#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২৭]
সেদিনের পর তরীর বাসার বাইরে বা ছাদে অকারণে যাওয়াটা নিষেধাজ্ঞায় পরিণত হয়েছে। অবশ্যই সিদাতের জন্যে নয়। অন্য এক কারণে। বাড়িওয়ালা তার বখাটে ভাতিজার জন্যে তরীর প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। সে নাকি প্রায়-ই ছাদে ওঠলে তরীকে দেখতো। যুবতী মেয়ে যতোই নিজেকে ঢেকে চলাচল করুক না কেন, কিছু পুরুষদের নজর তাদের ওপর পরেই। এজন্য আকবর সাহেব ইদানীং ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছেন।
যেই বাড়িতে ভাড়া থাকছে সেই বাড়িতেই এরকম একটা দম বন্ধকর পরিস্থিতি। আকবর সাহেব প্রস্তাবে “না” করে দিলেও ওই ছেলে নির্ঘাত তার মেয়ের পিছু নিবে, মেয়েকে উত্ত্যক্ত করবে। মেয়েকে নিয়েই আকবর সাহেবের যত দুশ্চিন্তা। একজন মেয়ের বাবা হিসেবে সে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় থাকেন তার মেয়েকে নিয়ে, মেয়ের সুরক্ষা নিয়ে। নয়তো আজকাল যা দিন পরেছে, কোথাও মেয়েদের সুরক্ষা নেই। ওদিকে সিদাত অস্থিরতায় কাহিল এই ভেবে যে তরী তাকে নীরবে রিজেক্ট করেছে।
রাতে ঘুম হয় না তার, খাওয়া-দাওয়া ঠিক ভাবে হয় না। তার নিজস্ব হৃদয় তার বেঁচে থাকাটাই কেমন দুর্বিষহ করে তুলেছে। এ মন বন্ধু নাকি শত্রু? উত্তর পায় না সিদাত। সাহস করেও সিদাত তার বাবাকে কিছু বলতে পারে না। বাবাকে খোলামেলা এসব বলা সম্ভব? সে তো আর সাইফ নয়, তার যথেষ্ট জড়তা কাজ করে বাবার সম্মুখে। একজন মানুষ কথা বলায় যতই পটু হোক না কেন সে কোনো এক জায়গায় গিয়ে ঠিকই থমকায়। সিদাতের বেলায় হয়েছে ঠিক সেরকম।
যবে থেকে তরীকে নিয়ে উপলব্ধি করতে শিখেছে ঠিক তখন থেকেই তার কাঙ্খিত চোখ জোড়া তাকে খুঁজে বেড়ায়। সেদিন ছাদের ঘটনার পর আর চোখের দেখা মিলেনি তরীর। সেই থেকেই সিদাত ব্যাকুল। সে প্রতিনিয়ত বুঝতে পারে তরী শুধু তার মায়ের পছন্দ নয়, তরী তার বাজে রকম পছন্দের। যেই পছন্দকে সিদাত খুইয়ে ফেলবে ভাবলেই চোখ জোড়ায় অন্ধকার দেখে। অনয়ের বলা টিপসে সে অনয়ের বাসাতে এখন তেমন যায় না বললেই চলে।
বাঙালি মেয়ের বাবারা ছেলেদের নিজের বাড়ি থেকে বন্ধুর বাসায় পড়ে থাকাটা মোটেও ভালো ভাবে নেয় না। ওদিকে অনয়টাও নাকি বাসা চেঞ্জ করবে, কয়েক মাস পর তার বিয়ে। এজন্যে আরও সাজানো-গোছানো ভালো বাসাতে কিছুদিনের মধ্যেই যাবে। তখন সিদাতের কী হবে?
————–
আকবর সাহেব চিন্তিত মনে বাসা থেকে বের হতেই দেখলো অনয়ের ফ্ল্যাট থেকে জিনিসপত্র নামছে। আকবর সাহেব ভুরু কিঞ্চিৎ কুচকালো। অনয় হঠাৎ বেরিয়ে আসতেই তাকে দেখতে পেলো। অনয় চওড়া হাসির সাথে সালাম দিয়ে খুবই নম্র গলায় বলল,
–“কী অবস্থা স্যার?”
