হৃদয় জুড়ে তার ছায়া পর্ব-১৬+১৭

0
127

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১৬
#আদওয়া_ইবশার

রাত আনুমানিক দশটা। শাহিনূর সাইদুর রহমান ছেলে-মেয়েদের নিয়ে খেতে বসেছে। এর মাঝেই স্বশব্দে কলিং বেল বেজে ওঠে। অবাক হয় সবাই। খাওয়া থামিয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। ভাবে এতো রাতে কে আসতে পারে তাদের এখানে? কোনো আত্মীয় স্বজন হলেও এই রাতের বেলা না বলে আসার কথা না। সাইদুর রহমান শাহিনূর দুজনেই সরকারি চাকরিজিবী হওয়াই সরকার থেকে কোয়ার্টার পেয়েছে। সেখানেই ছেলে-মেয়েদের নিয়ে থাকেন। রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া হওয়ায় এ যাবৎ কখনো কোনো অসাধুর আক্রমনের স্বীকার হয়নি। আজকেও যে এমন কিছু হবেনা এটা নিশ্চিত। কিন্তু এতো রাতে হঠাৎ করে না জানিয়ে আসার মতো কেউ না থাকায় একটু চিন্তিত হয় সকলে। স্ত্রী- সন্তানদের দিকে তাকিয়ে সাইদুর রহমান ওঠে দাঁড়ায়। এঁটো হাত নিয়েই এগিয়ে যায় দরজার দিকে। ছেলে মেয়েদের বলে,

“তোমরা খেতে থাকো। আমি দেখে আসি কে এলো।”

দরজার ঐ পাশের ব্যক্তিটা নিজেকে অধৈর্য প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে আছে। একের পর এক কলিং বেল দিয়েই যাচ্ছে। বিরক্ত হয় সাইদুর রহমান। গলা চড়িয়ে বলতে বলতে দরজা খুলে,

“আরে কে ভাই? অন্তত দরজাটা খোলার সময় টুকু তো দিবেন! এতো রাতে এভাবে অভদ্রের মতো কলিং দেয় কেউ? ম্যানার্স নেই একটুও।”

বলতে বলতেই দরজা খুলে বিরক্ত ভঙ্গিতেই সামনের দিকে তাকায়। তৎক্ষণাৎ ভিষণ ভাবে চমকে যায় এতো রাতে নিজের ছেলেকেই দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কাধে একটা ব্যাগ নিয়ে উস্কুখুস্কু চুলে দাঁড়িয়ে আছে নাহিদ। নিজের ছেলেকেই এতোক্ষন এতো কথা বলেছে ভাবতেই কিছুটা লজ্জিত হয় সাইদুর রহমান। তবে লজ্জাটুকু আপাতত পিছনে রেখে ছেলের এতো রাতে এভাবে ঢাকা থেকে না জানিয়ে বাড়ি আসার কোনো কারণ খোঁজে না পেয়ে প্রশ্ন করেন,

“কি রে! এভাবে হুট করে কিছু না জানিয়ে চলে এলি যে?কোনো বিপদ হলো না তো!”

সাইদুর রহমানের কথার ধরণে ডায়নিং এ বসা কারো বুঝতে অসুবিধা হয় নি কে এসেছে এতো রাতে। তারাও খাবার ফেলে ছুটে আসে দরজার কাছে। সকলের চোখে-মুখে বিস্ময়। হতবম্ভের মতো কিছুক্ষণ নাহিদের দিকে তাকিয়ে থেকে ছেলের কাছে এগিয়ে যায় শাহিনূর। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“এভাবে না বলে চলে এলি কেন বাবা? আবার আমাদের সারপ্রাইজ দিতে বলে আসিস নি তাই না! তোর এই স্বভাবটা কি আর যাবেনা? বলে আসলে তো আমাদের একটু ধ্যান থাকে। আল্লাহ না করুক আবার যদি রাস্তা-ঘাটে কোনো অঘটন ঘটে তখন তো আমরা জানতেও পারবনা কোথায় আছিস না আছিস। ছোট বাচ্চাদের মতো সারপ্রাইজ দেওয়ার স্বভাবটা এবার একটু বদলা। আমার এতো সারপ্রাইজ লাগবেনা। আমার সন্তান সুস্থ্যভাবে আমার কোলে ফিরে আসলেই খুশী।”

কোনো জবাব দেয়নি নাহিদ। শান্তভাবে মায়ের সাথে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে। সবাই এটো হাতে দাঁড়িয়ে আছে দেখে বুঝতে পারে হয়তো খেতে বসেছিল। শীতল কন্ঠে বলে,

“খাচ্ছিলে তোমরা! খাওয়া শুরু করো আবার। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।”

আর এক মুহুর্ত দাঁড়ায়না নাহিদ। সকলকেই অবাকের চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে দিয়ে ধুপধাপ পা চালিয়ে চলে যায় নিজের নামে বরাদ্ধকৃত রুমে।

