#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব ২২+২৩
#কায়ানাত_আফরিন
২৯.
সন্ধ্যের মৃদু আভাসে চারিপাশ হয়ে উঠেছে চমৎকার। গলিতে মাঝে মাঝে রিক্সার টুং টাং হাকাহাকিতে যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে পরিবেশটা।নিভ্র গাড়ি থেকে নেমে একবার চারিদিক তাকালো। বনশ্রীর একটা আবাসিক এলাকা এটা। এখানে থেকেই তবে মৌনি পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছে। মৌনিও খানিকটা উচ্ছ্বাসের সাথে গাড়ি থেকে নামলো। সময়ের ব্যবধানটা খুব একটা বেশি না তবুও মৌনির কেনো যেন মনে হয় দীর্ঘ বছর পর ঢাকায় পা রেখেছে মৌনি। সামনে ১১ তলা বিশিষ্ট যেই এপার্টমেন্টটা দেখা যাচ্ছে সেটার চার তলাতেই থাকে মৌনি আর ওর ২ বান্ধবী। মৌনি নিভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
–”চলেন আমার সাথে?”
–” হ্যাঁ । আসছি।”
————
বসার ঘরে চাইনিজ কুড়ালের মতো ধারালো চোখে মৌনির দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলো রাত্রি। একবার মৌনির পাশে বসা সুদর্শন ছেলেটার দিকেও চোখ বুলিয়ে নিলো। রোদেলাও ড্যাবড্যাব করে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। সামনের টি টেবিলে শরবত পরিবেশন করা থাকলেও সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। মৌনতা কাটিয়ে রাত্রি দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
–”আমি তো মনে করেছিলাম যে তুই বিয়ে শাদি করে একবারে নাতিপুতি নিয়ে এখানে আসবি।এত তাড়াতাড়ি আসলি যে।”
মৌনি চুপ হয়ে আছে। রাত্রির এতটা রিয়্যাক্ট করা স্বাভাবিক। কারন এই ঝামেলায় পড়ার পর রাত্রি আর রোদেলার সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ করেনি ও। আসলে মৌনি চায়নি যে ওর জন্য রাত্রি আর রোদেলা কোনো বিপদে পড়ুক। কিন্ত এখন পরিস্থিতি সামলাতে হবে। রোদেলাকে ম্যানেজ করা সম্ভব কিন্ত রাত্রির ক্ষেতে তা সাধ্যের বাইরে। তাই আমতা আমতা করে মৌনি বললো,
–”স্যার তোদেরকে বলে নি যে আমি……………”
–”স্যার কেনো বলবে? স্যার আমার ফ্রেন্ড নাকি তুই আমার ফ্রেন্ড?আর ইনি কে?”
ক্ষীপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো রাত্রি। নিভ্র এতক্ষণ দর্শক হিসেবে রাত্রি মেয়েটার কার্যকলাপ দেখছিলো। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা ভয়ঙ্কর পরিমাণের রাগ নিয়ে চলাফেরা করে। নিভ্রর প্রসঙ্গ চলে আসতেই নিভ্র মুচি হেসে বলে উঠলো,
–”আমি নিভ্র। তোমাদের ফ্রেন্ডের ফিউচার পার্টনার।”
নিভ্রর ভাবেশহীন কন্ঠ। রাত্রি আর রোদেলা দুজনেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে নিভ্রর দিকে। জীবনে অনেক ছেলেই দুজনে দেখেছে কিন্ত এমন ডোন্ট কেয়ার টাইপ ছেলের মুখোমুখি কখনোই দুজনে পড়েনি। কি সুন্দর করে বলে দিলো , মৌনির ফিউচার হাজবেন্ট।
রোদেলা দাঁত কেলিয়ে রাত্রিকে বললো,
–”দেখলি রাত্রি ! তুই বললি না মৌনি মনে হয় নাতি-পুতিরে নিয়ে আসবে ; দেখ ! নাতি-পুতিকে না নিয়ে আসলেও আমাদের জিজুকে নিয়ে আসছে।
রাত্রি এখনও বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছে। যেন একথা সে বিশ্বাসই করতে পারছে না। মৌনি নিভ্রর দিকে চোখ বাকিয়ে তাকালো। রাত্রি মেয়েটা এমনিতেও ওর ওপর রেগে আছে কোনো যোগাযোগ না করার কারনে আর এখন তো ওদের সম্পর্কের কথা জানাইনি দেখে আরও ফেটে পড়বে। মৌনি তাই রাত্রিকে বললো,
–”রাত্রি ! দোস্তোওও রাগ করিস না তোকে জানাইনি দেখে। আগে আমার কথা সব শুনিস তবেই বুঝতে পারবি সব ঘটনা।”
রাত্রি বিনিময়ে মুখ চুপসে বসে রইলো। রোদেলা এবার নিভ্রকে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো ,
–”তো ভাইয়া এভাবে চুপ করে বসে আছেন কেনো? একটু আমাদের সাথেও কথা বলেন !”
