হৃদয়ের সুখ আপনি পর্ব-২৭+২৮(শেষ পর্ব)

0
322

#হৃদয়ের সুখ আপনি
#পর্ব-২৭+২৮(শেষ পর্ব)
#Nishi_khatun

দেখতে দেখতে অনেক গুলো দিন পার হয়ে গেছে।
দাইয়ান শহরে যেয়ে কাজের চাপের জন্য আসতে পারে নাই।
তার যোগ্যতা আর অভিজ্ঞতা দেখে তাকে চাকুরী দিয়েছে। দাইয়ান এখন নতুন চাকুরীতে জয়েন করেছে কিছুদিন যাবৎ।
নতুন চাকুরী থেকে ছুটি নিয়ে আসতে পারছে না।
আবার রিমশা কে ছাড়া থাকতে তার বহুত কষ্ট হচ্ছে।

রোজ কয়েকবার রিমশা’র সাথে তার মুঠোফোনে কথা হয়। তবে সামনে থেকে দুজনে পাশাপাশি বসে হাতে হাত রেখে গল্প গুজব করাতে যে সুখ আছে। তা কি মুঠোফোন দূর করতে পারে?
এখানে কথা হয় সাময়িক সময়ের জন্য।

দাইয়ান তার প্রিয়তমা’র থেকে দূরে থাকাটা মেনে নিতে পারছে না। তা-ই দ্রুত কাজের স্থানের কাছাকাছি একটা ভাড়া বাসা নিয়েছে। তবে সে কথা রিমশা কে জানাবে না। হুট করে একদিন বাড়িতে যেয়ে রিমশা কে সারপ্রাইজ দিবে।

তাছাড়া সে রিমশা কে এই অবস্থায় এখানে নিয়ে আসলে ওর দেখাশোনা করার জন্য একজন বিশ্বত লোকের দরকার হবে। তেমন একজনের ব্যবস্থা আগে করতে হবে তারপর রিমশা কে বাসায় নিয়ে আসতে পারবে।

দাইয়ান তার শ্বশুরের সাথে এই বিষয়ে যোগাযোগ করে।
শাওন শেখ মেয়ের দেখাশোনা করার জন্য সব থেকে বিশ্বস্ত লোক হিসাবে ইফার মা নিলুফার কথা দাইয়ান কে বলে। নিলুফার বেগমের কথা শুনে দাইয়ান একটু দ্বিমত পোষণ করে।

দাইয়ানের কথা হচ্ছে,

–“আমাদের জন্য তার মেয়ের কুকীর্তি গুলো জনসম্মুখে এসেছিল। কোথাও না কোথাও তার মেয়ের মৃত্যুর জন্য আমরা দায়ী। উনি যদি মেয়ের প্রতিশোধ নিতে রিমশা বা বাচ্চার সাথে খারাপ কিছু করে তখন কি হবে?”

শাওন শেখ দাইয়ান কে অনেক কথা বুঝিয়ে বলে!

তারপর উনি বলেন,” নিলুফার অনেক ভালো।
সে রিমশা কে নিজের মেয়ের চোখে দেখে।
আমাদের বিশ্বাস সে রিমশা’র কোনদিন কোন ক্ষতি করবে না। দরকার পড়লে রিমশা’র জন্য সে নিজের জীবন ত্যাগ করবে। আর তোমাদের সাথে থাকলে ওর ভালোই হবে।
একমাত্র মেয়েটা মৃত! তোমাদের সাথে থাকলে রিমশা’র কাজে সাহায্য হবে অন্যদিকে বাচ্চা হওয়ার পর কোন চিন্তা থাকবে না। নিলুফার বাচ্চার দেখাশোনাতে ব্যস্ত থাকবে। ওর শেষ জীবনের দিনগুলো ভালোভাবে কেটে যাবে।”

