অতঃপর প্রেমের গল্প পর্ব-৪৩

0
352

#অতঃপর_প্রেমের_গল্প❤️
#লেখিকা: কায়ানাত আফরিন
#পর্ব__৪৩

রাতের আকাশ আজ কিছুটা নিস্তব্ধ। তবে সাঁ সাঁ বাতাসের আলোড়নে সবকিছুতে নতুনত্ব আনছে প্রকৃতি। ফারহান গাড়ির ডেকে নিজের গা এলিয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে নিস্তব্ধ আকাশটার দিকে। মন বারবার ছুটে যাচ্ছে ফাহিমের অপেক্ষায়। কি এমন হলো যে ফাহিম এরকম অদ্ভুত কথা বললো তখন? ফাহিমের ব্যাবহার ফারহানকে রীতিমতো না চাইতেও যেন ভাবিয়ে তুলছিলো বড্ড। অবশেষে অপেক্ষার প্রহরের অবসান ঘটলো। গাড়ির ইন্জিনের শব্দ কানের কাছে ভেসে আসতেই ফারহান চোখ ঘুরিয়ে তাকালো সেদিকে। ছিমছাম অন্ধকার রাস্তা রাইফেল রোডের। সেখানে গাড়ির হলদে রঙের হেডলাইটের আলো টা অন্ধকার পুরোপুরি কাটিয়ে না তুললেও কিছুক্ষণ পূর্বের ন্যায় ঘুটঘুটে অন্ধকার বলা যাবে না৷ ফারহান সোজা হয়ে বসলো এবার৷ গাড়িটা যে ফাহিমের এটা দেখা মাত্রই বুঝে ফেলেছে।

ফাহিম ততক্ষণে গাড়ির ইন্জিন বন্ধ করে দিলো, সাথে হেডলাইটও। হয়ে গেলো পুনরায় আগের মতো অন্ধকার। তবে আকাশে আজ কালোবর্ষণ না থাকাতে তারার সমাহারে দেখতে লাগছে অপূর্ব। ফাহিম এবার ঠিক বরাবর এসে দাঁড়ালো ফারহানের৷ ফারহান মৌনতা কাটিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ তোমার তো এসময় চেম্বারে থাকার কথা ফাহিম। আফটার অল সিলেট বিভাগের ওয়েল নোন ডক্টর ফাহিম তুমি। সন্ধ্যার পর যার চেম্বারে রোগীর লাইন ধরে যায়, আর সেই মানুষ আজ সেসব রেখে আমার সাথে কথা বলার জন্য এসেছে?’

ফারহান কথাগুলো বললো অনেকটা বেপোরোয়া সুরে। ফাহিম আলতো হাসলো। বলে উঠলো,

‘ তাহলে ভেবে নেও যে খুব জরুরি কথার জন্যই এসেছি আমি এখানে।’

‘ যেটা বলতে এসেছো, বলে ফেলো।’

‘ আফরা যে আগামীকাল চলে যাচ্ছে তা তুমি জানো?’

ফারহান প্রচন্ড অবাক হলো এতে। কেননা সে-রাতের পর আফরার সাথে ওর কোনো কথাই হয়নি, যার জন্য ওর তাৎক্ষণিক ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটি নিয়ে জানে না ফারহান। জিভ দিয়ে হালাকা ঠোঁট ভেজালো সে। বলে উঠলো,

‘ না, জানি না।’

‘ হঠাৎ করে কেনো এভাবে চলে যাচ্ছে সেটা তো জানো?’

‘ সেটা আমি কেনো জানবো?’

কাটকাট গলায় উত্তর দিলো ফারহান, ওর চোখ স্পষ্ট বলে দিচ্ছে যে এটা সম্পূর্ণ মিথ্যে একটি কথা। ফাহিম তপ্ত শ্বাস ছাড়লো ফারহানের এমন প্রতিউত্তরে। ফারহানের এসব বেপোরোয়া মনোভাব যে দুজনের জীবনই ধ্বংস করে দেবে সেটার আগাম দৃশ্য অনুভব করতে পারছে ফাহিম। জিজ্ঞেস করলো,

‘ তাহলে এটা তো ভালোভাবেই জানার কথা যে আফরা ভালোবাসে তোমায়!’