–”অবশ্যই বলবো। তবে কে কথা আগে শুরু করবে? আমি ; নাকি তোমরা?”
রোদেলা আর নিভ্রর কথার মাঝে রাত্রি আগ বাড়িয়ে বললো,
–” আগে আমরা। আমি রাত্রি আর আমার পাশে এই কুমড়োপটাশ মেয়েটা রোদেলা। মৌনি , আমি আর রোদেলা তিনজনেই সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশুনা করছি। এখন আপনার সম্পর্কে বলেন।”
–”অন্য পাঁচ-দশজনের মতো আমিও একজন সাধারন মানুষ। আমার সম্পর্কে জানতে গেলে যদি আমার কাজ সম্পর্কে জানতে চাও তবে আমি পেশায় একজন সাইক্রেটিস্ট।গুলশানে নিজের এপার্টমেন্টেই থাকি। অবসরে ঘুরাফেরা , বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া আর প্রকৃতি বিলাস করতে পছন্দ করি।আর যদি মৌনি আর আমার সম্পর্কের কথা জানতে চাও তবে তা কাকতলীয়ভাবেই হয়েছিলো। সেটাও বিরাট কাহিনী। বলা শুরু করলে সকাল হয়ে যাবে শেষ করতে।”
অল্প কথায় নিজের সম্পর্কে খুলে বললো রোদেলা আর রাত্রিকে। মৌনি নিভ্রর কথায় অভিভূত হয়ে গিয়েছে। চমৎকার পার্সোনালিটির এই ছেলেটা অল্প কথার ছন্দেই সবার সাথে মিশে যেতে পারে যা আসলেই মজার একটা বিষয়। বেশ কিছুক্ষণ আলাপচারিতা চালানোর পর নিভ্র এখান থেকে যেতে উদ্যত হলো।
———————
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মৌনি। চোখে মুখে ক্লান্তি নেমে এসেছে। নিভ্র মৌনির ক্লান্তিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলো। তারপর নিজের দুহাত মৌনির গালে আগলে রেখে কোমল কন্ঠে বললো,
–”এখন ফ্রেস হয়ে রাতের খাবার খেয়ে নিবে। আর হ্যাঁ। ওষুধ খেতে কিন্ত মোটেও ভুলবে না। কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই আমায় কল করবে। ঠিকাছে?”
–”হুমম।”
–”ভালোবাসি।”
নিভ্রর ”ভালোবাসি” কথাটি শুনে মৌনির মনে বয়ে যেতে লাগলো অনুভূতির জোয়ার। নিভ্রর ভালোবাসা সম্পর্কে ও বরাবরই অবগত ছিলো তবে এভাবে নিভ্র কখনোই ওকে ভালোবাসি বলেনি। নিভ্রর নজরকাড়া চোখ দুটোতে মৌনি অনুভব করতে পারছে রাজ্যের ভালোবাসা। এই ছেলেটা এমন কেনো? সবসময় হুট করে মৌনির হৃদয় ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এত সুখ অনুভব হচ্ছে কেনো মৌনির?
.
.
.
——————.
৩০.
