অতঃপর প্রেমের গল্প পর্ব-০৬

0
466

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব_৬

ফারহান আর আফরা দুজনেরই চোখাচোখি হলো এবার।আফরা যে বাঙালি পরিবেশে বড় হয়নি তা গতরাতেই ফারহান আন্দাজ করতে পেরেছিলো। মেয়েটার মতো ওর নামটাও সুন্দর। ফারহান মৃদুভাবে ঠোঁটজোড়া নাড়িয়ে বললো,

‘হ্যালো আফরা!’

আফরা হাসে বিনয়ীভাবে। ভদ্রতার খাতিরেও সেও প্রতিউত্তরে বললো,

‘হ্যালো!’

ফারহান তৎক্ষণাৎ চোখ ঘুরিয়ে নিলো আফরার কাছ থেকে। এমন ভান করছে যে আফরাকে সে একেবারেই চিনেনা। এই মুহূর্তেই তার সাথে আফরার যেন প্রথম দেখা। ফারহান এবার মিঃ ইফাজের দিকে দৃষ্টিনিয়োগ করে বললো,

‘কোনো জরুরি প্রয়োজনে আমায় ডেকেছিলে চাচু?’

মিঃ ইফাজ হাসলেন মলিনভাবে। পত্রিকা ভাজ করতে করতে সে বললেন,

‘তোমায় জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ডাকতে পারি না?’

ফারহানের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসির রেশ দেখা যাচ্ছে। এই পৃথিবী যে কতটা স্বার্থপর তা মিসেস নাবিলাকে দেখেই অত্যন্ত ফারহানের ভালোমতো জানা । কিন্ত এসব কথা একটা বাইরের মেয়ের সামনে এভাবে বলতে ওর মন সায় দিলো না …..তাই শান্ত গলায় প্রতিউত্তরে বললো,

‘আজ পর্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া আমায় তুমি কখনই ডাকোনি চাচু।’

লজ্জায় মাথানুয়ে ফেললেন মিঃ ইফাজ। এই বৃদ্ধ বয়সে এসে তিনি আন্দাজ করতে পারছেন যে ছেলেটর মনে প্রচন্ড ক্ষোভ আর অভিমানের অস্তিত্ব রয়েছে যা কখনোই হয়তো সে প্রকাশ করবে না। আফরা এদের কথপোকথন শুনে অবাক হলো । কিছু একটা গন্ডগোল আছে যা হয়তো সে ধরতে পারছে না। মিঃ ইফাজ মৌনতা ভেঙে বললেন,

‘আজ ব্যস্ত আছো অনেক?’

‘উমমমম! আছি।’

‘কোথায় যাচ্ছো এখন?’

‘বর্ডারের দিকে………….একটা মিটিং আছে ওই এলাকার চেয়ারম্যানের সাথে।’

‘ইলা আর আফরাকে তাহলে বর্ডারের ওদিকে যেকোনো ট্যুরিস্ট জায়গায় নিয়ে যাও।ওদেরকে রেখেই তুমি তোমার মিটিংয়ে যেও। মেয়েটা দুদিন ধরে বাংলাদেশে এসেছে অথচ ফাহিমের এত কাজের চাপ যে ও নিয়েই যেতে পারছে না।’

মিঃ ইফাজের কথায় কোনোরূপ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না ফারহান। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সে স্থির গলায় বললো,

‘ঠিক আছে।’

প্রসন্ন হলেন। মিঃ ইফাজ। আফরা আর ইলার উদ্দেশ্যে তাই বললেন,

‘তোমরা দুজন রেডি হয়ে বাইরে দাঁড়াও। ফারহান গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবে তোমার জন্য।’
______________

আফরা একটি হালকা বেগুনী রঙের ফতুয়া আর জিন্স পরে নিলো। কাধে বরাবরের মতো একটি ছোট ব্যাগ। আফরার কেন যেন মনে হচ্ছে আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় ওকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে।তুলি দিয়ে আটকানো সিল্কি চুলগুলো খুলে ক্লিপ লাগিয়ে নিলো। ইলা আজও প্রথম দিনের মতো হলুদ রঙের একটি থ্রিপিস পড়েছে। দ্রুতস্বরে সে বললো,

‘আপু তাড়াতাড়ি চলো। ভাই রেগে গেলে পরে আমাদের রেখেই চলে যাবে।’

ইলার কথায় দ্রুতপায়ে বাইরে চলে গেলো আফরা। চা বাগানের ছোট ছোট টিলার মাঝখানে সরু পথ দিয়ে দু’তিন মিনিট হাটলেই পিচঢালাই রাস্তার সামনে বিশাল গেট। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে ফারহান। গাড়িতে হেলান দিয়ে আনমনে মোবাইল স্ক্রলিং করছে।আফরা সেখানে গিয়ে বললো,

‘এইযে মিঃ ! এসে পড়েছি।’

‘ওকে। গাড়িতে উঠে পড়ুন।’

ফারহান আফরার দিকে না তাকিয়েই নির্বিঘ্নে কথাটি বলে ওঠলো। ছেলেটার কীর্তিকলাপ দেখে অবাক হলো আফরা। ইতিমধ্যে ইলাও এসে পড়েছে গাড়ির সামনে। আফরা। আবার বললো,

‘গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসবো নাকি ব্যাক সিটে?’

ফারহান মোবাইল রেখে সরু চোখে তাকালো আফরার দিকে। মেয়েটা ওর দিকেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। একটু চাঞ্চল্যতার ভাব। কাটা চুলগুলো হাওয়ার তালে উড়ে যাচ্ছে বারবার।ফারহান মোবাইল পকেটে পুরে গম্ভীর স্বরে বললো,

‘ব্যাক সিটে বসুন ইলার সাথে।’

আফরাকে তারপর আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না সে। সোজাসুজি ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো।

গাড়ি ছুটে চলছে নিদারুন ভাবে। আকাশের মেঘও সামনতালে বয়ে যেতে ব্যস্ত। কি একটা মিস্টি হাওয়া! যেন এই মুহূর্তে আফরার মনেও মিষ্টতা ছড়িয়ে পড়বে। আফরা কানে ইয়ারফোন গুজে আনমনে গান শোনার চেষ্টা করলো কিন্ত পারলো না। তার মনে হচ্ছে এখন গাড়িতে অতীব নজরকাড়া একজন মানুষ ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। মানুষটা কথা কম বলে, যতটুকু বলে তাতে বোঝা যাচ্ছে সে অনেকটা গম্ভীর ধাচের। কালো গহীন চোখে, ঘন পল্লবে তার সৌন্দর্য বেড়ে গিয়েছে। উচু নাক………কথা বলার সময় গালে মৃদু একটি ভাঁজ পড়ে। রোদপোড়া গায়ের রং , বোঝাই যায় ছেলেটার দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে কড়া রৌদ্দুরে। তবুও কেমন যেন চুম্বকের মতো টানে। ছেলেটার চেহারা নায়কদের মতো এতটা সদর্শন না হলেও ভীড়ের মাঝে নজর কাড়ার মতো একটা মোহনীয় চেহারা এতটুকু আফরা নিশ্চিত।

আফরা এবার ফারহানের উদ্দেশ্যে বললো,

‘আর কতক্ষণ লাগবে ফারহান?’

‘এইযে ১০ মিনিটের মতো। ‘

এরই মধ্যে মোবাইলে কল আসলো ফারহানের । স্ক্রিনে ভেসে ওঠছে শামসুর নাম্বার। ফারহান কলটা ব্লুটুথ স্পিকারে ট্রান্সফার করে রিসিভ করলো,

‘হ্যালো শামসু!’

অপরপাশ থেকে কি বলছে আফরা শুনতে পারলো না। কারন ফারহান ব্লুটুথ স্পিকারে কথা বলছে। ফারহান অপরপাশের কথা শুনে প্রতিউত্তরে বললো,

‘ওইসব ট্যাক্সের কাগজপত্র ঠিকঠাকমতো রাখো। ওই চেয়ারম্যানের বাটপারি আজ যদি ফাস না করতে পারি তবে আমার নামও ফারহান জুবায়ের না। ওই এলাকায় আমার পাওয়ার না থাকলেও যেহেতু স্থানীয়রা আমার কাছে বিচার নিয়ে এসেছে আমি অবশ্যই উপরমহলে এটা বরখাস্ত করবো। ‘

আফরা মৌনতার সাথে কথাগুলো শুনলো।হাজার চেষ্টা করেও ফারহানের কথার কোনো ঠিকঠিকানা সে খুঁজে পেলো না। ফারহান অপরপাশের কথা শুনে আবার বললো,

‘ওই চেয়ারম্যান হাজার খুঁজেও আমার দুর্বলতা বের করতে পারবে না। আমায় মরার হুমকি দিচ্ছে ওই বাস্ার্ড? আমি ১০ মিনিটের মধ্যে আসছি। রাজনীতি নিয়ে অনেক দেমাগ না……….আমি আসলেই দেখা যাবে। রাখছি!’

কল কাটলো ফারহান। আফরা সামনের আয়নায় খেয়াল করছে ফারহানের চোয়াল কেমন যেন শক্ত হয়ে ওঠেছে। হয়তো ফোনে এমন কোনো অপ্রীতিকর কথাবার্তা হয়েছে যা ফারহানের হয়তো পছন্দ হয়নি।

