হৃদয় জুড়ে তার ছায়া পর্ব-১৮+১৯

0
190

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১৮
#আদওয়া_ইবশার

লাবিব রাফিনের কথা কিছুই বুঝতে পারেনা পাপড়ি। চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে দুজনের দিকে। পাপড়ির অভিব্যক্তি দেখে রাফিন পূণরায় বলে,

“নিশ্চই বুঝতে পারছোনা কি বলছি! সবটাই বুঝিয়ে বলব। তার আগে চলো কোথাও একটু বসি। অনেক লম্বা কাহিনী ঘটে গেছে। পুরোটা বিশ্লেষণ করতে সময় লাগবে একটু।”

কিছুক্ষণ ভাবে পাপড়ি। হাতে থাকা পিঠার বক্সের দিকে তাকায়। বেশিক্ষণ থাকলে পিঠা গুলো হয়তো নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এদিকে লাবিবদের মুখের উপর না’ও বলে দিতে পারেনা। বিষয়টা খারাপ দেখায়। তাছাড়া ঘটনা নিশ্চয়ই নাহিদ কেন্দ্রিক। না হয় তাকে জানানোর জন্য হয়তো ওদের প্রয়োজন হতনা। কৌতূহল সৃষ্টি হয় পাপড়ির। মাথা নাড়িয়ে সায় জানায় রাফিনের কথায়। আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে দুই মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ অতিক্রম করে একটা কফি শপে গিয়ে বসে। তিনজনের জন্য তিনটা কফির অর্ডার দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করে রাফিন,

“গত বৃহস্পতিবার ছুটি পেয়ে অনেক দিন পর নাহিদের বাসায় এক হয়েছিলাম চার বন্ধু। অর্ধেক রাত পযর্ন্ত আড্ডা দিয়ে ফজরের আগ মুহুর্তে ঘুমিয়েছিলাম। সকালে না কি নাজিমের ফোনের শব্দে আমাদের আগেই ঘুম ভেঙ্গে যায় নাহিদের। ফোনটা এসেছিল নাদিয়ার নাম্বার থেকে। বোনের নাম্বার থেকে নাজিমের ফোনে কল আসায় একটু ভাবনায় পরে যায় নাহিদ। কৌতূহল বসত ফোন ঘেটে নাদিয়ার সাথে নাজিমের অনেক গুলো ম্যাসেঞ্জারে কনভার্সেসন দেখতে পায়। ম্যাসেজ গুলো দেখে যে কেউ বুঝতে পারবে দুজনের মাঝে গভীর প্রেমের সম্পর্ক। হুট করে এমন কিছু একদম অপ্রত্যাশিত ছিল নাহিদের জন্য। বিষয়টা মানতে না পেরে ঘুমন্ত অবস্থা থেকেই নাজিমকে টেনে তুলে জেরা করতে শুরু করে। কথার এক পর্যায়ে নাজিমের গায়ে’ও হাত তুলে নাহিদ। ওদের হুড়োহুড়ির শব্দেই ঘুম ভাঙ্গে আমাদের। কাঁচা ঘুম থেকে ওঠে ওদের এই অবস্থা দেখে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারিনি আমরা। পরে ঘটনার বিস্তারিত জানার পর আমরাও কম অবাক হয়নি। নাজিমের সাথে যে নাদিয়ার কোনো সম্পর্ক আছে বিষয়টা আমরা কেউ জানতাম না। এরপর যা ঘটে গেল কি আর বলব। তোমার খ্যাঁপা ষাড় একদম দিকশূণ্য হয়ে যেভাবে পেরেছে সেভাবেই আঘাত করেছে নাজিমকে। এক পর্যায়ে নাজিম’ও চুপ করে না থেকে পাল্টা আঘাত শুরু করে। নাহিদের এক কথা,নাজিমের মতো মেয়েবাজ একটা ছেলে তার বন্ধু হতে পারে ঠিক আছে। হাজারটা মেয়ের সাথে তার রিলেশন থাকতে পারে। এতেও নাহিদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কিন্তু তার বোনের দিকে কোন সাহসে নজর দিল সে! বন্ধু হয়ে বন্ধুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা কেন করল। প্রথমে নাজিম শান্তভাবে নাহিদকে বুঝানোর চেষ্টা করলেও এক পর্যায়ে সে নিজেও পাল্টা নাদিয়ার দিকে আঙুল তুলে। নাহিদকে ব্লেম দিয়ে বলে, “আমি না হয় খারাপ। মেয়েবাজ বখাটে একটা ছেলে। কিন্তু তোর বোন কোন ধোয়া তুলসী পাতা? এতোই যখন ভালো তোর বোন তাহলে আমি বললেই কেন সম্পর্কে জড়াবে আমার সাথে? এখানে যদি কেউ দোষী হয়ে থাকে তাহলে আমি একা না, তোর বোনও সমান দোষী। আমাকে শাসানোর আগে তোর বোনকে সামাল দে।” ব্যাস! তোমার ওনাকে আর কে আটকায়? সাথে সাথে রওনা হয়ে যায় রাজশাহীর উদ্দেশ্যে। এতোক্ষনে হয়তো বাচ্চা মেয়েটার উপর কেয়ামত সৃষ্টি করে ফেলেছে।”