শাওন শেখের কথায় দাইয়ান রাজী হয়ে যাই।
এরপর সে শ্বশুর কে বলে,
“তাহলে খালাম্মা কে রেডি থাকতে বলবেন। আমি যেদিন রিমশা কে আনতে যাব। ঐদিন তাকে আমাদের সাথে শহরে নিয়ে আসব।”
*
*
মেঘাচ্ছন্ন একটা দিন সকাল থেকেই পরিবেশ গুমোট রুপ ধারণ করে আছে। কিছুদিন হলো রাইসা ভাবী বাচ্চাদের নিয়ে তার বাবার বাড়িতে গেছে। অনেকদিন হলো সে ঐ বাড়িতে যায়নি।
এবার তার এবাড়িতে ফিরে আসার কথা!
তখন তার বাবা- মা একটু দ্বিমত পোষণ করেন।
তাদের কথা বেয়াই -বেয়াইন নিজে এসে তার নাতনীদের নিয়ে যাবে। আমার এমন অবস্থায় তারা আমাকে একলা রেখে যেতে সাহস পাচ্ছে না। ঐ দিকে তাদের বেড়াতে যেতে ইচ্ছা করছে।

তখন আমি নিজেই এগিয়ে যেয়ে বললাম- আম্মা আপনারা সবাই একটু ভাবীর বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসেন। আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। খালাম্মা বাড়িতে থাকবে তো। একদিন আমার দেখাশোনা ন হয় খালাম্মা করবে। তাছাড়া কোন সমস্যা হলে অবশ্যই আপনাদের খবর দেওয়া হবে।
ঝর্ণা আর ইলমার কোথায় বেড়াতে যাওয়া হয়না। এই সুযোগে ওদের একটু বেড়িয়ে আসা হবে। নয়তো আমার বাবু হলে তখন তো আবার সবাইকে ব্যস্ত থাকতে হবে।”

আমার কথায় তারা একটু স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে সকালের দিকে রওনা দেয়।
এদিকে বাড়ির সকলে চলে যাবার পর ঝর্ণার মা বাড়ির সকল কাজ একা হাতে সম্পন্ন করতে হিমশিম খাচ্ছিল।
এতো কাজের ভিড়ে আজকে মেরিনার কাছে তার যাওয়া হয়নি। বিকালের দিকে মেরিনার খাবার রেডি করে খাওয়াতে যাবে ঠিক সে সময় রিমশা তাকে কিছু মেডিসিন আনতে দোকানে পাঠিয়েছে।

এই অসময় প্লেটে খাবার দেখে রিমশা’র বুঝতে বাকি রইলো না এগুলো কার জন্য। রিমশা ভাবলো আমার জন্য খালা তার মেয়েটা কে খাবার খাওয়াতে যেতে পারলো না।
তাহলে আমি না হয় খাবার গুলো মেরিনা কে খাওয়াই দিয়ে আসি।

একটা মানুষিক রোগীর সাহায্য করতে গিয়ে যে বিপদে পড়বে তা কে জানতো?
*
*

ঠিক সেই সন্ধ্যায় চেয়ারম্যান বাড়ির সদর দরজার সামনে এসে দাইয়ান দাঁড়ায়। সেখানে দাঁড়াতে-ই দাইয়ানের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে।

রিমশা’র গলার কাছে ধাঁরালে ছুড়ি ধরে রেখেছে মেরিনা।
সে পাগলের মত জোড়ে জোড়ে প্রলাপ বাক্য আওড়াই বলতে থাকে,

“দান ভাই শুধু আমার। দাদাভাই বলেছে সে শুধু আমার।
তাহলে তুমি কেমন করে দান ভাইয়ের বউ?
দান ভাই এর বাচ্চা শুধু আমার পেটে থাকবে!
তার বাচ্চা তোমার পেটে কেন? আমি এখুনি এই ছুড়ি দিয়ে সুন্দর করে তোমার পেট কেটে আমার বাচ্চাকে বাহির করে নিব। তাহলে দান ভাই এর বাচ্চা আমার হয়ে যাবে।”

তীব্র ভয়ে রিমশা’র শরীরটা পুরো কাঁপাকাঁপা শুরু করেছে। এই মেয়ের কাছে যাওয়া টাই তার কাল হয়ে গেছে। কোন দুঃখে যে এই পাগলের উপকার করতে গেছে।

মেরিনা ধাঁরালো ছুঁড়িটা রিমশা’র গলা থেকে আস্তে আস্তে ওর সাত মাসের ফোলা বড় পেটের উপর আনতেই পেছনে থেকে দাইয়ান ছুটে এসে মেরিনার হাত থেকে ছুড়ি টা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

