#অনিন্দিতা
#২য় এবং ৩য় পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
তাজের মা দরজা খুলেই নিজের ছেলেকে অনির সাথে দেখে চমকে যায়৷ তাও আবার বউ সাজে! অনিকে যে তাজ বিয়ে করে এনেছে তা বুঝতে বাকি থাকে না উনার৷ উনি তাজের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“এটা তুই কেন করলি বাবা? আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না? আমি কি তোর কাছে এতটাই অপ্রয়োজনীয়? ”
চোখের জলটাকে আটকে রাখতে পারছিলেন না। তাজ অনিকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এসে নিজের মায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল,
–“আমাকে ক্ষমা করে দাও মা! পরিস্থিতিটা এমন ছিলো যে আমি তোমাকে জানাতে পারিনি।”
তাজের মা অনিকে লক্ষ্য করে একটু কঠোর সুরে বললেন,
–“আমার বাড়িতে বউ হয়ে আসার এতো ইচ্ছে ছিলো তা আমাকে একবার জানালেই পারতে। আমি নিজে তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতাম! আমাকে তুমি কি অনেক খারাপ মানুষ ভাবো! তোমার বাবা কি জানে তুমি তাজের সাথে এসেছো? পালিয়ে কেন আসলে?”
উনার মুখে এমন কথা শুনে তাজ আর অনি দুজনেই অনেক অবাক হয়ে যায়৷ অনি কিছু বলার আগেই তাজ ওর মাকে বলে,
–“মা তুমি আমাদের ভুল বুঝছো। তুমি যা ভাবছো তা নয়! অনির পরিবার থেকেই আমাদের বিয়েটা দিয়েছে!”
তারপর তাজ ওর মাকে সবটা খুলে বলে। ইমতিয়াজ আর পিহু কি করে অনিকে ধোঁকা দিয়েছে। আর অনি কোন পরিস্থিতিতে তাজকে বিয়ে করেছে।
পুরোটা শোনার পর তাজের মা নিজের ছেলে আর অনিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“তোমরা দুজনে কি আসলেই খুশি এই বিয়েতে?”
মায়ের প্রশ্ন শুনে তাজ ততক্ষণাত উত্তর দেয়,
–“হ্যাঁ মা, আমি খুশি! ভীষণ খুশি! ”
অনিকে চুপ থাকতে দেখে তাজের মা আবার বলে,
–“অনিন্দিতা, তুমি চুপ করে আছো কেন? তুমি কি এই বিয়েতে খুশি নও?”
অনি তাজের মাকে ভীষণ ভয় পায়৷ তাই এইবার ভয়ে-ভয়ে উত্তর দেয়,
–“হ্যাঁ আন্টি, আমিও ভীষণ খুশি তাজকে মানে তাজওয়ারকে বিয়ে করে!”
তাজের মা এমন পরিস্থিতিতেও হেসে ফেলে৷ তারপর অনির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
–“আমাকে তুমি এখন থেকে মা বলতে পারো৷ আন্টি বলতে হবে না৷ আর তাজওয়ারকে তুমি যা খুশি ডাকতে পারো।তবে স্বামী হিসেবে একটু মান্য করেই কথা বলো! তাহলেই হবে!”
একথা শুনেও অনির ভয় দূর হয়না। মনে মনে ভাবে যে, যার থেকে সব সময় একশ হাত দূরে থাকার চেষ্টা করতো আজ তার পাশে বসে থাকতে হচ্ছে! আসলে তাজের মা ওকে অপছন্দ করে তা নয়! বরং নামাজ-কালাম আর হাদীসের কথা শুনায় বলে অনির কাছেই উনাকে ভালো লাগে না! ভয় লাগে, কখন কী বলে বসে!
–“তুমি কি আমাকে ভয় পাও?”