ঘটনা বিস্তারিত শুনে বিস্ময়ে বাকহারা পাপড়ি। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে রাফিনের মুখের দিকে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে প্রশ্ন করে রাফিনকে,

“আমি নিজেও জানতাম আপনারা অনেক ভালো বন্ধু। নাজিম ভাইয়ের চরিত্র কেমন সেটা আমি জানিনা। তবে আপনাদের কথা অনুযায়ী সত্যিই যদি নাজিম ভাই প্লেবয় টাইপ হয়ে থাকে তবে ওনি কিভাবে নিজের প্রাণপ্রিয় বন্ধুর বোনের দিকে নজর দেয়? এদিক থেকে ভাবলে কিন্তু আমার মনে হয় ভাই হিসেবে আপনাদের বন্ধুর এমন রিয়েক্ট করা যুক্তিসঙ্গত। কোনো ভাই নিশ্চয়ই চাইবেনা তার বোন কোনো মেয়েবাজ ছেলের পাল্লায় পরুক। হোক সেই ছেলে নিজের যতই ভালো বন্ধু। বোনের ভালোর কাছে এমন বন্ধুত্ব কিছুই না।

“প্লেবয় টাইপ ছেলেরা কি কখনো কোনো মেয়েকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে পারেনা?”

পাপড়ির কথা শেষ হতেই প্রশ্ন ছুড়ে দেয় লাবিব। ধোয়া উঠা কফির মগেদ দিকে দৃষ্টি দিয়ে একটু রয়েসয়ে জবাব দেয় পাপড়ি,

“অবশ্যই পারে।”

“তাহলে নাহিদের মতো তোমারও কেন মনে হচ্ছে নাজিম নাদিয়ার সাথে ভালোবাসার নাটক করে ঠকাচ্ছে তাকে? হতেও তো পারে সে সত্যিই নাদিয়াকে ভালোবাসে!”

এবার একটু বিরক্ত হয় পাপড়ি। তাকে এভাবে আসামীর মতো জেরা করার কোনো মানে হয়? তাদের বন্ধু কাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসে আর কাকে বাসেনা এটা পাপড়ি কিভাবে জানবে? অদ্ভুত সব প্রশ্ন! বিষয়টা বিরক্তিকর ঠেকলেও যথেষ্ট নমনীয় কন্ঠে জবাব দেয় পাপড়ি,

“এটা তো আমার জানার কথা না ভাইয়া। নাজিম ভাই নাহিদ দুজনেই আপনাদের ভালো বন্ধু। কে কাকে ভালোবাসে সে তো আমার থেকে আপনাদেরই ভালো জানার কথা।”