এই মানুষটাকে যতই ঘেটে দেখার চেষ্টা করছে ততই প্রহেলিকার জালে হারিয়ে যাচ্ছে আফরা। আফরা এবার চেষ্টা করলো একেবারে শূণ্য থেকে সবকিছুর স্মৃতিচারন করার।গতরাতে ফারহানের সাথে ওর দেখা হয়েছিলো এক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। সময়টাতে সারা শ্রীমঙ্গলে ছাত্রহরতালের জমজমাট আমেজে পরিপূর্ণ ছিলো। এমন সময়ই বৃষ্টির নিদারুন গতির মাঝে আফরার সাথে প্রথম দেখা হলো আহত ফারহানের। ফারহানের ভাষ্যমতে ওর বাহুতে পুলিশের গুলি লেগেছিলো। কিন্ত কেনো?প্রশ্ন জাগলো আফরার মনে। আচ্ছা ফারহান কি তবে ক্রিমিনাল টাইপ কেউ যার কারনে পুলিশের সাথে তার ঘোরতর সম্পর্ক? এমন কিছু আফরা কল্পনা করতে যাবে তখনই ওর মনে পড়লো একটি কথা………’অধিকারের জন্য লড়াই করি।’

কথাটি ফারহান বলেছিলো।এমন ধরনের দাম্ভিক কথাবার্তার মানুষ আর যাই হোক কখনোই অপরাধের সাথে যুক্ত হতে পারে না।

হঠাৎ গাড়ি থামার আওয়াজে নিমিষে আফরার মনের প্রশ্নের পাহাড় কর্পূরের মতো উড়ে গেলো। গাড়িটি থেমেছে একটা সমান্তরাল পথের সামনে। একপাশে বড় করে সাইনবোর্ডে ঝুলানো , ‘Not for driving!’ অর্থাৎ পথটি গাড়ি চলাচলের জন্য না। আফরা আর ইলা বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। পিছু পিছু ফারহানও।

আকাশটা পরিষ্কার। তাই অনেক মানুষই ঘুরতে এসেছে এখানে। বলা বাহুল্য শ্রীমঙ্গলে আষাঢ় মাসে এমন দৃশ্য দেখা দুর্লভ। আফরা অপার নয়নে তাকিয়ে থাকলো পথের দিকে।সামনে সরু পথ দু’ধার দিয়ে বিস্তৃত ক্ষেত। শেষ প্রান্তে কিছু চায়ের স্টল আছে পানাহারের জন্য। আফরা আসার আগে গুগলে জায়গাটির নাম দেখে এসেছিলো কিন্ত কোনো এক কারনে তা ভুলে গেলো সে।
আফরা খেয়াল করলো ফারহান কাউন্টারের দিকে গিয়েছে। ৫ ফুট ৮ ইঞ্চির এই মানুষটার কথাবার্তার ধরনই এমন যে সহজেই কাউকে আকৃষ্ট করতে পারে। ফারহান ওখানে কি বলেছে আফরা তা জানেনা। ছেলেটার সব কিছুই সুন্দর। মাঝে মাঝে ফারহানের বলা কিছু সিলেটি ভাষাও কানে ভেসে আসছে যা আফরার বোধগম্য হলো না। এখানকার স্থানীয়দের সাথে সিলেটি ভাষায় কথা বলতে হবে এটাই স্বাভাবিক…………..বরং প্রমিত ভাষায় কথা বলাটাই হয়তো কিছুটা অস্বাভাবিক। ফারহান দুটো টিকেট নিয়ে এলো আফরা আর ইলার কাছে। আফরার উদ্দেশ্যে বললো,

‘এই নিন টিকেট । আর প্লিজ………..ইলাকে রেখে বেশি দূরে যাবেন না। চাচু যদিও আপনাকে এখানে আনার দায়িত্ব আমায় দিয়েছে তবুও আপনার সিকিউরিটির ব্যাপারে আমি হেলফেল করতে চাচ্ছি না !’

‘বুঝেছি। আপনি আবার আসবেন নাকি আমরা একাই যাবো?’

ফারহান ভ্রু কুচকে আফরার দিকে তাকালো। কেন যেনো মনে হচ্ছে যে এ মেয়েটা হয়তো বড্ড বাচাল ধরনের।আফরাকে কোনো উত্তর না দিয়ে ইলাকে বললো,

‘উনার খেয়াল রাখিস…………….এক-দেড়ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবো।’

বলেই গাড়ি নিয়ে চলে গেলো ফারহান। আফরা এখনও সেপানে তাকিয়ে আছে। মানুষটির ব্যবহার আজব, সেইমতো কথাবার্তাও বড়ই আজব ! কেমন যেন মায়াজালে নিয়ে যায়। তবুও কতটা চোখ ধাধানো তার প্রতিটা কান্ড। আফরা অ্যামেরিকায় থাকাকালীন অনেক ধরনের ছেলেমেয়ের সাথেই অবাধে মেলামেলা হয়েছে কিন্ত বাংলাদেশের এক কোণে শ্রীমঙ্গলের ‘ফারহান জুবায়ের’ এর মতো এতটা প্রলুব্ধ করার মতো ব্যাক্তি সে কখনও দেখেনি….. হয়তো দেখবেও না।
আফরার মনে শত কৌতুহল থাকলেও সে তা মনের মধ্যে পুষে রাখলো। বিড়বিড়িয়ে বললো,

‘আপনার রহস্য বের করেই ছাড়বো রেইনকোর্টম্যান!’

.
.
.
.
#চলবে………ইনশাআল্লাহ!!!