হে সখা মম হৃদয়ে রহো পর্ব-২৩+২৪

0
273

#হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
#পর্ব ২৩

ঘড়ির কাঁটায় তখন সকালে দশটা।পিচঢালা শহুরের ব্যস্ত রাস্তায় শো শো করে ছুটে চলেছে গাড়ি।গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে আছে সংকল্প।তার পাশে প্রতিজ্ঞা।সংকল্পের দৃষ্টি গাড়ির উইন্ডশিল্ডের মাধ্যমে রাস্তায় নিবদ্ধ।মনে হচ্ছে খুব মনোযোগ দিয়ে গাড়ি চালাতে ব্যস্ত সে।চেহারা শান্ত,নির্লিপ্ত।বুঝার উপায় নেই কি খেলা করছে তার মাথায়।প্রতিজ্ঞা সিটে মাথা হেলান দিয়ে রেখেছে।তার দৃষ্টি বাহিরের ব্যস্ত রাস্তা, ব্যস্ত শহুরে। চেহারায় মলিনতার ছাপ।তাদের গন্তব্য প্রতিজ্ঞাদের বাড়ি।অনেকটা সময় পর গাড়ি এসে থাকে দোতালা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে।পুরো রাস্তায় তাদের মধ্যে একটা কথাও হয় নি।রাস্তা বললে ভুল হবে,গতকাল রাত থেকেই আর কথা হয় নি।গাড়ি থামিয়েই সংকল্প সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইলো।প্রতিজ্ঞা একবার তাকালো সংকল্পের দিকে।সংকল্প কিছু বলবে সেই আশায়।কিন্তু তার আশা ভেঙ্গে দিলো সংকল্প। কিছু বলা তো দূর তাকালোই না।ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো প্রতিজ্ঞার।দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে সে নামলো গাড়ি থেকে।পা বাড়াতে নিলেই কর্ণকুহরে ভেসে এলো পুরুষালী ভারী কন্ঠস্বর,

“দূরে থাকতে চেয়েছো,থাকতে দিচ্ছি,দিবো।তবে সেটা বেশিদিনের জন্য নয়।আমার কাছেই ফিরতে হবে তোমায়।মনে রেখো,তোমার শেষ গন্তব্যস্থল আমি।ঘুড়ি,তুমি শুধু আমার আকাশেই বিচরণ করবে।অন্য কারো আকাশে বিচরণ করার মতো ভুল করো না।তাহলে ঘুড়ির সুতা ছিড়ে ফেলতে আমি দু’বারও ভাববো না।ভুলে যেও না লাটাই আমার হাতে ছিলো,আছে আর থাকবে।”

প্রতিজ্ঞা পিছু ফিরে কিছু বলতে যাবে তার আগেই গাড়িটা সর্বোচ্চ স্পিডে জায়গা ত্যাগ করলো।প্রতিজ্ঞা বুঝতে পারলো না এমন কথা কেনো বললো সংকল্প।তৃতীয় ব্যক্তির কথা আসলো কোথা থেকে।বুঝে নিলো সংকল্পের কাছ থেকে দূরত্ব চাওয়ায় হয়তো সংকল্প তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে আছে।এসব ভাবতে ভাবতেই বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো প্রতিজ্ঞা। ড্রয়িংরুমে তাসলিমা বেগমের মুখোমুখি হলো।পাশে নাদিয়া দাঁড়ানো। নাদিয়ার চোখে খুশীর ঝলক।তবে শাশুড়ীর সামনে প্রকাশ করতে পারছে না।সে জানে শাশুড়ী রেগে আছে অনেক।প্রতিজ্ঞা এড়িয়ে যেতে চাইলো। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় পা থেমে গেলো মায়ের ভারী কন্ঠে।তাসলিমা বেগম কঠিন স্বরে বললেন,
“কোথায় ছিলে দুইদিন?”