পরিস্থিতি অন্য দিকে ঘুরে যাচ্ছে বুঝতে পেরে দুজনকেই থামিয়ে দেয় রাফিন। পাপড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“এই মাথা মোটার কথায় কিছু মনে করোনা বোন। ওর কথা বাদ দাও। তবে এটা সত্যি নাজিম নাদিয়াকে সত্যিই ভালোবাসে। এমন একটা পরিস্থিতির কথা ভেবেই বিষয়টা এতোদিন আমাদের কাওকে জানাতে ভয় পাচ্ছিল নাজিম। এতোদিন ওর যতগুলো মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল সবটাই আমাদের জানা। জাস্ট ফোনেই কথা হতো সবার সাথে। একটা মানুষের চোখ দেখেই বোঝা যায় তার ভিতরে আসলে কি চলছে। তোমার জন্য আমরা নাহিদের চোখে সবসময় যেমন ভালোবাসা দেখেছি তেমনটাই গতকাল থেকে নাজিমের চোখে দেখেছি। কালকের ঘটনার পর থেকে নাজিমের পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো না। ছেলেটা একদম ভিতর থেকে গুড়িয়ে গেছে। একদিকে ভালোবাসা হারানোর ভয় অপরদিকে বন্ধু হারানোর ভয়। আমরা ছেলেরা কিন্তু খুব সহজে কাঁদিনা পাপড়ি। নাজিমের সাথে নাহিদ লাবিবের বন্ধুত্বটা ভার্সিটি লাইফ থেকে শুরু হলেও ওকে আমি চিনি সেই কলেজ লাইফ থেকে। সবসময় হাসিখুশি থাকা ছেলেটাকে আমি কাল থেকে কাঁদতে দেখেছি। বারবার আমাদের কাছে একটা কথায় বলছে, দরকার পরলে বন্ধুর জন্য সে জীবনের প্রথম ভালোবাসা বিসর্জন দিবে। কিন্তু তবুও যেন নাহিদ তাকে দূরে ছুড়ে না দেয়। ছয় মাসের ভালোবাসার জন্য পাঁচ বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট হোক এটা সে চায়না।”

“ভালোবাসা ছয় মাসের হোক বা ছয় দিনের। বন্ধুত্বের জন্য সেটা এতো সহজে বিসর্জন দিতেও রাজি ওনি? এতোই স্বস্তা ভালোবাসা? বেষয়টা আমার কাছে কেমন যেন ঠেকছে ভাইয়া। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। আমার মাথায় যা এসেছে তাই বলে দিয়েছি। আসলে আমার কাছে ভালোবাসার সজ্ঞাটা অন্যরকম। পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক। তাই বলে মাঝ পথে ভালোবাসার মানুষটার হাত ছেড়ে দেবার কথা ভাবতে পারিনা নিশ্চয়ই!”

পাপড়ির কথা গুলো শুনে অল্প হাসে রাফিন। ঠান্ডা হয়ে আসা কফির কাপে অল্প ঠোঁট ছোঁয়ায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,

“তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু প্রকৃত বন্ধুত্বের বন্ধন কতটা দৃঢ় হতে পারে জানো তো? আচ্ছা বাদ দাও সে কথা। তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। ধরো তোমার আর নাহিদের পরিবার তোমাদের দুজনের সম্পর্কটা মেনে নিলনা। নিরুপায় হয়ে নাহিদ তোমাকে নিয়ে পালিয়ে যাবার কথা ভাবলো। তখন তুমি কি করবে? নাহিদের দুদিনের ভালোবাসার কাছে কি জন্ম থেকে পাওয়া বাবা-মা’র ভালোবাসাকে তুচ্ছ করে দিবে? না কি সবটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের পরিবারকে বুঝানোর চেষ্টা করবে?”

প্রসঙ্গটা এভাবে নিজের দিকে ঘুরে যাওয়ায় একটু অস্বস্থিতে পরে যায় পাপড়ি।নড়েচড়ে বসে ধীরস্থির ভাবে উত্তর দেয়,

“নাহিদের ভালোবাসা আমার কাছে যেমন মূল্যবান। তার থেকেও দ্বিগুণ মূল্যবান বাবা-মায়ের ভালোবাসা। বাবা-মা সেই ছোট থেকে আমাকে আদর-যত্নে বড় করে আজ এই পযর্ন্ত এনেছে বলেই আমি নাহিদকে পেয়েছি। ওনারা যদি আমাকে এই পৃথিবীর আলো না দেখাতো বুকে আগলে যত্ন করে বড় না করতো। তাহলে আপনাদের বন্ধুকে পেতাম না। সেই দিক থেকে ভেবে অবশ্যই আমি বাবা-মায়ের মনে কষ্ট দিয়ে শুধু আপনার বন্ধুর ভালোবাসার মূল্য দিতে তার হাত ধরবনা।”