তাজের মায়ের কথায় চমকে উঠে অনি। তারপর নিজের ভয়টাকে যথাসাধ্য লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে আমতা-আমতা করে বলে,
–“না!… মানে…. আসলে!…”
ওকে এমন আমতা-আমতা করা দেখে তাজের মা তাজকে বলে,
–“বৌমাকে ঘরে নিয়ে যা! ”
তাজ অনিকে নিয়ে ঘরে যাচ্ছে এমন সময় আবার কলিংবেল বেজে উঠে৷ তখন তাজ দরজা খুলতে গেলে ওর মা ইশারায় ওকে রুমে যেতে বলে নিজেই দরজা খুলে দেয়৷ আর সাথে-সাথেই পাশের ফ্ল্যাটের মহিলাটা হুড়মুড় করে বাসায় ঢুকে বলতে থাকে,
–“তাজ নাকি বউ নিয়ে এসেছে? আমার মেয়েটা বলছিলো যে, ‘তাজ ভাইয়া একটা বউ এনেছে! ‘ আমারতো প্রথমে বিশ্বাস-ই হচ্ছিলো না! ছোট মানুষ ভুলভাল বকছে! কিন্তু বাইরে নতুন হিল দেখে সন্দেহ হলো তাই!…”
তাজের মা হাসিমুখে উনাকে ভেতরে এসে বসতে বললেন। তারপর বললেন,
–“তুমি ঠিক-ই শুনেছো৷ আমার তাজওয়ার একটা টুকটুকে বউ নিয়ে এসেছে৷ আসলে আমার অনুষ্ঠান করার কোনো ইচ্ছে ছিলো না! তাই এমন হুটহাট করে বিয়ে করালাম। ”
আসলে তাজের মা চাচ্ছিলো না যে, কেউ জানুক তাজ কীভাবে বিয়ে করেছে। মহিলাটাও অনেক চালাক প্রকৃতির ছিলো। তিনি তাজের মাকে বললেন,
–“সে আমরা বুঝি আন্টি! এখনকার ছেলে-মেয়েদের কর্মকাণ্ড! তা বউয়ের মুখটা কি দেখা যাবে? নাকি বউকেও লুকিয়ে রাখবেন আমাদের থেকে?”
তাজের মা হেসে বললেন,
–“না তা কেন হবে মিনা! আমি এক্ষুনি আমার বউমাকে ডেকে দিচ্ছি৷ ”
একথা বলে অনিকে ডাকতে যাবে তখনি সেখানে অনি এসে হাজির। আসলে মিনাকে আসতে দেখে তাজ অনিকে বসার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে।
অনি ওখানে দাঁড়িয়ে পড়লো। তারপর মিনাকে সালাম দেওয়ার পর তাজের মা খুশিমনে অনিকে ওখানে বসতে বলল।
অনিকে দেখার সাথে-সাথেই মিনা চেঁচিয়ে উঠল,
–“আরে অনি যে! আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম এই দুইটার মধ্যে কিছু চলছে! আন্টিকে বলতে চেয়েছিলাম, আন্টি বিশ্বাস করবে না ভেবে বলিনি আর! তাহলে আমার ধারণাটাই ঠিক ছিলো!”
কথাগুলো শুনে বোঝা যাচ্ছিলো যে, অনিকে তাজের বউ হিসেবে দেখতে পেয়ে উনি যেন ভীষণ খুশিই হয়েছে! তারপর আবোলতাবোল গল্প শুরু করে দিলো মিনা। তার কোন-কোন আত্মীয় লাভ ম্যারেজ করেছে! তাদের পরিণতি কি হয়েছে! আরো অনেক কিছু। তাজের মা যখন বুঝতে পারলো যে, মিনা যাওয়ার নাম নিচ্ছে না তখন তিনি বললেন,
–“মিনা ডিনার করে যাও! বসো আমি সব রেডি করছি। আমাদের এখনো ডিনার হয়নি, একসাথে করা যাবে!”
একথা বলার পর মিনা উঠে বলল,
–“না আন্টি আমি উঠি আজ৷ অনেকক্ষণ হলো এসেছি! ওদিকে আমার বাসায় কি হচ্ছে কে জানে! কাল আবার আসবনে!”
বলেই মিনা চলে গেলো। তাজের মা অনিকে নিয়ে উনার মেয়ে আফিয়ার ঘরে গেলেন। তারপর ওর একটা ড্রেস অনিকে দিয়ে বলল,
–“যাও এসব চেঞ্জ করে নাও! তাজওয়ারকে বলব কাল তোমাকে শপিং করাতে নিয়ে যেতে। এখনকার মতো এটা পড়ে নাও।”
অনি কি বলবে বুঝতে পারছিলো না। তাই চুপ করে ড্রেসটা নিয়ে নিলো৷ তাজের মা বলল,
–“আমি খাবার রেডি করছি, তুমি তাজওয়ারকে নিয়ে চলে আসো।”
–“আমি এখন কিছু খাবো না। আসলে…”
অনিকে থামিয়ে দিয়ে তাজের মা বলল,
–“রাতে না খেয়ে থাকতে হয়না। একটু কিছু হলেও মুখে দেবে!”