থমথমে পরিস্থিতিতেই কেটে যায় কয়েক মুহুর্ত। হাত-মুখ ধুয়ে শান্ত ভঙ্গিতেতেই ড্রয়িং রুমে এসে উপস্থিত হয় নাহিদ। শাহিনূর হাজারবার জোরাজোরি করার পরও খেতে রাজি হয়নি। জানিয়ে দিয়েছে রাস্তায় খেয়েছে। ক্ষিদে লাগলে পরে খাবে। সকলের খাওয়া শেষ হতেই বোনকে ডেকে বলে,

“মাথাটা ধরেছে। এক কাপ কফি করে দিয়ে যা তো আমার রুমে।”

কথাটা বলে আবারও চলে যায় নিজের রুমে। কিছুটা গিয়ে পিছন ফিরে বাবা-মা’কে উদ্দেশ্য করে বলে,

“রাত অনেক হয়েছে। তোমরা ঘুমিয়ে পরো। সকালে কথা বলব।”

সাইদুর রহমান, শাহিনূর ছেলের এমন ব্যবহারে যথাপরনায় অবাক। নাফিস নাদিয়াও ভাইয়ের এমন আচরণ হজম করতে পারছেনা। যে ভাই বাড়িতে এসেই মাতিয়ে রাখে পুরো বাড়ি। রাত দুইটা-আড়াইটা পযর্ন্ত সবাইকে সাথে নিয়ে গল্পগুজবে মজে থেকে। সেই ভাই আজ এসে বাবা-মায়ের সাথেই ঠিকমতো কথা বলছেনা। এটা কি আদও মানা যায়? বিষয়টা একদম স্বাভাবিক ঠেকছেনা কারো কাছে। সকলের মনেই একটা ভাবনা। কিছু একটা ঘাপলা আছেই। কিন্তু কেউ সাহস করে কিছুই জিজ্ঞেস করছেনা। শাহিনূর ঠিক জানেন যা কিছুই হোক, আগে অথবা পরে ছেলে তার কাছে বলবেই। তাই এবারও ছেলেকেই সময় দিয়েছে। নাহিদ ঠিক নিজেকে সামলে যা ঘটেছে মায়ের কাছে সবটা বলবে।

দশ মিনিটের মাথায় কফি করে ভাইয়ের রুমের সামনে হাজির হয় নাদিয়া। সবসময়ের মতো ভাই হাসিখুশি থাকলে কখনো রুমে ডোকার জন্য হয়তো অনুমতির আশায় দাঁড়িয়ে থাকতনা। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। ভায়ের এমন শান্ত রূপ কিছুতেই ভালো ঠেকছেনা। ভিড়ানো দরজাটা অল্প ফাঁক করে মিনমিনে স্বরে অনুমতি চায়,

“ভাইয়া আসব?”
হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয়েছিল নাহিদ। বোনের আওয়াজ শুনে চোখ খুলে তাকায়। শান্ত ভঙ্গিমায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,

“আমার রুমে আসতে কবে থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন মনে করছিস?”
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় নাদিয়া। আমতা আমতা করে বলে,

“না মানে তুমি ঘুমিয়ে গেছো কি না তাই আর কি।”

প্রতিত্তুরে আর কিছুই বলে না। নিরবতাকেই সম্মতি ভেবে গুটিগুটি পায়ে ভিতরে প্রবেশ করে নাদিয়া। কফির কাপটা বাড়িয়ে দেয় ভাইয়ের দিকে। অল্প আওয়াজে গলা পরিষ্কার করে বলে,

“তোমার কফি!” অলস ভঙ্গিতে কাপটা নেয় নাহিদ। ধীর গতিতে দুটো চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“তোর ফোন কোথায়?”

“আমার রুমে। কেন, তোমার প্রয়োজন?”

“নিয়ে আয় তো।” ভাবে হয় তো লম্বা জার্নিতে নাহিদের ফোনের চার্জ শেষ।কোনো দরকারি ফোন করতেই হয়তো তার ফোন চাচ্ছে। খুশী মনেই দৌড়ে নিজের রুম থেকে ফোনটা এনে দেয় ভাইয়ের হাতে। অর্ধ শেষ করা কফির কাপটা খাটের পাশের ছোট্ট টেবিলটাতে রাখে নাহিদ।কপালে কিন্চিৎ কুঁচকানো ভাব এটে বোনের ফোনে কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে। কাঙ্ক্ষিত কিছু না পেয়ে পূণরায় গম্ভীর দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকায়। ভরাট কন্ঠে বলে,

“এই বয়সেই আমার মাথায় টুপি পরাতে চাইছিস? আর দুদিন পর কি করবি তাহলে?”

কি বলে এসব উল্টাপাল্টা? কিছুই বোধগম্য হয়না নাদিয়ার। কপাল কুঁচকে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন,

“কি বলছো এসব? কিসের কি টুপি পরানো? কিছুই তো বুঝতে পারছিনা আমি।”

“আচ্ছা!” রাশভারি কন্ঠে কথাটা বলে নাদিয়ার ফোনটা ছুড়ে বিছানার এক পাশে ফেলে নিজের ফোনটা হাতে নেয়। কিছু একটা বের করে তুলে ধরে বোনের চোখের সামনে।,

“এসব কি? দেখতো কিছু বুঝিস কি না!”