মুচকি হাসে রাফিন। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলে,

“বাবা-মা আমাদের জন্ম দিয়ে আদর-যত্নে লালন করে মৃ’ত্যু’র আগ পযর্ন্ত আমাদের মাথার উপর ছায়া হয়ে থাকে। আর একজন প্রকৃত বন্ধু ঢাল হয়ে পাশে থেকে সমস্ত প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে সামনের দিকে অগ্রসর হবার স্পৃহা জোগায়। বাবা-মায়ের নিরাপদ আশ্রয় থেকে বেড়িয়ে যখন আমরা এই অস্থিতিশীল সমাজের ঝাতাকলে পৃষ্ঠ হয়ে বেঁচে থাকার অনুপ্ররেণা হারিয়ে ফেলি। তখন বন্ধু নামক মানুষ গুলোই ভরসার হাত রাখে কাধে। নতুন করে বেঁচে থাকার উদ্যম জোগায়। একটা মেয়ের ভালোবাসার কাছে যদি বাবা-মায়ের ভালোবাসা ঠুনকো না হতে পারে। তাহলে বাবা-মায়ের পর সবথেকে আপন বন্ধুর ভালোবাসা কিভাবে ঠুনকো হয়? কেন পারবেনা একটা ছেলে বন্ধুর জন্য ভালোবাসা বিসর্জন দিতে? খাঁটি বন্ধু যে কারো ভাগ্যে জুটেনা পাপড়ি। এটা পেতে হলেও ভাগ্য লাগে। যে মানুষ গুলো ভাগ্য করে সেই বন্ধুত্ব পেয়েও ধরে রাখতে পারেনা তার থেকে হতভাগা আমার মতে এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই। এইযে আমাদের চারজনকে দেখছো না! আমরা চারজনকে চার দেহের এক আত্মা বললেও ভুল হবেনা। আমরা এই চারজন মানুষ ছাড়া বাইরের কেউ জানেনা আমরা একে অপরের কাছে ঠিক কতটা মূল্যবান। তবে আর একটা কথা বলি!নাজিম মুখে যতই বলোক বন্ধুর জন্য প্রেমিকার ভালোবাসা বিসর্জন দিতে রাজি সে। কিন্তু আমার মনে হয় এটা পারবেনা সে। সর্বোচ্চ মুখে স্বীকার করবে ভালোবাসেনা। তবে অন্তরে ঠিকই সে থাকবে। আমরা ছেলেরা পরিবারের কথা ভেবে আপন মানুষের কথা ভেবে অনেক কিছুই হাসিমুখে ত্যাগ করতে পারি। পরিবর্তে যে আমাদের বুকের ভিতর কতটা রক্তক্ষরণ হয় এটা কেউ দেখেনা। মৃ’ত্যু’র আগ পযর্ন্ত এক অ’দৃ’শ্য আগুনে পু’ড়ে অঙ্গার হই আমরা। তবুও কারো কাছে মুখ ফোটে বলিনা নিজের দুখের কথা। নাজিম’ও হয়তো সে পথের সারথীই হবে।”

কথাগুলোর মাঝখানে একটু বিরতি নেয় রাফিন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে পাপড়ির দিকে তাকিয়ে অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করে। নিরব পাপড়ি মাথা নত করে আছে। রাফিনের মতো করে এতোটা গভীরভাবে হয়তো সময় কথা গুলো ভেবে কিছু বলেনি। যার কারণে এতোটা সহজ ভাবে বলে দিতে পেরেছিল তার কথা গুলো। পরিবর্তে রাফিনের যুক্তিগুলো শুনে বোবা হয়ে গেছে সে। অল্পক্ষণ চুপ থেকে পূণরায় রাফিন বলে,