প্রতিজ্ঞা তাকালো মায়ের দিকে।স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“কোথায় ছিলাম সেটা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়।”

তাসলিমা বেগম মেয়ের এমন ত্যাড়া উত্তরে অপ্রসন্ন হলেন। ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,
“আমি তোমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছি।”

প্রতিজ্ঞা ঠান্ডা স্বরে বললো,
“সংকল্পের সাথে ছিলাম।”

তাসলিমা বেগম ক্ষিপ্রতা বজায় রাখলেন।ক্ষিপ্ত স্বরেই বললেন,
“তুমি কেনো ঐ ছেলের সাথে গেলে?ঐ ছেলে তোমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলো, ভুলে গেছো?এর আগের কথা ভুলে গেছো তুমি?দুই বছর কি কি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছো ভুলে গেছো?কিভাবে থাকলে?আত্মসম্মানবোধ নেই তোমার?”

প্রতিজ্ঞার ইচ্ছে করছে না তর্ক করতে।সে তাকিয়ে রইলো মায়ের দিকে।রাগ তরতর করে বাড়লেও প্রকাশ করলো না।স্বাভাবিকভাবেই বললো,
“কিছুই ভুলি নি।সেটা একান্তই আমার ব্যাপার।তুমি নাক গলাবে না।”

তাসলিমা বেগম রাগান্বিত স্বরে বললেন,
“এতোদিন নাক গলাই নি।এখন গলাবো।তোমাকে তো ভেসে যেতে দিতে পারি না।আমি এই বিয়ে মানি না।তুমি এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসবে।এই সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই।তোমাদের কাছেও নেই,আমার কাছেও নেই।তোমাদের কাছে মূল্য থাকলে এভাবে আলাদা থাকতে পারতে না।বিয়ে ছেলেখেলা নয়।তানিমের অফিসের ওউনার কালকে বাড়িতে আসবে।তুমি তৈরী থেকো।”

প্রতিজ্ঞা বিস্ফোরিত চোখে মায়ের দিকে তাকালো।একটু আগে সংকল্পের বলা কথাগুলোর সাথে এই কথাগুলোর সংযোগ রয়েছে বুঝতে পারলো।সংকল্প আগে থেকে জানতো বলেই বারবার এই কথা বলেছে,বুঝতে সময় লাগলো না প্রতিজ্ঞার।এখন আর মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না।কিছু বলতে যাবে তার আগেই,তাসলিমা বেগম বললেন,
“আমি কিছু শুনতে চাই না।আমার কথা-ই শেষ কথা।”

প্রতিজ্ঞা ক্ষিপ্তস্বরে বললো,
“মুডটা ভীষণ খারাপ,তাই কিছু বললাম না…”

নাদিয়া বুঝলো পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।সে প্রতিজ্ঞাকে নিয়ে ঘরে চলে গেলো।প্রতিজ্ঞা বাঁধা দিলো না।তারও এসব ঝামেলা ভালো লাগছে না।মনে শান্তি না থাকলে পুরো দুনিয়া বি ষা ক্ত লাগে।ভালো কথাও বি ষের মতো লাগে।সুন্দর ভাবে জীবন কাটানোর জন্য মানসিক শান্তি বড্ড বেশিই প্রয়োজন।

নাদিয়া প্রতিজ্ঞাকে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো।বিছানার উপর বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
“চলে এলে কেনো?থেকে যেতে পারতে তো।”

প্রতিজ্ঞা তাকালো নাদিয়ার দিকে।স্বাভাবিকভাবেই বললো,
“একটু শা স্তি দেওয়া প্রয়োজন উনাকে।একটু কষ্ট পাক।ওনার বুঝা উচিত,” দেখ কেমন লাগে!”।”

প্রতিজ্ঞার বলার ভঙ্গিমা দেখে শব্দ করে হেসে ফেললো নাদিয়া।প্রতিজ্ঞা চেয়ে আছে হাসির দিকে।তার মুখেও হাসির ঝলক।মায়ের কথা সে এক কান দিয়ে ঢুকিয়েছে,অন্য কান দিয়ে বের করেছে।এসব অসম্ভব রকমের কাজগুলো জীবনেও হওয়ার নয়।পৃথিবী উল্টে যাক,তবুও সংকল্প প্রতিজ্ঞার থাকবে।এর অন্যথা হবে না।

নাদিয়া হাসতে হাসতে বললো,
“বাহ বাহ!প্রতিজ্ঞারাণী রিভেঞ্জ নিতে চায়!গুড গুড!”