এদিকে বিদ্ধস্ত রিমশা কে দ্রুত নিজের অবয়বের আড়ালে লুকিয়ে রাখে। তখন দাইয়ান বলে,

“মেরিনা এসব কি হচ্ছে।
তুই এখানে কেন? আর রিমশা’র সাথে কি করছিস তোর কোন হুস আছে? আমার বউ আর বাচ্চার কোন ক্ষতি আমি সহ্য করবো না।”

মেরিনা পাগলের মতো মাথার চুল ধরে টানাটানি করে বলে,

” দান ভাই ঐটা তোমার বউ? তুমি জানো না আমি ছোট থেকে তোমাকে কতোটা ভালোবাসি? তোমাকে আর রিদিকে ভালোবাসি বলে নিজের সব কিছু উজাড় করে দিয়েছি। আমি যদি তোমাকে সত্যি কথা বলি তাহলে তুমি ঐ মেয়েকে ছেড়ে আমাকে আদর করবে? বাচ্চাটা আমাকে দিয়ে দিবেন?”

দাইয়ান উত্তেজিত হয়ে বলে,

“কি সত্যি বলবি তুই?”

মেরিনা একগাল হেসে বলল-

” দান ভাই- আমি রিদির সব অপরাধী কে নিজের এই দুই হাতে খুন করেছি। খুব ভালো কাজ করেছি না বলো? জানো ওদের জন্য আমার রিদি মা মরে গেছে। ওরা রিদিকে আর আমাকে খুব কষ্ট দিছে।
তা-ই আমিও ওদের সব ব্যাথা ফেরত দিয়েছি।”

বলে অট্টহাসি দিতে থাকে।

দাইয়ান আর রিমশা এসব কথা শুনে একদম হতভম্ব।
মেরিনা এসব কি বলছে?

রিমশা তখন পেছনে থেকে আস্তে করে বলে ওঠে,

“এই মেয়েটা কে দেখে বোঝা যাচ্ছে এর মাথায় সমস্যা আছে। তাহলে এই সব খুন এর একার পক্ষে করা কখনোই সম্ভব না। তাহলে কি কেউ মেরিনা কে ব্যবহার করে খুন গুলো করেছে?
যে এমন নিকৃষ্ট কাজ করেছে তাকে কখনো ক্ষমা করবো না।”

ঠিক সে সময় তাদের সামনে মাথা নিচু করে দিরহাম এসে উপস্থিত হয়। রিমশা আর দাইয়ানের আতঙ্কিত চেহারা দেখে সে সব কিছু বুঝে গেছে।

দিরহাম তখন বলে,

“মেরিনা যা বলেছে সাবটাই সত্যি কথা। ঐ জানোয়ার গুলোকে মেরিনা নিজের হাতে জবাই করেছে। কেনো করবে না?
ঐ জানোয়ার গুলো মানব সামাজের যোগ্যছিলো না।। ওরা বেঁচে থাকলে আরো কত রিদি আর মেরিনার সৃষ্টি হবে তার ঠিকানা নেই। আমি মেরিনা কে দিয়ে খুন গুলো করিয়েছি। শয়তান গুলোকে নারী দেহের লোভ দেখিয়ে তাদের রুপসী খালপাড়ে ডেকে আনতাম। তারপর ওদের হাত পা সুন্দর করে বেঁধে মেরিনার হাতে ছুড়ি ধরিয়ে দিয়েছি। মেরিনা হাতে ছুড়ি নিয়ে খুব হিংস্রতার সাথে তাদের খুন করেছে। আমি আর মেরিনা দু জনে মিলে এই সামাজের কীট গুলোকে পরিষ্কার করেছি। একদিক থেকে পাপীদের বিনাশ করেছি অন্যদিকে নিজেদের প্রতিশোধ পূরণ হয়েছে। আমার মেয়ের খুনি আর মেরিনা জীবনটা বিষাক্ত করা কীট গুলো ওপারের বাসিন্দা! ”

দাইয়ান দিরহামের সামনে এসে বলে,

“ভাই তুই কি করে ঐ অসুস্থ মেয়েটাকে এই গুনাহের কাজে শামিল করেছিস? এমন নিকৃষ্ট কাজ কেনো করেছিস? তাও মেরিনা কে দিয়ে?”

দিরহাম খেঁকিয়ে বলে ওঠে,

–“কিসের গুণাহ? ওরা আমার মেয়ে আর মেরিনার সাথে যা করেছে সব কিছু ঠিক ছিলো? আর তোর ঐ আইন পেরেছে জানোয়ার গুলোকে শাস্তি দিতে?
দেখ তোদের ঐ আইনের দৌড়! এতোগুলা খুন হলো তারা খুনির খোঁজ বাহির করতে পারলো না।
শেষ পর্যন্ত তাদের কেস অমীমাংসিত রেখে ক্লোজ করতে হচ্ছে। ”

দিরহাম মেরিনার হাত ধরে দাইয়ানের সামনে দাঁড় করিয়ে বলে,

—“বল, এই মেয়েটার কি দোষ ছিলো? শুধু মাত্র ঐ শয়তানদের শাস্তি দিতে চেয়েছিল! বলে আজ মেয়েটা ভারসাম্যহীন পাগলের লিস্টে। মেরিনা কি ভালো সুখি জীবন ডিজার্ভ করে না? না কি আমাদের বাড়ির আশ্রিত বলে ওর সাথে হওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতাম না? ইলমা যেমন আমার বোন ছিলো ঠিক তেমন ভাবে আমি ঝর্ণা আর মেরিনা কে নিজের বোন ভেবেছি। হ্যা একটু অন্যায়ের আশ্রয় নিয়েছি! পাগল মেয়েটাকে তোর বউ করার স্বপ্ন দেখিয়েছি।
জানতাম ও পাগল হলেও তোর প্রতি দুর্বল। আর সেই দুর্বলতা কে হাতিয়ার করে আমি মেরিনা কে দিয়ে খুন গুলো করিয়েছি।

তবে ভাগ্য খুব খারাপ। আজ তোর বউ যদি যেচে মেরিনার কাছে না যেতো তাহলে এই দিনটা কখনোই আসত না।
তোর বউ পণ্ডিতি করে খালাকে মেডিসিন কিনতে দোকানে পাঠিয়েছে, আর এদিকে মেরিনার জন্য খাবার নিয়ে যায়। উপকার করতে গেছিলো ভালো কথা!
বড়াই করে নিজের পরিচয় দিতে গেছে কেন?
আমি দাইয়ানের বউ আর এই যে ফোলা পেটের মধ্যে দাইয়ানের বাবু আছে।
আজকে মেরিনার হাত পা বাঁধা ছিলোনা।
তাই সে এসব কথা শুনে রিমশা কে মারতে তাড়া করে।
আমি সেখানে ছিলাম রিমশা কে দেখে আড়ালে লুকিয়ে গেছি। মেরিনা তার বিছানার নিচের ছুড়ি নিয়ে রিমশা কে তাড়া করে। আমি কোন খারাপ কিছু আন্দাজ করেছিলাম। কিছুসময় পর বাড়িতে এসে দেখি তুই। এরপর বাকিটা তুই ভালো জানিস।”

দাইয়ান এতসব কাহিনী শুনে স্তব্ধ। সে কি সব সত্যি জেনেও চুপচাপ থাকবে? নাহ ভাইয়ের করা অন্যায় তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না।

এদিকে দিরহাম মেরিনার হাত ধরে তাকে জলদী করে তার স্থানে রেখে আসে। সে চাইছে না অন্যকারো দৃষ্টিতে মেরিনা আসুক।

রিমশা দাইয়ানের বুকের মাঝে মুখ গুঁজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। আজকে যদি সে সঠিক সময় মতো না আসতে তাহলে হয়তো তার জীবন এখানেই শেষ হয়ে যেত।

কিছু সময়ের মধ্যে বাড়িতে সকলে এসে উপস্থিত হয়।

সবাইকে দেখে দাইয়ান রিমশা কে নিয়ে তার রুমে চলে যায়।
দাইয়ানের এমন ব্যবহারে সকলে স্তব্ধ।
#হৃদয়ের_সুখ_আপনি
#পর্ব-অন্তিম পর্ব
#Nishi_khatun