অনি নিজের রুমে চলে এলো। দেখলো সেখানে তাজ নেই৷ ও অহিকে ফোন করলো। অহি ফোন ধরেই কান্না করে দিলো। তারপর বলল,
–“আপু তুই ঠিক আছিস? তোর জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে৷ বাবাও খুব চিন্তা করছেন!”
অনি অহিকে শান্ত করে বলল,
–“বাবাকে বল আমাকে নিয়ে চিন্তা না করতে। আমি এখানে ভালই আছি৷ তাজের মাকে আমি যতটা খারাপ ভাবতাম উনি ততটাও খারাপ নয়! বাবা কিছু খেয়েছে?”
–“না, নামাজ পড়তে গেছে। তোর ওই পিহুকে কেউ মেনে নিচ্ছে না! চাচিতো সোজা বলে দিয়েছে যে, ওই মেয়েকে কিছুতেই ছেলে-বৌ হিসেবে মেনে নিবে না! চাচাও ভীষণ রেগে আছে। কেউতো ওর সাথে কথাও বলছে না! ইমতিয়াজ ভাইয়াকে না আমার খু*ন করতে মন চাচ্ছে! তোর সাথে এমনটা করতে পারলো! আমি হলে উনাকে খু*ন করে দরকার হয় জেলে যেতাম!”
–“পাগলী কোথাকার! এসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না! তুই শুধু বাবার খেয়াল রাখবি। আর হ্যাঁ, নিজের খেয়ালটাও এখন থেকে তোকেই রাখতে হবে।”
–“তুমি এমনভাবে কথাগুলো বলছো যেন আর কোনোদিনও এ বাড়িতে আসবে না! আচ্ছা কাল আমরা তোমাকে আনতে যাবো না?”
–“জানিনা! তাজের মা যা বলবে তাই! উনি এখন কি বলবেন!”
তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর অহিকে বিদায় জানিয়ে কল কেটে দিলো অনি। তারপর ড্রেস চেঞ্জ করতে যাবে তখনি ওর বান্ধবী লোপা কল করলো। অনি কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে লোপা বলে উঠলো,
–“কিরে অনি, খুবতো বলেছিলি যে, তোর ইমতিয়াজ তোকে ভীষণ ভালবাসে! এই তার পরিচয়! এক পিহুর রূপকেই সামাল দিতে পারলো না!”
অনি লোপার কথায় রেগে গিয়ে বলল,
–“তুই কি আমার বান্ধবী নাকি শত্রু! আমার এত বড় সর্বনাশ হয়ে গেলো আর তুই মজা নিচ্ছিস!”
লোপা তখন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
–“কে যেন তার ভালবাসার মানুষ নিয়ে গর্ব করেছিলো! চ্যালেঞ্জতো তুই-ই করেছিলি! এখন হেরে গিয়ে এমন লাগছে কেন?”
অনির তখন সেদিনের কথাটা মনে পড়ে গেলো। ইমতিয়াজ যেদিন দেশের বাইরে থেকে আসে। ও ওর বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেওয়ার সময় গর্ব করে বলেছিলো,
–“আমাকে ইমতিয়াজ ভীষণ ভালবাসে। কোনোকিছুই তাকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না!”
তখন লোপা হেসে উত্তর দিয়েছিলো,
–“আমাদের পিহুর রূপের কাছে যেকোনো ছেলে কুপোকাত! তোর ইমতিয়াজ আর কি!”
অনিও রেগে গিয়ে বলেছিলো,
–“দেখা যাক তোমাদের পিহুর রূপের আ*গুন আমার ভালবাসাকে জ্বালাতে পারে কিনা!”
কথাটা বলেই অনি ওখান থেকে উঠে চলে আসে। কিন্তু সেটাতো বান্ধবীদের সাথে মজা ছিলো! সেটাকেই পিহু সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছে! তারমানে পিহু কি ইমতিয়াজ এর সাথে ভালবাসার অভিনয় করছে?
