অনিন্দিতা পর্ব-০৫

0
191

#অনিন্দিতা
#৫ম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

তাজের মায়ের কথা শুনে অনি আমতা-আমতা করে বলল,

–“বাবাকে একটু দেখতে যেতাম। আপনি যদি একটু…!”

তাজের মা হেসে বলল,

–“ওহ! এই ব্যাপার! আমি তাজওয়ারকে বলছি তোমাকে নিয়ে যেতে। তার আগে দুজনে শপিংমলে গিয়ে তোমার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে নাও। তারপর না হয় যাও!”

অনি খুশি হয়ে বলল,

–“বাসায় আমার সব জিনিস আছেতো! আবার নতুন করে….! ”

–“বাসায় আছেতো কি! তোমাকে বিয়ের কোনো জিনিস-ই দেওয়া হয়নি! আজ গিয়ে সব তোমার পছন্দমতো কিনে আনবে। আমি তাজওয়ারকে বলছি।”

তারপর উনি নিজের ছেলেকে ডেকে বলে দিলেন অফিস থেকে আজকের ছুটি নিয়ে অনিকে নিয়ে বাইরে যেতে। আর তাজ নিজের বাইক কেনার জন্য যে টাকা জমিয়েছিলো আপাতত সেটা অনির মোহরানা হিসেবে দিয়ে দিতে। তাজ কিছুটা ইতস্তত করে অবশেষে মায়ের কথায় রাজি হয়ে গেলো!

অনি আফিয়ার আরেকটা ড্রেস পড়ে রেডি হয়ে নিলো। তখন ওর শাশুড়ী এসে ওর হাতে একটা বোরখা ধরিয়ে দিয়ে বলল,

–“এই বোরখাটা রাখো মা! আমি জানি তুমি বোরখা পড়ো না, তবে এখন থেকে চাইলে এটা পড়তে পারো। এটা নতুন বোরখা! আমি এখনো পড়িনি।আর আমি তোমাকে জোর করব না! তোমার যেদিন ইচ্ছে হবে সেদিন-ই পড়বে!”

অনি বোরখাটা হাতে নিয়ে দেখে বলল,

–“আসলে আমি কখনো পড়িনি! হুট করে এরকম বোরখা পড়ে ওই বাড়িতে গেলে সবাই কি ভাববে!”

–“কে কি ভাবলো সেটা বড় কথা নয়! তোমার মন যা চাইবে সেটাই করবে! একজন নারীর সৌন্দর্য শুধু তার স্বামীকেই দেখানো উচিত। ”

–“আচ্ছা মা, আমি চেষ্টা করব। ”

–“আসলে আমার খুব ইচ্ছে ছিল তাজওয়ারের জন্য এমন মেয়ে দেখবো যে খুব পরহেজগার! যাতে আমার ছেলেটাকেও কিছুটা ইসলামের পথে আনতে পারে! কিন্তু আল্লাহ সবচেয়ে উত্তম পরিকল্পনাকারী!এখানে আমার কোনো হাত নেই!”

অনিকে এসব বলছিলেন তখন কলিংবেলের আওয়াজ শুনে তাজের মা সেদিকে ছুটে গেলেন।দরজা খুলে দেখলেন যে, উনার বড়বোন এসেছে। উনি ঢুকেই বলতে লাগলেন,

–“কিরে তাজ নাকি বিয়ে করে এনেছে? আমাদেরকেও একবার জানালি না? আপন বলতে আমরাই দুইবোন! আমাকেও পর করে দিয়েছিস?”

তাজের মা বোনকে শান্ত করে বলল,

–“তুই কোথায় খবর পেলি?”

–“তাজ-ইতো কাল বলল। আমি তোকে ফোনে পাচ্ছিলাম না! তাজকে ফোন করায় ওই সবটা বলল যে, ওর কোন বান্ধবীকে নাকি বিয়ে করে নিয়েছে! কই বউ? দেখি!”

–“ওরা একটু বাইরে যাবে। এখন একটু শান্ত হ৷ আমি তোকে সবটা বলছি!”

তারপর উনি নিজের বোনকে সবটা খুলে বলতে লাগলেন।

অনি রেডি হয়ে তাজের জন্য অপেক্ষা করছিলো। তাজ একটু বাইরে গেছে৷ বোরখাটা নেড়েচেড়ে দেখছিলো এমন সময় তাজ রুমে ঢুকে অনিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–“কি ব্যাপার রেডি? ”

–“হুম। দেখোতো বোরখাটা পড়লে আমাকে কেমন লাগবে?”