দাইয়ান রিমশা কে নিজেদের রুমের ভেতরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। এরপর রিমশা কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দেয়। পুরুষ মানুষদের না কি কাঁদতে মানা আছে!
এ কথা কে বলেছে? তারাও মানুষ।
তাদেরও কষ্ট অনুভব হয়।

রিমশা দাইয়ানের মাথায় হাত বু্লিয়ে দিয়ে বলে,

–“দেখেন আমাদের ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস!
আমরা যাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য নিজেদের সাজানো
জীবন কতোটা এলোমেলো করেছি। তবে আজ জানতে পারছি আমাদের কাছের মানুষেরা নিজেদের হাতে আইন তুলে নিয়েছি। পরিস্থিতি আজ আমাদের এমন স্থানে দাঁড় করিয়েছে! যেখানে থেকে আমাদের যা করতে হবে ভেবে চিন্তে করতে হবে! হুটহাট এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। যার প্রভাব আমাদের আশেপাশের সকলের উপরে পড়বে। ”

দাইয়ান বলে,

–“এসব সত্যি জানার পর আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি কিছুই ভাবতে পারছি না।
মেরিনা ছোট থেকে আমাকে দান ভাই বলে ডাকে।
আজ সেই মেরিনা আমার স্ত্রী’র জন্য বিপদ হয়ে গেছে। সে তোমাকে খুন করতে এসেছিল। এই কথা মনে পড়তেই আমার কলিজায় মোচড় দিয়ে উঠে।”

রিমশা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে বলে,

—“আমার মনে হয়না মেরিনা আর ভাইয়া মিলে এসব খুন করেছে। আমার মনে হয় ভাইয়ার সাথে আরো কেউ জড়িত আছে। আবার এমনটাও হতে পারে সে এসবের সাথে জড়িত নাই। আসল খুনি কে বাঁচানোর জন্য আমাদের সামনে সাজিয়ে গুছিয়ে মিথ্যা কথা বলছে। নয়তো তুমি ভাবো ভাইয়া এতো অপেক্ষা কেন করবে? মেরিনা আমার উপর হামলা করবে তার জন্য?”

দাইয়ান বলে,

—“তোমার কথায় কিন্তু লজিক আছে।
তবে আমাদের কি করা উচিৎ বলে তোমার মনে হয় বলবে? আমি কিছুই ভাবতে পারছি না।”

রিমশা তখন বলে,

–“আসামী রুপে আজকে যারা সামনে এসেছে,
তারা সকলে আমাদের আপন মানুষ।
ইচ্ছা করলেই তাদের শাস্তি দিতে পারবোনা।
হ্যা! মানছি, তাদের রাস্তা ভুল ছিল।
তবে ঐ সমস্ত জানোয়ারদের প্রাপ্য শাস্তি তাদের দিয়েছে। তাছাড়া দেখো আমরা তাদের আইনের হাতে তুলে দিলে ঠিকি তারা একদিন মুক্ত হয়ে যেত।
তাছাড়া তারা কোন সৎ ব্যাক্তি ছিলো না।
যে তাদের খুন হয়েছে বলে আমরা ঐ ভুক্তভোগী মেয়ে হারা বাবা কে পুলিশের হাতে তুলে দিব।
যেখানে পুলিশ নিজে হার মেনেছে!
সেখানে আমরা কেনো নাক গলাতে যাব?
সব কিছু যে ভাবে চলছে, সে ভাবে চলতে দাও না।
হয়তো দেখা যাবে এসবের পেছনে ইলমা অথবা ঝর্ণা’র হাত আছে! আবার হয়তো ভাবী, বাবা- মা, তারা জড়িত থাকতে পারো। এসব যদি সত্যি হয় তাহলে সকলের জীবন নষ্ট হবে। তাছাড়া আমার মনে হয়।
যদি ভাইয়া এসবের মাস্টার মাইন্ড হয়ে থাকে,
তাহলে উনি খারাপ কোন কিছু করে নাই।
সমাজের ঐ বিষাক্ত কীট গুলোকে উপড়ে গ্রামটা কে নতুন জীবন দান করেছে। ওদের এমনিতে বেঁচে থাকার কোন অধিকার ছিলো না। তাছাড়া এতো জলঘোলা করে কোন লাভ নাই। যারা যেভাবে আছে তাদের সেভাবে থাকতে দেওয়া উচিৎ। ”

রিমশা’র সমস্ত কথা শুনে দাইয়ান মাথা নিচু করে বসে থাকে।
রিমশা দাইয়ান কে উদ্দেশ্য করে আর কিছুই বলে না ।
থাক না কিছু সময় মানুষটা একটু নিরবে।
নিজের সাথে নিজেই একটু যুদ্ধ করুক।
তারপর তা যা ইচ্ছে হয় সিদ্ধান্ত নিবে।

সে রাতে দুজনে আর খাবার খেতে রুমের বাহিরে যায়নি। সকলের থেকে দূরে একটু নিজেদের সময় দিয়েছে।
*
*
পরেরদিন সকালে রিমশা তার সমস্ত প্রয়োজনী সামগ্রী গুছিয়ে প্যাকিং করে রাখে। দুজনে রেডি হয়ে বাড়ির উঠানের এসে দাঁড়ায়। দিরহাম ভাবে হয়তো দাইয়ান সকলের উদ্দেশ্যে তার আর মেরিনার কথা বলবে।

তবে দিরহাম কে অবাক করে দাইয়ান সকলের উদ্দেশ্যে
বলে ওঠে,

“আমি রিমশা কে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে এসেছি।
তোমাদের রিমশা’র চিন্তা করতে হবে না।
শহরে ওর দেখাশোনা করার জন্য ব্যবস্থা করা আছে।
তা-ই তোমরা আমাদের দুজনকে যাওয়ার অনুমিত দাও।”

হুট কে ছেলের এমন ব্যবহারে বাড়ির সকলে বিচলিত হয়।
তবে তারা কোন প্রতিক্রিয়া করে না।
স্বামী -স্ত্রী একসাথে থাকবে সেখানে দ্বিমত করার কোন মানে হয় না।
তাই সকলে তাদের দু জনকে যাওয়ার অনুমিত দিয়ে দেয়।

আসার সময় দাইয়ান আর দিরহামের চোখাচোখি হতেই দিরহাম নিজের দৃষ্টি নত করে রাখে।
দাইয়ান কোন প্রতিক্রিয়া করে না।
রিমশা সকলের কাছ থেকে অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পরে তাদের স্বপ্নিল এক দুনিয়ার উদ্দেশ্য।

আসার পথে যখন দাইয়ান নিলুফার কে তাদের সাথে নিয়ে আসে তখন রিমশা একটু ঘাবড়ে যায়।

মায়ের কাছে সন্তান কখনো খারাপ হতে পারে না।
সেখানে ইফার মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে উনি যদি তাদের কোন ক্ষতি করে বসে?

দাইয়ান রিমশা’র মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তাকে বলে,

–“দেখো উনি মানুষটা অনেক ভালো।
তাছাড়া যে মা, মেয়ের কুকর্মের কথা জানতে পেরে মৃত মেয়ের লাশটা কে বেওয়ারিশ বলে গণ্য করে।
সেই জনমদুখিনী মা কখনো কারো সাথে খারাপ কিছু করতে পারে না। তোমার বাবা- মা তাকে বিশ্বাস করে পাঠিয়েছে। বাবা- মা’র বিশ্বাসের উপর আমাদের একটু ভরসা রাখা উচিৎ।”

এরপর মনে আর কোন সংশয় না রেখে দাইয়ানের হাত ধরে নতুন সংসারের যাত্রা শুরু করে।

সকালে দাইয়ান বেড়িয়ে যায় বিকালে বাসায় ফিরে আসে। সন্ধ্যায় দুজনে একটু বাহিরে ঘুরাঘুরি করে রাতে বাসায় ফিরে আসে।

এদিকে বাচ্চা প্রসবের সময় যতো ঘনিয়ে আসছে রিমশা’র শরীরটা খারাপ হচ্ছে। নিলুফার রিমশা’র এমন অবস্থার কথা শাওন শেখ কে অবগত করতেই, তারা দুজনে মেয়ে জামাই- এর কাছে চলে আসে।