আকবর সাহেব তার পেশাগত দিক দিয়ে একজন শিক্ষক। এজন্য অনয় তাকে স্যার বলেই সম্বোধন করে। আকবর সাহেব ম্লান হেসে বললো,
–“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। হঠাৎ বাসা বদলাচ্ছো যে?”
এই মুহূর্তে এসে অনয় কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পরে। মাথা চুলকে লাজুক হেসে বললো,
–“একচুয়ালি স্যার, মাসখানেক পরেই বিয়ে তো। এজন্যে ভালো পরিবেশে…”
আকবর সাহেব অনয়ের ইনিয়ে বিনিয়ে বলা কথার অর্থ বুঝে মুচকি হাসলো। পরমুহূর্তে কী ভেবে আবার চিন্তিত হয়ে পরল। বলল,
–“তোমার চেনা-জানা ভালো পরিবেশে কোথাও বাসা আছে? আসলে আমিও কিছুদিন যাবৎ চাচ্ছি এই বাসাটা ছেড়ে অন্য কোথাও শিফট হবো। থাকলে জানিও তো!”
অনয় বেশ চমকালো। অস্ফুট স্বরে বলল,
–“হঠাৎ? কোনো সমস্যা?”
–“না, বাবা। তেমন কিছু না। তবে বাসা চেঞ্জ করাটা খুব জরুরি! আমিও সময়, সুযোগ পাচ্ছি না নতুন বাসা খোঁজার। এজন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়েই তোমাকে বললাম।”
———–
তরী গলির মুখে রিকশা থেকে নেমে আপনমনে হাঁটতে লাগলো। বাসার পথ মিনিমাম পাঁচ মিনিট। এজন্যে হেঁটেই যাওয়ার সিদ্ধান্তি নেয় তরী। কিছুদূর যেতেই হঠাৎ কিছু বখাটে তরীর পথ আটকে দাঁড়ায়। তরী এতে ভীষণ ঘাবড়ে যায়। তবে সে নিজেকে নীরবে সামলে নিলো। মাঝের একদম সামনের ছেলেটাকে তরী চিনে। এটাই বাড়িওয়ালার সেই বখাটে ভাতিজা। বখাটে সোলেমান সিগারেট ফুঁকে তরীর দিকে তাকিয়ে বিশ্রী হাসি দিলো। তরী আগেই নজর অন্য দিকে ফিরিয়ে রেখেছে। এসব ছেলেদের দিকে তাকাতেও তরীর ঘেন্না করে। সোলেমান বিদঘুটে গলায় বলল,
–“চাইছিলাম পর্দানীরে বিয়ে করে ভালো হবো। কিন্তু কেউ চায়-ই না আমি ভালো হই। এটা কী ঠিক বলো তো?”
তরী অস্বস্তিতে পরে গেলো। সৎ সাহস টুকু পাচ্ছে না এদের সবাইকে একসাথে দেখে। হাঁটু জোড়া ইতিমধ্যে কাঁপতে শুরু করেছে তার। মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ে কম্পিত গলায় বলল,
–“পথ ছাড়ুন!”
তরীর ভীতিগ্রস্ত কন্ঠস্বর শুনে সোলেমান হো হো করে হেসে উঠলো। সোলেমানের সাথে তার চ্যালারাও না বুঝেই হাসিতে তাল মেলাল। তরী তার হাত জোড়া মুঠি বদ্ধ করে এদিকে সেদিক কিছু একটা খুঁজতে থাকল। কিন্তু সেরকম কিছুই নজরে পরছে না।
সোলেমান হাসি বজায় রেখেই তরীর দিকে দুই কদম এগিয়ে এলো। তরী ভয়ে পিছিয়ে গেলো। সোলেমান বলল,
–“বাহ! ভয় লাগছে আমাকে? তা তোর হুজুর বাপের ভয় লাগেনি আমার প্রস্তাবে না করার সময়? বুঝে নাই তার একটা “না” তে আমি তোর কী হাল করতে পারি? তোর তো বেহাল করবোই সাথে তোদের সবগুলাকেও বাড়ি ছাড়া করব। তখন রাস্তায় বসে পর্দা চর্চা করিস কেমন?”