–“বুড়ী দাদী লাগবে! ”

–“আমি কি বুড়ী নাকি!বউয়ের একটু প্রশংসা করবে কি আরো পঁচাচ্ছে!”

বলেই অনি মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। তাজ ওর পিছনে গিয়ে ক্লিপ দিয়ে বেধে রাখা চুলে একটা ফুলের মালা গুজে দিয়ে অনির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,

–“আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম যে, এই রূপবতী মেয়েটা এখন আমার বউ! তা আমার এই ছোট্ট উপহারটা কি তোমার পছন্দ হয়েছে?”

অনি মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারলো যে, তাজ ওর জন্য ফুলের মালা এনেছে৷ ক্যাম্পাসের যেকোনো প্রোগ্রাম থাকলে তাজকে দিয়েই ও আর পিহু মাঝেমধ্যে এইসব ছোটখাটো জিনিস আনাতো৷ তাজ যে সেটা মনে রেখেছে এটা ভেবে অনির খুব ভালো লাগলো। তবে কখনো এভাবে কেউ ওকে ফুলের মালা চুলে গুজে দেয়নি! ওতো সবসময় ইমতিয়াজকেই কল্পনা করতো ওর স্বামী হিসেবে! আবার ইমতিয়াজ এর কথা মনে হতেই অনির মনটা খারাপ হয়ে গেলো।

তাজ অনির মুখ দেখে বুঝে গেলো যে, ও মন খারাপ করেছে। ও ভাবলো যে, ওর মা হয়তো অনিকে বোরখা পড়তে জোর করেছে! যার কারণে ওর মন খারাপ৷ তাই অনির হাত থেকে বোরখাটা কেড়ে নিয়ে বলল,

–“এই বোরখার জন্য মন খারাপ? আচ্ছা পড়তে হবে না এটা! আমি মায়ের সাথে কথা বলে নেবো! এইবার আমার বউটা একটু হাসুক! বাইরে বেরুনোর সময় একটু হাসিমুখ না দেখলে হয়! লোকে ভাববে আমি আমার বউয়ের খেয়াল রাখিনা!”

তাজের কথায় অনি ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়ে আসলো। তারপর তাজের হাত থেকে বোরখা নিয়ে বলল,

–“আরে না! মা আমাকে মোটেও জোর করেনি! আমার ইচ্ছে হলেই কেবল পড়তে বলেছে।তুমি শুধু-শুধু মাকে ভুল বুঝছো!”

–“তাহলে এই সামান্য ফুলের মালা কি তোমার পছন্দ হয়নি? দেখো আমি আমার সামর্থ্য মতো তোমাকে খুশি রাখার চেষ্টা করছি! আর এখনতো আমরা যাবই শপিং করতে! আজ সব তোমার পছন্দের জিনিস কিনে দেবো! যত দামীই হোক না কেন! আজ আমি তোমাকে সব কিনে দেবো! ”

তাজের এমন কথা শুনে অনি হেসে ফেলে৷ তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের ফুলগুলো দেখে বলে,

–“এই ফুলগুলোই যে আমার সৌন্দর্য হাজারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে!”

কথাটা বলে নিজেই লজ্জা পায় অনি! নিজের প্রশংসা নিজেই করছে!

–“আজ শপিং শেষে যা টাকা থাকবে সেটা দিয়ে আমি তোমার মোহরানা শোধ করে দেবো! তুমিতো বড়লোক হয়ে যাবে আজ! আর আমি পথের ফকির হয়ে যাবো! বিয়ে করলে বুঝি ছেলেরা ফকির-ই হয়ে যায়! আর মেয়েরা বড়লোক্স!”

–“মজা নিচ্ছো না! আমি তোমার টাকা কেন নেবো! আর শপিংও করে দিতে হবে না! আমার লাগবে না তোমার দেওয়া কিছু!”

–“আরে বাবা রাগ করছো কেন! এখন কি আর আমি তোমার বন্ধু নাকি! এভাবে রাগ করলে সবাই ভাববে আমি খুব খুব খুব খারাপ একটা স্বামী! আমার জিনিস না নিলে কার জিনিস নেবে শুনি! আমি কি এমনি এমনি তোমাকে সব দেবো নাকি! স্বামী হিসেবে একটা কর্তব্য আছে না! ”

–“কিন্তু আমিতো শুনেছি স্বামী হচ্ছে মেয়েদের সবচেয়ে বড় বন্ধু! আর স্ত্রী ছেলেদের!”