প্রতিজ্ঞা ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,
“রিভেঞ্জ না ভাবী।একটু টাইট দিতে চাই।এতটুকুই!উনার উপর রিভেঞ্জ নেওয়ার সাধ্য আমার নেই।এসব ভাবার আগেই আমার মরণ হোক!”

নাদিয়া এমন উত্তরে প্রসন্ন হলো।সে ভাবুক হয়ে বললো,
“উমমম,তাহলে একটা ঝাক্কাস প্ল্যান আছে।”

প্রতিজ্ঞা কৌতুহলী হয়ে চোখ সরু করে তাকালো নাদিয়ার দিকে। আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাস করলো,
“কি প্ল্যান?কাজে আসবে তো?”

নাদিয়া হেঁসে বললো,
“কাজে আসবে না মানে!দৌড়াবে।”

প্রতিজ্ঞা উৎসুক হয়ে বললো,
“তাহলে তাড়াতাড়ি করে প্ল্যানটা বলে ফেলো তো।আমার আবার উনার থেকে দূরে থাকতে কষ্ট হচ্ছে।”

শেষের কথাটা নাক টেনে টেনে বললো প্রতিজ্ঞা।পরে দু’জনে একসাথে হেসে উঠলো।

নাদিয়া সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসলো।হালকা কেশে গলা ঠিক করে নিলো।প্রতিজ্ঞা চোখ ছোট ছোট করে দেখছপ তাকে।নাদিয়ে বলতে শুরু করলো,
“কালকে যে তোমাকে দেখতে আসবে, তুমি তাতে রাজি হয়ে যাও।”

প্রতিজ্ঞার আগ্রহে,কৌতুহলে এক বালতি পানি ঢেলে দিলো নাদিয়া।তার মুখটা চুপসে গেলো।রেগে বললো,
“অসম্ভব।কিসব বলছো তুমি!”

নাদিয়া বললো,
“আরেহ শুনো।তুমি তো অভিনয় করবা।এই নিউজটা সংকল্প জানলে কেমন হবে বলো তো?তোমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে,তুমি কোনো বাঁধা দাও নি,তুমি সম্মতি দিয়েছো।এটার থেকে বেশি ভালো টাইট তুমি দিতে পারবে?তাও কম সময়ে?”

প্রতিজ্ঞা চুপ করে রইলো। ভাবলো কিছুক্ষণ।নাদিয়ার কথাটা ঠিক।একটু না অনেক বেশিই টাইট দেওয়া যাবে সংকল্পকে।ভাবতেই ক্রুর হাসি হাসলো প্রতিজ্ঞা।নাদিয়াকে খুশিতে জড়িয়ে ধরে বললো,
“এতো সুন্দর বুদ্ধির জন্য এত্তোগুলা ভালোবাসা,ভাবী।উম্মাহ!”

ঘড়ির কাঁটায় রাত নয়টা।খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে সবে মাত্র সবাই নিজ নিজ ঘরে গিয়েছে।প্রতিজ্ঞা নিজের ঘরেই খাবার খেয়েছে।বাড়ির লোকের মুখোমুখি হতে চায় নি সে।ভালো লাগে না তার।শান্তি নেই মনে।তখনই তানিম দরজায় নক্ করলো।প্রতিজ্ঞা বিছানায় বসে ছিলো।তানিম ঘরে বসতেই সে উঠে দাঁড়ালো। তানিম হাসিমুখে বোনের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বিছানায় বসলো।প্রতিজ্ঞা জানে ভাই কেনো এসেছে।তবুও প্রকাশ করলো না।দেখছে ভাই কেমন উশখুশ করছে।প্রতিজ্ঞা ঠান্ডা গলায় বললো,
“কিছু বলবে ভাইয়া?”
তানিম তাকালো।ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
“কেনো এমনিতে আসতে পারি না তোর ঘরে?”