সাথে সাথেই পিলে চমকে ওঠে নাদিয়ার। বসেছিল ভাইয়ের পাশে। তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে যায় বসা থেকে। থরথর করে কাঁপতে থাকে ছোট্ট শরীরটা।,

“এখনো বুঝতে পারছিস না কিছু? নিজের প্রেম কাহিনীর গল্প এখন কি আমার মুখে শুনতে চাইছিস?”

জবাব দিতে পারেনা কিছুই নাদিয়া। আসন্ন বিপদের কথা স্বরণ হতেই হাত-পা অসাড় হয়ে আসে। ঝাপসা হয়ে ওঠে চোখ দুটো। ভাবতে পারেনি কখনো এভাবে ভায়ের কাছে এতো তাড়াতাড়ি ধরা পরে যাবে। ফাঁকা মস্তিষ্কে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনা। বোনকে এমন নিরব মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এতোক্ষনের দমিয়ে রাখা রাগটা তরতর করে বেড়ে যায় নাহিদের। শান্ত রূপটা মুহুর্তের মাঝেই হয়ে ওঠে অশান্ত। সর্ব শক্তি দিয়ে হুঙ্কার ছাড়ে,

“চুপ করে আছিস কেন এখন? কথা বল। কি এসব?”

সাথে সাথে ভয়ে ফুপিয়ে ওঠে নাদিয়া। ছোট বেলা থেকে সর্বদা হাস্যোজ্জ্বল শান্ত-শিষ্ট স্বভাবের নাহিদের খুব বাজে একটা অভ্যাস ছিল। অতি সহজে কোনো কারণে কখনো রাগতো না সে। কিন্তু কিছু একটা নিয়ে হঠাৎ যদি রেগে যেতো তাহলে একদম নিজের স্বভাবের বাইরে গিয়ে চুপচাপ হয়ে যেতো। চিল্লাচিল্লি না করে একদম নিরব থেকেই বুঝিয়ে দিতো রাগের মাত্রা ঠিক কতটা। হুটহাট রেগে যাওয়া স্বভাবের মানুষ গুলোর যেমন রাগ করতেও বেশি সময় লাগেনা। তেমন রাগ গলে পানি হতেও সময় লাগেনা। কিন্তু যে মানুষ গুলো খুব সহজে রাগেনা। তারা একবার রেগে গেলে রাগের তীব্রতা কতটা তা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেয় সকলকে। ঠিক তেমন স্বভাবের ছেলেই নাহিদ। আদরের ছোট্ট বোনটার এমন অধঃপতন কিছুতেই মানতে পারছেনা। মানবেই বা কিভাবে? তার বোনের বয়সটাই কত? মনে হয় মাত্র ঐদিন ছোট্ট একটা পুতুল কাপড়ে মুড়িয়ে তার কোলে তুলে দিয়েছিল বাবা। বলেছিল, “এই পৃথিবীতে যদি তোমার সবথেকে আদরের কেউ হয়ে থাকে তাহলে সে হলো এই বোন। একটা মেয়ের কাছে সবথেকে দামি আর মূল্যবান সম্পদ হয় তার ভাইয়ের ভালোবাসা। পৃথিবীর সব বোনেরা ভাইয়ের কাছে চোখের মণি হয়ে থাকে। তুমি তোমার চোখের মণিটাকে আজীবন আগলে রেখো বাবা।” সেই ছোট্ট বোনটা কি না প্রেম করছে এইটুকু বয়সেই! এখনো স্কুলের গন্ডি পেরোয়নি। ১৪-১৫ বছরের একটা মেয়ে প্রেম ভালোবাসার কি বুঝে? জগৎটাই বা কতটুকু চিনে সে? এই বয়সে তার বইয়ের মাঝে ডুবে থাকার কথা। অথচ সেটা না করে বাবা-মা, ভাইয়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে দিব্যি প্রেম করে বেড়াচ্ছে। প্রলম্বিত একটা নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসে নাহিদের বুক চিরে। তাচ্ছিল্য করে বলে,

“ভালোবেসে বোনের আহ্লাদ পূরণের জন্য ক্লাস এইটে থাকতেই ফোন কিনে দিয়েছি বাবা-মায়ের হাজার নিষেধ অমান্য করে। ভেবেছি আমার বোন কখনো কোনো অন্যায় করতে পারেনা। ভাই কষ্ট পাবে এমন কাজ করার কথা ভাবতেই পারেনা। আমার সেই ভালোবাসা বিশ্বাসের প্রতিদান তোরা এভাবে দিলি?”