“সে যায় হোক। অনেক কথা বলে ফেলেছি। আমার কথা গুলো যদি তুমি বুঝে থাকো তাহলে তোমার কাছে একটা রিকোয়েস্ট থাকবে বোন। আমার একটু হলেও বিশ্বাস আছে নাহিদ আর কারো কথা না শুনলেও তোমার কথা একটু হলেও বোঝার চেষ্টা করবে। আমরা কেউ কাল থেকে ওর সাথে যোগাযোগ করতে পারছিনা। সে ভাবছে নাদিয়ার সাথে নাজিমের সম্পর্কটা আমরা আগে থেকেই জানতাম। যে কারণে ভুল বুঝে সে আমাদের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তুমিই আমাদের শেষ ভরসা। তুমি একটু নাহিদকে নিজের মতো করে বোঝানোর চেষ্টা করো প্লিজ। ওকে বলো এই সামান্য একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে যেন আমাদের এতো বছরের বন্ধুত্বটাকে নষ্ট করে না দেয়।”

চলবে……

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১৯
#আদওয়া_ইবশার

গোধূলিয়া বিকেল। দীপ্তিময় সূর্যটা সোনালী আলো ছড়িয়ে একটু একটু করে ঢলে পরছে পশ্চিম আকাশের বুকে। জানালার পাটাতনে বসে আপন ভাবনায় বিভোর পাপড়ি। চোখের সামনে নাম না জানা একঝাঁক পাখির দল কলরব তুলে উড়ে যাচ্ছে নিজ নীড়ে। দৃষ্টিসীমায় থাকা গাছের পাতা গুলো উড়ছে তিরতির বাতাসের দাপটে। মাঝে মাঝে পাপড়ির বড্ড ইচ্ছে হয়, কোনো এক গোধূলি বিকেলে এই কোলাহলপূর্ণ পৃথিবীকে বিদায় দিয়ে পাখির ডানায় ভর করে উড়ে যেতে অচিনপুরের রাজ্যে। যে রাজ্যের সর্বত্র জুড়ে থাকবে শুধু শান্তি আর শান্তি। থাকবেনা কোনো দুঃখ-হতাশা, অপ্রাপ্তির বঞ্চনা আর না পাওয়ার বেদনা। কিন্তু আফসোস! ইচ্ছে গুলো আজীবন অধরায় থেকে যায়। মনের মাধুরী মিশিয়ে কল্পরাজ্য তৈরী করার সাধ থাকলেও যে সে রাজ্যে পারি দেবার সাধ্য নেই। হতাশায় ডুবে গিয়ে স্বপ্নালো চোখ দুটো বুজে নেয় সহসা। পূণরায় নেত্রপল্লব আলগা করে তাকায় মায়াবী প্রকৃতির পানে। দৃষ্টি স্থির করে অনঢ় সূর্যের প্রতিবিম্বের দিকে। মনে হয় সূর্যটাও বুঝি তাচ্ছিল্য ভরে হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। কটাক্ষ করে বলছে,

“হতাশায় জর্জরিত এই নশ্বর পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে তুমি অচীনপুরের রাজকন্য হবার স্বপ্ন দেখো মেয়ে! রূপকথার রাজ্য তোমার জন্য না। যতবার চোখের তারাই স্বপ্ন বুনবে ঠিক ততবার নিরাশার প্রাচীরে বন্দি হবে। এই এক জীবনে মনুষ্য জাতির সব ইচ্ছে পূর্ণতা পায়না। কিছু অপূর্ণ ইচ্ছে, বেদনা, হাহাকার নিয়েই কাটিয়ে দিতে হয় গোটা একটা জীবন। অপূর্ণতার ঝুলিটাকে পূর্ণ করেই একটা সময় বিদায় জানাতে হয় এই মায়ার পৃথিবীকে।”