সোলেমানের এই ধরণের বিশ্রী কথায় তরী কেঁদে দিল। বলতে চাইল, “তোরা আল্লাহ্কে ভয় কর!”
সোলেমান তরীর হাত ধরতেই নিবে ওমনি কেউ তার হাত ধরে ফেলে। তরী “আল্লাহ্” বলে চিৎকার দিয়ে সরে আসে ভয়ে। চোখ জোড়া বন্ধ। সোলেমান রাগাম্বিত হয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো সিদাত ধরে আছে তার হাত। সিদাতের পেছন থেকেই সাইফ মাথা বাঁকিয়ে সোলেমানের দিকে চেয়ে চওড়া হাসি দিয়ে বলল,
–“ভালো আছো ছোটো ভাই?”
সাইফের গলা শুনে তরী চোখ মেলে তাকায়। সিদাত, সাইফকে একসাথে দেখে ভীষণ অবাক হয়। তার চাইতেও বেশি অবাক হয় সোলেমান সহ তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা। সিদাতের চোখ জোড়া রাগে টগবগ করছে। সে মুহূর্তেই সোলেমানের হাত মুঁচড়ে দিলো। সোলেমান দাঁত, চোয়াল খিঁচে চাপা আর্তনাদ করে উঠল। সিদাত ভীষণ গম্ভীর গলায় বলল,
–“এত সাহস এসব নোংরা চিন্তা-ভাবনা মাথায় আনার, তাও আবার নিকাব রাণীকে নিয়ে? তোর এই হাত যদি তোর গলায় না ঝুলিয়েছি…”
বলেই আরও জোরে মুঁচড়ে ধরলো। সাইফ চট করে সকলের ছবি তুলে নিলো মোবাইলে। সেই ছবি গুলো জুম করে দেখতে দেখতে বললো,
–“ওয়াও! বাট একটু হাসলে ছবি গুলো আরও সুন্দর লাগতো!”
বিপদ অতি সন্নিকটে তা চ্যালাগুলোর বুঝতে বাকি রইলো না। এজন্যে যে যেদিকে পারে সেদিকেই ছুটে পালিয়েছে। একজন চেয়েছিলো সাইফের মোবাইল ছিনিয়ে ভাঙার। কিন্তু সবকিছু কী এত সহজ?
———-
পুরো মহল্লায় খবর ছড়িয়ে গেলো। বখাটে সোলেমান সহ আরও কিছু ছেলেরা হাসপাতালে ভর্তি। সকলেই বাজে রকম আহত। কে বা কারা এই কাজ করেছে তা কেউ জানে না। তবে এটুকু জানা গেছে সোলেমান কোনো এক মেয়েকে বাজে ভাবে উক্ত্যক্ত করছিলো, এজন্যই তাদের এ দশা।
কিন্তু মেয়েটি কে, কী তার পরিচয় তার কিছুই জানা যায়নি। সোলেমানের বাবা, চাচারা থানা-পুলিশ অবধি গেছে কিন্তু কেউ-ই বিশেষ সুবিধা দিতে পারেনি।
এসবটাই সামলাচ্ছে সাইফ এবং সাঈদ সাহেবের ম্যানেজার। আর এদিকে সিদাত তরীকে একের পর এক কল দিয়ে-ই যাচ্ছে। সিদাতের কাছে সেই প্রথম দিকেই তরীর নাম্বার ছিলো। কিন্তু সিদাতের কখনো প্রয়োজন পড়েনি তরীকে কল দেওয়ার। তরীর পছন্দ, অপছন্দ সবসময়ই খেয়াল রেখেছে সে। কিন্তু সেই ঘটনার পরপর তরীকে সে অনবরত কল করছে। তীব্র দুশ্চিন্তা তাকেও জেঁকে ধরেছে। ওই ঘটনা খুবই অপ্রত্যাশিত এবং জঘন্য। যা তরীর মস্তিষ্কে খারাপ আঘাত আনতে পারে। তরীর মতো মেয়ে কখনোই এই ধরণের ঘটনার সম্মুখীন হয়নি। এজন্য এই ঘটনা মেনে নেওয়া তার পক্ষে ভীষণ দুঃসাধ্য ব্যাপার।