নাহিদের উচ্চ কন্ঠের হুঙ্কারে সাইদুর রহমান শাহিনূর, নাফিস তিনজনেই ছুটে আসে। শেষের কথা গুলো স্পষ্ট শুনতে পায় সকলে। মেয়েকে কাঁদতে দেখে সাইদুর রহমান ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে নেন। নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলে,

“কি শুরু করেছিস তুই নাহিদ? নাদিয়া কাঁদছে কেন? কি বলেছিস তুই ওকে? হয়েছে কি তোর আমাদের বলবি তো? তা না করে মেয়েটাকে তুই ধমকাচ্ছিস কেন? যে বোনকে তোর মা একটু বকলেও তুই প্রতিবাদ করে উঠিস সেই বোনকে এভাবে ধমকাচ্ছিস! হয়েছে কি তোর হঠাৎ?”

“আমার কিছু হয়নি। হয়েছে তোমার মেয়ের। কি হয়েছে সেটা তাকেই জিজ্ঞেস করো।”

“আশ্চর্য! কিছুই না জেনে না বুঝে কি জিজ্ঞেস করব? তুই সবটা ক্লিয়ার করলেই তো হয়।”

পূণরায় চেঁচিয়ে ওঠে নাহিদ।,

“কি ক্লিয়ার করব আমি? এটাই যে আমার ওকে আদর দিয়ে আহ্লাদ করে মাথায় তোলা অপরাধ হয়েছে? না কি ভাই হিসেবে আমার ব্যর্থ?কোনটা ক্লিয়ার করব বলো?”

বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সকলেই তাকিয়ে আছে নাহিদের দিকে। বাবার বুকে মুখ গুজে নাদিয়া এখনো ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। শাহিনূর দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায় ছেলের কাছে। হাত টেনে খানে বসিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,

“এভাবে চিল্লায়না আব্বা। তুই না আমার শান্ত ছেলে! কি হয়েছে বল আমাকে! কি করেছে নাদিয়া? মা’কে বল বাবা।”

সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে মুখ ফুলিয়ে নিশ্বাস ছাড়ে নাহিদ। যথাসম্ভন নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে মায়ের দিকে তাকায়। অসহায় স্বরে বলে,

“তোমার মেয়ে প্রেম করছে মা। তাও আবার আমারই বন্ধু নাজিমের সাথে। অথচ আমি জানিনা। এবার ভাবো! ভাবো এবার কতটা বড় হয়ে গেছে তোমার মেয়ে। তবুও আমি কিচ্ছু বলতাম না। বিশ্বাস করো কিছুই বলতাম না আমি। যদি না ছেলেটা নাজিম হতো। ও যতই আমার বন্ধু হোক। কিন্তু ওর স্বভাব কেমন আমি তো জানি। যে ছেলে পোশাক বদলানোর মতোই গার্লফ্রেন্ড বদলায় সেই ছেলের সাথে আমার বোন প্রেম করছে। একবারো বুক কাঁপলনা ওর? বন্ধু না হয় দূরের বুঝলাম। কিন্তু ও তো আমার বোন! একটাবারও ও এটা ভাবলনা বিষয়টা আমি জানতে পারলে কতটা কষ্ট পাব? এভাবে তোমার মেয়ে আমার নিঃস্বার্থ ভালোবাসার প্রতিদান দিল?”

চলবে…

#হৃদয়_জুড়ে_তার_ছায়া
#পর্বঃ১৭
#আদওয়া_ইবশার

পরিস্থিতি গুমোট। পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে পুরো রুম জুড়ে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। দেয়ালে দেয়ালে বারি খাচ্ছে শুধু প্রত্যেকের বুক চিরে বেড়িয়ে আসা দীর্ঘশ্বাসের শব্দটুকু। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে সকলেই বোবা হয়ে তাকিয়ে আছে নাদিয়ার দিকে। ব্যতিক্রম শুধু নাহিদ। শাহিনূর সাইদুর রহমানের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তাদের মেয়ে এমন একটা কাজ করতে পারে। নাফিসের মনেও ভাবনার দোলাচল। সেও ভাবতে পারছেনা তার বোন এমন করতে পারে। নাদিয়ার থেকে সে মাত্র দুই বছরের বড়। পিঠাপিঠি হওয়ায় কেউ কখনো কারো থেকে এক চুল পরিমাণ কিছু গোপন রাখেনা। সারাদিন দুজন মিলে ঝগড়াঝাঁটি করার পরও দিন শেষে ঠিক একজন অপরজনের কাছে মনের কথা খুলে বলে। এক চুল পরিমাণ ঘটনাও কেউ কারো থেকে গোপন করে থাকতে পারেনা। সেখানে এতো বড় একটা কথা কিভাবে গোপন করল নাদিয়া তার থেকে? ভাবতেই বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে নাফিসের। শাহিনূর শান্ত ভঙ্গিতে নাহিদের পাশ থেকে ওঠে এগিয়ে যায় নাদিয়ার দিকে। এখনো বাবার বুকে মাথা রেখে শার্ট খামচে ধরে কেঁদে যাচ্ছে নাদিয়া। এক ঝটকায় মেয়েকে বাবার কাছ থেকে আলাদা করেন শাহিনূর। কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে শীতল কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন,

“কবে থেকে চলছে এসব?”