–“কিরে এখন চুপ হয়ে গেলি কেন? বেলুনের হাওয়া বের হয়ে গেছে বুঝি! ”
লোপার কথায় সম্বিৎ ফিরে পায় অনি। তারপর রেগে বলে,
–“তুইও আমার সাথে কথা বলবি না!”
–“কেন? তাজকেতো পেয়েছিস! আর কি লাগে!”
–“কিসের তাজ! আমি কি তাজকে শখ করে বিয়ে করেছি নাকি! বড্ড বড় ভুল করে ফেলেছি এই তাজকে বিয়ে করে! তখন যে আমার কি হয়েছিল! কেন যে আমি এই তাজকে….”
কথাটা বলে পিছনে ফিরে তাজকে দেখে চমকে যায় অনি। তারপর লোপার কল কেটে দিয়ে তাজকে বলে,
–“তাজ, তুই কখন আসলি? আসলে আমি লোপার সাথে কথা বলছিলাম! আসলে কথাগুলো ওভাবে বলতে চাইনি। আসলে…”
তাজ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
–“তুই এটা কেন করলি অনি? আমিতো ভেবেছিলাম তুই আমাকে অন্তত ভালো বন্ধু ভাবিস! কিন্তু..”
–“তাজ এমন কিছুই নয়। ব্যাপারটা আসলে এমন যে, সবকিছু হুটহাট করে হয়ে গেলো! তাই মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে!”
–“আমাকে বিয়ে করে তুই রিগ্রেট করছিস তাইনা? ”
–“ব্যাপারটা এমন নয় তাজ!”
অনি আরকিছু বলার আগেই তাজ ওখান থেকে মন খারাপ করে চলে যায়। অনি কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। ও তাজের সাথে কথা বলার জন্য রুম থেকে বের হওয়ার আগেই তাজের মা রুমে প্রবেশ করে বলে,
–“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে অনিন্দিতা! ”
চলবে…?
#অনিন্দিতা
#৩য়_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা
হঠাৎ করে চোখের সামনে তাজের মাকে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে যায় অনি। তারপর আমতা-আমতা করে বলে,
–“জ্বি বলুন।”
–“আচ্ছা, আগে বসো। ”
তারপর দুজনে তাজের বিছানার একপাশে বসে পড়ে। তাজের মা অনিকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলে,
–“তুমি এখনো ফ্রেস হওনি? ড্রেসটা কি তোমার পছন্দ হয়নি? আমাকে নিঃসঙ্কোচে বলতে পারো।”
–“না তেমন কিছুই না। আসলে বাসায় কথা বলছিলামতো তাই…!”
–“ওহ আচ্ছা! তা বাসার সবাই ভালই আছেতো?”
–“হ্যাঁ, শুধু বাবা একটু চিন্তা করছেন!”
–“তোমার বাবাকে বলো চিন্তা না করতে। আমরা আছিতো এখানে।”
–“হুম।”
–“আসলে তোমাকেতো বলার অনেক কথাই আছে। তবে সবতো আর একবারে বলা যাবেনা! প্রথম যে কথাটা বলতে চাই তা হলো, তাজওয়ার এখন তোমার স্বামী, আর তুমি ওর স্ত্রী! আমি জানিনা তোমাদের মনের মধ্যে এখন কি চলছে! আর জানতেও চাইনা। শুধু এটুকু বলতে চাই যে, আল্লাহ যার সাথে যার জুড়ি লিখে রেখেছেন তার সাথেই তার মিলন হবে। এতে কারোর কোনো হাত নেই! আমি তোমাকে বা আমার ছেলেকে কাউকেই দোষ দিচ্ছিনা। কারণ এটা আল্লাহ তায়ালার হুকুমেই হয়েছে। আমার কথা কি তুমি কিছু বুঝতে পারছো?”
–“জ্বি।”
–“শুধু জ্বি বললে হবে না মা! তোমার প্রতি তাজওয়ারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে তেমনি আজওয়ারের প্রতি তোমারও দায়িত্ব রয়েছে। আমি শুধু তাজওয়ার নয়, তোমার মা হিসেবেও বলছি, নিজের জিনিস সব সময় নিজেকেই দেখে রাখতে হয়! নইলে তা হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া যে বড় মুশকিল! আজ হয়তো স্বামীর মর্ম তুমি বুঝছো না! কিন্তু তার মর্ম তুমি যত দেরিতে বুঝবে ততই বেশি পস্তাতে হবে! ”
–“মা আপনি ভুল ভাবছেন। আমার আর তাজের মধ্যে সব ঠিকঠাক আছে। আমরা একে অপরকে মেনে নিয়েই বিয়ে করেছি। আপনি এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না।”
–“মা হিসেবে একটা কথা বলব? কিছু মনে করবে নাতো?”
–“না মা, বলেন।”
–“বিয়ের আগে হোক বা পরে! একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কখনো ভালো বন্ধু হতে পারেনা। এইজন্য আমি তোমাকে সাবধান করতাম। আমি তোমাকে অপছন্দ করি তা নয়! আসলে আমি আমার নিজের ছেলেকেই যেখানে ঠিক করতে পারিনি সেখানে তোমাকে জোর করি কি করে!আসলে মেয়েদের সৌন্দর্য হচ্ছে চুম্বকের মতো, আর ছেলেদের দৃষ্টি হচ্ছে লোহার মতো। তাই মেয়েদের সৌন্দর্য দেখলেই ছেলেদের লোলুপ দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট হয়! মেয়েদের সৌন্দর্য চুম্বকের মতো ছেলেদের কাছে টানে। যা থেকে মেয়ে আর ছেলে কেউই বাঁচতে পারেনা!”
কথাটা শুনেই ওর পিহু আর ইমতিয়াজ এর কথা মনে পড়ে মনটা খারাপ হয়ে যায়। ওর মন খারাপ দেখে তাজের মা বলে,
–“আমি তোমাকে আজ আর তেমন কিছু বলব না। তবে তুমি চাইলে নামাজ-কালাম আর ইসলামিক জীবনের ব্যাপারে তোমাকে শাসন করতে পারি। কি দিবেতো সেই অনুমতি? ”
একথা শুনে অনি কিছুটা লজ্জা পায়৷ আর ওর মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। সারাক্ষণ ওকে আর অহিকে নামাজের জন্য বকাঝকা করতো। যখন ওরা দুবোন নামাজ পড়তো তখন ওর মা ভীষণ খুশি হতো। কই ওর মায়ের এত বকা সত্বেওতো ও কখনো ওর মাকে অপছন্দ করেনি! তাহলে তাজের মাকে ওর এত ভয় কেন লাগে?
–“কি আমাকে কি তোমার মা ভাবতে পারছো না?”
অনি তাড়াতাড়ি বলে উঠে,
–“আরে না! তা নয়! আসলে আপনার কথা শুনে আজ মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি?”
কথাটা বলে অনি নিজেই অবাক হয়ে যায়। এসব ও কি বলল! কিন্তু তাজের মা ওকে অবাক করে দিয়ে অনিকে নিজের বুকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,
–“আজ থেকে তুমি আমাকে তোমার নিজের মা ভাবতে পারো। কোনোকিছুর দরকার হলেই আমাকে জানাবে।”
অনেকদিন পর তাজের মায়ের বুকে অনি তার মায়ের সেই ভালবাসার উষ্ণতা খুঁজে পায়। তারপর তাজের মা বলল,
–“পারলে আজ রাতে তাজওয়ারের সাথে দুই রাকাআত নফল নামাজ পড়ে নিও মা। এটা মুস্তাহাব!”
অনি কিছু না বলে চুপ করে থাকে। আজ ওর কাছে কেন জানি তাজের মায়ের বলা কথাগুলো শুনতে অনেক ভালো লাগছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ও উনার বলা প্রতিটা কথা শুনে যাচ্ছে আর ভাবছে যে, যেভাবেই বিয়ে হোক না কেন তাজ এখন ওর স্বামী! আর ওকে এটা মেনে নিতেই হবে!
ড্রেসটা পরিবর্তন করে অনি আফিয়ার ড্রেসটা পড়ে ডিনার করতে যায়। ও খেতে না চাইলে তাজের মা নিজহাতে ওকে খাইয়ে দিতে থাকে। তখন তাজ ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“মা তুমি কি ছেলের বউকে পেয়ে নিজের ছেলেকেই ভুলে গেলে! আমাকেও একটু খাইয়ে দাও!”
