হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো পর্ব-৩৩+৩৪

0
148

#হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
#পর্ব ৩৩

শেষ রাতে বৃষ্টি হওয়ায় আজ আবহাওয়া সুন্দর।সূর্যমামা তার তাপমাত্রার তীব্রতা কমিয়েছেন।তার হয়তো ইচ্ছে করে নি এতো সুন্দর একটা দিনে তীব্র তাপদাহে মানুষজনকে অতিষ্ঠ করতে।আজ দিনটা যে বড্ড সুন্দর,শান্তির।আজ যে দু’টো মানুষের প্রণয় পরিণতি পেতে চলেছে।

আহমেদ মেনশন লোকসমাগমে ভরপুর।প্রত্যেকে আনন্দে মেতে উঠেছে,হৈচৈ করচে সবাই।একটু পরেই বরযাত্রী চলে আসবে।সাবিহার সাজগোছ শেষ।পরনে তার মেরুন রঙের ভারী লেহেঙ্গা,মানানসই গহনা।যেনো রূপকথার কনেবউ।তাকে কেন্দ্র করে বসে আছে বন্ধুমহল।প্রতিজ্ঞা নেই এখানে।সাবিহাকে তৈরী করে প্রতিজ্ঞা গিয়েছে নিজেকে সাজাতে।আয়েশা সকালেই স্বামীর সাথে এসে পৌঁছায়।সোহানা,ফিহা,আয়েশা তিনজন একই ডিজাইনের একই রঙের ভারী কাজ করা শাড়ী পরেছে।এটা প্রাক পরিকল্পিত ছিলো।সাবিহার ঘরে বসে তারা আড্ডা দিচ্ছে।রামিম একটু পরপর ফিহার দিকে তাকাচ্ছে।চোখা সরানো দায় যেনো।তার ইচ্ছে করছে একটা জনমানবশূণ্য স্থানে ফিহাকে নিয়ে গিয়ে নিজের সামনে বসিয়ে রাখতে।তারপর ঘন্টার পর ঘন্টা,দিনের পর দিন,মাসের পর মাস নিজ প্রেমিকার এই রূপ চোখভরে দেখতে।ফর্সা গায়ে মেজেন্টা রঙের শাড়ীটা মানিয়েছে বড্ড।রামিমের একটু পর পর আড়চোখে তাকানো ফিহা খেয়াল করেছে।লজ্জা মরি মরি অবস্থা তার।সে রামিমের চোখে তাকাতে পারছে না।ফিহার সাথে সাথে সোহানারও নজর এড়ায়নি ব্যাপারটা।সে গলা খাঁকারি দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো।চেহারায় অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে দুষ্টৃুমির স্বরে বললো,
“আজ একটা প্রেমিক নেই বলে কেউ বারবার আড়চোখে তাকায় না।”

সোহানার কথা কর্ণপাত হতেই ফিহা চোয়াল ঝুলালো।মিনমিনিয়ে বললো,
“বইন,আজকে অন্তত মান সম্মান নষ্ট করিস না।”

রামিম কটমট করে তাকালো সোহানার দিকে।বললো,
“একটু আগে যে ভিডিও কলে কথা বলে আসলি,তখন আমরা কিছু বলছি?অন্যের প্রেমে বা হাত ডুকাস কেন,শাঁকচুন্নি।”

সোহানা যেনো বিষম খেলো।সাবিহা,আয়েশা ঠোঁট টিপে হাসছে।ফিহার চোখ-মুখ মুহুর্তেই উজ্জ্বল হয়ে গেলো।রামিম একদম ঠিক জায়গায় গুঁতো দিয়েছে।ফিহা কনুই দিয়ে ধাক্কা দিলো সোহানাকে।বললো,
“সাব্বির ফোন দিয়েছিলো নাকি রে?”

সোহানা আমতাআমতা করে বললো,
“ও কেনো ফোন দিবে?”
রামিম ভেঙচি কাটলো।
“ন্যাকা!নিজেকে গভীর জলের মাছ ভাবে।কালকে আন্টির জন্য কিছু বলতে পারি নি।আজকে চুপ থাকছি না!”

আয়েশা সেই গোল চশমা ঠেলতে ঠেলতে মুচকি হাসলো।বললো,
“লুকিয়ে লাভ নেই,আমরা জানি।”

রামিম,ফিহাও ভাব নেয়,
“হুহ!”

সোহানা ঠোঁট উল্টায়।সাবিহা হেসে বলে,
“অন্যের জন্য ফাঁদ ফেলতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে গেছে, বেচারি।”

সবাই উচ্চস্বরে হেসে ফেলে।সোহানা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়,
“তুইও!”

সাবিহা চোখ দিয়ে ইশারা করে।মুচকি হাসে,
“এই হয়েছে,আমার বিয়েতে বেচারিকে নিয়ে আর মজা করিস না।আজকে ছেড়ে দে।”

ফিহা গটগট করে বলে উঠে,
“তাহলে ওকেও বল আমাদের নিয়ে মজা না করতে!”

তখনই ঘরে আগমন ঘটে রাহিব-সাহিবের।ভাব নিয়ে বলে,
” হেয় সুন্দরী লেডিস্,হোয়াটস্ অ্যাপ?”

তাদের সাথে প্রবেশ করে বিয়ে বাড়ির আরো কিছু বাচ্চা কাচ্চা।তারা সবাই কম-বেশ সমবয়সী।দুই ভাই অফ হোয়াইট রঙের শেরওয়ানি পরেছে।চোখে কালো চশমা।তাদের ভাব এমন যেনো তারা রাজপুত্র।আজকে তাদেরই বিয়ে।বিস্ময়ের ব্যাপার দুই ভাইয়ের হাতে দু’টো গোলাপ ফুল।

রাহিব চোখ থেকে চশমাটা খুলে মাথায় আটকায়।ফিহার সামনে দাঁড়ায়।ফিহা সরু চোখে তাকায়,
“কিরে কি ব্যাপার?”
“এই টুনির মা,তোমাকে ফেসবুকতে রিকোয়েস্ট দিয়েছি,একসেপ্ট করলে না কেনো?”