উত্তর দেয়না নাদিয়া। মায়ের এমন রূপ দেখে ঘাবড়ে যায় অত্যাধিক। কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি ওঠে যাচ্ছে। মেয়ের থেকে জবাব না পেয়ে রাগ সংবরণ করতে না পেরে সপাটে এক চড় বসিয়ে দেয় গালে। চমকে ওঠে সকলেই। বিস্তারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মা-মেয়ের দিকে। ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার করেন শাহিনূর। পূণরায় প্রশ্ন করেন মেয়েকে,

“কথা বলছিস না কেন? কবে থেকে চলছে এসব? খুব বড় হয়ে গেছিস তাই না! এতোটা বড় হয়ে গেছিস যে প্রেম-ভালোবাসা পযর্ন্ত এগিয়ে গেলি অথচ কাওকে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করলিনা। একবারও ভয়ে বুক কাঁপলনা? একবারও মনে হলনা নিজের ভাইয়ের বন্ধুর সাথে প্রেম করছি বিষয়টা জানাননি হলে পরিস্থিতি কি হতে পারে? একটাবার ভাবলি না বাবা-মায়ের সম্মানের কথা? শুধুমাত্র তোদের কথা ভেবে আমরা দুটো মানুষ জীবনটা কয়লা করে ফেলছি খাটতে খাটতে। না তাকিয়েছি কখনো নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার দিকে আর না তাকিয়েছি নিজেদের শরীরের দিকে। রাত-দিন এক করে খেটেছি শুধু তোদের ভালো চেয়ে। তার বিনিময়ে এই প্রতিদান দিলি আমাদের?”

কান্না ছাড়া আর কিছুই যেন অবশিষ্ট নেই নাদিয়ার। কি জবাব দিবে মা-বাবা,ভাইকে? সত্যিই তো সে কখনো ভাবেনি তাদের কথা।আজকের এই পরিস্থিতির কথা। ভালোবাসার কাছে বিবেক অন্ধ হয়ে গেছিলো। মজে গিয়েছিল রঙিন নেশায়। অপরিনত বয়সের মন্দ দোষে একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যাবার আগে মাথায় আসেনি কখনো এমন পরিস্থিতি আসতে পারে। জবাবদিহি করতে হবে তখন পরিবারের কাছে। একটা মাত্র মেয়ে নিয়ে অনেক আশা ছিল সাইদুর রহমান শাহিনূরের। দুটো ভাইয়ের একমাত্র ছোট বোন হওয়ায় ভাইদের ও কম স্বপ্ন ছিলনা তাকে নিয়ে। সেই মেয়েটাই আজ এতো গুলো মানুষের স্বপ্ন ভেঙে অবিশ্বাস্য এক ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। বিষয়টা হজম করা কারো পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। সাইদুর রহমান অপলক তাকিয়ে আছে মেয়ের কান্নারত নত মুখের দিকে। নিস্তেজ কন্ঠে একসময় বলে ওঠে,

“তুমি আমাদের একমাত্র মেয়ে ছিলে। আমি বা তোমার মা,ভাই কেউ কখনো তোমার ভালোবাসার বাধা হয়ে দাঁড়াতাম না। বরং এটা ভেবে খুশি হতাম মেয়ে তার ভালোবাসার মানুষ খোঁজে পেয়েছে। যদি সেটা হতো তোমার পরিনত বয়সে। কিন্তু যে বয়সে দাঁড়িয়ে তুমি এমন একটা সম্পর্কে জড়িয়েছো এই বয়সে কি ভালোবাসার আসল মানে জানো তুমি? নিজের পরিবার ছাড়া বাইরের জগতটাকেই বা কতটুকু চেনো তুমি? আমি ভেবেছিলাম আমার মেয়েটা অত্যন্ত বুদ্ধিমান একটা মেয়ে। তার দ্বারা কখনো কোনো ভুল হতেই পারেনা। কিন্তু আমি ভুল। আমাকে সম্পূর্ণ মিথ্যে প্রমাণিত করে আজ এতো বড় এক সত্যের সম্মুখিন করলে। আমার আসলে এই পরিস্থিতিতে কি করা উচিৎ আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছিনা।”

কথাগুলো শেষ করে এক মূহুর্ত থামে সাইদুর রহমান। একে একে স্ত্রী সন্তানের পানে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে আদেশ জারি করে,

“রাত অনেক হয়েছে। যে যার রুমে ঘুমাতে যাও। ছেলেটা অনেক দূর থেকে জার্নি করে এসেছে। তোমাদের বিশ্রামের প্রয়োজন না হলেও ওর প্রয়োজন। বাকী কথা যা হবার সকালে হবে।”

আর এক মূহুর্ত দাঁড়ায়না সাইদুর রহমান। চুপচাপ শান্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। করুণ চোখে একবার ছেলের দিকে তাকায় শাহিনূর। আবারও এগিয়ে যায় নাহিদের কাছে। মাথায় হাত বুলিয়ে অসহায় স্বরে বলে,