কথা গুলোর মর্মার্থ হয়তো বুঝতে পারে পাপড়ি। অলীক ভাবনার রাজ্য ছেড়ে ফিরে আসে নিজ ভূবনে।বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসের সাথে ইচ্ছুগুলোকে মুক্তি দেয় বন্দি দশা থেকে। সকাল থেকেই মনটা কেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে তার। শরীর জুড়ে ভীড় জমিয়েছে ক্লান্ত, অবসান্নতা। শেষ বিকেলের ঐন্দ্রজালিক মুহুর্তটাও কিছুতেই মনটাকে শান্ত করতে পারছেনা। বারবার কিছু অযাচিত ভাবনা, অমূলক ইচ্ছেরা এসে অপূর্ণতার গ্লানিতে ডুবিয়ে দিচ্ছে পুরো সত্তাটাকে। কেমন যেন ছন্নছাড়া একটা ভাব কাজ করছে। ইচ্ছে করছে জাগতিক সমস্ত কিছু ভুলে আপন ভাবনাতেই মগ্ন থাকতে। অলস ভঙ্গিতেই জানালার কাছ থেকে ওঠে দাঁড়ায়। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে চার্জে লাগানো ফোনটা হাতে নেয়। লাবিব রাফিনের থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর থেকেই নাহিদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। কল দিতে গিয়েও বারবার পিছিয়ে আসছে। কিভাবে কথা শুরু করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। ভাবছে গতকালের মতো আজকেও যদি নাহিদ তার সাথে রুক্ষ আচরণ করে! ভাবনার দোলাচল বন্ধ করে অবশেষে সাহস জুগিয়ে কল করে বসে। রিং হচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে অধীর অপেক্ষায় কখন অপর প্রান্ত থেকে প্রিয় মানুষটার গলার স্বর ভেসে আসবে। একবার, দুইবার রিং হতে হতে একটা সময় কলট কেটে যায়। হতাশ হয় পাপড়ি। ফোনটা ছুড়ে মারে বিছানায়। উদ্যত হয় রুম থেকে বের হবার। এরমাঝেই সহসা বেজে ওঠে নিস্তেজ ফোনটা। সাথে লাফিয়ে ওঠে পাপড়ির বুকের ভিতরটা। এক মুহুর্ত সময় নষ্ট না করে ঝটপট হাতে তুলে নেয় ফোন। স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করছে নাহিদের নাম্বার। এক পলক দেখেই রিসিভ করে কানে ঠেকায় ফোনটা। জ্বিভের ডগায় শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিচু কন্ঠে বলে,

“হ্যালো!”

“ফোন দিয়েছিলে?”

ভরাট স্বরে জানতে চায় নাহিদ। একটু মনক্ষুন্ন হয় পাপড়ির। চোখে-মুখে লেপ্টে যায় অভিমানের ছাপ। কাল তো ঠিকমতো কথা বলা দূরের কথা, পাপড়ির কোনো প্রশ্নের উত্তর’ও দেয়নি। আজকেও বেহায়ার মতো নিজে থেকেই ফোন করার পরও কেমন ছন্নছাড়া ব্যবহার! একটা সমস্যা হয়েছে বুঝেছে সে। তার জন্য প্রথমদিন ওমন ব্যবহারের পরও কিছু বলেনি। সবটা মেনে নিয়েছে নিরবে। কিন্তু আজকেও কেন সে একই ব্যবহার করবে? ঐ ঘটনায় তো পাপড়ির কোনো দোষ নেয়। তাহলে কেন শুধু শুধু তাকে অবহেলা করবে? বড্ড অভিমান হয় পাপড়ির। কিন্তু অপর মানুষটাকে বুঝতে দেয়না তা। নিরব অভিমানটুকু নিজের কাছেই গোপন রেখে ছোট্ট করে জানতে চায়,

“কেমন আছেন?”

“আছি ভালোই।”

ব্যাস! এটুকুই। উল্টো একটাবার তো তাকেও জিজ্ঞেস করতে পারতো সে কেমন আছে! খুব কি কষ্ট হয়ে যেতো এটুকু জানতে চাইলে? এমন অবজ্ঞা সহ্য হয়না পাপড়ির। হুট করেই সমস্ত বিষাদ গুলো কান্নায় রূপ নেয়। গলার পাশে দলা পাকিয়ে থাকা কান্নার লহর টুকু গিলে নিয়ে বলে,