তরী প্রথমদিন সিদাতের কল ধরেছিলো যেদিন রাতের মধ্যে সোলেমান সহ তাদের সাথের গুলাকে ধরে উদুম মা* দেওয়া হয়েছিলো। সবই করেছে সাঈদ সাহেবের খুবই পুরানো লোক। স্বয়ং সিদাত করিয়েছে। এগুলা না করলে আগামী দিন তরীর মতো আরও মেয়েরা এদের কবলে পরবে। সবাই তো সবসময় তাদের বাঁচাতে আসবে না। এছাড়াও তরী এখন সিদাতের প্রাণ। প্রাণে কেউ খারাপ চিন্তায় স্পর্শ করতে আসলে তাকে অবশ্যই শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা সে রাখে।
তরী কল রিসিভ করার পরপর সিদাত শুধু এইটুকুই বলেছিলো,
–“এসবের চরম মূল্য চুকাতে হবে ওদের। শুধু কালকে থেকে চোখ-কান খোলা রেখো। সময় মতো সুন্দর খবর পেয়ে যাবে!”
ব্যাস! এটুকুই। তরীর অবস্থা আর জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায়নি। তরী তৎক্ষনাৎ সিদাতকে ব্লকলিস্টে ফেলে দিয়েছে। যা সিদাত বোঝা সত্ত্বেও মনে ক্ষীণ আশায় অসংখ্যবার কল করে চলেছে। কিছুদিন পর সিদাত সেই বাড়ি যাওয়ার পর জানতে পারে তরীরা বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও শিফট হয়েছে। এ খবর শোনার পরপর সিদাতের মাথায় যেন পুরো আকাশটা দুম করে ভেঙে পরলো।
©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]
#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [২৮]
নতুন বাসায় আসার পর গোছগাছে-ই প্রায় তিন দিন চলে গেল তরীদের। নতুন বাড়িটা খুব ভালো পরিবেশে। চারপাশে বাড়ি-ঘর তেমন নেই। কিছুটা দূরে দূরে নতুন, নতুন ভবনের ইন্সট্রাকশন চলছে। এবার তাদের ফ্ল্যাটটা পাঁচ তলায়৷ সিঁড়ির সাথে আধুনিক লিফটও আছে। ভাড়াটা বেশি হলেও আকবর সাহেব এই পরিবেশকেই খুব নিরাপদ অনুভব করল। এই ভবনটাও নতুন।
তরী খোলা বারান্দায় গিয়ে শান্তির শ্বাস গ্রহণ করল। দমকা হাওয়ায় তরীর ভেজা চুল গুলো উড়ছে। এই বারান্দায় তরীকে ওড়না দিয়ে মুখ লুকিয়ে আসতে হবে না। একে তো পাঁচ তলা। আশেপাশের তেমন বিল্ডিং-ও নেই যে তরীকে অন্য কেউ দেখতে পারবে। আগে রাস্তার পাশে বেলকনি ছিলো বিধায় রাত ছাড়া যেতেই পারত না। এখন মনে হচ্ছে সবকিছু সুন্দর, স্বচ্ছ।
সেই পথে হওয়া ঘটনা এখন অবধি তরী ভুলতে পারে না। ভোলা সম্ভব কিনা তরীর জানা নেই। তবে এই ভয়ংকর স্মৃতি তার মস্তিষ্কে পুরো জীবনের মতো থেকে যাবে। সত্যি বলতে সে সাইফ এবং সিদাতের প্রতি কৃতজ্ঞ। সিদাতের প্রতি সন্তুষ্টও। সিদাতের বলা কথাগুলো তার কানে সবসময় তরঙ্গিত হয়। তরীর কেমন মোহময় লাগে। এই মোহটা উপলব্ধি করতেই সেদিন সিদাতকে তরী ব্লক করে দিয়েছে। এবং প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থেকেছে এই ভেবে, না জানি সিদাত আবার তাকে কোন নাম্বার দিয়ে কল দেয়। কিন্তু তরীর সেই আতঙ্ক অবশ্য খামাখাই ছিলো।
