হৃদয়ের সুখ আপনি পর্ব-১৫+১৬

0
231

#হৃদয়ের সুখ আপনি
#পর্ব-১৫+১৬
#Nishi_khatun

সেই যে বনবাসী হওয়ার সময় গ্রামটা দেখেছিলাম।
সেই আগের রুপে গ্রামটা আমার আর নেই। আমিও সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়েছি। আমার সাথে সাথে আশেপাশের সব কিছু পরিবর্তন হয়েছে।

আমি বাড়িতে আসার পথে দেখি রুপসী খাল। এই খালের আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনেক মনোমুগ্ধকর। আশেপাশের সব গ্রামের মানুষেরা এখানে ঈদের সময় ঘুরতে আসে। আমাদের আশেপাশে গ্রামের মানুষের বিনোদনের একটা স্থান।

তবে আমি আজকে দেখছি এখানে শহুরে ওভার স্মার্ট, বেয়াদব টাইপের ছেলেরা আড্ডা দিচ্ছে। বাবাকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তার উত্তর এমন ছিল,” আম্মু যে কোন স্থানের প্রকৃতিক সৌন্দর্যের উপর সে স্থান ব্যতীত অন্য স্থানের মানুষদের উপভোগ করার অধিকার আছে। প্রকৃতি আমাদের সবার জন্য। তার সৌন্দর্য কোন একটা স্থানের মানুষদের জন্য সীমাবদ্ধ না।”

তখন বুঝেছিলাম আমার বাবাকে কিছু জিজ্ঞাস করে লাভ হবে না। সে আগে থেকে এমন স্বভাবের মানুষ। তবে আমার এসব মোটেই পছন্দ না। বাঙালি যেখান নিরিবিলি পরিবেশ দেখে, সেখানে দলবল বেধে চলে যাই। তাদের নিজেদের তো প্রাইভেসি নাই আবার অন্যদের প্রাইভেসির খবর রাখে না। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখলেই হলো। স্থান টা কে একদম জঙ্গলে পরিণত করে ছাড়ে।

বাড়িতে আসার পরপর আম্মুর কড়া আদেশ দরকার ছাড়া রুমের বাহিরে একপা রাখবে না। আমি জানি আম্মু আমার উপরে কেনো এমন ধারা জারি করেছে। কারণ আমি রুমের বাহিরে গেলে বাড়ির বাহিরে যাব তখন গ্রামের লোকেরা আমাকে দেখে অপমান জনক কিছু বাক্য প্রয়োগ করবে। তাদের সে সমস্ত কটু কথা শুনে আমার মনটা বিষাদগ্রস্ত হবে। আমিও চাইছি না তাদের এই সমস্ত বাজে কথা কানের ভেতর প্রবেশ করাতে। তা-ই নিজেই নিজেকে সংযত রাখলাম কিছুদিন।

ভাইয়ার বিয়েতে সে ভাবে খুব আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হয় নি। তবে গ্রামে বাস করে যে টুকু না করলে চলে না সেই পরিমাণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যায় ছোটখাটো ভাবে হলুদের আয়োজন। পরেরদিন বিয়ে বরযাত্রী যাওয়া। বিয়েরপর দিন বউভাতের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই তিন দিন আমি নিজেকে নিজেই বাবার বাড়ির মেহমান মনে করেছি।
আমার গ্রামে থাকার মেয়াদ বউভাতের দিন পর্যস্ত ছিলো। পরেরদিন সকালে বাড়ির সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মামা-মামী আর বাবার সাথে শহরের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরি।