বইয়ের দিকে নিজের মুখ গুজে আনমনে পড়ে যাচ্ছে মৃধা। কিছুদিন পর ওর পরীক্ষা শুরু হবে। তাই এখন পড়ার অনেক চাপ। হঠাৎ রিদান এসে ওর কাছ থেকে বই কেড়ে নিলো। তাই মৃধা কিছুটা হকচকিয়ে যায়। রাগী দৃষ্টি নিয়ে রিদানের দিকে তাকাবে তখনই ও থমকে গিয়েছে। রিদান গোসল সেরে কোনো টিশার্ট না পড়েই এখানে ধাঁড়িয়ে আছে। গলায় টাওয়েল ঝুলানো। গায়ে বিন্দু বিন্দু পানি জমে থাকার কারনে রিদানকে এখন কোনো এট্রাকটিভ পার্সন থেকে কম কিছু মনে হচ্ছেনা। হঠাৎ সকালের ঘটনা মনে পড়তেই মৃধার চোখ-মুখ লাল হতে শুরু করলো। যদিও রিদান ওসব কথা নেশার ঘোরে বলেছে আর মৌনির মনে হয়না যে রিদানের ওসব কথা মনে আছে। একটা শুকনো ঢোক গিলে অপ্রস্তুত গলায় বলে উঠলো,
–”এভাবে বই কেড়ে নিলে কেনো?”
–”এত কি পড়া তোর; যে আজ সারাদিন আমার সামনেই আসলি না। ”
–”আজব তো? তোমার সামনে আসবো কেনো? আমার পরীক্ষা আর আমি তাই মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। আর তোমার যা দরকার সব তো সমির কাকাকে বলে দিয়েছি। তাহলে?”
–”তুই কি তবে পণ করেছিলি যে আমার সামনে আসবি না?”
দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে রিদান। তাই মৃধা এবার চুপসে গিয়েছে। রিদানের ব্যবহারে হঠাৎ এত পরিবর্তন দেখে মৃধা যেমন অবাক তেমনি নীরব।রিদান এবার একটা ছোট্ট খাম মৃধার দিকে এগিয়ে দেয়। মৃধা খামটি নিয়েই যেন হতভম্ব হয়ে গেলো। কাগজ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটা লাভ লেটার। উপরে বাচ্চাদের মতো ফুল-পাতা-নকশা আকা। মৃধা ভাবলো এই রিদান কি পাগল-টাগল হয়ে গেলো নাকি। মৃধা এবার ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলে উঠলো,
–”দাভাই তুমি নির্ঘাত পাগল হয়ে গিয়েছো? তোমাকে শীঘ্রই একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে।”
চোখ-মুখ কুচকে ফেললো রিদান। সে দিলো একটা লেটার আর মৃধা সেটা না পড়েই কি সব আবোল তাবোল বলছে।
–”What rubbish ! মাথা ঠিকাছে তোর?”
–”আমার মাথা ঠিকাছে দাভাই কিন্ত তোমারটা ঠিক নাই। একটা কাজ করি। শোনো , পুরান ঢাকার তাতিবাজারে একটা বড় পীর সাহেব থাকে। তার থেকে পানি পড়া নিয়ে আসলেই তুমি নিশ্চিত ঠিক হয়ে যাবে। নাহলে যেই রিদান শেখ খুন-খারাপি ছাড়া কিছুই বুঝতো না সেই রিদান শেখ আমারে লাভ লেটার দিচ্ছে? আমি বললাম না , মামার জন্য তুমি তোমার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছো।”
এতক্ষণে বুঝলো আসল ব্যাপারটা। তাই কটাক্ষ সুরে মৃধাকে বলে উঠলো,
–”এক চড়ে তোর সব কয়টা দাঁত আমি ফালায় দিবো। ফাজিল কোথাকার? এত বড় ঢিংড়ী মেয়ে হয়েছিস ; এখনও কিছু বুঝস না। আমি কি একবারও বলেছি যে এই লাভ লেটারটা আমার লিখা? কাগজ খুলে ঠিকমতো পড়।”
মৃধা এবার চিঠি খুলে পড়া শুরু করলো। লাভ লেটারটা মৃধার উদ্দেশ্যে ছিলো ঠিকই তবে লিখেছে অন্যকেউ । শেষে সীমান্ত নাম দেওয়া। মৃধার ক্লাসমেট এই ছেলেটা। রিদান বলে উঠলো,
–”পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখন লাভ লেটার আনানেওয়া হচ্ছে তাইনা? ছেলেটার কত্ত বড় সাহস ! ফুলের সাথে বাসায় লোক দিয়ে লাভ লেটার পাঠিয়ে দেয়।”
মৃধার এখন আর কিছুই বলার নাই। বেশ কিছুদিন যাবৎ সীমান্ত ওর পিছে পড়ে ছিলো আর আজ কিনা বাসায় লাভ লেটার পাঠিয়ে দিয়েছে?কি সাংঘাতিক !