ফিহা ভ্রু কুঁচকায়,
“আমি টুনির মা?
আর কবে দিয়েছিস?নাম কি?”
“হালকা বাতাসে লুঙ্গি আকাশে।”

এমন নাম শুনে উপস্থিত সবাই চোখ বড় বড় করে তাকায়।পরক্ষণেই হো হো করে হাসতে থাকে।একেকজন যেনো মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।

রামিম যেনো তেনো প্রকারে হাসি থামিয়ে বললো,
“আন্ডা বাচ্চারা ফেসবুকও চালায়?আবার নাম?হালকা বাতাসে লুঙ্গি আকাশে!”

বলে আবারো হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায়।

রাহিব চোখ ছোট ছোট করে তাকায় রামিমের দিকে,
“এই একদম হাসবে না।কত ইউনিক একটা নাম!
আর কে আন্ডাবাচ্চা?আমার বয়স কতো জানো? ব আকার র ওকার।”

সবাই রাহিবের কথায় মিটমিটে হাসছে।সে পাত্তা না দিয়ে দৃষ্টি ফেলে ফিহার দিকে।শাহরুখ খানের সিগনেচার স্টাইলের মতো হাত দুটো মেলে বলতে শুরু করে,
“কালকে মেয়েদের সাথে বিজি ছিলাম।তাই তোমাকে সময় দিতে পারি নি।বুঝলে টুনির মা!”

ফিহা হকচকিয়ে গেল।সাথে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো বন্ধুমহল।
রাহিব হাতের ফুলটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি আমার সাথে প্রেম করবে টুনির মা?”

ফিহা চোখ বড় বড় করে বললো,
“আমি?তোর সাথে?প্রেম? আমি তো এটাই বুঝিনা তোরা কে কোনটা?রাহিব কে সাহিব কে!পরে দেখা যাবে জামাইর রুমে না গিয়ে দেবরের রুমে চলে গেছি!”

রাহিব কিছু বলার আগে রামিম অধরে হাসি ঝুলিয়ে বলে,
“ও ঠিক বয়সে বিয়ে করলে তোর মতো দুইটা বাচ্চা থাকতো ওর।ফিহা তোর মায়ের বয়সী!এখন থেকে খালাম্মা ডাকবি, খালাআআআআআ আম্মাআআআআ।”

উপস্থিত সবাই শব্দ করে হেসে ফেলে।

—————

অন্যদিকে,প্রতিজ্ঞা খাটের উপর এত্তোগুলো শাড়ী ছড়িয়ে ছিটিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কোনটা রেখে কোনটা গায়ে জড়াবে বুঝে উঠতে পারছে না।ভেবেছিলো শাশুড়ীমা সাহায্য করবে।তাই গিয়েছিলো জাহানারা বেগমের কাছে।দুই শাশুড়ী এতো ব্যস্ত যে বলে দিয়েছেন,
“তোর যেটা ভাল্লাগে ঐটা পরে নে।তুই যা পরবি,তাতেই সুন্দর লাগবে তোকে।”

অগত্যা ঠোঁট উল্টিয়ে ফিরে এলো সে।এখন কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মুহুর্তেই সংকল্প ঘরে এলো।তার পরনে কালো কোট,প্যান্ট।প্রতিজ্ঞাকে এখনো তৈরী হয় নি দেকে সে অবাক হয়।চিন্তায় পড়ে গেলো আবার কিছু হলো নাকি।এই মেয়ে তো অল্পতেউ কেঁদে কেটে এক-সার।গতকাল রাতে প্রতিজ্ঞার কান্নার জারণ শুনে বেচারা সংকল্প বড্ড হেসেছিলো।হেসে লুটোপুটি খাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিলো তার।এতো সামান্য কারণে প্রতিজ্ঞা নাজেহাল হয়েছিলো।এখনো এমন হলো কিনা আবার ভেবেই পেছন থেকে জিজ্ঞাসা করলো,
“বউ,কি হয়েছে?রেডি হও নি কেনো এখনো?”

সংকল্পের আওয়াজ পেতেই প্রতিজ্ঞা খুশি হয়ে পেছনে ফেরে।তার চোখ দেখে মনে হচ্ছে এবার যেনো সমস্যার সমাধান এক নিমিষেই হয়ে যাবে।কনফিউশান দূর হয়ে যাবে।

“আপনি এসেছেন খুব ভালো হয়েছে।দেখুন না আমি কোন শাড়ীটা পরবো বুঝতে পারছি না।একটু সিলেক্ট করে দিন না!”

সংকল্প হাপ ছেড়ে বাঁচলো।তার বউয়ের মন খারাপ হয় নি।সে প্রতিজ্ঞার দু’কাধে হাত রেখে বলে,
“যেকোনো একটা পরে নাও।সবগুলাই সুন্দর।”

প্রতিজ্ঞার রাগ লাগলো।সে তো জানে সবগুলা সুন্দর।কোনটা পরবে,একটা নির্দিষ্ট করে দিলেই তো হয়। কপট রাগ দেখালো,
“আমি জানি সবগুলা সুন্দর।কিন্তু আপনি আমাকে সিলেক্ট করে দিন।”

সংকল্প বুঝলো তার বউ মহা কনফিউশানে আছে।সে অধর প্রসারিত করলো।হাত দু’টো কাঁধ থেকে নামিয়ে প্রতিজ্ঞার কোমড় আঁকড়ে ধরলো,থুতনি রাখলো প্রতিজ্ঞার ডানদিকে।দু’জনেই খাটে ছড়ানো শাড়ীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। সংকল্প খুঁটিয়ে দেখছে শাড়ী গুলোকে।

“উমমমমম,ঐ লাল শাড়ীটা পরো।একদম বউ বউ লাগবে।”
“লাল?”
“হ্যাঁ।কোনো সমস্যা?”
“আমার অনেক শখ ছিলো আমি লাল বেনারসী পরে বিয়ে করবো।আটপৌরে করে শাড়ী পরবো,দেহ ভর্তি অলঙ্কার, মাথায় দোপাট্টা।ঠিক যেনো রাজা-রাণীর আমলের বউ।কিন্তু….”