তাদের আসার কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন ভোরে রিমশা’র প্রসব বেদনা শুরু হয়। দাইয়ান দ্রুত রিমশা কে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে যাবার কিছুসময় পর রিমশা নরমাল ডেলিভারির মধ্যমে ফুটফুটে এক রাজপুত্রের জন্ম দেয়।

নার্স যখন বাবুকে এনে দাইয়ানের কোলে তুলে দেয়।
ছেলেকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে পরম সুখে চোখের অশ্রু বিসর্জন দেয়। সে বাবা হয়েছে! তার সন্তান সুস্থ আছে এটাই অনেক।

নার্স বলে,”আপনার স্ত্রী সুস্থ আছে!
বিকালের দিকে তাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন। ”

বিকালে দাইয়ান রিমশা কে হাসপাতালে থেকে বাসায় নিয়ে চলে আসে।

গ্রামে খবর যেতেই দিরহাম আর রাইসা বাদে সকলে এসে রিমশা কে দেখে যায়।

এদিকে বাবুর সকল দেখাশোনা নিলুফার নিজেই করে।
বাবুর কোন কাজ রিমশা কে করতে দেয় না।
এই জন্য বার বার রিমশা দাইয়ানের কাছে বিচার দিতে থাকে।

দাইয়ানের কথা বাবুর দেখাশোনা করার জন্য যখন নানিমা আছে। তখন তোমার এতো চিন্তা কিসের?
বাচ্চা বড় হচ্ছে তুমি বাচ্চার চিন্তা ছেড়ে বাচ্চার
বাবার চিন্তা করা শুরু করে দাও।

রিমশা বলে,
–“এক ছেলের বাবা হয়ে গেছেন তবুও কথার গতি ঠিক হলো না। বাচ্চার বাবার এতো রোমান্টিক হতে নাই।”

দাইয়ান বলে,

–“যাহ বাবা! রোমান্টিক না হলে আমার আরো ছেলে-মেয়ের জন্ম হবে কি করে? তুমি নিরামিষ হতে পারো, আমি নিরামিষ না বুঝলেন মিসেস?”

রিমশা দাইয়ানের পিঠে কিল ঘুশি দিয়ে বলে,
“ধুর আপনি জীবনে বদলাবেন না। ”

দাইয়ান রিমশা’র হাত ধরে সামনে এসে আলিঙ্গন করে বলে,

–“আরে জীবনে সব থেকে বড় পাওয়াটা কি জানো?
স্বামী স্ত্রী’র মধ্যে সম্মান আর বিশ্বাস থাকতে হবে দুজনের প্রতি। যতো- সমস্যা হোক তৃতীয় কাউকে মাঝে আনা যাবে না।
যদি কখনো সম্পর্ক থেকে মনের শান্তি না পাও!
তাহলে দুজনে একটু সময় নিয়ে আবারো নতুন ভাবে শুরু করা দরকার । সব থেকে বড় কথা হচ্ছে সারাজীবন একসাথে থাকবে এমন মানুষিকতা রাখতে হবে। তাহলে দেখবে দুজনের মাঝে কখনো কোন সমস্যা হলেও তার সমাধান ঠিক বেড়িয়ে আসবে। আজকাল সকলে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সম্পর্কে কোন সমস্যা দেখা দিলে সে সম্পর্ক ভাঙ্গতে তৎপর হয়ে যায়। এভাবে কখনো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। তাই বিয়ের সময় মন-মানুষিকতা একদম দৃঢ় রাখবে! যার সাথে পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছি! তার সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ একটা সম্পর্ক বজায় রেখে সারাজীবন চলতে হবে।”

রিমশা মুগ্ধ নয়নে দাইয়ানের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবতে থাকে, “এই লোকটাকে যতো দেখি ততোই মুগ্ধ হতে থাকি।
আর বারংবার তার প্রেমে পরতে বাধ্য হচ্ছি।
একজনের প্রেমে বারবার পড়াতে মজা আছে।
এটাই আসল ভালোবাস। এখানে মনের তৃপ্তি। ”
*
*
এদিকে নিলুফার খালা বাবুর দেখাশোনা করে।
আর আমরা দুজনে এখন চুটিয়ে প্রেম করছি।
কে বলে বিয়ের পর বাচ্চা হলে প্রেম পালিয়ে যাই?
সব কিছু নিজেদের উপর ডিপেন্ড করে।