–”ভার্সিটি যাবি , ক্লাস করবি ; সুন্দরমতো বাসায় ফিরে আসবি। কোনো ছেলের সাথে কথা বলবিনা। আর যদি কোনো ছেলেকে তোর সাথে দেখি ; ওই ছেলের ইন্নাল ইল্লাহ তো হবেই ! সাথে তোরও ঠ্যাং ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো।”
একথা বলেই মৃধার দিকে এগিয়ে আসতে থাকলো রিদান। আর মৃধা একপা একপা করে পিছিয়ে যাচ্ছে। রিদানকে আজ বেশ অচেনা মনে হলো মৃধার। একে তো গায়ে কোনো শার্ট জড়ানো না বিধায় একটু অন্যরকম লাগছে রিদানকে। তারওপর সেই তীক্ষ্ণ চাহিনী মৃধাকে মুহূর্তেই ভস্ম করে ফেলবে। মৃধা আমতা আমতা করে বললো,
–” এ কি? তুমি এভাবে এগিয়ে আসছো কেনো?”
রিদান কিছু না বলে নিজগতিতে এগোতে থাকলো। ঘটনার একপর্যায়ে দেয়ালে মিশে গেলো মৃধা। রিদান ওর কাছ থেকে সামান্য দুরত্ন দিয়ে দাড়িয়ে থাকে মৃধার দুপাশে হাতের বেড়াজাল দিয়ে। রিদান বলে উঠলো,
–”আমি এখন কিছু বলিনা বলে বড্ড বেড়ে গিয়েছিস তুই। কি যেন বলছিলি? আমারে পীর সাহেবের পড়া পানি খাওয়াবি। তাই না? শোন ! আমার থেকে জীবনেও কোনো লাভ লেটার আশা করবিনা। তোরে ভালোবাসলে ডিরেক্ট বলবো। এসব 19 Century এর মতো চিঠির আদান প্রদান আমারে দিয়ে জীবনেও হবেনা।”
রিদানের কথায় কেপে উঠলো মৃধা। খানিকটা বিভ্রান্তে ; খানিকটা অস্বস্তিতে। অনুভূতির জোয়ারের নতুন খেলা বয়ে চলছে ওর মনে। মৃধা বুঝতে পারছে বদলে যাচ্ছে রিদান। মনে হয়তো ভালোবাসার ফুল ফুটা শুরু করেছে।
.
.
———————————————
চাদর পেচিয়ে সরু দৃষ্টিতে আনমনে টিভি দেখে যাচ্ছে রাত্রি। মৌনি ওর পাশে বসে থাকলেও মনে যেন কোনো ভাবান্তর নেই। টানা দু ঘন্টা ধরে মৌনি ওকে সরি বলার চেষ্টা করছে কিন্ত রাত্রি বরাবরের মতই নির্বাক। রোদেলাও কখন থেকে বলে চলছে যে , ”দোস্তো। ওরে মাফ করে দে। মৌনি জীবনেও আর তোর থেকে কথা লুকাবে না।”
তবুও রাত্রি চুপ। মৌনির জ্বালাতনে শেষমেষ বিরক্ত হয়ে বললো,
–”আমার হাতের ঠাডাইয়া চড় খাওয়ার আগে দূর হ আমার চোখের সামনে থেকে। শয়তান , হারামী । তোর সাথে এতকিছু হয়ে গেলো আর তুই একবারের জন্যও আমাদের কিছু বললি না।”
–”সত্যি রাত্রি। সরি। কসম , আর জীবনেও এমন করবো না। ”
কিছু একটা আনমনে ভেবে নিলো রাত্রি। তারপর গম্ভীরস্বরে বললো,
–”মনে থাকে যেনো। এটাই তোর লাস্ট চান্স।”
বন্ধু জিনিসটা জীবনের একটা চমকপ্রদ বিষয়। বাবা-মা এর পরে যদি কোনো নিঃস্বার্থ নিকটজন থাকে ; তবে সেটা হলো বন্ধু। যত ঝড় , বন্যা হোক না কেন ? এ সম্পর্কে কোনো মলিনতা ধরে না। অন্তরের সাথে বন্ধুর সম্পর্ক ; আর বন্ধুর সাথে অন্তরের ! (হুমায়ূন আহমেদ)
.
.
.
.
.
~চলবে