ফারহান অবাকের আরও এক ধাপে চলে গেলো এতে। কেননা ও ভাবতেও পারেনি যে ফাহিম এ ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারবে। ফাহিম এবার বললো,

‘ অবাক লাগছে ফারহান যে আমি কিভাবে জানলাম? আমি এটাও জানি যে তুমিও দুর্বল আফরার প্রতি।’

‘ অহেতুক কথাবার্তা বাদ দাও ফাহিম!’

ফারহান এড়িয়ে যেতে চাইলো কথাটি, তবে পারলো না৷ কেননা ফাহিম বেশ কড়াকড়িভাবেই ওকে জব্দ করেছে। থমথমে গলায় ফাহিম এবার বলে উঠলো,

‘ কোনটাকে অহেতুক কথাবার্তা মনে হয় তোমার ফারহান! তুমি কি ভাবো আমি ছোটো বাচ্চা? আর তাছাড়া তোমাদের চোখের ভাষা, অঙ্গভঙ্গি, কথাবার্তা, আচার আচরণ এসব দেখে একটা বাচ্চাও বুঝতে পারবে যে তোমাদের ব্যাপারটা কতদূর এগিয়েছে। শুধু তাই না, তুমি আমার ফিলিংস গুলোও স্পয়েল করতে দু’বার ভাবো নি।’

ফাহিমের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ফারহানের প্রতি। এতদিনের জমানো ক্ষোভ সব আজ যেন বেরিয়ে যেতে চাইছে৷ রাগের বশে ফাহিম এবার নিজের দু-হাত দিয়ে চেপে ধরলো ফারহানের শার্টের কলার। থমথমে গলায় বলে ওঠলো,

‘ তোমায় নিজের ভাই মনে করেছিলাম আমি। মায়ের শত বাধা এড়িয়ে সম্পর্ক রেখেছি তোমার সাথে, কারন আমি জানি আমার মা ভুল। তুমি নিঃসঙ্গ মানুষ ছিলে ফারহান, যা আমার ভেতরকেও পুড়াতো অনেক। তাই তো তোমায় সময় দিতাম। তোমার সাথে খেলতাম, কথা বলতাম যাতে তোমার মাথায় একবারও না আসে যে তুমি এতিম, তোমার চাচ্চুর পরিবারে কেউ ভালোবাসে না তোমায়। শুধু তাই না, তুমি যখন রাজনীতিতে ভয়াবহ ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলে তখনও সাপোর্ট করেছিলাম আমি। কম তো আঘাত পাওনি, কম তো হুমকির সম্মুখ হওনি, কম তো রক্তাক্ত হওনি। বলতে পারবে যে তোমার আহত অবস্থায় কখনও আমি তোমার পাশে ছিলাম না? যত রাতই হোক না কেনো, শুধু মাত্র তোমার জন্য আমি রিস্ক নিয়ে হসপিটালে গিয়েছি, ধামাচাপা দিয়েছি তোমার আহত হওয়ার বিষয়টা যাতে পুলিশি মামলায় জড়িয়ে না পড়ো।

এর পর আমায় কি প্রতিদান দিলে তুমি? তুমি খুব ভালোমতোই জানতে যে আফরাকে আমি পছন্দ করতাম। সেটা পছন্দ থেকেও হয়তো বেশি ছিলো। তখন তুমি ছিলে নীরব দর্শক। কেন, বললে কি ক্ষতি হতো যে তুমিও দুর্বল আফরার প্রতি? আর আফরা তোমায় পাগলের মতো ভালোবাসে? দিন নেই রাত নেই একে অপরের সাথে কম তো সময় কাটাও নেই, একবারও কি মনে পড়লোনা এই ভাইয়ের বলা সেই কথাগুলো? একবার বলে তো দেখতে, ট্রাস্ট মি, আমি নিজ থেকে সরে আসতাম। মা’কে আমার আর আফরার বিয়ের সম্পর্কের কথা বলতেও দিতাম না আসিফ আঙ্কেলকে। কিন্ত আমার ফিলিংস গুলোকে তুমি দাম দাও নি ফারহান। যার জন্য এতবড় কথাটি আমায় লুকাতে তুমি দু’বার ভাবলে না।’