তরী মা*রা-মা*রিকে কখনোই প্রশ্রয় দেয় না। কিন্তু সেদিন সোলেমানের ব্যবহার, কাজ এতটাই বিশ্রী এবং জঘন্য ছিলো যে তরী মনে মনে না চাইতেও তাকে খুব ভয়াবহ অভিশাপ দিয়ে ফেলেছে। যে পুরুষ নারীকে সম্মান করতে জানে না, নারীকে সর্বদা ছোটো করে এবং নিজের চাহিদা মেটানোর বস্তু মনে করে সেই পুরুষ আর যাই হোক, মানুষের কাতারে পরতে পারে না। সোলেমাবনের বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার ভঙ্গি এবং আচরণ উভয়-ই অসুলভ। তরীর যদি সোলেমানের সাথে বিয়েও হতো তবুও তরী ভালো থাকত না, আর না সোলেমান ভালো হতো। এজন্যে তরী মাবুদের কাছে লাখ লাখ শুকুরিয়া করে। সাথে ক্ষমাও চায় এমন অভিশাপ দেওয়ার জন্য।
——————
সিদাত চেষ্টা করল তরীদের খুঁজে বের করার। সাইফকেও জানালো। কিন্তু সাইফ ইদানীং খুব ব্যস্ত। সিদাত দিনকে দিন কেমন অস্থির হয়ে যাচ্ছে। একসময় সাইফ সিদাতকে কল দিত! আর এখন সিদাত সাইফকে কল দেয়। বারবার জিজ্ঞেস করে,
–“তুমি কী এই ইহজনমেও ফ্রী হবা না ভাইয়া?”
সাইফ তখন সিদাতের অধৈর্য হওয়া গলা শুনলে মিটিমিটি হাসে। হাসি কোনোরকমে আটকে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
–“মিটিং আছে, আমি ফ্রী হলে কল দিব!”
বলেই সিদাতকে কিছু বলতে না দিয়ে কল কেটে দেয়। সাইফ তখন চাপা হেসে দিয়ার হাত ধরে হাঁটতে লাগে। আসলে এসব মিটিং, কাজ, ব্যস্ততা সবকিছুই বাহানা৷ সাইফ তো এসেছে বউ, শ্বশুরদের নিয়ে দিয়ার দাদু বাড়ি বেড়াতে। অথচ সিদাত জানে সাইফ রাজনৈতিক কাজে কোথাও গিয়েছে। অস্থির সিদাত খেয়াল-ই করছে না সাইফ ছাড়া এ-বাড়িতে দিয়াও নেই।
দিয়া মাথা তুলে সাইফের হাসির দিকে চাইলো। ভুরু কুচকে বলল,
–“ছেলেটাকে শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছ কেন?”
–“শুধু, শুধু কী বলো? এগুলা ওর পানিশমেন্ট। তুমি তো জানো না এই ছেলে আমাকে কতবার নাকে দড়ি দিতে ঘুরিয়েছে। একটু বিরহ সহ্য করুক। বিরহ না হলে আবার প্রেম-ট্রেম জমে না!”
দিয়া চট করে সাইফের হাত ধরে দূরে সরে দাঁড়ায়। সাইফকে পথ দেখিয়ে দিয়ে চাপা হেসে বলল,
–“তুমিও তবে ঢাকা চলে যাও। এরপর ভাইয়ের সাথে বসে বসে বিরহ সহ্য করো। নয়তো আমি বুঝব কী করে তুমি আমায় কেমন ভালোবাসো?”
দিয়ার এরকম কথায় সাইফের মুখখানা দেখার মতো ছিল। মুখ ভার করে বলল,
–“এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আমি কী তোমার প্রেমিক নাকি? আমি তোমার বর! বউকে ফেলে আমি কেন খামাখা ঢাকা যাব?”
–“প্রেমিক হলেই কেন বিরহ সহ্য করতে হবে? বিরহ সহ্য করার স্পেশাল অনুভূতি তো বরদের পাওয়া উচিত। তুমি যাও, আমি আব্বা-আম্মার সাথেই ফিরব!”