“আচ্ছা! রাখছি। মা ডাকছে।” আর এক মুহূর্ত অপেক্ষায় থাকেনা। চুপচাপ ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। গাল বেয়ে টুপ করে দু-ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে। চারপাশের সবকিছুই কেমন বিষাক্ত ঠেকছে তার কাছে। রাফিনকে কথা দিয়েছিল নাহিদকে বুঝাবে সে। কিন্তু কিভাবে বুঝাবে সে? যে মানুষটা ঠিকমতো কথায় বলছেনা তার সাথে তাকে বুঝানোর ক্ষমতা কি আদও পাপড়ির আছে? খুব তো আত্মবিশ্বাসের সাথে রাফিন বলেছিল তার বন্ধু আর কারো কথা না শুনলেও ঠিক পাপড়ির কথা শুনবে। অথচ সে হয়তো জানেই না মেয়েটাকে ঠিক কতটা অবহেলায় জর্জরিত করছে তার বন্ধু গতকাল থেকে।

***
সকাল থেকে বারবার নাদিয়া চেষ্টা করে যাচ্ছে ভাইয়ের সাথে কথা বলার। কিন্তু নাহিদ তাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যাচ্ছে। মা-বাবার কাছে ভুল স্বীকার করার পর সাইদুর রহমান স্বাভাবিক আচরণ করলেও শাহিনূর এখনো গম্ভীর। ঠিকঠাক নাদিয়ার কোনো কথার জবাব পযর্ন্ত দিচ্ছেনা। একটা দিনেই পরিবারের মানুষ গুলোর থেকে এমন অবহেলা পেয়ে হাঁপিয়ে ওঠেছে মেয়েটা। ঘুম, নাওয়া-খাওয়া সব ভুলে চেষ্টা করছে সবার কাছে মাফ চেয়ে ভুলটা সুধরে নিতে। ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। উদাস মনে নিজের রুমেই বসেছিল নাদিয়া। ভিড়ানো দরজাটা অল্প ফাঁক করে প্রবেশ করে নাফিস। বোনকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে কিছুক্ষণ একধ্যানে তাকিয়ে থাকে। কিছু সময় পর গলা পরিষ্কার করে ত্যাড়ছা ভাবে বলে ওঠে,

“ভাইয়া রেডি হচ্ছে। একটুপরেই হয়তো চলে যাবে। কেউ যদি চায় তার জন্য ভাইয়া কষ্ট না পাক। তাহলে এখনো সময় আছে। দরকার পরলে গিয়ে হাতেপায়ে ধরে হলেও ভুল স্বীকার করে মাফ চেয়ে নিতে পারে। কোনো চুন্নির জন্য যদি আমার ভাই মনে কষ্ট নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় তাহলে কিন্তু আমি তার চুল একটাও মাথায় রাখবনা। কথাটা মনে থাকে যেন।”

আর একটুও দাড়ায় না নাফিস। আড়চোখে এক নজর বোনের দিকে তাকিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে চলে যায় রুম ছেড়ে। নাদিয়া নিজেও লাফিয়ে ওঠে দাড়ায়। হুড়মুড়িয়ে ছুটে যায় বড় ভাইয়ের রুমের দিকে। দরজার সামনে গিয়ে ভিতু মনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সাহস জুগিয়ে ডুকে পরে রুমের ভিতর। নাফিসের কথা অনুযায়ী দেখতে পায় সত্যি সত্যিই নাহিদ তৈরী হচ্ছে। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে ভাইকে ডাকে নাদিয়া,

“ভাইয়া!” এক মিনিটের জন্য স্থির হয় নাহিদ। মুখে গম্ভীর্যতা ফুটিয়ে তাকায় বোনের দিকে। ছলছল করে ওঠে নাদিয়ার চোখ দুটো। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে আকুতি নিয়ে বলে,

“আমি তো তোমার ছোট বোন। ছোটরা তো ভুল করতেই পারে তাইনা! আমিও না হয় একটা ভুল করে ফেলেছি। মাফ করে দাওনা প্লিজ! বিশ্বাস করো আমি একটুও বুঝিনি তুমি এতোটা কষ্ট পাবে। যদি বুঝতে পারতাম তাহলে এতো বড় ভুল করতাম না। তুমিই তো বলো মানুষ ভুল থেকেই শিক্ষা নেই। আমিও এই ভুল থেকে যথেষ্ট শিক্ষা নিয়েছি। তোমাদের অবহেলা একদম সহ্য হচ্ছেনা আমার। দম বন্ধ হয়ে আসছে। এবারের মতো মাফ করে একটা সুযোগ দাও আমাকে প্লিজ! আর কখনো এমন কিছুই করবনা। আমি আর তোমাদের অবহেলা নিতে পারছিনা ভাইয়া। একটাবার মাফ করো না প্লিজ!”