হঠাৎ রুপসী খালের রাস্তার সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখি শত শত মানুষের ভিড়। এতো মানুষের ভিড় দেখে খুব কৌতূহল হচ্ছিল। সেখানে পুলিশের গাড়ি, এম্বুলেন্স এসব দেখে কিছুটা অনুমান করেছিলাম, হয়তো এখানে কোন এক্সিডেন্ট হয়েছে।
আমাদের গাড়িটা সেখানে কিছু সময়ের জন্য থেমেছিল।
বাবাকে কিছু জিজ্ঞাস করলে কোন উত্তর দিতে পারে না।
সেখানে অনেক স্কুলের মেয়েরা উপস্থিত ছিলো।
সাথে আশেপাশের গ্রামের লোকেরা। এই ভিড়ের মধ্যে থেকে ভিকটিমের বাড়ির লোকদের আর্তনাদ বাতাসে বাতাসে ভেসে কানে এসে বাঁজছিল। কি এক ভয়াবহ পরিবেশ। যে কোন দূর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে অন্যদের কিছু না হলেও ভিকটিমের পরিবার হারায় তাদের বাড়ির একজন ভালোবাসার সদস্য। হয়তো সেই সদস্য তাদের বাড়ির একমাত্র উপার্জিত ব্যক্তি হতে পারে। হারিয়ে যাওয়া মানুষ গুলো তার বাড়ির প্রাণ হয়ে থাকে।

আমাদের গাড়িটা হঠাৎ সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তখন খালপাড় থেকে ভিকটিমের লাশটা এম্বুলেন্সের ভেতরে প্রবেশ করাতে নিয়ে আসছিল। দূর থেকে কিছু বুঝতে না পারলেও লাশটা ভেতরে রাখার দৃশ্যটা হৃদয়ে রক্তক্ষরণের সৃষ্টি করছিল। জানি না কোন মা তার কলিজার টুকরো সোনার ধন হারিয়েছে। আল্লাহ তুমি যাকে নিজের কাছে নিয়েছ তাকে বেহেশত দান করিও, আর সেই অভাগী মা’কে ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা দান করবেন, আমিন।

আমি বিষাদগ্রস্ত মনটা নিয়ে বাড়িতে আসতেই নিজের রুমে এসে ছুটে যাচ্ছি। তবে সেখানে যেতেই একরাশ হতাশা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আমার ছোট্ট হৃদয়টাকে। কারণ বারান্দার ওপাশের জানালাটা বন্ধ ছিলো। এতোবছর তার সাথে সম্পর্ক কিন্তু আজ পর্যন্ত কখনো জানালা বন্ধ পায়নি। তাহলে আজ কেনো বন্ধ? বাড়িতে যেয়ে তার সাথে যোগাযোগ করা হয়নি বলে কি সে রাগ করেছে? আসলে সেখানে মোবাইলে নেটওয়ার্ক সমস্যা ছিলো। কিন্তু সে আমার উপরে রাগ করবে কেনো? আমি কখনো আমার অনুভূতি তার নিকটে প্রকাশের সাহস করা হয়নি।

বিষাদগ্রস্ত মনটা নিয়ে মামা-মামীর সাথে কথা বলতে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াতেই পা দুটো আমার বরফের মতো জামাটা বেধে গেলো। মামা দেখি মামী কে উদ্দেশ্য করে বলছে, “জানো আমাদের পাশের বাড়ির ছেলেটা তিনদিন আগে মারা গেছে আল্লাহ ছেলেটার বাবা- মা কে ধৈর্যশীল করুণ।”

এতটুকু কথায় যথেষ্ট ছিলো আমার পুরো পৃথিবী অন্ধকার করে দেওয়ার জন্য। আমি সেখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারি নাই। এক দৌড়ে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে বাথরুমে প্রবেশ করি।তারপর হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পরি। এটাই বুঝি আমার প্রাপ্য ছিলো? ভালোবাসার মানুষকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না আবার তাকে ছাড়ে বেঁচে থাকবো এটা ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম। এতোবছর আমি যে আমার আপনিতে আসক্ত। তাকে ভুলে যাবো কি করে? তার সাথে যোগাযোগ না করাটা আমার ভুল। একটু দূরত্ব সারাজীবনের কান্নার কারণ হয়ছে। এসব আকাশ পাতাল চিন্তায় আমার হৃদয়ের মাঝে ঘূর্ণিঝড় হচ্ছিল।