বলেই হাঁ করে মায়ের দিকে মুখটা বাড়িয়ে দেয়। তাজের মা ভাতের নলাটা তাজের মুখে দিতে-দিতে অনিকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–“তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি জন্য লজ্জা পেতে হবে না। আফিয়া আর তাজওয়ারকেও এখনো মাঝেমধ্যে খাইয়ে দিতে হয়! আফসোস! ছেলেটাকে নিয়মিত নামাজ-কালাম পড়ানোটাই এখনো শেখাতে পারলাম না! এখন তুমি যদি পারো!”
তাজওয়ার ওর মাকে বলে,
–“মা আমি কিন্তু যথেষ্ট বুদ্ধিমান একটা ছেলে। বাইরে সবাই আমার প্রশংসা করে, তুমি ছাড়া! আর মায়ের কাছে কি সন্তান কখনো বড় হয় নাকি!”
–“আমিও প্রশংসা করতাম যদি একটু আমার কথা মেনে চলতি! নিয়মিত নামাজ পড়লে কি এমন ক্ষতি হয়? প্রতিদিন সকাল থেকে শুরু করে কতবার তোকে নামাজের কথা বলি! সেদিকে খেয়াল থাকে তোর! ছোটবেলায় যাওবা পড়তি এখনতো একদম-ই পড়তে চাস না!”
–“মা অন্যকারো সামনে তুমি এভাবে আমাকে না বললেও পারতে! আমার মান-সম্মান বলে একটা জিনিস আছে না!”
–“অনিন্দিতা এখন এ বাড়ির বউ! বাইরের মানুষ কি করে হয়! তুই আমার কথা শুনিস না! আমার বউমা আমার কথা ঠিক শুনবে দেখিস!”
–“আচ্ছা দেখা যাবে!”
অনি শুধু মা-ছেলের খুনসুটিগুলো শুনে যাচ্ছিলো আর ওর বাসার কথা ভাবছিলো। ও আর অহিওতো ওর মায়ের সাথে কত মজা করতো! মাঝেমধ্যে ওর বাবাও যোগ দিতো! এসব ভেবে অনির চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। সবার অগোচরেই অনি সেটা মুছে ফেলে।
খাওয়া শেষে তাজের মা নিজের রুমে চলে যায়। আর রুমে যাওয়ার আগে তাজের রুমে একগ্লাস দুধ আর কিছু মিষ্টি দিয়ে যায়। অনি আগে থেকেই রুমে বসে ছিল। ওর শাশুড়ীর কথামতো ওজু করে তাজের জন্য অপেক্ষা করছিলো। তাজ রুমে ঢুকতেই অনি ওর হাত ধরে বলল,
–“সরি তাজ। আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দে….না মানে দাও!”
অনির মুখে ‘তুমি’ ডাক শুনে তাজ ভীষণ অবাক হয়ে যায়৷ নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে তারপর অনিকে বলল,
–“আমার মা কি তোর উপরে কোনো যাদু-টাদু করলো নাকি! মুহূর্তেই তুই আমাকে তুমি করে বলছিস? আর সরি কিসের জন্য?”
–“তোমাকে বিয়ে করে আমি কোনো ভুল করিনি! ”
–“এটা কি আবেগের বশে বলছিস? নাকি আমার মায়ের কথা শুনে আমাকে করুণা করছিস?”
–“দেখো আমি তোমাকে তুমি করে বলছি। সো আশা করি তুমিও আমাকে তুমি করেই বলবে৷ আমরা এখন স্বামী-স্ত্রী!”
তাজ কিছুটা রেগে গিয়ে বলে,
–“তো? আজ থেকেই আমাকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছিস? দেখ আমাকে বিয়ে করাটা তোর আইডিয়া ছিলো! আমি তোকে জোর করে বিয়ে করিনি! সো তুই চাইলে….”
এটুকু বলেই থেমে যায় তাজ। আজ কি বলবে ভেবে রেখেছিলো আর এসব কি বলছে তাজ! নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। নিজের ভালবাসার মানুষটাকে এত কাছে পেয়েও ভালবাসার কথাটা বলতে পারছে না তাজ। এর চেয়ে বড় দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে!
–“আমি চাইলে কি তাজ?”