“ঘুমিয়ে পর আব্বা। যে আমাদের ভালোবাসার মূল্য দিতে জানেনা তার কথা ভেবে শরীর খারাপ করিস না আর। সে যখন নিজের জীবনের এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত একাই নিতে পেরেছে তখন হয়তো আমাদের আর কোনো প্রয়োজন নেই তার। হাতে-পায়ে বড় হয়ে গেছে তো। কোলে-পিঠে করে বড় করে চোখ-কান ফুটিয়ে দিয়েছি। এবার নিজের বুঝেই তো সব করবে। সে ম’রো’ক মন চায় বাঁ’চো’ক। এমন হারামি, পাষণ্ডকে নিয়ে ভাববিনা আর।”

মায়ের শেষের কথা গুলো যেন বুকের ভিতর ছুরিকাঘাতে ক্ষতবীক্ষত করে দিয়েছে নাদিয়ার। কান্না ভুলে বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। সে কি এতোটাই জঘণ্য অপরাধ করে ফেলেছে যার কারণে এতো বড় একটা কথা বলতেও মায়ের বুক কাঁপলনা! ভালোবাসার এতো কষ্ট আগে জানলে এই ভালোবাসা নামক আগুনে হয়তো কখনো ঝাপ দিতোনা সে। প্রিয় মানুষ গুলোর হুট করে এমন কঠোর আচরণ সহ্য হচ্ছেনা নাদিয়ার। বুকের ভিতরটা অসহনীয় যন্ত্রণায় বারবার লাফিয়ে উঠছে তার। ইচ্ছে করছে মাটিতে গড়িয়ে কাঁদতে। অতীতের স্মৃতি গুলো মুছে ফেলার যদি কোনো দৈব শক্তি তার কাছে থাকত তাহলে হয়তো এই মুহুর্তে সে নাজিমের সাথে হওয়া সম্পর্কটা সূচনলগ্ন থেকে আজ পযর্ন্ত পুরোটাই মুছে ফেলতো। তবুও চায়তো জন্ম থেকে ছায়ার মতো পাশে থাকা প্রিয় মানুষ গুলো কষ্ট না পাক।কিন্তু আফসোস! এমন কোনো শক্তি সৃষ্টিকর্তা শুধু তাকেই না। কোনো মানুষকেই দান করেন নি।শব্দ করে ফুঁপিয়ে ওঠে নাদিয়া। অস্ফুট স্বরে বহু প্রতিক্ষার পর মুখ দিয়ে শুধু একটা শব্দই উচ্চারণ করে,

“মা!” আর কিছুই বলতে দেয়না শাহিনূর। থামিয়ে দেয় মাঝ পথেই। জলদগম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,

“এতোক্ষন যখন এতোবার কিছু বলতে বলার পরও চুপ করে ছিলি, তখন না হয় এখনো চুপ করে থাক। এই মুহুর্তে তোর থেকে আর কিছুই শোনার ইচ্ছে নেই। নাটক বন্ধ করে চুপচাপ রুমে যা।”

এমন জবাবের পর আর কিছুই বলতে পারেনা নাদিয়া। অশান্ত মনে অপরাধের গ্লানি নিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। বোনের যাবার একবার চোখ তুলে তাকায় নাহিদ। বুক ফুলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মায়ের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে বলে,

“ওর প্রতি সবাই এতোটা কঠোর হলে হিতে বিপরীত হতে পারে মা। আবেগের বশত হয়তো আরও ভুল স্টেপ নিয়ে নিতে পারে। যাও ঘুমিয়ে পরো।”

শাহিনূরের গাল বেয়ে উষ্ণ জলের ধারা গড়িয়ে পরে অঝোর ধারায়। ছেলেকে কিছু বলতে চেয়েও পারেনা। বেড়িয়ে যায় রুম থেকে। পূণরায় এক হতাশার নিশ্বাস বেড়িয়ে আসে নাহিদের বুক চিরে। চোখ ঘুরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখতে পায় সবাই চলে গেলেও এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নাফিস। ভ্রু কুঁচকে নাহিদ বলে,

“তোকে কি এখন নতুন করে ইনভাইটেশন কার্ড দিয়ে রুম থেকে বেড়োনোর কথা বলতে হবে?”

একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায় নাফিস। আমতা আমতা করে বলে,

“ভাই দেখো, তুমিও ওর বড় ভাই আমিও কিন্তু ওর বড় ভাই। কষ্ট যেমন তোমার হচ্ছে তেমন আমারও হচ্ছে। দুজনের যখন একই রকম কষ্ট তো আজকে না হয় দুজন একসাথে থেকে কষ্ট বিলাস করে নেই!”