রোজ সকালে নাস্তা রেডি করে তাকে নিজ হাতে খাওনো। দুপুরবেলা সে আসে না। তাকে অবগত করে একসাথে লাঞ্চ করি। রাতের বেলাতে সে নিজের খারাবের অর্ধেকটা আমাকে খাওয়াই দেয়।

সম্পর্কে ভালোবাস ধরে রাখার জন্য আর কি চাই?
প্রতিদিন রাতে রাত তার বুকে মাথে রেখে ঘুমানোর মাঝে এক প্রশান্তি আছে। বাচ্চার জন্য রাত জাগতে হলে দু জনে একসাথে জেগে থাকি।

এইভাবে আমাদের টোনাটুনির সুখের সংসার কেটে যাচ্ছে।
আমরা আর কখনো গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাইনি।
তবে তারা মাঝেমধ্যে চলে আসে আমাদের সাথে দেখা করতে।
এরপর আর কখনো মেরিনার খবর নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি নাই। সে থেকে গেছে লোক চক্ষুর আড়ালে।
দিরহাম ভাইয়ার সাথে আমাদের কথা না হলেও ভাবীর সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে।

ছেলেটা আমাদের বড় হয়েগেছে। আমি আজকাল নানারকম নারীদের উন্নয়নমুখী কাজ করছি। নানারকম সংস্থার সাথে জড়িত। গ্রামের গরীব দুঃখী নারীদের উন্নত জীবনযাপনের ব্যবস্থা করি।

আমার জীবনের সব থেকে বড় প্রাপ্তির নাম দাইয়ান।
ঐ লোকটাকে ছাড়া আমার পুরো জীবন বৃথা।
আমার তাকে দিনের শুরুতে আর শেষে লাগবেই।
আমি আর সে আলাদাভাবে কখনো সুখে থাকতে পারবো না।
প্রেম ভালোবাসা একটা সময় কমে আসে। দায়িত্ব বোধ,
কাজের চাপ, নানারকম ভবিষ্যৎ চিন্তা মানুষকে একটা সময় গ্রাশ করে নেয়।

তখন ভালোবাসা টা বেস্বাদ লাগতে থাকে।
তবে একটা জিনিশ যা কোনদিন বেস্বাদ হবে না।
তা হচ্ছে আপনি যেখানে মনের তৃপ্তি খুঁজে পাবেন।
আমার মানুষিক শান্তির স্থান, আমার হৃদয়ের সুখ আমার স্বামীর নিকটে। কী যে এক প্রশান্তি তার সান্নিধ্যে তা অনুভব করা যায় ভাষাতে প্রকাশ করা সম্ভব না।
সব সময় রোমান্টিক আর রোমান্সে ভরপুর ব্যক্তিগত জীবন নাও হতে পারে। রোমান্টিক আর রোমান্সে ভরপুর পুরুষ অথবা নারী সবসময় হৃদয়ের সুখ আপনি হতে পারে না।
যে মানুষকে মানুষিক শান্তির ভাণ্ডার, বিশ্বাসের অপর নাম, মনের তৃপ্তি দান কারী মনে হয়। সেই আসলে #হৃদয়ের_সুখ_আপনি হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
আর আমার হৃদয়ের সুখ আপনি সারাজীবন আমার স্বামী থাকবে। এটা কখনো তার নিকটে ব্যক্ত করা হয় না।
এভাবে আমরা জীবনে অনেক গুলো বছর অতিবাহিত করেছি। হয়তো শেষ সময়টা ঘনিয়ে আসবে এভাবে।

ভালো থাকুক ঐ ভালোবাসা গুলো যেগুলো কখনো ধুমধাম করে প্রকাশিত হয় না। নিরবে দুটি মানুষের চোখের ভাষাতে থাকে। দুজনের পাশাপাশি হাত ধরে থাকার মাঝে থাকে।
জীবনটা সব সময় সাজানো গোছানো থাকে না।
তাকে দুটি ব্যক্তির সম্মতিক্রমে সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়।

~~~~~~~~সমাপ্ত ~~~~~~~