–“যাব না।”
–“যাবে। আমার সামনেই ম্যানেজার ভাইয়াকে কল দিচ্ছ তুমি ব্যাস!”
–“সিদাতের জন্যে এসব করছ তো? বরের চাইতে দেবর প্রিয় হয়ে গেলো?”
–“নাহ! সুযোগের সৎ ব্যবহার করছি। তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা! প্রেক্টিক্যালি টিকোনি এখনো!”
সাইফ গোমড়া মুখে বাড়ি ফিরতেই সিদাত চেঁচিয়ে উঠল। বলল,
–“আমাকে টেনশনে ফেলে, কাজের বাহানা দিয়ে এভাবে বউয়ের সাথে ঘুরতে চলে গেছ তুমি ভাইয়া!! ম্যানেজার না বললে তো আমি জানতেই পারতাম না। এদিকে যে আমার বউয়ের জায়গাটা ফাঁকা সেদিকটা দেখছ না!? এত স্বার্থপর কবে হলা তুমি?”
সাইফও রেগে যায়। সব কথা উপেক্ষা করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
–“শুধুমাত্র তোর জন্যে আমার বউ আমাকে ধরে বেঁধে ঢাকা পাঠিয়ে দিলো৷ নয়তো কত সুন্দর টাইম স্পেন্ড করতাম। এটা তোর স্বার্থপরতা না? পড়ছিস তো প্রেমে কয়েকদিনের। এতেই কান ঝালা-ফালা না করলে তোর হয় না?”
দুই ভাইয়ে দাঙ্গা লাগল বউ নিয়ে। একজন বিয়ে করে একা, আরেকজন বিয়ে না করে বউ ছাড়া একা। একজন আরেকজনের দুঃখ বলে বলে ঝগড়া করতে ব্যস্ত। ফিরোজা খাতুন মুখে হাত দিয়ে হা করে দুই ভাইয়ের ঝগড়া দেখছে। সাইফ শেষমেষ চেঁচিয়ে বলল,
–“তোর ওই রাণী কই আছে, বলতাম না যাহ। দূরে যাহ!”
বলেই হনহন করে উপরে চলে গেল। আর সিদাত চুল ঠিক করতে করতে অফিস চলে গেল। সিদাতের আরও একটা দিন কেটে গেলো তরীকে ছাড়া। দুই ভাই-ই বিরহে সারা রাত পুড়লো। সাইফের জুবুথুবু অবস্থা। দিয়া তার ফোনও বন্ধ করে রেখেছে। এসবের কোনো মানে হয়? বউ ছাড়া জীবন এত অন্ধ, অন্ধ জানলে সে বিয়েই করত না!
তরী ভার্সিটির গেটের কাছাকাছি আসতেই ভীষণ রকম চমকালো। সিদাত দাঁড়িয়ে আছে। সিদাতের চেহারা মাস্ক দ্বারা আবৃত থাকলেও সিদাত প্রায় পুরোটাই তরীর চেনা। তরী ভেতরের তীব্র কম্পন অনুভব করল। ভীত চোখে কয়েক পলক চেয়ে দ্রুত পালানোর চেষ্টা করলো। তরী চলে যেতে নিলেই দূর থেকে অস্ফুট স্বরে নিজের নাম শুনতে পেলো। এটা কার ডাক তরী তা জানে। তবুও কোনোরকমে একটি রিকশা নিয়ে সে দ্রুত পালায়। তরী চায় না সিদাত তাকে খুঁজে পাক, তরীর বর্তমান বাড়ির ঠিকানা জানুক। তরী এবং সিদাত দুজনেই দুই মেরুর মানুষ। তাদের দেখা হওয়াটা-ই অসম্ভব ব্যাপারের মধ্যে পরে।
—-
ছুটির দিনে অনয় সিদাতকে ডেকে পাঠালো। আপাতত অনয় ছাড়া আর কোনো গতি নেই। শহরে প্রায় অনেক জায়গাতেই তরীকে খোঁজা হয়েছে। কিন্তু সিদাত কোথাও পায়নি। সেদিন ভার্সিটিতে তরীকে একপলক দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো তার। কিন্তু তরী যেন ভীড়ের মধ্যেই হারিয়ে গেছে। খোঁজার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল সিদাত। অনয়ের কাছেও এতদিন আসেনি। বাসাতেই থেকেছে, মায়ের সংস্পর্শে থেকেছে সে।
কলিংবেল চাপতেই সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুললো না। সিদাত দূরবীন বাইরে থেকে চেপে রাখলো যাতে অনয় তাকে না দেখতে পায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে অনয় দরজা খুলতে দেরী করছে। সিদাত বিরক্তিতে কপাল কুচকাল। অনয় তো এত দেরী করে দরজা খোলে না। আজ সমস্যা কী?