এমন একটা মুহুর্তে এসেও ভাইয়ের মুখে এমন হাস্যকর কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয় নাহিদের। ক্ষিপ্র কন্ঠে বলে,

“কানের নিচে কন্টিনিউয়াসলি থাপ্পড় খেতে না চাইলে চুপচাপ বের হো রুম থেকে।”

একটুও দমেনা নাফিস। বরং ভাইয়ের ধমকটাকে পাত্তা না দিয়ে দরজা লাগিয়ে হেলেদুলে এগিয়ে আসে বিছানার কাছে। বলে,

“যা ইচ্ছা করতে পারো। আই ডোন্ট মাইন্ড। বাট আজকে তোমার বিছানা ছাড়ছিনা।”

এক দিকে বন্ধুর প্রতারণা অপর দিকে বোনের প্রতারণা। আপনজনের তালিকায় থাকা দুজন মানুষের থেকে হঠাৎ এতো বড় একটা ধাক্কা পেয়ে নিশ্চয়ই ভাইয়ের মনের অবস্থা যথেষ্ট সূচনীয়। উপর থেকে নিজেকে নাহিদ যতই গম্ভীর দেখাক। ভিতরে ভিতরে ঠিক কতটা গুড়িয়ে যেতে পারে সে তার ছোট ভাই+বন্ধু হিসেবে একটু হলেও জানে নাফিস। যার কারণেই ভাইকে এই পরিস্থিতিতে একা ছাড়তে চাইছেনা। সে জানে সারাটা রাত নির্ঘুম কাটাবে নাহিদ। কাছের দুজন মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার কথা স্বরণ করে গুমরে ম’র’বে প্রতি মুহূর্ত। নাফিস হয়তো ভাইয়ের কষ্টটা লাঘব করতে পারবেনা। কিন্তু সঙ্গ তো দিতে পারবে! এই ভেবেই নিষেধ অমান্য করেই থেকে যায় ভাইয়ের পাশে। নাহিদ’ও আর কিছুই বলেনা। বললেও হয়তো কোনো লাভ হতনা। এজন্য অযথা আর কোনো কথাও খরচ করেনি। কাটিয়ে দেয় দুই ভাই মিলেই নির্ঘুম একটা রাত্রি।

***

রাতের অন্ধকার কেটে দেখা দেয় নতুন এক স্নিগ্ধ সকাল। বাতায়নের ফুরফুরে বাতাসের উষ্ণ আলিঙ্গনে দুঃখ গুলোতে হালকা প্রলেপ তৈরি হয়। প্রকৃতিতে শীত শীত আমেজ। শহরের অলিতে গলিতে পিঠা-পুলির মো মো গন্ধ। কর্মজীবনে সদা ব্যস্ত থাকা মানুষ গুলোর মনে পিঠা-পুলি করে খাবার প্রয়াস জাগলেও
নিজেদের ব্যস্ততা কাটিয়ে অতৃপ্ত ইচ্ছেটাকে তৃপ্ত করতে পারেনা অনেকেই। নিজে বানিয়ে খাবার সাধ্য না থাকলেও জ্বিভের ডগায় পিঠা-পুলির অল্প স্বাদের ছোঁয়া পেতে সময় করে ছুটে যায় রাস্তার পাশে বাহারি পিঠার দোকান গুলোতে। শত শত মানুষের লাইন পরে যায় দোকানের সামনে। শীতের রুক্ষ প্রকৃতির মাঝে এ যেন এক মন তৃপ্ত করা খাবারের সন্ধানে বেড়োনো পথচারীদের চোখ জুড়ানো দৃশ্য। পাপড়িদের ভার্সিটির পাশেই সারি সারি পিঠার দোকান। গরম গরম ভাপা পিঠার লোভ সামলাতে না পেরে ভার্সিটিতে এসেই ঐশীকে নিয়ে ছুটেছিল দোকানে। ভীড় মাড়িয়ে দুটো ভাপা নিয়ে চলে আসার সময় চোখে পরে এক পাতিলে টসটসে রসে ডুবানো চিতই পিঠা। মনে পরে ছোট বোন পালকের বড্ড প্রিয় এই পিঠা। প্রতি বছরই রওশন আরা বাড়িতে নিয়ম করে পিঠা বানায়। কিন্তু এবার বিভিন্ন ব্যস্ততায় এখনো বানানো হয়নি। এবার না হয় প্রথমে বাইরে থেকেই কিনে নিয়ে খেয়ে দেখল রসে ডুবানো শীতের পিঠার স্বাদ। ভাবনা অনুযায়ী তিনজন খেতে পারবে এমন পরিমাণে রসে টইটুম্বুর দুটো পিঠার বাটি দুই হাতে নিয়ে বেড়িয়ে আসে ভীড় ঠেলে। ঐশীকে জানিয়ে দেয় আজকে আর ক্লাস করবেনা। ফুরফুরে মনে গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে রিকশার অপেক্ষায়। কিছু সময় পার হতেই দূর্বার গতিতে একটা বাইক এসে সহসা থেমে যায় পাপড়ির সামনে। আচমকা ক্ষিপ্র গতিতে বাইকটাকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয় পেয়ে যায় পাপড়ি। আসন্ন বিপদের কথা ভেবে লাফিয়ে ওঠে অন্তরাত্মা। টটস্থ ভঙ্গিতে পিছিয়ে যায় দুই-তিন পা। হাতে থাকা পিঠার বাটি গুলো একটুর জন্য নিচে পরা থেকে বেঁচে যায়। নিজের থেকে কিছুটা দূরত্বে বাইকটা থেমে যাওয়ার আওয়াজ শুনে ভয়ের তাড়নায় বন্ধ হয়ে যাওয়া চোখ দুটো ফাঁক করে পিটপিট করে তাকায়। দেখতে পায় দুটো পরিচিত মুখ। সাথে সাথেই স্বস্থির এক নিশ্বাস ছাড়ে বুক ফুলিয়ে। পাপড়িকে ভয়ে সিটিয়ে থাকতে দেখে বাইকে বসা লোক দুজন বোকা বনে যায়। কিছু না বলে শুধু তাকিয়ে থাকে ভয়ে মিইয়ে যাওয়া পাপড়ির মুখের দিকে। এক পর্যায়ে লাবিব বলে ওঠে,

“কি রে ভাই! এই মুরগির কইলজা নিয়ে বাইরে বের হও?”

লাবিবের কথাটা একদম পছন্দ হয়না পাপড়ির। একেতো একদম কাছাকাছি এভাবে বাইক এনে থামিয়েছে। যদি কোনোভাবে শরীরে লেগে যেতো এটা নিয়ে কোনো অনুতাপ নেই। তারওপর কেমন কথা বলছে!,

“এভাবে কেউ এতোটা কাছাকাছি এসে বাইক থামালে কে ভয় না পাবে? মা’রা’র প্ল্যান করেছিলেন না কি?”

হৈ হৈ করে ওঠে রাফিন। এক লাফে বাইক থেকে নেমে বলে ওঠে,

“আস্তাগফিরুল্লাহ! বন্ধুর বিয়ের ফুল ফোটার আগেই তাকে সঙ্গীহারা করে দেবার কথা ভাবতেই পারিনা আমরা। এতোটা পাষাণ এখনো হতে পারিনি বোন।”

রাফিনের কথায় পাত্তা দেয়না পাপড়ি। চোখ ছোট ছোট করে আশেপাশে তাকায়। ভাবে হয়তো নাহিদ তাদের সাথে এসেছে। আগেভাগে দূরে কোথাও হয়তো নেমে ঘাপটি মেরে পাপড়িকে লক্ষ্য করছে। বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে ওমন গম্ভীর আচরণ করে নিশ্চয়ই কালকে রাতে তার সাথে আবার মজা করেছে।
পাপড়িকে আশেপাশে তাকাতে দেখে হতাশ হয় দুই বন্ধু। হতাশামিশ্রিত কন্ঠেই রাফিন বলে,

” এতো খোঁজে কোনো লাভ নেই ডিয়ার হবু ভাবি। আপনার ওনি আসেনি আজকে। শুধু ওনার বন্ধুরাই এসেছে।”

সরাসরি এমন কথায় একটু বোধহয় লজ্জা পায় পাপড়ি। ঘনঘন চোখের পলক ফেলে ঝটপট একটা মিথ্যে বানিয়ে বলে দেয়,

” রিকশা খুঁজছি আমি বাড়ি যাব বলে।”

মুহূর্তেই চোখ বড় বড় করে অবিশ্বাস্য কন্ঠে লাবিব বলে,

“হায় আল্লাহ! কি দিন আইলোরে রাফিন্ন্যায়া! এই মাইয়া তো দেখি বন্ধুর বউ হবার আগের আমগোরে ইগনোর করা শুরু করে দিছে। বিয়ার পর তো মনে হয় বন্ধুরেও তাবিজ কইরা আমাদের থেকে কাইড়া নিব। নাহ! এরে ভাবি করা যাইবোনা।”

এমন ভড়কে যায় পাপড়ি। চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। হড়বড় করে বলে ওঠে,

“ছিঃ ছিঃ ভাইয়া! আপনাদের আমি ইগনোর করতে যাব কেন? আপনারা আসার আগে থেকেই তো আমি এখানে রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। তাছাড়া আপনারা আমার কাছে এসেছেন না কি অন্য কোনো কাজে এসেছেন তা তো জানিনা।”

পাপড়ির কথা শেষ হতেই চোখে-মুখে দুঃখী দুঃখী ভাব ফুটিয়ে তুলে দুজনেই। ফাজলামি ছেড়ে রাফিন বলে,

“ঠেলাই পরে সকাল হতেই বাইক ছুটিয়ে কু’ত্তা’র মতো দৌড়ে তোমার কাছে আসছি বোন। ঘোর বিপদ। বিপদের ঠেলাই চোখের সামনে তুমি ছাড়া আর কাওকে দিখছিনা। একমাত্র তুমিই হয়তো পারবে এই বিপদ থেকে রক্ষা করতে আমাদের।”

চলবে….