#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [৩৩]
আজ জয়ার মৃ*ত্যুর চারদিনের মিলাদ পড়ানো হল। মাদ্রাসার বাচ্চাদের দিয়ে কুরআন পড়ানো হয়েছে, তাদের খাওয়ানো হয়েছে। এতিম খানার বাচ্চাদেরকেও খাবার পাঠানো হয়েছে। বলা বাহুল্য বেশ বড়ো আয়োজন করেছেন সাঈদ সাহেব। সব আয়োজন বাচ্চাদের এবং হত- দরিদ্রদের জন্য। আকবর সাহেবরা যাওয়ার পরদিন-ই দুই ভাই বুকে পাথর চেপে আয়োজনের ফর্দ এবং কাজে মশগুল হয়ে গিয়েছিল। তরী এবং সিদাতের সম্পর্ক দুই দিনে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। দিয়া এবং তরীর সম্পর্কটাও খুব দারুণ হয়েছে। দিয়ার একমাত্র সঙ্গী এবং তরী-ই। দিয়ার সব কাজেই তরী তাকে সাহায্য করে। ফিরোজা এখন একা একা থাকে। আবার দু’এক সময় বউদের কাজে সাহায্যও করে।
আত্নীয় স্বজন আবারও ভীড় জমিয়েছে আহমেদ ভিলা তে। আজ দিয়ার বাবা-মা, তরীর পরিবারও এসেছে। আকবর সাহেব মেয়েকে বারবার জিজ্ঞেস করেছে, এই বাড়িতে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে কী না, সিদাত তার খেয়াল রাখছে কী না। তরী তার বাবাকে মুখ ফুটে শুধু এইটুকুই বলেছে,
–“সব ঠিক আছে বাবা। সকলেই খুব আন্তরিক।”
আর মায়ের কাছে টুকিটাকি কথা শেয়ার করেছে। সিদাত কী রকম, কেমন খেয়াল রাখছে, বাকিদের ব্যবহার সবটাই মাকে বলল। কামরুন নাহার সব শুনে আকবর সাহেবের সাথে ব্যাপারটা বললে আকবর সাহেব স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। মনে হল বুকে থাকা শক্ত ধাঁচের পাথরটি নেমে গেল।
রাতে আবার সকলে বাড়ির পথে রওনা হল। মানুষ জনে গিজগিজ করা বাড়িটা আবারও কেমন খালি হয়ে গেল। দিয়া সাইফের জন্যে কফি করে নিয়ে গেল। তরী ফিরোজার থেকে জেনে নিয়ে সিদাতের জন্যে চা বানাল। সিদাত চা এবং কফি দুটোই খায়। তবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে। তরী দুই কাপ চা বানাল। এক কাপ হাতে নিয়ে বলল,
–“বাবাও বোধহয় এখন চা পিপাসায় ভুগছে। এজন্যে এক কাপ বেশি বানালাম!”
ফিরোজা আলতো হেসে বলল,
–“ঠিক বলেছ। তুমি গিয়ে সিদাতকে চা টা দাও। আমি তোমার বাবাকে চা দিয়ে আসছি!”
তরী ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। ফিরোজা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে চা নিয়ে গেল সাঈদ সাহেবের রুমের দিকে। দরজার সামনে এসে পা থামিয়ে ভেতরটা পরখ করে নিল। সাঈদ সাহেব আরাম দায়ক চেয়ারে বসে জানালা ভেদ করে অদূর আকাশে চেয়ে আছে। ফিরোজা হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে তার উপস্থিতি জানান দিল। অতঃপর ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে চা টা সাঈদ সাহেবের কাছাকাছি রেখে নীরবে আবার ফিরে আসতে গেলে সাঈদ সাহেব খুবই নরম গলায় বলল,
–“আমাকে মাফ করে দিও, আমার বোকামীর আচরণে!”
ফিরোজা চমকালো সাঈদ সাহেবের কথায়। সাঈদ সাহেব হালকা নড়ে চড়ে পাশ ফিরে ফিরোজাকে পরখ করে নিল। অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–“আমি এতদিনে উপলব্ধি করেছি, এসকল পরিস্থিতির পেছনে তোমার হাত নেই। তবুও নীরব, প্রকাশ্যে তোমাকে এতটা দিন অবহেলা, লাঞ্চিত করে গিয়েছি। তোমার অধিকার থেকে তোমায় বঞ্চিত করেছি। ভুলে গেছিলাম জয়ার মতই তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। তুমিও আমার স্ত্রী। শুধুমাত্র “দ্বিতীয় স্ত্রী” বলে তোমায় অবহেলা করতাম, কষ্ট দিতাম। কিন্তু স্ত্রী তো স্ত্রী-ই হয়। সকল স্ত্রীকেই সমান চোখে দেখতে হয়, যা আমি শ*তানের ধোকায় পড়ে ভুলে বসেছিলাম। বারবার মন বলতো আমি আমার জায়গায় ঠিক!”
সাঈদ সাহেব থামল। ফিরোজা কথার মাঝেই পিছে ফিরে তাকিয়েছে। তার চোখ-মুখে বিস্ময় ভরা। সাঈদ সাহেব পরপর দু’বার চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–“সেই দুর্ঘটনার পরপরই বোধহয় জয়া আন্দাজ করেছিল তার হাসি-খুশির দিনগুলি অল্প সময়ের। সে না থাকলে আমি থাকব কী করে? এছাড়া ছেলে দুটোর কী হবে? এসব নানান চিন্তায় মগ্ন হয়ে জয়া নিজের বুকে পাথর চেপে বলেছিল, শুনছেন! আমি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত শোনাতে চাই। আপনি আবার বিয়ে করবেন। শুনেছিলাম নিজের স্বামীর পাশে নারী তার ছায়াকেও সহ্য করতে পারে না। কিন্তু সেখানে জয়া নিজেই তার সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়ে আমার এবং আমাদের ছেলেদের জন্যে এত বড়ো কাজ করল। তোমার সাথে আমাকে বিয়ে দিল। হয়তো জয়া এই ভেবে স্বস্থি পাচ্ছিল, সে চলে গেলে আমার পাশে কেউ থাকবে, সে চলে গেলে আমাদের ছেলেরা মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হবে না। আসলে-ই তোমার বান্ধুবী আগে থেকেই তীর্যক বুদ্ধিমান। নয়তো দেখো, কীভাবে জীবনের হিসাব আগেই করে রেখেছিল। এও কী সম্ভব?”
ফিরোজার চোখ জোড়া ভিঁজে উঠেছে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে কম্পিত গলায় বলল,
–“আমার আপনার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই। আপনার আচরণ যথার্থ ছিল।”
–“এই কথা বলে আমাকে আবারও অপরাধ বোধে ডুবিয়ে দিও না। তোমার অভিযোগ থাকা জরুরি, সঙ্গে অধিকারও। হয়তো সব চাওয়া এখনো পূরণ করতে ব্যর্থ। তবুও আমি অনুরোধ করছি, আমাকে আরও কটা দিন সময় দাও। আমি নিজেকে তোমার সাথে মানিয়ে নিই!”
ফিরোজা বুঝতে পারল সাঈদ সাহেব আসলেই অনুতপ্ত। তার এসব গ্লানি সে দূর করতে চাইলেও কোথাও একটা বাঁধা পাচ্ছে। জয়াকেও ইদানীং হারিয়েছে সে, মনের অবস্থা ভালো নেই। এজন্যে ফিরোজা সময় দিল। সাঈদ সাহেব এখন থেকে চেষ্টা করবে যতটা নরম সুরে ফিরোজার সাথে কথা বলা যায়!
———–
তরী রুমে গিয়ে দেখল সিদাত অনয়ের সাথে কথা বলছে। তরীকে নজরে পড়তেই সিদাত বলল,
–“অনয়, পরে কথা বলব।”
কল কেটে তরীকে নিয়ে বারান্দায় চলে এল। তরীর হাতে এক কাপ চা দেখে সিদাত থমথমে সুরে বলল,
–“আরেক কাপ কোথায়?”
তরী কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
–“আমার এই সময়ে চা খাওয়ার অভ্যেস নেই। আপনি খেয়ে নিন!”
–“আগে অভ্যেস ছিল না এবার অভ্যেস করে নাও। এক কাপেই দুজন চা খাব!”
বলেই সিদাত চায়ে চুমুক দিল। তরীর চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায় এ কথা শুনে। যেন মনে হচ্ছে অনেক অবাক করা কথা শুনল। তরীর অভিব্যক্তি দেখে সিদাত বলল,
–“এভাবে তাকাচ্ছ কেন? এক প্লেটে, এক হাতে ভাত খেতে পারলে কী এক কাপে চা খাওয়া যায় না? কাছে এসো। এক চুমুক দিয়ে যাও!”
সময় তার আপন গতিতেই চলতে শুরু করল। কারো মৃ*ত্যুতেই জীবন থেমে থাকে না। সে তার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চলতে থাকে। শোক ব্যথা ধীরে ধীরে ভুলিয়েও দেয় সে। দিব্যি তাদের নিত্য দিনে ফিরে যেতে হয়, ব্যস্ততায় জুবুথুবু হতে হয়। আজ জয়ার মৃত্যুর প্রায় দুই মাস। তরী এবং সিদাতের জীবনটা সেই প্রথম দিন গুলোর মতোই চলছে। তরী মানিয়ে নিবে বলে দুই মাস পার করে ফেলল, অথচ সে এখনো সেভাবে নিজেকে প্রস্তুত করেনি। সিদাতের সাথে সবকিছু মানিয়ে নিতে পারেনি। তবে সিদাতের সাথে তরী অনেকটা সহজ হয়েছে। তরী প্রতিদিন সিদাতকে নামাজ পড়তে পাঠায়। ফজরের এলার্মে মাঝেমধ্যে তরী উঠতে না পারলে সিদাত তখন তাকে উঠিয়ে দেয়। তারা মুখে প্রকাশ না করলেও একে অপরের পূর্ণতা হয়ে গিয়েছে। কেউ কাউকে ছাড়া চলতেই পারে না। খুনশুটি, ভালোবাসা যেন তাদের জীবন জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। সিদাতের বিষাদে ভরা সময় গুলোতে তরী সিদাতের ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়াত। তাকে আশ্বস্ত করত, মন ভালো করার চেষ্টা করত। আবার তরীর মন খারাপ হলেও ঠিক তাই।
তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই দুই মাসে তাদের একদমই কোনো রকম ঝগড়া হয়নি। আবার কখনো কখনো সিদাতের মায়ের জন্যে খুব মন খারাপ করলে হয় মায়ের রুমে গিয়ে একাকী বসে থাকত নয়তো মায়ের কবর জিয়ারত করে আসত।
মাঝেমধ্যে সিদাত তরীর জন্যে রান্না করে। আর তরী বলে দেয় কোনটা কীভাবে রান্না করতে হবে। কোন মশলা দিতে হবে ইত্যাদি। সেই খাবার খুব ভালো না হলেও মোটামুটি চলে যায়। সিদাত এগুলো সবাইকে সাথে নিয়ে খায়। পরিবারকে সাথে নিয়ে খাওয়া এবং সময় কাটানোর মজাই আলাদা। তরী এবং দিয়া যেন এই বাড়ির প্রাণ। এর মাঝে সিদাত এবং সাইফ হঠাৎ সিদ্ধান্ত জানায়, সাঈদ সাহেব এবং ফিরোজা খাতুন হজ করতে যাবে। হজের সম্পূর্ণ খরচ তারা দুই ভাই বহন করবে। সাঈদ সাহেব এবং ফিরোজাও এতে রাজি হল। মানসিক শান্তি মিলবে তাহলে।
তরী ফিরোজাকে ব্যাগ গোছাতে সাহায্য করছে। দিয়ার পরীক্ষা চলছে, বাড়িতে নেই সে। এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমেই দিয়া তার পড়ালেখা জীবনের ইতি টানবে। তরী আজ ভার্সিটি যায়নি। বিয়ের পর তরীর পড়াশোনা থেমে থাকেনি। বিয়ের দশ-বারোদিন পর থেকে তরীকে ভার্সিটি দিয়ে আসে এবং নিয়ে আসে সিদাত। প্রতিবারই তারা ট্যাক্সি করে যাওয়া-আসা করত। পরের মাসেই সিদাত নিজের টাকা এবং সাইফের থেকে কিছু টাকা ধার করে প্রাইভেট কার কিনেছে। শুধুমাত্র তরীর জন্যে। তরী বাইকে অভ্যস্ত নয় এবং অস্বস্থিও অনুভব করে। এজন্যে সিদাত তার বাইকটা বিক্রি করে এই গাড়িটা কিনেছে। সিদাত যেদিন গাড়ি কিনে বাড়ি ফিরেছে সেদিন মুচকি হেসে বলেছিল,
–“এটা করে আমরা খুব দূর পর্যন্ত ঘুরে বেড়াব নিকাব রাণী!”
তরী ব্যাগ গুছিয়ে দিতে দিতে ফিরোজার উদ্দেশ্যে বলল,
–“আর কিছু বাকি আছে মা?”
–“না, তুমি ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করো। আর কাজ করতে হবে না। আমি বাকিটা সামলে নিব!”
তরী লাগেজের পাশে বসে বলল,
–“তা কী করে হয়? আজ রাতে তোমাদের ফ্লাইট, আর আমি হাত গুটিয়ে রুমে বসে থাকব? এটা হয়? আমি তোমার সাথে সময় কাটাব। কোথাও যাচ্ছি না!”
ফিরোজা হাসল তরীর কথা শুনে। তরী আবার মন খারাপ করে বলল,
–“তোমাদের ছাড়া খুব একা লাগবে!”
ফিরোজা হেসে বলল,
–“তাহলে আরেকজন আনার ব্যবস্থা করে ফেলো। যাতে করে আমরা ফেরার পর সুসংবাদ শুনতে পাই?”
তরী ফিরোজার এই কথার অর্থ বুঝতে পেরে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথা নুইয়ে ফেলল। তার ভেতরটা কেমন ধুকপুক করছে তীব্র অনুভূতিতে। ফিরোজা তরীর এরকম অভিব্যক্তি দেখে উচ্চ স্বরে হেসে দিল। বলল,
–“পাগলি, এত তাড়া নেই। আগে নিজেকে গুছিয়ে নাও। পড়াশোনা শেষ করো। এরপর নাহয় আল্লাহ্’র হুকুমে একজন আসবে। দিয়াকেও একবার মশকরা করে বলেছিলাম। ওই মেয়েটাও লজ্জা পেয়েছে!”
তরী আড়চোখে অল্প করে তাকাল। তরীর মাথায় চট করে একটা প্রশ্ন আসল। ফিরোজার কোনো সন্তান নেই? সন্তান ছাড়া এতগুলো বছর কী করে পার করেছে সে? মা হওয়ার টান তো প্রতিটা মেয়ের মধ্যেই রয়েছে। তবে ফিরোজা খাতুন সেই টান ছাড়া কীভাবে টিকে আছে? তার কষ্ট হয় না?
©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]
#হৃদয়_এনেছি_ভেজা – [৩৪]
জোছনা রাঙা রাত। আকাশে থালার ন্যায় চাঁদখানা তার আলোর রশ্নি জমিন বুকে ছড়িয়ে দিয়েছে। কী এক রোমাঞ্চকর মুহূর্ত, দমকা হাওয়া বারবার ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তরী জানালা মেলে দিয়ে বিছানায় শুয়ে এই মুহূর্ত ভীষণ রকম উপভোগ করছে।
কানে তার ব্লুটুথ গোঁজা। সিদাতের কন্ঠস্বর শুনছে সে। বিয়ের পর থেকে সিদাতের শো-এর রেগুলার স্রোতা হয়ে গিয়েছে সে। যখনই মিউজিক, বাদ্যযন্ত্র কানে বিঁধত, সঙ্গে সঙ্গে কান থেকে ব্লুটুথ খুলে ফেলে সে। যদিও সিদাতের শো-তে ইদানীং বাদ্যযন্ত্র শোনা যায় কম। কেন তা তরীর জানা নেই।
সিদাতের কথাগুলো তার কাছে অন্যরকম ভালো লাগে। অনুভব-ই হয় না সিদাত তার পাশে নেই। মনে হয় সিদাত যেন তার সাথে নিঃশ্বাসের মতো করে মিশে আছে।
কয়েক মাস আগেও ভাবেনি এই ছেলেটা-ই তরীর ভাগ্যে আছে, এই ছেলেটার-ই অর্ধাঙ্গিনী হবে। আজও মাঝেমধ্যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এই ছেলেটাই তার বর, তার সবথেকে কাছের মানুষ।
তরী খেয়াল করেছে সিদাতকে ভেবে সে আনমনে হাসে, সিদাতের আশেপাশে থাকার জন্যে তার হৃদয় ব্যাকুল থাকে। সিদাতকে দীর্ঘক্ষণ দেখার পর তার হৃদয় সিক্ত হয়। অথবা সিদাতের ভাষায় ভালো লাগায় ভিজে যায়।
সিদাতের ভেজা হৃদয়ের সাথে মিশতে মিশতে ইদানীং তার হৃদয়টাও কেমন ভেজা, সিক্ত লাগে। এরকম আকাশ-পাতাল ভাবতে গিয়ে তরী আপনমনে হাসল।
দিয়া কিছুক্ষণ আগেই তার রুমে গিয়েছে। সাইফ সারাক্ষণ বিভিন্ন কাজে বাইরে থাকে। তাই যখন সাওফ ফিরে, দিয়াকে তাকে সঙ্গ দিতে হয়। সাঈদ সাহেব এবং ফিরোজা হজ করতে গিয়েছেন আজ প্রায় পাঁচ দিন হল।
তরী কী ভেবে তার গোপন সখটাকে উম্মুক্ত করল। স্কেচবুক, পেন্সিল নিয়ে বসল। চাঁদকে লক্ষ্য করে একটা একটি দৃশ্য স্কেচ করল।
চাঁদের চারিপাশে ধবধবে মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। চাঁদ মেঘকে সরিয়ে দিয়ে জমিনে নরম, শান্ত আলো ছড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তরীর অধরে লেপ্টে আছে অদ্ভুত হাসি।
কানে বেজে চলেছে প্রিয় পুরুষের কন্ঠস্বর, আর আনমনে প্রিয় মুহূর্তটি স্কেচ করে সংগ্রহ করছে তরী।
আজ বেশ রাত করেই সিদাত বাড়ি ফিরল। রুমে এসে দেখল তরী পেন্সিল, ইরেজার, স্কেচবুক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। সেগুলোর পাশেই জানালার দিকে মুখ করে সুখ ঘুমে তলিয়ে আছে তরী। জানালা ভেদ করে আসা নরম বাতাস তরীর মুখশ্রী ছুঁয়ে দিচ্ছে।
যার ফলস্বরূপ তরীর সামনের চুলগুলো মৃদু দুলছে। সিদাতের চোখ জুড়িয়ে গেল যেন এই দৃশ্য দেখে। রুমে আসার আগেই দিয়া বলেছিল,
–“তরীকে দেখলাম ঘুমিয়ে গেছে। এখনো কিছুই খায়নি মেয়েটা। দেখো তো উঠিয়ে খাওয়াতে পারো কী না! আর নিজেও আসো খেয়ে যাও।”
কিন্তু সিদাতের ইচ্ছে করল না, এই ঘুমন্ত নিকাব রাণীকে ডেকে তোলার। সে এই মুহূর্তে ঘুমন্ত অবস্থাতেই সুন্দর। পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুন্দর।
কাউকে ভালোবাসলে বুঝি তাকে সবসময় সেরা লাগে? তার ঘর্মাক্ত, গুটি গুটি ব্রণ, বাম্পস এর দাগেও বুঝি তাকেই অসাধারণ লাগে, তাকেই আমার জীবনে চাই এরকম অনুভব হয়? সিদাতের মনে হয় তরী-ই তার জীবনে দেখা সেরা নারী, সেরা স্ত্রী। যাকে সিদাত প্রথম ভালোবাসার স্থান দিয়েছে, যাকে স্ত্রী রূপে পেয়েছে।
অবশ্যই মায়েরাও সেরা হয়। কিন্তু ওইযে, সকলেরই নির্দিষ্ট একটা অবস্থান রয়েছে। তাদের নিজেদের অবস্থান থেকে তারা সুন্দর, অমায়িক সুন্দর। একজন জননী রূপে, আরেকজন সহধর্মিণী রূপে।
সিদাত আলতো পায়ে জানালার কাছাকাছি গেল। স্কেচবুক শব্দহীন হাতে নিল। পৃষ্ঠা উলটে দেখল দুইটা স্কেচ। একটি চাঁদের আশেপাশে মেঘের আনাগোণা, অপরটি বিরাট চাঁদের মাঝে একটি তরী নদীতে ভাসছে।
দ্বিতীয় ছবিটি-ই সিদাতকে বেশি আকর্ষণ করল। মন বলল এই ছবিটার অর্থ আছে। সিদাত গভীর চোখে ছবিটা দেখল। হঠাৎ তার মাথায় দুটো এলোমেলো লাইন এল। সিদাত ছবিটি থেকে চোখ সরিয়ে তরীর দিকে তাকালো। ঘোর লাগা কন্ঠে আওড়ালো,
–“আকাশে চাঁদ, নদী কুলে প্রেমের তরী
অসংখ্য চন্দ্র বিলাসে
তরী জুড়ে হারাব, হারাচ্ছি আমি।”
সিদাতের হঠাৎ কী হলো জানা নেই। সে তরীর দিকে এগিয়ে তরীর দিকে ঝুঁকে কপালে অধর ছোঁয়াল। সেই ছোঁয়া দিতে গিয়ে সিদাতের সর্বাঙ্গ জুড়ে শীতল অনুভূতি ছড়ালো। বিছানাটা নীরবে গুছিয়ে সিদাত তরীর পাশেই শুয়ে পড়ল। শুয়ে শুয়ে এক নজরে তরীকেই দেখতে লাগল।
আলতো হাতে তরীর লালাভ গাল ছুঁয়ে দিল। মেয়েটাকে সিদাতের হৃদয়ে বন্দি করে রাখতে ইচ্ছে করে। মায়াভরা মুখশ্রী, লালাভ গাল, চেহারার লাবণ্য সবটাই সিদাতকে অসংখ্যবার পিছলে পড়তে বাধ্য করেছে।
দিয়াকে সিদাত মেসেজ করে জানিয়ে দিয়েছে আজ তারা কেউ-ই খাবে না। এজন্য দিয়াও নিজের রুমে এসে শুয়ে পড়েছে। সাইফ তখনো ল্যাপটপে ডুবে আছে। দিয়া আড়চোখে সাইফের এরকম ব্যস্ততা দেখে গাল ফোলাল। একপ্রকার রাগ করেই চোখ শক্ত করে শুয়ে রইল। সাইফকে দেখবেও না, কথাও বলবে না।
মিনিট দুয়েকের মাঝে সাইফ গায়ের পারফিউমের ঘ্রাণটা দিয়া খুব কাছ থেকে পেল। সেই ঘ্রাণ পেয়েও দিয়া ভ্রুক্ষেপ করল না। আগের ন্যায় নড়াচড়া ছাড়া শুয়ে রইল। হঠাৎ সাইফের শীতল স্পর্শ পেতেই দিয়া দূরে সরে যেতে চাইল। কিন্তু সাইফ তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল,
–“জামাইয়ের ব্যস্ততা সহ্য করতে পারো না? সহ্য করতে না পারলে পেট চলবে কী করে বউ?”
দিয়া তাও সাইফের থেকে ছোটার চেষ্টা করতে লাগল। সাইফ আবার বলল,
–“আহা, অভিমানী বেগম। এভাবে রাগছ কেন? এসেছি তো সব ব্যস্ততা ফেলে। তাও দূরে সরিয়ে দিবে?”
দিয়া এবারও জবাব দিল না। সাইফ হাল ছেড়ে বলল,
–“ওকে, কিচ্ছু বলতে হবে না। এভাবেই থাকো! ঘুমাতে দাও। নিজেও ঘুমাবা!”
বলেই দিয়াকে জড়িয়ে ধরে সাইফ চোখ বুজল। দিয়া চাপা স্বরে বলল,
–“ঘুমালে আমার ছেড়ে ঘুমান। আমার ভালো লাগছে না!”
সাইফ চোখ বুজেই বলল,
–“আরেকবার নড়াচড়া করলে কালকের ছুটি আমি ক্যান্সেল করে দিব কিন্তু বউ!”
দিয়া সঙ্গে সঙ্গে নড়াচড়া বন্ধ করে দিল। সাইফ তবে কাল বাসাতেই থাকবে? মন জুড়ে ভালো লাগা ছেয়ে যায় দিয়ার। অধর বাঁকিয়ে হেসে সাইফের বাহুতে মুখ গুঁজে চোখ বুজল।
পরেরদিন সাইফ, সিদাত দুজনেই বাড়িতে। দিয়া এবং তরীরও আজ কোনো কাজ করা বারণ। খাবার আজ বাইরে থেকে অর্ডার করা হবে। আজ চারজন মিলে একসাথে সময় কাটাবে। আবার নিজেদেরকেও সময় দিবে। বাহির থেকে খাবার আসার পরপর চারজন ছাদের মেঝেতে বসে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
তরী অন্যদিকে ফিরে বসল। আর সিদাত বসল তরীর পিছেই। যার ফলস্বরূপ দুজনের পিঠ একই সংস্পর্শে। সাইফ সিদাতের মুখোমুখি বসায় তরীর মুখ দেখার কোনো রকম পন্থা নেই। তরী খুব সন্তুষ্ট সিদাতের উপর। সিদাত তার পর্দার ব্যাপারটা সেই প্রথম থেকেই খেয়াল রাখছে। সিদাত একদিন উচ্ছাসের সাথে বলেছিল,
–“আমি ভাগ্যবান আমার মূল্যবান নিকাব রাণীকে পেয়ে। মন থেকে দোয়া করি আমার মূল্যবান রাণীর মায়াবী মুখখানা আমি ছাড়া আর কোনো পরপুরুষ স্বচক্ষে না দেখুক।”
—————
রাতে সিদাত এবং তরী পাশাপাশি বসে চা খাচ্ছে। সিদাত হুট করে বলে ওঠে,
–“নিকাব রাণী!”
তরী অস্ফুট সরে বলল, “হুঁ!”
–“তোমার মনে অনেক প্রশ্ন তাই না? আমি এলকোহল খাই..”
তরী সিদাতের এ কথা শুনে ভীষণ ঘাবড়ে যায়। ঘাড় বাঁকিয়ে সিদাতের চোখে চোখ রাখে। সিদাত আলতো স্বরে বলল,
–“একটা মিস আন্ডাস্ট্যান্ডিং হয়েছে তোমার। সেই মিস আন্ডাস্ট্যান্ডিং-টা আমি অনেকদিন যাবৎ দূর করতে চাইছিলাম, কিন্তু সময় সুযোগ হচ্ছিল না। সাথে কেন যেন বলতেও পারছিলাম না। শোনো তবে, আমি কখনো এলকোহল মুখে নেইনি। এটার থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকতাম। কিন্তু সেদিন…”
বলেই সিদাত ধীরে ধীরে সেদিনের ঘটনা খুলে বলল। তরীর চট করে সেদিনের গুন্ডা লোকগুলোর কথাও স্মরণে আসে। কী বিপদজনক ছিল সেই রাত। ভাগ্যিস আল্লাহ্ সহায় ছিল, নয়তো সেই রাত কীভাবে তারা দুজন মেয়ে এই বিপদ থেকে রক্ষা পেত। সত্যি-ই মাবুদ পাশে থাকলে ভয় কিসের?
সব বলা শেষে সিদাত বলল,
–“ভাইয়া তখন মাত্র ইলেকশনে দাঁড়িয়েছে। এজন্য বিপক্ষ দল ভেবেছিল আমাকে ড্রাগ দিয়ে দুর্বল করবে। কিন্তু সত্যি-ই সেদিন আমি বেঁচে গিয়েছিলাম!”
তরী বড্ড নরম গলায় বলল,
–“রক্ষা করার মালিক আল্লাহ্। তার কাছে ক্ষমার পাশাপাশি শোকরিয়া আদায় করুন।”
সিদাত তাই করল। পরমুহূর্তে দুষ্টু হেসে বলল,
–“সেদিন থেকে তো ঠিকই ভাবছিলে, বড়োলোকের বিগড়ে যাওয়া মাতাল ছেলে তোমার জীবন অতীষ্ঠ করে রেখেছে। তাই না?”
তরী ধরা খেয়ে চুপ করে রইল। আগে যেমন তেমন ব্যাপারটা হলেও এখন সিদাত তার স্বামী। চাইলেও লাজ-শরম গিলে সেসব কথার স্বীকারোক্তি উচ্চারণ করতে পারবে না। এজন্য চুপ থাকাকেই শ্রেয় মনে পরল। সিদাত তরীর এমন নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া দেখে হো হো করব হেসে ওঠল। হাসি থামিয়ে হঠাৎ বলল,
–“নিকাব রাণী! তোমায় বুকে আবদ্ধ করতে চাইছি। আসবে আমার এই তুমিহীন বুকে? মাথা রেখে চোখ বুজবে?”
©লাবিবা ওয়াহিদ
~[ক্রমশ]