সংকল্প বুঝলো লাল শাড়ী নিয়ে তার বউয়ের অনেক আবেগ জমানো।সে প্রতিজ্ঞাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,
“আজকে তুমি এই শাড়ীটাই পরবে।ইটস্ ফাইনাল।”

প্রতিজ্ঞা বাঁধা দিতে চাইলো।সংকল্প জানালো,
“কোনো না শুনছি না। চলো আজকে আমি তোমাকে সাজিয়ে দেই।”

বলে সংকল্প চলে গেলো দরজা বন্ধ করতে।রেখে গেলো হা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিজ্ঞাকে।সংকল্প ফিরে এসে প্রতিজ্ঞাকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্মিত হাসলো।দুষ্টুমির স্বরে বললো,
“আমাকে কি বেশি সুন্দর লাগছে?এখনই খেয়ে ফেলতে চাও?খেয়ে দেখতে পারো,আমি আমার অনেক টেস্টি।”

সম্বিত ফিরে পেতেই প্রতিজ্ঞা কটমট করে তাকালো সংকল্পের দিকে।বউয়ের চাহনি দেখে শব্দ করে হেসে ফেললো সংকল্প।সংকল্প এগিয়ে গিয়ে জানালার পর্দা টেনে দিলো,বেলকনির দরজা বন্ধ করে দিলো।ঘরের কৃত্রিম আলোটাও নিভিয়ে দিলো।এই দুপুরবেলাতেও ঘরটা আবছা অন্ধকার হয়ে গেছে।

সংকল্প প্রতিজ্ঞার কাছে এসে শাড়ীটা জড়িয়ে দিলো।প্রতিজ্ঞা কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।বরং আবেশে ছেয়ে গেলো। সে তো এমন ভালোবাসা আশা করতো।প্রতি পদে পদে সংকল্পের ভালোবাসার জানান পেতে চেয়েছিলো।সংকল্পের ভালোবাসার সাগরে ঠাঁই হারাতে চেয়েছিলো।এখন প্রতিনিয়ত মনে হচ্ছে সে তার অতীব চাওয়া ভালোবাসার নাগাল পেয়েছে।পৌঁছাতে পেরেছে সেই সুউচ্চ,দূর্গম জায়গায় যেখানে ভালোবাসা নামক রত্নরা তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলো।তার ইচ্ছে করছে চিৎকার করতে।চিৎকার করে বলতে,”পৃথিবী দেখো আমাকে ভালোবাসারা ঘিরে আছে,আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে সেই ভালোবাসা, যাকে আমি বছরের পর বছর চেয়ে এসেছি।যে পুরুষের সাধনা করেছি এতো বছর,সে আজ আমার,একান্তই আমার।পৃথিবী দেখো,আমি কত সুখী,আমাকে এখন দুঃখরা স্পর্শ করে না।আমাকে তো সুখেরা স্পর্শ করে,ভালোবাসারা স্পর্শ করে।দমকা হাওয়ার মতো ভালোবাসারা আমাকে জড়িয়ে ধরেছে,আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভালোবাসারা জায়গা করে নিয়েছে।পৃথিবী দেখো আমি সফল,আমি পূর্ণ,আমি আজ পরিপূর্ণ।তুমি কিন্তু আমাকে আবার হিং সে করো না যেনো!”

“কোথায় হারিয়ে গেলে?বলো না কেমন সাজিয়েছি তোমায়?”

প্রতিজ্ঞার ভাবনার সুঁতায় টান পড়ে সংকল্পের কথায়।প্রতিজ্ঞা প্রথমে তাকায় সংকল্পের দিকে।সংকল্পের চেহারায় প্রশান্তির হাসি,প্রাপ্তির হাসি।তারপর তাকায় আয়নায়।সে চমকায়,বড্ড বেশিই চমকায়।আটপৌরে করে শাড়ী,গা ভর্তি গহনা,কোমড় সমান চুল গুলো উপরের দু’দিকে বেণী করে ছেড়ে দেওয়া।সে অবাক হয়,একজন ছেলে এতো সুন্দর করে শাড়ী পরাতে পারে? সাজাতে পারে? মস্তিষ্ক হাতড়িয়েও কোনো উত্তর পায় না।তার ইচ্ছে করছে আয়নার সামনে বসে থাকতে।ঘন্টার পর ঘন্টা নিজেকে দেখতে।অবুঝ মন হুট করে চেয়ে বসলো,”এই সাজ সারাজীবন আমার গায়ে লেপটে থাকুক।এই সাজে আমার সাধনার প্রাণপুরুষের স্পর্শ আছে যে।” কিন্তু বলা হলো না।বড্ড বাচ্চামো হয়ে যাবে যে।

সংকল্প প্রতিজ্ঞার কাঁধে দু’হাত রেখে ভর দিয়ে ঝুঁকে গুনগুন করে,
“দুধে আলতা গায়ের বরণ রূপ যে কাঁঞ্চা সোনা
আচল দিয়া ঢাইকা রাইখো চোখ যেন পড়ে না
আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম
মন যে আর মানে না।”

প্রতিজ্ঞা আয়নার উপর পড়া সংকল্পের প্রতিবিম্বে দৃষ্টি ফেললো।দেখলো সংকল্পও তার পানে চেয়ে আছে।চাহনিতে নেই কোনো কামনা,নেই কোনো প্রমত্ততা,না আছে উন্মত্ততা, মা*দকতাটুকুও নেই।শুধু আছে ভালোবাসা,ভালোবাসা আর ভালোবাসা।এক আকাশ পরিমাণ ভালোবাসা আর প্রেম যেনো উপচে পড়ছে সেই চাহনিতে।

প্রতিজ্ঞা বললো,
“আপনি এগুলা শিখলেন কিভাবে?”

সংকল্প দূর্বোধ্য হাসলো।প্রতিজ্ঞার কাঁধে হাত রেখে ঝুঁকে বললো,
“তোমার জন্য শিখেছি।বলেছিলাম না?এবার ভালোবাসাবাসি হবে সমানে সমানে?”

প্রতিজ্ঞা অধর প্রসারিত করলো।তবে কিছু বললো না,বলতে ইচ্ছে করছে না।তার মনে হলো এখন চুপ করে এই মুহুর্তটাকে অনুভব করা উচিত।এমন মুহুর্ত জীবনে খুব কমই আসে।তাই সে নিরব রইলো।তবে মনে মনে একটা বাক্য আওড়ালো।
“হে পৃথিবী,আমি আজ সত্যিই পরিপূর্ণ।”

সংকল্প ভাবুক হয়ে বললো,
“উমমম!কিছু একটা মিসিং।কি মিসিং বলো তো?”
“কই ঠিকই তো আছে।” শান্ত স্বরে বললো প্রতিজ্ঞা।
“না ঠিক নেই।পেয়েছি!”

বলে আশেপাশে তাকায় সংকল্প।মুহুর্তেই কাঙ্ক্ষিত বস্তু পেয়ে যায়।এনে প্রতিজ্ঞাকে দেখিয়ে বলে,
“এটা মিসিং ছিলো।”
“গাজরা?”
“ইয়েস মাই বিউটিফুল ওয়াইফ।”

বলে প্রতিজ্ঞার মাথার পেছনে চুলে গাজরাটা আটকে দেয়।
তারপর শান্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“এবার কমপ্লিট।
ঐদিন নিজ দায়িত্বে তোমার সাজ নষ্ট করেছিলাম,আজকে নিজ দায়িত্বে তোমাকে মনের মতোন সাজিয়ে দিলাম।যদিও আমিই আবার দায়িত্ব নিয়ে সাজটা নষ্ট করবো।”

ভাব নিয়ে ভণিতা করে কথাটা বলায় প্রতিজ্ঞা সংকল্পের দিকে কটমট করে তাকায়।সংকল্প ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
“সত্যিই তো বললাম!”

কপট রাগ দেখায় প্রতিজ্ঞা,
“এতো সত্যি বলতে কে বলেছে?”
“বউ,তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো?আমার রোমান্টিকের ডিব্বা বউটা লজ্জাও পায়?”

প্রতিজ্ঞা চোখ বুঝে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে,
“নির্লজ্জ লোক!”
“তুমিই তো নির্লজ্জ বানিয়েছো।”

সংকল্পের ঠোঁট উল্টিয়ে বলা বাক্যর বিপরীতে প্রতিজ্ঞা অসহায় চোখে তাকালে সংকল্প শব্দ করে হেসে উঠে।

———-
বিয়েতে প্রতিজ্ঞার বাড়ির লোকও এসেছে।আনোয়ার সাহেব,তাসলিমা বেগম,তানিম,নাদিয়া আর তাদের ছোট্ট মেয়ে তুর।প্রতিজ্ঞা মা আর ভাবীর সাথে দাঁড়িয়ে আছে।তুর প্রতিজ্ঞার কোলে।
তুর অস্ফুটস্বরে বলে,
“পিপি দাণীর মতো লাগচে।”
প্রতিজ্ঞা ঠোঁট এলিয়ে হাসে।আদুরে স্বরে বলে,
“পিপিকে রাণীর মতো লাগছে?”

তুর মাথা নাড়ে।বলে,
“সুন্দল লাগচে।”

নাদিয়া তাল মেলায় মেয়ের সাথে।
“একদম পিপিকে সত্যিই সুন্দর লাগছে।মাশাআল্লাহ।নজর না লাগোক কারো।

কেমন আছো এখন প্রতিজ্ঞা?”

প্রতিজ্ঞা হেসে বলে,
“কল্পনার চেয়েও বেশি ভালো আছি ভাবী।”
“অবশেষে!”
“অবশেষটাই অনেক সুন্দর।”

তাসলিমা বেগম পাশ থেকে মেয়ে এবং বউমার কথোপকথন শুনছিলেন।তিনি প্রতিজ্ঞার উপর একটু একটু রাগ করে ছিলেন।তবে কথোপকথন শুনতে পেয়ে সে রাগ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।তিনি তো চেয়েছিলেন মেয়েটা সুখী হোক।এখন সুখী,আর কি চাই?বাবা-মা তো ছেলে-মেয়ের সুখই চায়।তারা ভালো থাকুক এটাই চান।তাসলিমা বেগমের মন প্রশান্তিতে ভরে উঠলো।মেয়ের গালে হাত রেখে বললেন,
“আরো বেশিই সুন্দর হোক তোমার জীবন।”

হঠাৎ মায়ের এমন কথায় প্রতিজ্ঞা কিঞ্চিত অবাক হয়।বলে,
“তুমি আমার উপর রাগ করে নেই তো?”

তাসলিমা বেগম হাসলেন,
“একদমই না।আমি চেয়েছিলাম তুমি সুখী হও।সেই চেষ্টাই করতে চেয়েছিলাম।এখন তুমি তোমার কাঙ্খিত সুখ পেয়ে গেছো,আমি আর কি চাইবো?সুখে থাকো তোমরা।”

প্রতিজ্ঞা মাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো।
তুর তেতে উঠলো।রাগী স্বরে বললো,
“দাদু পিপিকে আদল কচচে কেনো?দাদু য়ামাল।”

ছোট্ট মেয়ের রাগ দেখে সবাই হাসেন।দূর থেকে এটা সংকল্প দেখে।মা-মেয়ের সম্পর্ক ঠিক হয়ে গেছে,এতেই তার শান্তি।

————–
সাবিহা-নাদিমের বিয়ে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে।কাজী সাহেব যখন বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ বিবাহ সম্পন্ন হইয়াছে।”

তখনই সংকল্প সবার সামনে বলে উঠে,
“আরেকটা বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে যে কাজী সাহেব।”

উপস্থিত সবাই অবাক হলো।কানাঘুষা শুরু হয়ে গেলো কার বিয়ে হবে আবার!প্রতিজ্ঞা নিজেও বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে।সংকল্পের কথা সে বুঝতে পারে নি।

কাজী সাহেব বললেন,
“কিন্তু আমাকে তো একটা বিয়ের কথা বলা হয়েছিলো!”

সংকল্প ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
“তাতে কি, আরেকটা বিয়ে হবে।”
“আচ্ছা,বর-বউ কোথায়?তৈরী তারা?নিয়ে আসুন।”
“একদম।”

তারপর প্রতিজ্ঞার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
“চলো বউ, বিয়ে করবো।”

উপস্থিত সবার সাথে সাথে প্রতিজ্ঞাও অবাক হয়।চোখ বড় বড় করে বলে,
“মানে?”
“মানে তোমার শখ পূরণ করবো।লাল শাড়ী পরে বিয়ে করবে না?”
“পা গল হয়ে গিয়েছেন?”
“চুপ করো তো বউ।”

কাজী সাহেব হা হয়ে বললেন,
“আপনারা তো বিবাহিত।কয়বার বিয়ে করবেন?”
“যতবার মন চায়।একটা বউকেই বারবার বিয়ে করবো।”

উপস্থিত এতো এতো মানুষের সামনে এভাবে বলায় প্রতিজ্ঞার ইচ্ছে করছে মাটি ফাঁক হয়ে যাক,আর সে ঢুকে পড়ুক।ইশশশশশ!সবাই কি ভাবছে কে জানে!

নূরজাহান বেগম সরু চোখে তাকিয়ে বললেন,
“হ্যাঁ হ্যাঁ কয়দিন পরপর বিয়ে কর।আর তোর বউ আমাকে বলুক,আমার চোখের পাওয়ারে সমস্যা।আমার মেমোরি ভালো না।”

সবাই এই কথার মানে না বুঝলেও যারা বুঝলেন তারা সবাই হেসে উঠলেন।
প্রতিজ্ঞা আর সংকল্পকে মুখোমুখি বসানো হয়েছে।সামনে টেনে দেওয়া হয়েছে ফুলের ঝালর।প্রতিজ্ঞার মাথায় দেওয়া হয় লাল দোপাট্টা।কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করেছেন।শাহআলম সাহেব,জাহানারা বেগম,আনোয়ার সাহেব, তাসলিমা বেগম প্রাণভরে ছেলেমেয়ের আবার বিয়ে দেখলেন।স্বাক্ষী হলেন একই জুটির আরেকটি অদ্ভুত বিয়ের, যেখানে বর আকস্মিকভাবে বিয়ে করতে চায়।
আনোয়ার সাহেব স্ত্রীর কানে কানে বললেন,
“দেখেছো আমার জামাইও কিন্তু কম যায় না।”

তাসলিমা বেগম ভ্রু কুঁচকালেন।বললেন,
“তাই তো দেখছি।একবার কিনা ক্লাস থেকে বের হয়ে মেয়ের বিয়ের স্বাক্ষী হতে হয়,আবার কিনা মেয়ের ননদের বিয়ে খেতে এসে মেয়ের বিয়ের স্বাক্ষী হতে হয়।কপাল আমার!”

স্ত্রীর কথার বিপরীতে মুচকি হাসলেন আনোয়ার সাহেব।

অবশেষে আরেকবার বিয়ে সম্পন্ন হলো সংকল্প-প্রতিজ্ঞার।
প্রতিজ্ঞা খুশীতে আত্মহারা।এই তো একটু আগেই সে ভাবছিলো ভালোবাসারা যেনো।তাকে আরো বেশি করে ঘিরে ধরুক।সত্যিই আজ নিজেকে পরিপূর্ণ লাগছে।অতীতের কষ্ট এই এতো এতো ভালোবাসার মাঝে তুচ্ছ, তুচ্ছ, তুচ্ছ।

সংকল্প আর প্রতিজ্ঞা পাশাপাশি বসে আছে।তাদের অপরপাশে বসে আছে নাদিম-সাবিহা।রাহিব ফিহাকে আস্তে আস্তে বলে,
“টুনির মা চলো আমরাও বিয়েটা করে নেই।”
“সর,এটা আমার প্রোপার্টি।”

রাহিবের কথার বিপরীতে কপট রাগ দেখিয়ে বলে রামিম।রাহিব ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছে।ফিহা মজা নিচ্ছে।

সংকল্প প্রতিজ্ঞাকে ফিসফিসিয়ে বললো,
“খুশী তুমি?”
“অনেএএএক।”
“এভাবেই তোমাকে কয়দিন পরপর বিয়ে করে বারবার তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিবো যে তুমি শুধু আমার,তোমার প্রাণপুরুষের।তোমার প্রাণপুরুষ তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে।”

#চলবে….

#হে_সখা_মম_হৃদয়ে_রহো
#মুগ্ধতা_রাহমান_মেধা
#পর্ব ৩৪

সময় গড়িয়েছে কয়েক সপ্তাহ।দুই বছরের মতো সময় প্রাণহীন হয়ে পড়ে থাকা আহমেদ মেনশন এখন চব্বিশ ঘন্টা-ই উচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত থাকে।আনন্দ,হৈ হুল্লোড়ে মেতে থাকে সবাই।প্রতিজ্ঞা-সংকল্পকে পেয়ে আহমেদ মেনশন যেনো নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে।রাহিব-সাহিব তো আছেই সবাইকে বিনোদন দেওয়ার জন্যে।শরতের আকাশে সাদা সাদা মেঘগুলো যেমন আনন্দে ভেসে বেড়ায়,তেমনি প্রতিজ্ঞার দিনগুলোও এতোটা আনন্দেই পার হয়।প্রতিদিন নতুন রূপে আবিষ্কার করে সংকল্পকে।ভালোবাসাময় দিনগুলো যেনো হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো।দেখতে যেমন সুন্দর,খেতেও তত স্বাদ আবার তাড়াতাড়ি মিলিয়ে যায়।তারপর আবার নতুন করে স্বাদ পেতে ইচ্ছে করে।প্রতিজ্ঞার দিনগুলো কল্পনার মতো কাটছে।এতোবছরের চুটিয়ে প্রেম করার শখ সে সুদে আসলে উশুল করছে।সংকল্পও তাতে সায় দিচ্ছে।সারাদিন এতো ব্যস্ত থাকার পরেও একটু পর পর ফোন করে,মেসেজ করে খোঁজখবর নেয়।প্রতিজ্ঞার উপর তার ব্যস্ততার প্রভাব পড়তে দেয় না।মেয়েটা যেনো একাকিত্ব অনুভব না করে তার দিকে সম্পূর্ণ নজর রাখে সংকল্প।

আজ সংকল্প অফিস যায় নি।প্রতিজ্ঞাকে নিয়ে নিজের শ্বশুরবাড়িতে এসেছে সে।শাশুড়ী নিজে তাকে বারবার ফোন করে বলেছে।মাঝের এই সময়ে সংকল্পের সাথে তাসলিমা বেগমের সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে।বরং খুনসুটিপূর্ণ মজার একটা সম্পর্ক হয়েছে।তাসলিমা বেগম এখন সংকল্পকে তানিমের মতোই স্নেহ করেন।প্রতিদিন রুটিন করে খোঁজখবর নেন।আজ তাসলিমা বেগম ভালো করেই জামাই আদর করেছেন।

পড়ন্ত বিকেল।এবার প্রতিজ্ঞা-সংকল্পের বাড়ি ফেরার পালা।
সবাই জোর করেছে কয়েকটা দিন থেকে যাওয়ার জন্য।কিন্তু প্রতিজ্ঞা রাজি হয় নি।এখন ঐ বাড়ি ছাড়া তার ভালো লাগে না।

রওয়ানা হওয়ার সময় তাসলিমা বেগম প্রতিজ্ঞাকে বললেন,
“আজকের দিনটা থেকে যাও।”

মায়ের কথা শুনে প্রতিজ্ঞা কি বলবে বুঝতে পারলো না।এতোবার না করা যায়?সে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সংকল্পের পানে।সংকল্প ভয় পাওয়ার অভিনয় করলো।ভণিতা করে বললো,
“না না আমার বউকে এখানে রাখা যাবে না।আপনি আমার বউকে বিক্রি করে দিতে পারেন।আপনার উপর বিশ্বাস নেই আমার।আপনি তো আমার বউচোর।”

আনোয়ার সাহেব শব্দ করে হেসে ফেললেন।তানিম,নাদিয়া, প্রতিজ্ঞা মিটিমিটি হাসছে।সূক্ষ ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে তাসলিমা বেগম কটমট করে তাকালেন সংকল্পের দিকে।ছোট্ট তুর সেখানেই উপস্থিত ছিলো।আদো আদো শব্দে বললো,
“দাদু তোল,দাদু তোল।বউতোল।”

তুরের কথা যেনো আগুনে ঘি ঢাললো।উপস্থিত সকলো ঠোঁট টিপে হাসছে।এতোদিনে সবাই জামাই-শাশুড়ীর খুনসুটি সম্পর্কে অবগত হয়ে গেছে।তাসলিমা বেগম চোখ গরম করে তাকিয়ে বললেন,
“আমার মেয়ে,আমি যা ইচ্ছে তাই করবো।চুরি করবো না বিক্রি করবো সেটাও আমার ব্যাপার।তুমি কে?”

শাশুড়ীকে রাগাতে পেরে বিশ্বজয়ের হাসি সংকল্পের ঠোঁটে।
“আমি আপনার একটামাত্র মেয়ের একটামাত্র ভালোবাসার পতিদেবতা, শাশুড়ীআম্মু।”

প্রতিজ্ঞা লজ্জায় পড়ে গেলো।বাড়িভর্তি লোকের সামনে এই লোক ভালোবাসার কথা বলছে!তাসলিমা বেগম বোকাবনে গেলেন।কয়েক মুহুর্তের জন্য তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন তার সামনে একটা ঠোঁটকাটা ছেলে বসে আছে।
তিনি ধমকালেন,
“চুপ করো।প্রতিজ্ঞা আজ থাকবে এখানে।”
“প্রতিজ্ঞাকে বারবার থাকতে বলছেন,আমাকে তো একবারো বলেন নি শাশুড়ীআম্মু।”

সংকল্পের কাঁদো কাঁদো বাচ্চামো স্বরে বলা কথার বিপরীতে তাসলিমা বেগম স্মিত হাসলেন।সাথে সাথে হাসি লুকিয়ে ফেললেন।খোঁ চা মে রে বললেন,

“প্রতিজ্ঞা যেখানে থাকবে তুমিও যে সেখানেই থাকবে,এটা আমি জানি বাবা।তাই তোমাকে আলাদা করে বলিনি।আমি চিনি তো তোমাকে।”

সংকল্প চোখ বড় বড় করে অবাক হওয়ার ভাব ধরে বললো,
“আপনি কি আমাকে ইনডিরেক্টলি অপমান করলেন, শাশুড়ীআম্মু?”
“তুমি এটা এতোক্ষণে বুঝলে বাবা?”

এভাবেই কিছুক্ষণ তাদের জামাই-শাশুড়ীর খুনসুটি চলে।পরে সংকল্প বুঝিয়ে বলে সে প্রতিজ্ঞাকে দিয়ে যাবে কয়েকদিনের জন্য।তবে কয়েকদিন পর।ইদানিং বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে তাই প্রতিজ্ঞা এখন ঐবাড়িতেই থাকবে।তাসলিমা বেগম জানেন কিসের অনুষ্ঠান।তাই আর বাঁধা দেন নি।

নাদিয়া তুরকে কোলে নিয়ে প্রতিজ্ঞা-সংকল্পকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যায়।গাড়িতে উঠার সময় নাদিয়ার দিকে মিষ্টি হাসি দিয়ে সংকল্প বলে,
“তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না।তুমি না থাকলে আমি দুই বছর নিশ্চিন্তে থাকতে পারতাম না।প্রতিজ্ঞার সব ইনফরমেশনও পেতাম না।তুমি সবসময় এমন ভালো থেকো।”

নাদিয়া বিপরীতে হেসে বললো,
“এটা আমার দায়িত্ব ছিলো।আমার মিষ্টি ননদটা কষ্ট পাবে,আমি কিভাবে দেখতাম!”

প্রতিজ্ঞা দু’জনের কথপোকথনের খানিকটা বুঝলেও সমীকরণ মেলাতে পারছে না।
“মানে?”

সংকল্প নাদিয়াকে ইশারা করে প্রতিজ্ঞাকে বললো,
“নাদিয়া-ই হচ্ছে সেই গুপ্তচর,যার মাধ্যমে তোমার সব ইনফরমেশন আমার নখদর্পনে থাকতো।”

——–
পিচঢালা রাস্তার উপর দিয়ে গাড়ি চলছে।প্রতিজ্ঞা জানালা দিয়ে বাহিরে মুখ করে বসে আছে।সংকল্পের মনোযোগ সামনের দিকে।চলতি গাড়ির মাঝে খুব পরিচিত একজনকে দেখে প্রতিজ্ঞা নড়েচড়ে বসলো।সে এখানে,বাংলাদেশে, কিভাবে!অস্থির হয়ে বললো,
“সংকল্প!তাড়াতাড়ি গাড়ি থামান।”

হঠাৎ এমন বলায় সংকল্প অবাক হয়।
“কি হয়েছে?শরীর খারাপ লাগছে?বমি পাচ্ছে?”
“আগে গাড়ি থামান।”

সংকল্প গাড়ি থামায়।প্রতিজ্ঞা তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নামে।সংকল্পও নামে।প্রতিজ্ঞা পেছনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সে মেলাতে ব্যস্ত আসলেই সেই মানুষটা কিনা!সংকল্প প্রতিজ্ঞার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করে,
“কি হয়েছে?নামলে কেনো?”

প্রতিজ্ঞা ঐ মানুষটার দিকে আঙ্গুল তাঁক করলো।মানুষটা কারো সাথে কথা বলছে।সংকল্পও অবাক হলো।বিস্ময় ছেয়ে গেলো তার মাঝে।অস্ফুটস্বরে বললো,
“ফ্রাঞ্চিস!”

“রাইমা আপুর প্রেমিক।উনার তোর অস্ট্রেলিয়া থাকার কথা।উনি বিডিতে কি করছেন?”

“আমারও একই প্রশ্ন।”

প্রতিজ্ঞা ফ্রাঞ্চিসের সাথে কথা বলতে চায়লো।সংকল্পও সায় মেলালো।তারা ফ্রাঞ্চিসের দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই সে একটা সিএনজিতে উঠে পড়ে।সিএনজি চলতে শুরু করলে প্রতিজ্ঞা অস্থির হয়ে বলে,
“উনাকে ফলো করতে হবে।”

সিএনজির পিছু পিছু আসতে আসতে তারা পৌছায় সু-উচ্চ এক ভবনের সামনে।গাড়ি এসে পৌছানোর আগেই ফ্রাঞ্চিস ভবনের ভেতর ঢুকে পড়ে।

সংকল্প-প্রতিজ্ঞা ছুটে আসে।গেইটে দারোয়ানকে দেখতে পেয়ে দারোয়ানের কাছে যায়।সংকল্প দারোয়ানকে সালাম দিয়ে জানতে চায়,
“মামা,এইমাত্র যেই বিদেশি লোকটা ভেতরে গেলেন।তিনি কার কাছে এসেছেন?কত তালায় এসেছেন?জানেন?”

দারোয়ান মধ্য বয়স্ক।পানের পিক ফেলে হলদে দাঁত বের করে হেসে বললেন,
“ফ্রাঞ্চিস সাহেবের কথা বলতিছেন আপনারা?”
“জ্বি জ্বি।”

দারোয়ান আবার হলদে দাঁত বের করে হেসে বললেন,
“তেনা তো কেউর লগে দেহা করতে আয় নাই।পাঁচ তালায় থাহেন তেনা।দের বছর আগে এই ফেলাটটা কিনচে।তারপর থেকে মাস-দুই মাস পরে পরে তেনা আহেন,পাঁচ-সাতদিন যতদিন মন চায় থাহেন আবার চইল্যা যান।”

দারোয়ানের কথা শুনে একে অপরের মুখের দিকে তাকায় সংকল্প-প্রতিজ্ঞা।চেহারায় কৌতুহল।তারা দারোয়ান থেকে বিদায় নিয়ে ভবনের ভেতরে চলে যায়।

পাঁচতালায় দাঁড়িয়ে আছে সংকল্প-প্রতিজ্ঞা।সংকল্ক বেল বাজিয়েছে,এখন দরজা খোলার অপেক্ষা।পরমুহূর্তেই খট করে দরজা খোলার শব্দ হয়।বিপরীতপাশের ব্যক্তির চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে সংকল্প-প্রতিজ্ঞাকে সে আশা করে নি।বড্ড বেশিই অবাক হয়েছে সে।বিস্ময়ের সহিত বলে,
“তোমরা এখানে?”
“আমাদের ওতো একই প্রশ্ন।তুমি এখানে কেনো?”

সংকল্পের প্রশ্নের বিপরীতে ফ্রাঞ্চিস তপ্ত শ্বাস ফেলে।

মুখোমুখি বসে আছে ফ্রাঞ্চিস সংকল্প আর প্রতিজ্ঞা।
ফ্রাঞ্চিসকে নতমস্তকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সংকল্প আবার বলে,
“তুমি এখানে কেনো?”

ফ্রাঞ্চিস তাকায় সংকল্পের দিকে।বলতে শুরু করে,
“রাইমার সাথে থাকার জন্য।রাইমার লাস্ট মেমোরি তো বিডিতে।ইয়্যু নো সংকল্প,বিডি থেকে ব্যাক করার পর ইনার পিচ টাকে খুব মিস করেছি।রাইমার সাথে আমার ওয়ান এন্ড হাফ ইয়ারের রিলেনশন ছিলো।ডু ইয়্যু নো দ্য ওয়ার্ড ” লাভ”?আই ওয়াস ইন লাভ উইদ হার।আই নিউ হার হেলদ কন্ডিশনস্।বাট নেভার লিভ হার।শী হ্যাড অ্যা চান্স টু রিকোভার।বাট গড ওয়ান্টেড এনাদার।ফার্স্ট টাইম অব আওয়ার রিলেশনশিপ,আই থ্যট ইট ওয়াস জাস্ট এন অ্যাট্রাকশন,বাট টাইম মেইড মি রিয়েলাইজড্ দ্যাট ইট ওয়াস নট অ্যাট্রাকশন,ইট ওয়াস লাভ,ভালোবাসা।আই কুড নট একসেপ্ট হার ডেথ্।বাট ডেথ ইজ অ্যা টেরিবল ট্রুথ।মৃত্যু ভয়ং কর সত্যি।অস্ট্রেলিয়াতে ব্যাক করার পর আমি ফিল করতাম আমি খুব কাছের একটা জিনিস বিডিতে ফেলে গিয়েছি।আই কুড নট অ্যাটাচ উইদ এনাদার গার্ল।আউ কুড নট কনসার্নট্রেট অন অ্যানি ওয়ার্ক।আফটার টু মানথ্,আই কেইম বিডি এগেইন।হোয়াট ইউ গায়স সে?কবর জিয়ারত?
আমিও তাই করলাম।বেশি না পাই কিছুটা শান্তি পেলাম।অস্ট্রেলিয়াতে এই শান্তিটুকুও খুঁজে পাইনি।দ্যান আই ম্যানেজড এভ্রিথিং।ফ্ল্যাট কিনলাম।একমাস,দু’মাস পরপর আসি এখানে,থাকি যতদিন ইচ্ছে করে।গ্রেভিয়ার্ডে গিয়ে রাইমার সাথে গসিপ করি।এইতো,ডেইস আর গোয়িং ওয়েল।”

ফ্রাঞ্চিস থামলো।আবিষ্কার করলো তার সামনে বসা দু’টো মানুষের মধ্যে একজনের চোখে জল আরেকজনের চেহারায় বিস্ময়।ট বিস্ময় যে দুঃখের।প্রতিজ্ঞা বললো,
“হোয়াই ডিড ইয়্যু নট কন্টাক্ট উইদ আস্?”

ফ্রাঞ্চিস ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
” আই ডিড নট ওয়ান্ট টু ডিস্টার্ব ইয়্যু গাইস্।তবে আমি সংকল্পের খোঁজ করেছিলাম।জানতে পারি ও কানাডা চলে গিয়েছে।ও যে ব্যাক করেছে আমি জানতাম না।জানলে নিশ্চয়ই কন্টাক্ট করতাম।”

“তুমি এতো ইজিলি বাংলা বলছো কিভাবে?”

সংকল্পের কথার বিপরীতে ফ্রাঞ্চিস হাসলো।
“দেড় বছর যাবৎ থাকছি এখানে।প্রথম প্রথম কষ্ট হতো খুব।বেশিরভাগ মানুষ ইংলিশ বুঝে না।এখানে এসে নিজেকেই সব করতে হয়,তাই বাংলা শেখাটা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিলো।তারপর ধীরে ধীরে শিখতে শিখতে এখন আমি বাংলা ইজিলি বুঝতেও পারি,বলতেও পারি।”

প্রতিজ্ঞা বললো,
“দুই বছরে মনে হয় নি মুভ অন করা উচিত?”

ফ্রাঞ্চিস গাল ফুলিয়ে বুকভরা নিঃশ্বাস ফেললো।
“আই ট্রাইড টু মুভ অন।বাট পারি নি।মম,ডেড অনেক প্রেসার দিয়েছে টু গেট ম্যারিড।কিন্তু আমি মন থেকে ভুলতে পারছি না রাইমাকে।মম যখনই প্রেসার দেয় আমি বিডিতে চলে আসি।রাইমার সাথে সময় কাটাই।এখন তো মম ডেডও হাল ছেড়ে দিয়েছে।তবে হ্যা,যখন ভুলতে পারবো তখন বিয়ে করবো। আমার একটা ইচ্ছে আছে।যদি কখনো আবার দ্বিতীয় কারো প্রেমে পড়ি,তাহলে সে যেনো কোনো বাঙ্গালি নারী হয়।বাঙ্গালি নারীরা ভালোবাসার আসল মানে জানে, ভালোবাসতে জানে,ভালোবাসায় ঘিরে ফেলতে জানে।ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে।তারা মায়ার বাঁধনে এমনভাবে আঁটকে ফেলে যে সেই বাঁধন ছিন্ন করা বড্ড মুশকিল।অসম্ভব হয়ে পড়ে।”

তারপর ঠোঁটে দূর্বোধ্য হাসি ঝুলিয়ে বললো,
“এক বাঙ্গালিনীকে ভালোবেসে আমি আজ এক ছন্নছাড়া বিদেশী।”
“বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে,অলিতে-গলিতে খুঁজে বেরাই তাকে,
তবুও পাই না তার দেখা।”

প্রতিজ্ঞার কাছে শব্দগুলো কেমন যেনো লাগলো।সে সংকল্পের হাতটা শক্ত করে মুঠোবন্দি করলো।তার মনে হলো,
“ভালোবাসা সুন্দর, বড্ড বেশিই সুন্দর।”

#চলবে….