প্রতিজ্ঞা নির্লিপ্তভাব নিয়ে বললো,
“তা পারো।তবে এখন কোন কারণে এসেছো সেটা আমি জানি।ভণিতা না করে বলে ফেলো।”

তানিমের মুখের হাসি চুপসে গেলে।ভণিতা ছাড়াই বললো,
“আমার স্যার অনেকদিন যাবৎ আসতে চাইছেন।কালকে আসতে বলেছি,তুই না করিস না।”

প্রতিজ্ঞা চমৎকার হাসলো।তানিম অবাক হয়ে গেলো।সে বুঝলো না এই হাসির মানে।কারণও জানলো না।সে তো ভেবেছিলো এখন প্রতিজ্ঞা রাগ করবে,চেঁচামেচি করবে।কিন্তু এসবের কিছুই হলো না।সেও আর মাথা ঘামালো না।এখন শুধু উত্তরের অপেক্ষায় রইলো।

প্রতিজ্ঞা স্বাভাবিকভাবেই বললো,
“সমস্যা নেই,উনাদের আসতে বলো।আমি যাবো ওনাদের সামনে।”

#চলবে…

#হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
#পর্ব ২৪

সূর্যালোকের তীব্র তাপদাহে অতিষ্ঠ ধরণীতল।তবে বাড়ির ভেতরে এসি থাকার কারণে সূর্যের তাপ বাড়ির ভেতরে তেমন প্রভাব ফেলতে পারলো না।সূর্যের হার মানতে হলো এই কৃত্রিম যন্ত্রটার কাছে।ড্রয়িং রুমে বসে আছে তানিমের অফিসের বস সেলিম খান,তার স্ত্রী মাহফুজা বেগম, তাদের একমাত্র ছেলে আকাশ খান।এই আকাশ-ই প্রতিজ্ঞার সেই বন্ধু আকাশ।তাদের পাশে বসে আনোয়ার সাহেব মুখ গোমড়া করে বসে আছেন।বুঝা যাচ্ছে স্ত্রী এবং ছেলের এমন কাজে তিনি অপ্রসন্ন।তাসলিমা বেগম এবং তানিম সবাইকে সঙ্গ দিচ্ছেন।আপ্যায়নে ব্যস্ত তারা।প্রতিজ্ঞা এখনো ঘরে।সবাই হাসি-খুশি আলোচনায় ব্যস্ত।আলেচনার এক পর্যায়ে মাহফুজা বেগম হাসি মুখে বললেন,
“প্রতিজ্ঞাকে ডেকে আনুন।দেখি তাকে,কথা বলি ওর সাথে।”

তাসলিমা বেগমও তাতে সম্মতি দিলেন।নাদিয়াকে বললেন,
“প্রতিজ্ঞাকে নিয়ে আসো।”

নাদিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে প্রতিজ্ঞাকে আনতে উপরে চলে গেলো।

আয়নার সামনে বসে আছে এক বাইশ বছর বয়সী সুন্দরী কণ্যা।পরনে তার নীল শাড়ী।কোমড় অব্ধি চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া,ঘন অক্ষিপল্লবের সৌন্দর্য আরো কয়েক ধাপ বাড়িয়ে দিলো গাঢ় করে দেওয়া কাজল।গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁটগুলোয় হালকা কৃত্রিমতার ছোঁয়া।আরো সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য হালকা গহনা যথেষ্ট।কণ্যা নিজেই নিজেকে দেখছে,এতো সুন্দর করে শেষ কবে সেজে ছিলো তার মনে নেই।আগে তো ভাবতো,বিয়ের পর প্রতিদিন শাড়ী পরবে,আর প্রতিদিন সংকল্পের কাছে নিত্যনতুনরূপে ধরা দিবে।সংকল্পকে চমকাবে।প্রতিদিন নতুন নতুন উপায় অবলম্বন করে সংকল্পকে উপলব্ধি করাবে যে, “পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী নারীটা তার অর্ধাঙ্গিনী।এই নারীর হৃদকোটরে বসবাস সংকল্প নামক এক নির্লিপ্ত পুরুষের।”
ভাবতেই অধর প্রসারিত হলো প্রতিজ্ঞার।পরক্ষণেই চেহারায় আঁধার ঘনিয়ে এলো। আচমকা এসে যাওয়া এক ঝড়ের কথা মনে পড়লো।যে ঝড় এক দমকা হাওয়ায় সবকিছু উলটপালট করে দিয়েছিলো।ঝড় দুই বছর আগে শেষ হলেও তার রেশ থেকে গেছে।ক্ষয়ক্ষতির ছাপ এখনো রয়ে গেছে।তবে ক্ষয়ক্ষতি এবার দায়িত্ব নিয়ে ঠিক করার পালা।

“মাশাআল্লাহ,আমার ননদিনীকে আজকে এতো সুন্দর লাগছে।সংকল্প দেখলে তো চোখ ফেরাতে পারবে না।”

প্রতিজ্ঞার ভাবনার সুতো ছিড়ে নাদিয়ার কথায়।লজ্জারা ঘিরে ধরে তাকে।নাদিয়া পেছন থেকে প্রতিজ্ঞার কাঁধে হাত দিয়ে আয়নায় প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার সামনে লজ্জা পেতে হবে না।স্বামীর সামনে লজ্জা পেয়ো।লজ্জারা কাজে আসবে তখন।”

প্রতিজ্ঞার গাল রক্তিম বর্ণে ধারণ করতে সময় লাগলো না।মেকি রাগ দেখিয়ে বললো,
“ধ্যাত ভাবী।মজা নিও না তো।”

নাদিয়া হাসলো।বললো,
“আচ্ছা যাও,মজা নিবো না।তোমাকে ডাকছে, নিচে চলো।”

নিচে যাওয়ার কথা শুনে প্রতিজ্ঞার চেহারায় চিন্তার ছাপ দেখা দিলো।চিন্তার স্বরে বললো,
“সংকল্প আসবে তো?”

নাদিয়া আহ্লাদী হয়ে বললো,
“আসবে আসবে।না এসে যাবে কই!”

দু’জনে নিচে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো।

ড্রয়িং রুমে সবাই খোশমেজাজে আলোচনায় ব্যস্ত।তখনই একে একে বিশজন অপরিচিত পুরুষ-মহিলা হাতে এতো এতো তত্ত্ব নিয়ে প্রবেশ করতে শুরু করলো।শাক-সবজি থেকে শুরু করে নানা প্রকারের বড় বড় মাছ,ফল-ফলাদি, মিষ্টি,কাপড় সব কিছুই রয়েছে তাতে।উপস্থিত সকলে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।প্রতিজ্ঞার বাড়ির লোক ভেবেছে সেলিম খান এসব নিয়ে এসেছেন।
তাসলিমা বেগম এই ভেবে অনেক প্রসন্ন হলেন।প্রসন্ন মুখেই বললেন,
“আপনারা এতোসব কেনো এনেছেন?”

সেলিম খান আমতা আমতা করে বললেন,
“আমরা তো এসব আনি নি।”

তাসলিমা বেগম ধাক্কা খেলেন।চেহারার হাসি উবে গেলো।আনোয়ার সাহেব এবং তানিমের চেহারায়ও চিন্তার ছাপ।সেই মুহুর্তে প্রবেশ করে আহমেদ পরিবারের সকলে।
শাহআলম সাহেব,সাইদুল সাহেব,জাহানারা বেগম,মাধুরী বেগম,সাবিহা,রাহিব-সাহিব সবাই প্রসন্নচিত্তে প্রবেশ করলো।
তাদের দেখে উপস্থিত সকলের চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।আনোয়ার সাহেবের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।উপর থেকে নাদিয়া এবং প্রতিজ্ঞা সব অবলোকন করছে।প্রতিজ্ঞা অবাক হয়ে গেছে।সে ভেবেছিলো সংকল্প আসবে।কিন্তু পুরো পরিবার এভাবে এন্ট্রি নিবে সে কল্পনাও করে নি।

শাহআলম সাহেব এসে আনোয়ার সাহেবের সাথে হাত মেলালেন।কুশলাদি বিনিময় করলেন।সবাই সোফায় আরাম করে বসলেন।সাবিহা উপরে প্রতিজ্ঞার কাছে চলে গেলো।

খান সাহেব শাহআলম এবং সাইদুল সাহেবকে দেখে চমকালেন।ফার্মাসিটিউক্যালসের মালিক এখানে কেনো তার বুঝে আসে নি।তারা আগে থেকে পূর্বপরিচিত।

তাসলিমা বেগমের চেহারায় কাঠিন্যতা।এতো মানুষের সামনে রাগ প্রকাশ করলেন না।স্বাভাবিকভাবে বললেন,
“আপনারা এখানে?”

শাহআলম সাহেব বিপরীতে স্মিত হাসলেন।কিছু বলার আগেই প্রধান প্রবেশদ্বার থেকে ভেসে এলো পুরুষালী কন্ঠস্বর,
“বউ নিতে এসেছি শাশুড়ীআম্মু।”

কথাটা বলতে বলতে বাড়িতে প্রবেশ করলো সংকল্প।পরনে তার স্যূট,বুট।হাটতে হাটতে চোখের সানগ্লাসটা হাতে নিলো সে।ঠোঁটে ইয়া বড় হাসি ঝুলানো।প্রতিজ্ঞা তব্দা খেয়ে ফেললো।

তাসলিমা বেগম আরেকবার ধাক্কা খেলেন।তার কলিগ ভদ্র আফনান আহমেদ সংকল্প এতো ঠোঁটকাটা!বড়দের সামনে কিভাবে কথা বলতে হয় সে জানে না।সংকল্প এতক্ষণে তাসলিমা বেগমের মুখোমুখি দাঁড়ালো।ঠোঁটে হাসি রেখেই বললো,
“আকাশে বাতাসে খবর ছড়িয়ে পড়েছে,আপনারা নাকি আমার বউকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন।আমার দশটা না,পাঁচটা না,একটা মাত্র বউ। আমি বউ ছাড়া থাকবো কি করে শাশুড়ীআন্মু?আমি আপনার একটামাত্র মেয়ের একটামাত্র বিয়ে করা একটামাত্র স্বামী।আপনি আপনার একটামাত্র জামাইকে বউ ছাড়া করতে চাচ্ছেন শাশুড়ীআম্মু?আপনি এতো নি*ষ্ঠুর!”

শেষের কথাগুলো ঠোঁট উল্টিয়ে বললো সংকল্প।সবার সামনে এমন কথা শুনে তাসলিমা বেগম বিষম খেলেন।খান পরিবার ব্যতীত সবাই মুচকি মুচকি হাসছেন।খান পরিবার বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে এখানে।

শাহআলম সাহেব পরিস্থিতি পরিবর্তন করলেন।আনোয়ার সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
“বেয়াই সাহেব, এতোদিন মেয়েকে নিয়ে যেতে দেন নি।সংকল্প দেশে না থাকায় আমরাও জোর করি নি।আজকে না করবেন না।আমরা আজকে আমাদের বউমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবো।”

আনোয়ার সাহেব প্রসন্নমুখে বললেন,
“আমার কোনো আপত্তি নেই।তবে বড় করে অনুষ্ঠান করে নিয়ে গেলে হয় না?”

সংকল্প ফটাফট বলে উঠে,
“একদমই না।আপনাদের বাড়িতে আমার বউ নিরাপদ না।এখানে থাকলে যেকোনো মুহুর্তে আমার বউ চু*রি হয়ে যেতে পারে।বউ হারানোর রিস্ক আমি নিতে চাই না।আমার বউ আমি আজকে সাথে করে নিয়ে যাবো।”

তারপর তাসলিমা বেগমের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে খোঁচা মে*রে বললো,
“আমার শ্বশুরবাড়িটা বউ চো*রে ভরে গেছে,বুঝলেন শ্বশুরআব্বু!”