পরেরদিন সকালে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম ভার্সিটিতে যাবার জন্য। তখন মামা এসে বলে,”রিমশা আজকের পর থেকে তোমাকে একা একা চলাফেরা করতে হবে। আহীদের পক্ষে আর তোমাকে প্রটেকশন দিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না।”

বাকিটা আর শোনবার মতো শক্তি আমার ছিলো না। তা-ই তো দ্রুত সামনে আসা ফাঁকা রিক্সাতে উঠে পরি। দ্রুত মামাকে বিদায় দিয়ে নিজের চোখের অশ্রু আড়ালে করতে তড়িঘড়ি শুরু করি।

আমি জানি, আমি যেমন কোয়ালেটির মেয়ে! তার এভাবে ভেঙ্গে পড়া ডোলে সাজে না। তা-ই নিজেকে যথেষ্ট সংযত রেখে নরমাল ভাবে জীবনযাপন করতে চেষ্টা করব। নয়তো সবাই জেনে যাবে আমার মনের ভেতরে থাকা গোপন অনুভূতির কথা। আমি চাইছি না সবাই আমার আহীদের প্রতি থাকা অনুভূতি সম্পর্কে জানুক। কী দরকার একজনের অনুপস্থিতি তে তাকে সবার সামনে অপমানিত করার।

এরপর থেকে শুরু হয় নতুন যুদ্ধ! আমি সবার সামনে প্লাস্টিক হাসি দিয়ে জীবন্ত লাসের ন্যায় বাঁচতে শুরু করি। খুব কষ্ট হতো এভাবে মুখোশের আড়ালে থাকতে।

এভাবে কীভাবে যেএকটা বছর কেটে গেলো বুঝতে পারলাম না
আমি আহীদ কে ছাড়া বেঁচে আছি জীবন্ত লাশে মতো।
চঞ্চল মেয়েটা হঠাৎ করে ম্যাচিউ হয়েছে।
যে ফোনে তার সাথে কাটানো হাজারো মূহুত্ব লুকিয়ে ক্যামেরা বন্দী করে রেখেছিলাম। সেই ফোনটাও আমাকে ধোঁকা দিয়ে বসে। পড়ে অবশ্য ভাইয়া নতুন ফোন আর সিম কিনে দিয়েছিল।

এরপর জীবনে ঘটে আরেকটা কাহিনী। মামাত দুই ভাই হঠাৎ করে বিয়ে করে তাদের বউদের নিয়ে বাড়িতে এসে ওঠে। তাদের সাথে মামা-মামী’র নানারকম পারিবারিক সমস্যা শুরু হয়। তাদের বাড়ির নতুন দুই বউয়ের আমাকে নিয়ে সমস্যা হতে শুরু করে। এবাড়িতে আমাকে নিয়ে চলমান সমস্যা সম্পর্কে আমি আমার পরিবারকে অবগত করি। এসব কথা শুনে বাবা গ্রামের মেম্বার চেয়ারম্যানের সাথে কথা বলে।

চেয়ারম্যান সাহেব অনেক ভালো মানুষ দেখে সে বাবাকে বলে,”যাও তুমি তোমার মেয়েকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে চলে আসো। এখানে আসার পর তার দায়িত্ব আমার। তোমার মেয়ে মানে আমার মেয়ে, আর কতোদিন মেয়েটা কে দূরে রাখবে। বিয়েরপর তো মেয়ে পরের বাড়িতে চলে যাবে।”

এরপর বাবা আমাকে নিতে চলে আসে। আমিও চাইছিলাম না আমার জন্য মামা-মামী’র তার সন্তানদের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হোক। বাবার সাথে গ্রামের ফিরে আসার সময় খুব খারাপ লেগেছিল। কারণ মানুষ সহজে কোন কিছুর মায়া কাটাতে পারে না। আমিও এ শহরের সাথে ঐ মানুষটার মায়াতে আবদ্ধ তা কি সহজেই ভুলে যাওয়া সম্ভব?

গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছি বেশ কিছুদিন হয়েছে।
আমাদের বাড়ির আশ্রিত ইফা আর তার মা।
ইফার মা বেশ ভালো ন্যায়পরায়ণ মানুষ। তবে তার মেয়েটা কে আমাকে তেমন সুবিধের মনে হয় না। আমি বাড়িতে ফিরে আশাতে সে খুশি হয়নি। আমার সাথে সে কথা বলতে আগ্রহী না। এমন একটা ভাব করে আমি মনে হয় ওর পাকা ধানে মই দিয়েছি। তবে কি আর করার ইফা গ্রামের সব কিছু ভালোমতো চেনে জানে। আমি এতো কিছু সম্পর্কে ঠিকঠাক ভাবে অবগত না। তাছাড়া আমি বেশ কয়েকবছর গ্রামের বাহিরে ছিলাম। বাবা- মা ইফার বেপারটা ঠিকি বুঝতে পারে। তারা আমার সাথে ইফার সম্পর্ক সুন্দর করতে নানারকম চেষ্টা করতে থাকে। তবে সবটা স্বাভাবিক হবে এর কোন গ্যারান্টি ছিলো না

#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-১৬
#Nishi_khatun

কোন এক দরকারি কাজের জন্য বদুরুদ্দিন চেয়ারম্যান রিমশাদের গ্রামে আসে। বাড়িতে ফিরে যাবার পথে তার শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছিল। তখন সে পথ দিয়ে রিমশা’র বাবা যাচ্ছিল। তিনি চেয়ারম্যান সাহবের অস্বস্তিকর অবস্থা দেখে দ্রুত তার বাড়িতে আসার জন্য অনুরোধ করেন। চেয়ারম্যান সাহেব এবং তার কিছু কর্মচারী ছিলো। তারা কেউ কোন রকম বারণ না করে রিমশা’র বাবার সাথে তার বাড়িতে যেতে রাজি হয়।

বদুরুদ্দিন সাহেব কে সাথে করে বাড়ির অন্দরমহলের ভেতরে নিয়ে প্রবেশ করেন রিমশা’র বাবা শাওন শেখ।
শাওন শেখ সবাইকে ড্রয়িংরুমে বসার জন্য অনুরোধ করেন। রান্নাঘরের ভেতরে যেয়ে বউ আর মেয়েকে দ্রুত নাস্তার ব্যবস্থা করতে বলে। বাবার মুখে শুনেছে কেউ একজন অসুস্থ! রিমশা ড্রয়িংরুমে অসুস্থ ব্যক্তিকে একপলক দেখতে ডু মেরে চলে যায়।

রিমশা বুঝতে পারে অতিরিক্ত গরমের জন্য তার শরীরটা খারাপ করেছে। করবে না কেন? বাহিরে সূর্যমামা যে অ্যাটিটিউড নিয়ে তার উত্তাপ ছড়াচ্ছে!
তাতে যে কোন প্রাণীর বারোটা বেজে যাচ্ছে।
তা-ই দ্রুত রান্নাঘরে যেয়ে শরবত, গ্লুকোজ, আর ডাবের পানি নিয়ে সোজাভাবে ড্রয়িংরুমে এসে হাজির।

উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে সালাম প্রদান করে বদুরুদ্দিন সাহেবের সামনে শরবতের ট্রে এগিয়ে দিয়ে বলে,” এখানে তিন রকমের পানিও আছে আপনার যেটা পছন্দ ওটা নিয়ে খেতে পারেন।”

বদুরুদ্দিন সাহেব রিমশা’র এমন কান্ড দেখে মুচকি হাসি দিয়ে শাওন শেখ কে উদ্দেশ্য করে বলে,” আমার মেয়েটাও একদম আপনার মেয়ের মতো! আমার শরীরটা একটু খারাপ হলে এমন ভাবে সামনে চার পাঁচটা আইটেম নিয়ে হাজির হয়।
তখন এতো আইটেম দেখে নিজেই কনফিউজড হয়ে বসে থাকি। কোনটা ছেড়ে কোনটা খাবো তা ভেবে।”

রিমশা বলে,”আপনি প্রথমে ডাবের পানি পান করুণ।
এত শরীরটা দ্রুত এনার্জি পাবে। এর কিছুটা সময়পর গ্লুকোজের পানি পান করবেন তার কিছু সময়পর শরবত সিম্পল।”

শাওন এবার একটু মেয়ের এমন গাধামি দেখে বিরক্তিবোধ করে বলে ওঠে,”রিমশা! এই দুপুরবেলা বাসায় মেহমান আসলে তাদরে শুধু শরবত পান করিয়ে পেট ভরাতে হয় বুঝি? তাদের জন্য মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন করতে হয় না?”

রিমশা এবার নিজের জিব্বাহ তে কামড় দিয়ে বলে,”দুঃখীত বাবা! আমার ভুল হয়েগেছে, দাঁড়াও আমি এখুনি তাদের খারাবের ব্যবস্থা করছি।”

এরপর বদুরুদ্দিন সাহেব শাওন শেখের বাড়িতে দুপুরবেলার খাবার খেয়ে একটু আরাম করছিল। তখন শাওন শেখের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে বলে,”তা আপনার মেয়ের বিয়ের বেপারে কিছু চিন্তা ভাবনা করেছেন?”

শাওন শেখ বলে,”জি, ভালো পাত্রের সম্বন্ধ আসলে ইনশাআল্লাহ কন্যার বিবাহ দিয়ে দিবো।”

তখন বদুরুদ্দিন সাহেব বলে,”আমি আমার ছোট পুত্রের জন্য পাত্রী খুঁজছিলাম। আপনার যদি কোন আপত্তি না থাকে তাহলে আমার ছোট ছেলের জন্য আপনার মেয়ের হাত চাইছি।
আমি চেয়ারম্যান বলে ভাববেন না ছেলে মেয়েদের মানুষের মত মানুষ করতে পারি নাই। আলহামদুলিল্লাহ্‌ আমার সন্তানদের সঠিক ভাবে মানুষ করেছি। তবুও আপনার ইচ্ছা হলে খোঁজ খবর নিয়ে না হয় আপনার মতামত প্রকাশ করবেন।”

শাওন শেখ একগাল হেসে বলেন,” ভাই সাহেব আপনি কী যে বলেন না। আমার রিমশা আম্মাজান আপনার বাড়িতে গেলে যে রাজরানি হয়ে থাকবে এটা আমি জানি। আপনার পরিবার সম্পর্ক আশেপাশের সকল গ্রামের লোকদের মুখে সুনামের সাথে উচ্চারিত হয়। সেখানে আপনি আমার মেয়ের হাত চাইছেন, আর আমি সেখানে মতামত দিতে দেড়ি করতে পারি না। আমি আপনার কনিষ্ঠ পুত্রের সাথে আমার কন্যার বিবাহ দিতে রাজি।”

বদুরুদ্দিন সাহেব আলহামদুলিল্লাহ্‌ বলে ওঠেন। তারপর তিনি আবারো বললেন- দেখুন সারাজীবন সংসারটা আপনার মেয়ে করবে। আমি চাইছি আপনি আপনার কন্যার থেকে এ বিষয়ে মতামত জানুন। তারপর না হয় বিয়ের কথাবার্তা আমরা সামনে আগাবো।