ফাহিম এবার ছেড়ে দিলো ফারহানকে। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ফারহান নিস্তব্ধ, একেবারে একটি জলজ্যাম্ত পাথরেরে মূর্তির মতো হয়ে গেলো সে।

এটা সত্য যে ফাহিম বলেছিলো ওর মনের কথা। কিন্ত ফারহান তা ভ্রুক্ষেপ করেনি। যদি ফারহান শুরুতেই ঘটনাটি সামলে নিতো তবে আজ দু’ভাইয়ের মধ্যে এত মান অভিমানের পাল্লার আসর বসতো না। ফাহিম এবার শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলো। ফারহানের কলার ধরার জন্য পরিবেশটা রীতিমতো দগ্ধ হয়ে উঠেছে। কিন্ত ফারহান নির্বিকার, আজ অন্য কেউ ওর কলার ধরলে ফারহান মানুষটার হাত ভেঙে গুড়িয়ে দিতেও দু’বার ভাবতো না। তবে যেখানে ফাহিমই এ কাজ করেছে তাই ফারহানই নিজেকে গুটিয়ে নিলো।বলে ওঠলো,

‘ আমার ওপর তুমি এতদিন রাগ পুষিয়ে রাখছিলে কেনো? সেদিনই বলে ফেলতে যেদিন তুমি জানতে পারলে আমি তোমায় ঠকিয়েছি। হোক আফরা আমায় ভালোবাসতেন, তবে সার্বিক ঘটনার বিচার করলে দোষী আমি। আমি তোমায় ঠকিয়েছি। তুমি আফরাকে পছন্দ করো এটা জানা সত্বেও উনার সাথে সময় কাটিয়েছি আমি। এককথায় হিসেব করলে তোমার আর আফরার বিয়ে ভাঙার ক্ষেত্রেও আমার পরোক্ষভাবে হাত আছে। কেননা তুমি হয়তো ভালোভাবেই আন্দাজ করতে পারছো ঠিক কার জন্য উনি এই বিয়ের কথাবার্তা এগোতে দেননি!’

ফাহিম নিশ্চুপ।

‘ এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরও আমার প্রতি বিন্দুমাত্র অভিযোগ ছিলো না৷ তো আজ কি এমন হলো যে এত রাতে তুমি বাড়ি থেকে এতদূর চলে এলে শুধু আমার সাথে কথা বলার জন্য?’

ফাহিম মৌনতা কাটিয়ে তুললো এবার। বলে উঠলো,

‘ কারন এতকিছুর পরও আমি চাইনা যে তুমি এভাবে নিঃসঙ্গে জীবন কাটাও।……আফরা আগামীকাল চলে যাচ্ছে ফারহান! এর পর আর কখনও আসবে কি না তার নিশ্চয়তাও নেই৷ তবে ওকে থামাও না কেনো? বলো না কেনো যে আফরাকে তুমি চাও?’

