অচিত্তাকর্ষক পর্ব-২১

0
219

#অচিত্তাকর্ষক
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২১|

ভাইকে দেখে স্মৃতির বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। জুভান তাকে টানতে টানতে এনে স্মৃতির পায়ের সামনে ফেলল। স্মৃতি ভাইকে তুলে দাঁড় করালো। জড়িয়ে ধরল তাকে। জুভান কর্কশ গলায় বলল,

‘জিহাদ কোথায়?’

স্মৃতি জবাব দিল না। ভাইয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

‘তুই ঠিক আছিস তো সোহান?’

সোহান মাথা নাড়াল কেবল। জুভান রেগে গিয়ে স্মৃতিকে এক টানে ভাইয়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিল। পুনরায় সে একই প্রশ্ন করল,

‘স্মৃতি, জিহাদকে তোমরা কোথায় রেখেছ?’

স্মৃতি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘জানি না।’

জুভান চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘আমার প্রশ্নের জবাব না দিলে কিন্তু আমি এখানের একজনকেও বাঁচতে দিব না। বলো জিহাদ কোথায়?’

স্মৃতি বরাবরের মতোই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্মৃতির এই নিরবতা জুভানকে আরো বেশি রাগিয়ে দিচ্ছে। তার মাথার রগ রাগে ফুলে উঠছে। সে স্মৃতির হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

‘আমাকে রাগিও না স্মৃতি। ভালোই ভালোই বলে দাও জিহাদ কোথায়।’

স্মৃতি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জুভান এবার আর না পেরে ঈশান কে ইশারা দিয়ে কিছু বলল। ঈশান তখন সোহানের কাছে গিয়ে তার পেট বরাবর জোরে একটা লাথি মারল। লাথির বেগ সহ্য করতে না পেরে সোহান সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। স্মৃতি এই দৃশ্য দেখে চেঁচিয়ে উঠে বলতে লাগল,

‘আমার ভাইকে ছেড়ে দিন আপনারা। জুভান, আপনি এতটা অমানুষ কী করে হচ্ছেন? কেন করছেন এসব? আর আপনি(ঈশানের দিকে তাকিয়ে), আপনি না আইনের লোক; এই আপনার নীতি, এই আপনার আইন? আপনি একজন অপরাধী কে না ধরে একজন নিরপরাধী কে এভাবে আঘাত করছেন? এর শাস্তি কতটা কঠোর হবে তার কোনো ধারণা আছে আপনার?’

স্মৃতির কথা শুনে ঈশান হাসে। জুভান শক্ত গলায় বলে,

‘জিহাদ কোথায় আছে বলে দাও, তাহলে আমিও আর কোনো ঝামেলা করব না।’

‘জানি না আমি। আমি জানি না জিহাদ কোথায় আছে। আমার ভাই আর আন্টি আংকেল কে ছেড়ে দিন, প্লিজ জুভান ছেড়ে দিন ওদের।’

স্মৃতি কাঁদতে আরম্ভ করে। কিন্তু ওর চোখের উষ্ণ জলে জুভানের কুৎসিত বক্ষ এইটুকুও কাঁপে না। সে বরং মাটিতে পড়ন্ত সোহানের চুল ধরে তাকে টেনে তুলে। সোহান ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে। স্মৃতি দৌড়ে গিয়ে জুভানের হাতটা শক্ত করে ধরে। অনুরোধের সুরে বলে,

‘প্লিজ ওকে ছেড়ে দিন জুভান।’

জুভান স্মৃতির দিকে তাকিয়ে মিহি কন্ঠে বলে,

‘ছেড়ে দিব তো, সবাইকে ছেড়ে দিব। আগে আমাকে জিহাদের খোঁজ দাও, তারপর আমি সবাইকে ছেড়ে দিব।’

স্মৃতি নাক টেনে কাটকাট গলায় বলে,

‘আপনাকে আমি বিশ্বাস করি না।’

‘বিশ্বাস তো আমি তোমাকেও করি না। আমার খেয়ে আমার পড়ে এখন আবার আমার পিঠেই ছুঁড়ি মারতে চাইছো। কী দরকার ছিল এসবের? একটা জমি নিয়েই তো এতকিছু, দিয়ে দিতাম জমিটা। দরকার পড়লে সেই জমিতে একটা বাড়ি করে দিতাম। সেখানে তোমার মা, ভাই থাকতে পারতো। ব্যাপারটা তখন কত সুন্দর হতো। কিন্তু না তুমি কী করলে, এসবের মাঝে আমার বোনকেও টেনে আনলে। এখন আবার বলছো, আমাকে পুলিশে দিবে ফাঁসিতে চড়াবে। কেন? আমি ফাঁসিতে চড়লে তো তুমি বিধবা হয়ে যাবে, সেটা ভালো লাগবে তোমার? এখনও সময় আছে স্মৃতি, এসব কিছু বন্ধ করে দাও। সহজে বলে দাও জিহাদ কোথায়, ওকে আমরা ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজেরা বেঁচে যাব। তারপর সবকিছু ভুলে আবার নতুন করে আমাদের জীবন শুরু করবো। এটা ভালো হবে না বলো?’

স্মৃতি অবাক হয়। এই মানুষটা এত জঘন্য? এত কুৎসিত উনার মন? উনি আদৌ একজন সুস্থ মানুষ তো? আদৌ উনার মস্তিষ্ক কাজ করছে তো? এতকিছুর পরও একটা মানুষ কী করে এসব কথা বলতে পারে। স্মৃতি ভেবে পায় না, কী করে সে এতদিন এই লোকটাকে বিশ্বাস করে এসেছে। ছি, ভাবতেই এখন তার গা শিউরে উঠছে।

সে জুভানের কথায় কোনো জবাব না দিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে। করার মতো কিছু নেই। এই লোকটাকে আটকানোর মতো কোনো উপায় সে আওড়াতে পারছে না। সে বড্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মাথা ঝিম ঝিম করছে, শরীর খারাপ লাগছে। ফ্যালফ্যাল চোখে সে জুভানের দিকে তাকিয়ে দেখে জুভান নির্বাক ভঙ্গিতে তার দিকে চেয়ে আছে। কত শান্ত অথচ কুৎসিত সেই চোখের দৃষ্টি।

জুভান আবারও বলে,

‘বলে দাও স্মৃতি, জিহাদ কোথায়?’

স্মৃতি চোখ বুজে জোরে নিশ্বাস ছাড়ে। সে নিরুপায় হয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঈশানের ফোনটা বেজে উঠে। সবাই ঈশানের দিকে তাকায়। ঈশান ফোনটা হাতে নিয়ে ঘাবড়ে যায়। জুভান তার মুখটা দেখে বলে,

‘কী হয়েছে? কে কল করছে?’

ঈশান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে,

‘এস.পি স্যার কল করছেন।’

‘ধর, ভয় পাচ্ছিস কেন?’

ঈশান ঢোক গিলে কলটা রিসিভ করে। এস.পি তখন তাকে কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করেন,

‘কোথায় আছেন আপনি?’

ঈশান কাঁপাকাঁপা গলায় বলে,

‘স্যার, ডিউটিতে।’

‘সেই ছেলেটাকে পেয়েছেন যার কথা বলেছিলাম?’

‘জ্বি স্যার, জ্বি স্যার। ও এখন আমার সাথেই আছে।’

‘আপনি এখন কোথায় আছেন?’

ঈশান আমতা আমতা করে বলে,

‘স্যার, আসলে আমি থানার দিকে আসছি।’

‘সাথে ঐ ছেলেটাকেও নিয়ে আসবেন।’

‘ঠিক আছে স্যার।’

‘ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি আসুন। আমিও থানায় আছি।’

ঈশান ভয় পেয়ে গেল। জুভানকে তাড়া দিয়ে বলল,

‘দোস্ত, ওকে নিয়ে আমার এক্ষুনি থানায় যেতে হবে। স্যার নাকি থানায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।’

‘কী বলছিস কী? একে নিয়ে এখন থানায় গেলে তো আমরা অসুবিধায় পড়ে যাব।’

‘না, চিন্তা করিস না। আমি ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করে নিব।’

‘কীভাবে করবি?’

‘বলছি। আগে ওকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চল আমার সাথে। গাড়িতে যেতে যেতে সব বলব।’

সোহানকে নিয়ে যাওয়ার সময় স্মৃতি জুভানের পথ আটকে দাঁড়াল। সে জুভানের হাতটা তার দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

‘আপনাকে আমি অনুরোধ করছি জুভান, প্লিজ আমার ভাইয়ের কোনো ক্ষতি করবেন না। ও এখনও বাচ্চা একটা ছেলে, আপনার বোনের বয়সী। প্লিজ। আমরা কিন্তু জারার এইটুকুও ক্ষতি করিনি। জারাকে আমি নিজের বোনের মতো ভালোবাসি। ওকে আমি আমার মায়ের কাছে রেখেছিলাম। আমি জানি আপনি ও আপনার বোনকে খুব ভালোবাসেন আর তাই প্লিজ সেই ভালোবাসার খাতিরে আমাদের ভালোবাসাটাও অনুভব করবেন। দয়া করে ওর কোনো ক্ষতি করবেন না।’

জুভান স্মৃতির কথার জবাব না দিয়ে সোহানকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। স্মৃতি নিষ্প্রভ চোখে চেয়ে কেবল তাদের যাওয়া দেখল। কী জানি, আবার সে তার ভাইকে ফিরে পাবে কিনা।

.

গাড়িতে উঠে জুভান ঈশানকে বলল,

‘এবার তোর প্ল্যান বল।’

ঈশান সোহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘তোমাকে আমি যা যা শিখিয়ে দিব, তুমি স্যারের সামনে গিয়ে তাই তাই বলবে বুঝতে পেরেছ?’

সোহান জ্বলে উঠে বলে,

‘কখনোই না। আমি সব সত্যি বলে দিব।’

‘তাহলে, তোমার বোনও বাঁচবে না।’

সোহান রেগে গিয়ে বলল,

‘আমার বোনের কোনো ক্ষতি করার চিন্তা আপনারা মাথায়ও আনবেন না।’

জুভান তখন বলল,

‘তুমি আগে আমাদের কথা শুনো, তাহলে আমরাও তোমার কথা শুনব। আর নাহলে, তোমার মা আর বোন দুজনেই তোমার বাবার কাছে চলে যাবে। আর হ্যাঁ, তোমার বোনকে কিন্তু আমি এত সহজে মারব না। তোমার বোন তো আবার মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর। সেই সৌন্দর্য তো আগে কাজে লাগাতে হবে, তাই না। অনেক অফার এসেছে আমার কাছে। আগে ওকে দিয়ে কিছু টাকা কামাবো তারপর ওকে মেরে দিব। ব্যাস, ঝামেলা শেষ।’

সোহান নাক মুখ কুঁচকে বলে,

‘আমার বোন আপনাকে ভালবেসেছিল। ছি, কতটা নোংরা হলে একটা মানুষ নিজের বউকে বিক্রি করে দেওয়ার কথা ভাবে। জানেন, আপনি যদি এখনও নিজের ভুল স্বীকার করে আমার বোনের কাছে ক্ষমা চাইতেন হয়তো সে আপনাকে ক্ষমা করে দিত। আপনি চাইলেই পারতেন আবার সবকিছু ঠিক করে ফেলতে। কিন্তু আপনি তো একটা অমানুষ, আপনার মতো মানুষ ক্ষমা না ফাঁসিতে ঝুলারই যোগ্য।’

‘আমাকে নিয়ে না ভেবে এখন নিজের কথা ভাবো শালাবাবু, তোমার হাতেই এখন তোমার মা অর বোনের জীবন লেখা। ভেবে দেখ, এখন কী করবে।’

চলবে..