শাওন শেখ তখন তার স্ত্রী আর কন্যাকে বসার ঘরে ডেকে ওঠেন। মা মেয়ে দুজনে কিছু সময়পর সেখানে এসে উপস্থিত হয়।

রিমশা এসে দেখে তার বাবার চোখ মুখ আনন্দময়। ঠোঁটের কোণায় তৃপ্তিজনক হাসি লেগে আছে। বাবার চেহারাতে এতো আনন্দের আভা দেখে রিমশা মনে মনে খুশি হয়।

শাওন শেখ রিমশা কে উদ্দেশ্য করে বলে,”আম্মাজান, তোমার জন্য চেয়ারম্যান সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্রের বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছেন। আমার এ সম্বন্ধে কোন আপত্তি নাই। তা শুনে চেয়ারম্যান সাহেব তোমার মতামত জানতে চেয়েছেন। আমি জানি আমার মেয়ের মতামত হ্যা হবে। তবুও তোমার মুখ থেকে কথাটা জানতে চাইছি মা।”

বাবার এমন কথা শুনে রিমশা’র কলিজায় মোচড় দিয়ে ওঠে। রিমশার চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছা করছিল। কিন্তু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সে কাজ করার সাহস তার হচ্ছে না। তার মনের ভেতরে চলা যুদ্ধের খবর তো বাবা- মা জানে না। তাহলে অযথা তাদের উপর রাগারাগি করার মানে হয় না। আবার এমন কোন রিলেশনে সে আবদ্ধ না যার জন্য বিয়েতে সে অমত করতে পারে। এখন তার সামনে একটাই পথ খোঁলা আছে বাবা-মা’র পছন্দমত ছেলেকে বিয়ে করে জীবনটা কে নতুন করে সাজানোর। এসব কিছু এতো সহজ হবে না। তবে মানুষ ইচ্ছা করলেই যে কোন কাজ করতে পারে। তাহলে বিয়েতে সমস্যা কোথায়?

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রিমশা বলল- বাবা তোমার যা ইচ্ছা হয় তা-ই করতে পারো। এই বিয়েতে আমার কোন আপত্তি থাকবে না। বলে সে স্থান ত্যাগ করে।

রিমশা’র মা বলে,”এতো মানুষের সামনের মতামত জানতে চেয়েছ একটু লজ্জা পেয়ে উল্টাপাল্টা ভাবে হলেও মতামত কিন্তু সে দিয়েছে।”

সে যেভাবে কথা বলুক তাতে সমস্যা নাই। আমরা সবাই বুঝি মেয়ে লজ্জায় এভাবে কথা বলেছে। এতে সমস্যা নাই।

এরপর চেয়ারম্যান সাহেব সহ তার কিছু কর্মচারীরা মিলে রিমশাদের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন সম্পন্ন করে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তার বাড়িতে চলে যায়।

চেয়ারম্যান সাহবে তার বাড়িতে যেয়ে বিবাহের কথা স্ত্রী কে বলেন। তার স্ত্রী কোন কিছুই বলে না, শুধু বলে,”ছেলেটা বিয়ের জন্য রাজী হবে মনে হয় না!”

বদুরুদ্দিন সাহেব বলেন,”ছেলে বিয়ে না করলে ওর ঘাড়ে বিয়ে করবে।”

রেহেনা বেগম বলে,”সে ছেলের ঘাড় বিয়ে করবে তাতেই খুশি।”

বদুরুদ্দিন সাহেব বলে,”সে সব পরে দেখা যাবে। এখন এ বেপারে কারো সাথে কোন আলাপ করবে না। পরে সময় হলে আমি নিজে সবাইকে এ বিষয়ে অবগত করবো।”

রেহেনা বেগম- দু দিকে মাথা নাড়িয়ে সম্মিত প্রকাশ করে।
*
*
নিজের রুমে এসে জানালার পাশে বসে দূরের ঐ আকাশের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ঐ নীল আকাশের নিচে কতো মানুষের বসবাস। তাদের মাঝে আমিও একজন যার জীবনটা কেমন যেনো তিক্ত হয়ে গেছে। তবুও আমি আমার পরিবারের জন্য সুখে থাকতে চেষ্টা করবো।

এদিকে নিলুফা বেগম এসে তার কন্যার কাছে নিজের খুশি প্রকাশিত করতে বলে ওঠে,”জানিস রিমশা বিয়ের আলোচনা চলছে শেখ বাড়িতে।”

ইফা ভ্রু কুঁচকে বলে,”ঐ চরিত্রদোষ আলা মেয়ের জন্য সম্বন্ধ আনলো কোন হালায়?”

নিলুফা নিজের মেয়েকে হাতের কনই দিয়ে গুতা দিয়ে বলে,”বেয়াদব মেয়ে, মুখ খুললেই খারাপ কথা বলতে হয় তোর? জানিস কোন বাড়ির সম্বন্ধ এসেছে?”

ইফা তাচ্ছল্যের সাথে বলে,”মেম্বার সাহেবের পোলা ছোট। আর তাছাড়া ঐ মেয়ের জন্য কোন ফকিন্নি বাড়ির সম্বন্ধ আসবে। এতে ডাকঢোল পিটানোর কি আছে?”

নিলুফার বলে,”চেয়ারম্যান সাহেবের কনিষ্ঠ পুত্রের জন্য সম্বন্ধ এসেছে রিমশা’র।”

ইফা দ্রুত মায়ের কাছ থেকে কিছুটা দূরে যেয়ে দাঁড়িয়ে বলে,”ঐ শহরে নানান পুরুষের সাথে মেলামেশা করা মেয়ে না কি চেয়ারম্যান বাড়ির বউ হবে? ওমা কোন ভাবে বিয়েরদিন বউ বদল করে আমাকে ঐ বাড়ির বউ করে দিতে পারবে? তাহলে ঐ মেম্বারের সাথে আমার পরকিয়ার সম্পর্কের ইতি টানবো। ”

নিলুফার নিজের মেয়ের গালে কষিয়ে এক থাপ্পড় দিয়ে বলে ওঠে,”বেয়াদ মেয়ে! যাদের নুন খাচ্ছিস তাদের সাথে বেইমানি করতে বলছিস? একদম বাপের রক্ত তোর শরীরে, এখন আফসোস হয় এতো কষ্ট করেও তোকে মানুষের মতো মানুষ করতে পাড়লাম না। নয়তো তুই মেয়ে হয়ে মায়ের কষ্ট বুঝবি না?”

ইফা বিরক্তির সাথে বলে,”তোমার কষ্ট বুঝি বলেই তো অন্যদের সাথে গভীর প্রেমের সম্পর্ক করে নিজের সকল চাহিদা পূরণ করি। আমি কখনো কোন কিছুর জন্য তোমার কাছে আবদার করি না। জানি তো পরের বাড়িতে কাজ করে তুমি কখনো আমার চাহিদা পূরণ করতে পারবে না।”

নিলুফার কান্না জড়িত কন্ঠে বলে,”হারাম সম্পর্ক গড়ে তুই যে বাহাদুরি করছিস তা দু দিনের। মনে রাখিস বেশি বারা ভালো না! একদিন ঝড়ে ভেঙে পড়বি। তখন একূল ওকূল দু কূল হারিয়ে কান্নায় হবে তোর শেষ সম্বল। ”

মায়ের মুখে এমন কথা শুনে ইফা নিলুফা কে জোড়ে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলেদিয়ে বলে,”তোর মতো মা বেঁচে থাকলে আমাকে সারাজীবন কাঁদতে হবে। ধুর তোর কাছে কিছু আশা করার থেকে নিজেই কিছু বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করি তাহলে হবে।”

বলে হনহন করে সে বাড়ির বাহিরে বেড়িয়ে যায়।



চলবে…