সিদাত আবার কলিংবেল চাপল। এক মিনিটের মধ্যেই দরজা খুলে গেল। সিদাত কিছু বলতে নিবে তখনই দরজার পেছন থেকে মাথা বের করা মানুষটিকে দেখতে পায়। তরী সঙ্গে সঙ্গে সরে গেলো। এবং সিদাতের মুখের ওপরই দরজা লাগিয়ে দিলো। আকবর সাহেব রোজ এই সময়ে বাড়ি ফিরে। এজন্যে তরী তার বাবাকে-ই ভেবেছিল। কামরুন নাহার অর্থাৎ তরীর মা তরীকে বারবার রান্নাঘর থেকে বলছিল দরজা খুলতে, কারণ তারও ধারণা ছিলো আকবর সাহেব-ই এসেছে। কিন্তু দরজা খুলে এমন কিছুর মুখোমুখি হবে তরী কল্পনাও করেনি। তার বুক কাঁপছে, দুরুদুরু শব্দ হচ্ছে ভেতরটায়।
সিদাত তখনো স্ট্যাচুর মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখ জোড়া বদ্ধ দরজায় আবদ্ধ। দ্বিতীয় বারের মতো তরীর মুখখানা সে স্বচক্ষে আবারও দেখতে পেলো। কিন্তু তার মস্তিষ্ক স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে এরূপ আকস্মিক ঘটনায়!
তখনই পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খুলে অনয় বেরিয়ে এলো। অনয়ের পেছন পেছন সাইফ। অনয় চওড়া হাসি দিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল,
–“কেমন লাগলো সারপ্রাইজ, দোস্ত? ঝাকানাকা না?”
সিদাত বাস্তবে ফিরে এল। ঘাড় বাঁকিয়ে দুজনকে পরখ করে বল,
–“পেটে পেটে তাহলে এই ছিলো?”
অনয় এবং সাইফ দুজনে একসাথে হেসে ওঠে। সিদাত গরম চোখে তাদের দিকে চেয়ে আছে। এরা সব কিছু জানতো অথচ সিদাতের সাথে এতদিন ধরে মজা নিয়েছে? সাইফ হাসি থামিয়ে বলল,
–“তোর ভাবী বলেছে বিরহ বেদনা না পেলে নাকি প্রেম-ট্রেম হয় না। এজন্য তোর মনের রাস্তা এতদিন যাবৎ পরিষ্কার করছিলাম। অথচ এদিকে আমার মনের রাস্তা পরিষ্কার হওয়া সত্ত্বেও তোর ভাবী আমাকে বিরহ বেদনায় টইটম্বুর করে রেখেছে। এবার অন্তত বিরহ কাটুক, তোর অভিশাপও আমার গায়ে না লাগুক!”
অনয় এবারও হাসলো। সাইফ আবার বলল,
–“আমি কিন্তু এখানে এসেছি বিরিয়ানি খেতে। অনয়, বাবুর্চি গিরি শুরু কর। অনেকদিন তোর হাতের বিরিয়ানি খাওয়া হয় না। আর হ্যাঁ সিদাত! বাবাকে আমি সবটা জানিয়েছি। বাবা এখন তরীদের পারিবারিক খোঁজ-খবর নিচ্ছে। আশা রাখছি বাবা কিছুদিনের মধ্যেই ওদের বাসায় আসবে।”
©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]