‘ আমিই যেতে বলেছিলাম উনাকে। আমার লাইফের কোনো নিশ্চয়তা নেই ফাহিম। এটা সত্য যে আমি এখন নিজের কাজ ভুলে বেমালুম আফরাকে মন দিয়ে বসেছি। তবে আমার ধারনা, এসব কিছুদিন পরই কেটে যাবে।
কিন্ত আমার ভয় হয় ফাহিম, এই প্রথম, এই প্রথম ফারহান জুবায়ের নিজের প্রাণআশঙ্কা নিয়ে ভয় পাচ্ছিলো, ভয় হচ্ছিলো মানুষটার জীবনের সাথে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জড়িয়ে পড়া ভীনদেশী সেই মেয়েটি নিয়ে। মেয়েটা শুধুমাত্র পিতৃ পরিচয়ে বাঙালী। এছাড়া বাঙালীত্বের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই তার মধ্যে। তবুও ফারহান সেই মানুষটার প্রতি নতজানু হয়ে গিয়েছে। কারন কি জানো? কারন সেই মেয়েটার মেঘালয়ের পাহাড়গুলোর মতো আকৃষ্ট করার এক চরম ক্ষমতা আছে। আর আমি চাইনা আমার দুর্বোধ্য জীবনের সাথে তাকে জরিয়ে ফেলতে। পেয়েছো তোমার উত্তর?’

ফাহিম নীরব দর্শকের মতো শুনলো ওর কথাগুলো, তারপর জিজ্ঞেস করলো,

‘ এসব পলিটিক্স করে কি লাভ ফারহান যা তোমায় তোমার পছন্দের জিনিস করতে বাঁধা দেয়?’

‘ প্রথমত, আমি এখানে জড়িয়েছি মানুষদের ভালোর জন্য। আমি একা বড় হয়েছিলাম ফাহিম। পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম৷ আর তাই আমি চেয়েছিলাম যে অন্যদের জন্য নিজেকে কাজে লাগাতে। ছোটো বড়ো কিছু একটা করে মানুষের মনে জায়গা করে ফেলতে। আর আজ আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি, আমার কমরেডের পরিচয়, এখানকার প্রতিটি মানুষের অন্তরে নিজের নামের জয়জয়কার! এটা কি একদিনেই হয়েছে? আমি কিভাবে এসব বেড়াজাল থেকে হারিয়ে যাবো স্পষ্ট উত্তর আছে?’

তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো ফাহিম৷ বলে উঠলো,

‘ পাগল হয়ে গিয়েছো ফারহান! নিজেকে এতটা পাষাণের পরিচয় দিওনা। তুমি আফরাকে ভালোবসো এটা তুমিও জানো, আফরাও জানে। তবে ওকে থামালে ক্ষতিটা কি হয় তোমার? ‘

‘ বলেছি কারনটা। আমি উনাকে এই অনিশ্চিত জীবনের সাথে জড়াতে চাইনা। আর অনুভূতি গুলো কখনোও বলে কয়ে আসেনা ফাহিম! যদি এসব আমার সাধ্যে থাকতো, আমি নিজে এসব থেকে সরে যেতাম।’

‘ সময় আছে এখনও। পুরোটা রাত এই আকাশ দেখো আর ভালোমতো ভাবো, কি কি বোকামিগুলো করছো তুমি। আফরাকে এভাবে হারিয়ে যেতে দিও না ফারহান! জাস্ট ভেবে দেখতো, তুমি বা আফরা, কেউ কি ভেবেছিলে যে এভাবে দু’প্রান্তের মানুষ পরিশেষে নিজেদের সর্বস্ব অনুভূতিপ্রবণ বানিয়ে ফেলেবে? ‘Destiny’ ব্যাপারটা বিশ্বাস করলে আফরাকে নিজের করে ফেলো। আজ রাতই সময় আছে তোমার কাছে। এমন যেনো না হয় যে, মরিচীকার পিছে ছুটে তুমি মহামূল্যবান কিছু হারিয়ে ফেললে!’

ফাহিম আর একদন্ড থাকলো না এখানে। গাড়ি নিয়ে সে সোজা বাড়ির দিকে চলে গেলো। এদিকে ফারহানের কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ফাহিমের বলা শেষ কথাগুলো। সে কি আসলেই তবে কোনো ভুল করছে? আর ভাবতে পারলো না ফারহান। পাশে সমান্তরাল ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশের সৌন্দর্যে বুদ হয়ে রইলো।
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ।