসি খুশি রাখার চেষ্টা করতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য যে মনোবল প্রয়োজন তার কদাচিৎ ই আছে রেবেকার মাঝে। এসব শুনে ভে ঙে পড়ে রুস্মি। হাজার হোক মা তো। আবরাজ খোঁজ লাগিয়ে রেবেকার চিকিৎসা করায়। ডাক্তার পরামর্শ দেয় এই ইট বালির শহর ছেড়ে একটু সবুজের মাঝে সময় কাটাতে। রুস্মি সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামে তার মামা বাড়ি যাবে। যদিও বা মামা বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয় তবে থাকতে অসুবিধা হবে না। খাওয়া সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় খরচ দিলেই হবে। কিন্তু বেঁকে বসে রুবি। কিছু দিন হলো ফ্যাশনের ক্লাসে আসা যাওয়া করছে। অডিশন হলো গত সপ্তাহে। বেশ ভালো চলছে সব। কিছু দিন পরই চ্যানেলের প্রোগ্রাম। এসব ফেলে সে যেতে চায় না। রুস্মি খুব রেগে গিয়েছিল। বেশ কথাও শুনায়। রুবির হৃদয়ে যে স্বার্থপরতার বীজ বপন হয়েছে তা ভবিষ্যৎ এর জন্য সুখময় নয়। কিন্তু একটা পরিবারে বাবা মা ই যখন অন্যায়কারী তখন সন্তান যদি খারাপ হয়েই যায় এতে সন্তানকে কি দোষ দেওয়া চলে? সেই কারণেই হয়ত রুস্মিকে দমে যেতে হলো। সীরাত এ বিষয়ে সাহায্য করল। চেনা জানা এক মহিলা হোস্টেলে থাকার ব্যবস্থা করা হলো রুবির। এসব নিয়ে রুবি ভাবছে না আপাতত। ওর শুধু স্বপ্নের ডানা ছুঁতে পারলেই হলো। রুস্মি আর রেবেকা বেগমকে ট্রেনে উঠানোর সময় ইষৎ জ্বালা করছিল আবরাজের হৃদয়। হঠাৎ ই রুস্মির জন্য ভীষণ মায়া হতে লাগল। মেয়েটির কোমল দুটি গাল লাল হয়ে উঠেছে। ফর্সা মুখে নির্ঘুম রাতের চিহ্ন। দুটি চোখ ব্যকুল। এসব যেন আবরাজের বুকে সুঁচের মত বিঁধে। রুস্মি ও তাকিয়ে। ছলছল দুটি নয়ন। আবরাজের দুটি হাত মুঠোবন্দী করে ঠোঁটে ছোয়ায়। আবরাজ নিরুত্তর। রুস্মির হৃদয় ভা ঙে। অনেকটা দ্রুত গত হয় সময়। যাওয়ার সময় রুস্মি বলে “আমার এ জন্মের সকল সুখ বৃথা হয়ে গেল তোমাকে না পাওয়ায়। যদি ফের জন্ম হয় তাহলে চাইব তোমার হাতে হাত রেখে যেন হয় আমার শেষ পথচলা।”

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ

#হাতে_রেখো_হাত (১৬)

অরির ক ব রের পাশে থাকা গাছটা প্রায় শুকিয়ে এসেছে। আবরাজের হৃদয় ধক করে উঠে। আজকাল ব্যস্ততায় আসা হয় না। যত্ন নেওয়া হয় না গাছ গুলোর। নিয়ম করে অরিকে মনে ও করা হয় না। চোখের জল ও ফেলা হয় না। তবে মাঝে মাঝে বুকের একাংশ ছ্যাঁত করে উঠে। কিছু দিন পূর্বেই একটি অনন্য কাজ করেছে আবরাজ। পৈতৃক সম্পত্তির প্রায় সবটাই দান করে দিয়েছে এতিমখানায়। যেখানে ছোট ছোট শিশুদের অবস্থান। বাবা মা হীনা বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যত তৈরি হবে সেই টাকায়। পড়াশোনা করবে। আর ভালো পুষ্টিকর খাবার ও পাবে। প্রায় অর্ধ শতাধিক শিশুর জন্য বিপুল পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ। আঠারো বছর অবধি সকল দেখা শোনা করা হবে। একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ হবে। আবরাজ কিংবা অরির মত কষ্টে দিন যাবে না মা বাবাহীন বাচ্চাগুলো। ছেলেটা একটু অদ্ভুত প্রকৃতির। এই যে কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি দান করল অথচ একটা প্রেস মিটিং তো বহুদূর কাউকেই জানতে দিল না। অনেকটা নীরবে রইল ঘটনাটা। কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রইল বিষয়টা। আবরাজের এই মহৎ দান সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে আবরাজের ধারণা এসব তো ওর বাবা দাদার অর্জন। তাদের সম্পদ। এসব অর্জনে তো ওর এক বিন্দু ঘাম ঝরে নি। তাহলে ক্রেডিট কেন যাবে ওর নামে?

সীরাত কারো সাথে ফোনে কথা বলছিল। আবরাজ কে ব্যাতিব্যস্ত আর ভগ্ন দেখে ছুটে এলো। “কি হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন তোমায়!”

“গাছটা মরে গেছে। দেখ কি হয়ে গেল। আমার বোনটা নিশ্চয়ই ভালো নেই। ভাইয়ের সাথে রাগ করেছে।”

সীরাত তাকায় তৎক্ষণাৎ। অর্ধমৃত প্রায়! মেয়েটির হৃদয়ে নাড়া দিল। আবরাজ ফের গাছের গোড়া খুঁড়ে। তারপর কিছু সার আর পানি দেয়। সীরাত অদ্ভুত ভাবে দেখল সবটা। হঠাৎ ই এখান থেকে একটা শিক্ষাগ্রহণ করে মেয়েটি। “গাছের মত প্রতিটা সম্পর্কের ও যত্নের প্রয়োজন। নতুবা সম্পর্কগুলো মরে যায় গাছের মতই।”

প্রায় ঘন্টা খানেক ধরে অরির কবরের চারপাশ পরিষ্কার করল আবরাজ। গাছ গুলোকে তরতাজা দেখার জন্য দু চোখে আকাশসম ব্যকুলতা। বালুতে ভরে গেছে শরীর। সীরাত এগিয়ে এসে মুছে দিল কপালের ডানপাশ। “ঘেমে গেছ, পরিশ্রান্ত লাগছে। আসো একটু বিশ্রাম করবে।”

“বিশ্রাম আর পরিশ্রান্ত? এসব তো অনেক রেয়ার জিনিস সীরাত। আমার জীবনে পরিশ্রান্ত,বিশ্রাম এসব মূল্যবান শব্দ নেই।”

সঙ্গে সঙ্গে জবার করল সীরাত। “এটা ভুল। প্রতিটা মানুষই পরিশ্রান্ত হয়। তাকে বিশ্রাম নিতে হয়। নতুবা জীবনের শুরুতেই হেরে যেতে হয়।”

মৌন রইল আবরাজ। সীরাত খাবার এনেছে। ব্যাগ থেকে একে একে সব নামিয়ে রাখল। আবরাজের চোখ এখনো অরির কবরে। মেয়েটা শুয়ে আছে ঐ টুকু ঘরে। কত গুলো দিন হলো একাকি জীবনের। আচ্ছা অরির কি মনে আছে ভাইয়ের কথা? এই যে অরির জন্য আবরাজের এত কষ্ট হয় অরির ও কি কষ্ট হয় ভাইয়ের জন্য?

“কি হলো খাচ্ছ না কেন?”

“হুম এই তো খাব।”

বিরিয়ানির প্যাকেট খুলতেই আবরাজের চোখ ভিজে উঠে। সীরাত বুঝতে পারে। বিষয়টাকে মশ্রিন করতে বলে “জানো তো আমার মা বলত পৃথিবীর সমস্ত সুখ হার মেনে যাবে জান্নাতের একটি আলোতেই। তাহলে ভেবে দেখ অরি কতটা আনন্দে।”

আবরাজ তাকিয়ে রইল কেবল। সীরাত আরও কিছু বলল। ছেলেটার মাঝে তেমন প্রতিক্রিয়া নেই। সীরাত হতাশ হলো। আবরাজের হাতে হাত রাখল। এক ভরসা আর স্বস্তির হাত।
.

সেনাবাহিনী তে জয়েন করার জন্য বেশ কিছু টাকা প্রয়োজন। আবরাজের কাছে তেমন কোনো টাকা পয়সা নেই। সবটাই দানস করেছে এতিমখানায়। এই মুহুর্তে কি করা উচিত ঠিক মাথায় আসছে না। এদিকে শপথ নিয়েছে নিজের দেশকে ভালোবেসে গ্রহন করবে।দেশের পথে উৎসর্গ করবে নিজের জীবন। নিজ শপথ থেকে সরে আসতে চাচ্ছে না ছেলেটা। এতে করে নিজের ব্যক্তিত্ব কে অপমান করা হবে। ছেলেটির মাথায় চট করেই বুদ্ধি এলো। বাড়িটা পুরে গেছে তবে জমি তো রয়েছে। শহরের বাসা ছিল। সামান্য জায়গা হলে ও বিক্রি করলে বেশ অনেক টাকা পাওয়া যাবে। ছেলেটি মনে মনে স্থির করলো জমিটা বিক্রি করবে। পর দিন ই লোক লাগিয়ে দেয়। প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে। হাতে অবশিষ্ট রয়েছে সামান্য কিছু অর্থ। যতদিন না জায়গাটা বিক্রি হয় ততদিন অবধি বেশ হিসেব করে চলতে হবে। রোজ ভাত খেলে ও আজ ভাত খেল না। বরং দোকান থেকে শুকনো রুটি কলা কিনে লাঞ্চ সেরে নিলো। এতে করে ত্রিশ টাকা বেঁচে গেল। যাহ দিয়ে আরেক বেলার খাবার হয়ে যাবে। হেঁটে হেঁটেই মাঠে আসে ছেলেটি। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিল সীরাত। আবরাজ কে দেখে বেঞ্চ থেকে উঠে দাড়াঁয়। মেয়েটা দারুন লম্বা। ৫’৬ বা তাঁর কাছাকাছি। হাইট এ সেনাবাহিনীতে বিনা সংকোচে চান্স পেয়ে যাবে মেয়েটি। অবশ্য আবরাজ নিজে ও অত্যধিক লম্বা। তাই চান্স পেতে কোনো রকম অসুবিধা হবে না। তবে বডি স্ট্রাকচার নিয়ে হরেক রকমের ঝামেলা। নানা রকমের ফিটনেস রাখতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে সীরাত বলল
“কি ভাবছ তুমি?”

“ভাবলাম ফিটনেস এর দিকে নজর রাখতে হবে।”

“অবশ্যই রাখতে হবে। শোনো নিজেকে এমন ভাবে গড়তে হবে যাতে করে প্রথম ধাপেই টিকে যাও। যে জীবনে একবার হেরে যায় তার উঠে আসতে অনেক সময় লাগে।”

“হ্যাঁ।”

একটা কথা বলব?”

“নিশ্চয়ই।”

ছেলেটার হাত ধরে সীরাত। অবাক হলো না আবরাজ। মেয়েটা একটু গাঁয়ে পড়াই বটে তবে প্রচন্ড রকমের ভালো মানুষ। আবরাজ বলল “কি হলো বললে না কি বলবে?”

“তুমি টাকার টেনশন করছ তাই না? প্লিজ আমার থেকে এই সামান্য উপহার গ্রহন করো।”

“ধন্যবাদ সীরাত। তবে আমি এই টাকা গ্রহন করতে পারব না।”

“কিন্তু কেন?”

“আমার বাবার রেখে যাওয়া সম্পদটা এখনো রয়েছে। সেটা যতদিন অবধি আছে আমি সাহায্য নিতে পারব না। না হয় উপর থেকেই বাবা কষ্ট পাবেন।”

ফোঁস করে দম ফেলল মেয়েটি। কতবার এই কথাটা বোঝানো হয়েছে জানা নেই ওর। তবে আবরাজ এর আত্মসম্মান বোধ এতবেশি যে একটা কানা কড়ি ও নিবে না। এই নীতি বদলানোর সাধ্য কারো নেই।

দুজনে কিছু শরীর চর্চা করতে লাগল। শরীর ফিট রাখার জন্য এই সাধারন শরীর চর্চা গুলো জরুরী। জগিং শেষে একটা বেঞ্চে এসে বসল দুজনেই। একটা জুসের বোতল এগিয়ে দিল সীরাত। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আবরাজ। নাকি সুরে মেয়েটা বলল
“প্লিজ এটা কে অন্তত নাকোচ করো না। এটা জুস মাত্র। টাকার পাহাড় না।”

হেসে ফেলল ছেলেটা। মেয়ে টার হাত থেকে বোতল নিয়ে জুস পান করল। এই পৃথিবী তে একজন বন্ধু পেল বটে। যে সমস্ত কিছু জেনেও নির্দ্বিধায় ওর সঙ্গে হাতে হাত রেখে এগোচ্ছে। সত্যি বলতে কে আপন আর কেই বা পর তা বোঝা মুশকিল। না হলে সামান্য কারনে রাই চলে গেল ওর থেকে?

চলবে……
কলমে ~ ফাতেমা তুজ