কথা গুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পরে নাদিয়া। বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে নাহিদের। হাত দিয়ে মুখ ডেকে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে বিছানায়। সময়ের সাথে সাথে নাদিয়ার কান্নার গতি বাড়ে। ভাবে হয়তো ভাইয়ের থেকে মাফ পাবেনা। বুকের ভিতর অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হয়। ওমনি নাহিদ মাথা তুলে তাকায়। হাত বাড়িয়ে কাছে ডাকে বোনকে। সাথে সাথেই দৌড়ে ভাইয়ের বুকে ঝাপিয়ে পরে নাদিয়া। স্নেহের হাত দুটো বুলিয়ে দেয় বোনের মাথায়। আস্তে করে বলে,

“কান্না থামা। মাথা ব্যথা করবে।”

শুনেনা নাদিয়া। থামার বদলে কান্নার গতি দ্বিগুণ হয়। নাহিদ’ও আর কিছু বলেনা। কাঁদতে দেয় মন খুলে। একটা সময় নিজে থেকেই কান্না থামে নাদিয়ার। নিস্তেজ হয়ে মিশে থাকে ভাইয়ের বুকে। নিজের বুক থেকে বোনের মাথাটা উঠিয়ে গালে লেপ্টে থাকা অশ্রুটুকু মুছে দেয় যত্ন করে। জলদগম্ভীর কন্ঠে বলে,

“একটা কথা সবসময় মনে রাখিস। যে মানুষ গুলো সবসময় আদর দিতে জানে। প্রয়োজনে সেই মানুষ গুলো কঠোর হতেও জানে। সেই কঠোরতার মাত্রা ঠিক কতটুকু তা হয়তো কল্পনাও করতে পারবিনা তুই। তোর বয়স কম। এই বয়সে সব ভুলেই তোর কাছে মনে হবে সঠিক। কিন্তু যখন সঠিক বয়স হবে তখন ঠিক এই ভুলগুলোর জন্যই আফসোস হবে। আমি চাইনা আমার বোন কখনো অতীতে করা ভুলের কথা ভেবে ভবিষ্যতে কষ্ট পাক। প্রয়োজনে যতটা কঠোর হওয়া প্রয়োজন আমি ঠিক ততটা কঠোর হতেও প্রস্তুত। বোনের সুখের জন্য ভাই সব করতে পারে। প্রথম ভুল বয়সের দোষ ভেবে মাফ করে দিলাম। একই ভুল যদি পূণরায় হয়ে যায় তখন কিন্তু একদম মাফ পাবিনা। আজকে থেকে তোর ফোন চালানো বন্ধ। যেদিন সঠিক সময় হবে। নিজের ভালো বুঝতে পারবি সেদিন হাতে ফোন পাবি। আশা করি সব ভুলে মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। কোনোমতেই যেন রেজাল্ট খারাপ না হয়। মনে থাকবে তো আমার কথা?”

উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে ভাইয়ের কথায় সায় জানায় নাদিয়া। বোনের কপালে ছোট্ট করে একটা আদরের পরশ বুলিয়ে বেড়িয়ে যায় বিদায় নিয়ে। মা-বাবা,ভাইয়ের থেকেও বিদায় নিয়ে রওনা হয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। গাড়িতে কাটানো পুরোটা সময় ভেবে যায় অভিমানী প্রিয়তমার কথা। অকারণেই মেয়েটাকে দুদিন যাবৎ অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে। তবুও কতটা নিখুঁত অভিনয়ের সাথে মেয়েটা নিজের অভিমানটুকু আড়াল করে রেখেছে। বুঝতেই দেয়নি নাহিদকে। তার বোকা রানীটা খুব চালাক হয়ে গেল না কি হঠাৎ!

চলবে…..