আনোয়ার সাহেব মুচকি হাসলেন।তাসলিনা এবং তানিম রাগী চোখে তাকিয়ে আছে সংকল্পের দিকে।প্রতিজ্ঞা এতোক্ষণে নিচে নেমে এসে।তার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।সবার সামনে কেমন অনায়াসে বউ,বউ বলে চলেছে।মুখে একটুও বাঁধছে না।ইচ্ছে করছে মাটি ফাঁক হয়ে যাক,সে ঢুকে পড়ুক,মুখ লুকাক।মজার ব্যাপার,সংকল্প একবারের জন্যেও প্রতিজ্ঞার দিকে তাকায়নি।

সেলিম খান হালকা কেশে সবার নজর কাড়লেন।বললেন,
“আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না।এখানে কি হচ্ছে যদি বুঝিয়ে বলতেন।”

তানিম আমতাআমতা করছে।আনোয়ার সাহেব কিছু বলতে নিবেন তার আগেই শাহআলম সাহেব হেসে বললেন,
“খান সাহেব আপনাকে তো বলেছিলাম হুট করে আমার ছেলের বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা।আমার ছেলে সংকল্পকে তো চেনেন।তার স্ত্রী প্রতিজ্ঞা, আনোয়ার সাহেবের একমাত্র মেয়ে।সংকল্প কানাডা থাকায় প্রতিজ্ঞা এখানে থাকতো।”

এতক্ষণে খান পরিবারের কাছে সব পরিষ্কার হলো।তাদের চেহারায় রাগেরা হানা দিলো।কাঠিন্যতায় পরিণত হলো।আকাশ চুপ করে বসে রইলো।সে তো জানতো এই কথা।রাগে ভিতর জ্বলে যাচ্ছে তার।সেলিম সাহেব আর এক মুহুর্তও দাঁড়ালেন না।তানিমকে উদ্দেশ্য করে কঠিন স্বরে বললেন,
“কাজটা ভালো করলে না তুমি।তোমার সাথে আমি পরে কথা বলবো।”

বলে গটগট করে বেরিয়ে গেলেন বাড়ির বাহিরে।আহমেদ বাড়ির কেউ এসবে পাত্তা দিলেন না।তারা আনোয়ার সাহেবের সাথে নানাবিদ বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।

এবার সংকল্প তাকালো প্রতিজ্ঞার দিকে।চোখে চোখ পড়ে গেলো।মেয়েটা তাকেই দেখছিলো।প্রতিজ্ঞা চোখ নামিয়ে নিলো।সংকল্প রাগী চোখে তাকিয়ে আছে।তবে ভেতরে ভেতরে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো।সংকল্প ভাবতে পারে নি প্রতিজ্ঞাকে এমন রূপে দেখবে।মেয়েটা কি জানে তাকে কতটা সুন্দর লাগছে।এভাবে থাকলে তো রাগ গলে জল হয়ে যাবে।রাগ দেখানো যে বড্ড মুশকিল হয়ে পড়বে।মেয়েটা আটঘাট বেঁধে নেমেছে। বড্ড জ্বালাচ্ছে,বড্ড বাড় বেড়েছে।
সংকল্প সোজা প্রতিজ্ঞার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।প্রতিজ্ঞা নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে।তাদের দিকে কেউ নজর দিচ্ছে না।সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত।

সংকল্প ফিসফিসিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে ত্রস্ত স্বরে বললো,

“বলেছিলাম বেশি উড়তে যেও না।সুতা কাটতে আমি দু’বার ভাববো না।কিন্তু তুমি কি করলে! তুমি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যেই আকাশ পরিবর্তন করে নিচ্ছিলে!তোমার সাহস দেখে আমি বরাবরই অবাক হয়েছি,এখনো হচ্ছি।বলেছিলাম এমন সাহস করো না,কিন্তু করলে।তোমার সব মেনে নিতাম,কিন্তু এটা মেনে নিতে পারছি না।এর শা*স্তি তো তোমাকে পেতে হবে।”

তারপর জাহানারা বেগমকে উদ্দেশ্য করে স্বাভাবিক স্বরে বললো,
“মা,আমি বাড়ি যাচ্ছি।তোমরা কথা-বার্তা শেষ করে এসো।”

বলে আচমকা প্রতিজ্ঞার হাত ধরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।

#চলবে…