–“কিছুনা। তুই চাইলে এই রুমে তুই একা থাকতে পারিস৷ আমি আফিয়ার রুমে যাচ্ছি।”
কথাটা বলেই তাজ রুম থেকে বের হতে গেলে অনি ওর হাতটা আবার ধরে ফেলে। তারপর নিজের কাছে টেনে এনে ওর মুখের সামনে গিয়ে বলে,
–“জীবনটা কোনো নাটক-সিনেমা বা গল্প-উপন্যাস নয় তাজ। এটা বাস্তবতা! আর এখানে একবার কারো বিয়ে হলে সে জীবন দিয়ে হলেও সেটা রক্ষা করে! আমিও তাই চাই!”
তাজ অনির থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
–“কি চাস তুই?”
–“একটা স্বাভাবিক জীবন! একটা দায়িত্ববান স্বামী, একটা আদর্শবান মা, আর একটা নিষ্পাপ বোন!”
–“আর আমি কি চাই তুই একবারও তা জানতে চেয়েছিস?”
–“তুমি আমাকে তুই বলাটা বাদ দেবে প্লিজ! কথাটা এখন আমার কানে কেন যেন কাঁটার মতো বিধছে! আমি তোমাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে চাই। আমার জীবনের ভুলটাকে আমি ফুল ভেবে গ্রহণ করতে চাই! তুমিওতো এটাই চাও তাইনা?”
তাজ ‘হ্যাঁ’ বলতে গিয়েও কেন জানি আটকে যায়। তখন অনির বলা সেই কথাটা ওর কানে বাজতে থাকে,’ বড্ড বড় ভুল করে ফেলেছি এই তাজকে বিয়ে করে!’
–“কি হলো বলো? তুমি কি চাও?”
অনির কথায় ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে তাজ। অনির বলা কথাগুলো ওর কাছে সস্তা আবেগ মনে হতে থাকে৷ মনে হয় এসব ও আবেগের বশে বলছে৷ ঠিক যেমন বিয়ের সময় বলেছিলো! পরে যদি এরজন্য আবার কষ্ট পায়! তাই নিজের ইচ্ছেগুলোকে ধামাচাপা দিয়ে রেখে তাজ অনেক কষ্টে বলে,
–“আমি কিছুই চাইনা। তুই ভালো থাকলেই হবে!তোর ভালোর জন্যইতো বিয়েটা করেছি! ভালো বন্ধুত্বের দায়িত্ব পালন করছি!”
অনি কিছুটা নিরাশ হয়ে বলে,
–“শুধুই বন্ধুত্ব?”
–“অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়! তুই চাইলে আমি আফিয়ার ঘরে…”
–“তুমি আবার সেই এক কথাই বলে যাচ্ছো! ওকে তুমিতো আমার ভালো বন্ধু তাইনা? তাহলে চুপচাপ আমি যা বলবো তাই করবে! তাহলেই আমি ভালো থাকবো! রাজি?”
তাজ কোনোকিছু না ভেবেই “হ্যাঁ” বলে দেয়। তারপর অনি ওকে বাথরুমের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে,
–“এইবার সুন্দর করে ওজু করে আসো৷ মা আমাকে বলেছে দু রাকাআত নফল নামাজ পড়তে।”
–“এখন বুঝতে পারছি কেন তোর এত পরিবর্তন! ”
–“মানে?”
–“মা নিশ্চয়ই তোর উপরে কোনো যাদু করেছে! নইলে তোর মতো মেয়ে বলবে নামাজের কথা!”
–“তুমি আবার আমাকে তুই করে বলছো! নেক্সট এই তুই শুনলে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিচ্ছি!”
–“আচ্ছা ঠিক আছে৷ বলব না!”
কোনো ছেলে যেন তার বান্ধবীকে বিয়ে না করে! প্রথমদিনেই এতো হুকুম! বাপরে! বাপ! আমার মা যে কি করেছে ওর তা সেই ভালো জানে! এই মোহটা যে কখন কাটবে! আর কখন আমি সেই আগের অনিকে ফিরে পাবো কে জানে! এই অস্বাভাবিক অনির সাথে থাকলে আজ আমিও অস্বাভাবিক হয়ে যাবো দেখছি! কথাগুলো ভাবতে-ভাবতে বাথরুমে ওজু করতে চলে যায় তাজ।
চলবে…?