–“আচ্ছা ঠিক আছে! তবে একটা কথা মাথায় রাখবে কিন্তু যে, আমি কিন্তু বড়লোক নই! যা পারি তাই দেবো! আর তাতেই তোমাকে খুশি থাকতে হবে! আমার বউয়ের মন খারাপ আমি দেখতে পারবো না! আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব তোমাকে ভালো রাখার!”

–“আচ্ছা বুঝলাম!”

–“কি?”

–“এটাই যে, আমি এখন একটা কাঙালের স্ত্রী!”

–“কিহ! আমি কাঙাল!”

–“তুমিইতো বললে…”

তারপর ওরা দুজন হাসাহাসি করছিলো। অনি ক্ষণিকের জন্য হলেও ইমতিয়াজকে ভুলে গেছে। এমন সময় তাজের মা ওদেরকে ডাকতে লাগলো। তাজ আর অনি রুম থেকে বের হয়ে তাজের খালাকে দেখতে পেলো। অনি প্রশ্নাতুর চোখে তাজের দিকে তাকালে তাজ অনিকে আস্তে করে বলল,

–“এটা আমার বড় খালা!”

অনি মাথার কাপড় ঠিক করে তাজের খালাকে সালাম দিলো। তারপর তাজের মায়ের ইশারায় উনাদের পাশে বসে পড়ল।

তাজ ওখান থেকে রুমে চলে গেলো রেডি হতে৷ হাজারহোক শ্বশুরবাড়ি যাবে! তাই ফিটফাট হয়ে তৈরি হচ্ছিলো!

কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর তাজের মা নিজের বোনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–“আচ্ছা ওরা এখন বাইরে যাবে৷ ওকে ছাড় এখন! আবার পরে এসে গল্প করিস! ”

তারপর অনি রুমে গিয়ে মাথা থেকে কাপড়টা ফেলে বিছানার উপরে ধপ করে বসে জোরে-জোরে শ্বাস নিতে লাগলো। তাজ আয়নার সামনে নিজের চুলটা ঠিক করতে-করতে বলল,

–“এমনভাবে হাঁপাচ্ছো কেন? আমার খালাকে দেখে ভয় পেয়ে গেছো মনে হচ্ছে? কি এমন বলল?”

অনি টেবিল থেকে জগটা নিয়ে গ্লাসে পানি ঢালতে-ঢালতে বলল,

–“কি বলল না তাই বলো! বাবারে বাবা! তোমার খালাতো নয় যেন আদালতের উকিল! একের পর এক প্রশ্ন! যেন আমি কোনো খু*নের আসামী!”

তারপর এক ঢোকে পানিগুলো খেয়ে নিলো। তাজ একটু মুচকি হেসে বলল,

–“তা উত্তরগুলো কি ঠিকঠাক দিয়েছো?”

অনি তাজের কাঁধের উপরে আলতো করে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল,

–“তুমি হাসছো! তোমার সাথে আমার বিয়ে না হলে এতক্ষণে….”

এটুকু বলেই থেমে যায় অনি। তাজ ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

–“কি করতে?”

–“কিছুনা! চলো বের হই! শপিং শেষে আবার আমাদের ওখানে যেতে হবে। ”

তাজ আর অনি বের হচ্ছে ঠিক তখন তাজের খালা ওর মাকে উদ্দেশ্য করে জোরে করে বলে উঠলো,

–“একি! তাজের বউ দেখছি বোরখা ছাড়াই বাসার বাইরে যাচ্ছে! আর তুই চুপচাপ বসে দেখছিস! আগে যা করেছে! করেছে! এখনতো এই বাড়ির নিয়ম মেনেই চলতে হবে! শাশুড়ী-ননদ সবাই বোরখা পড়ে! আর বউ হয়ে ঢ্যাং-ঢ্যাং করে বের হয়ে যাচ্ছে!”

তাজ রেগে ওর খালাকে কিছু বলতে যাচ্ছিলো। অনি ওর হাতটা চেপে ধরলো আর ইশারা করে কিছু না বলতে মানা করলো। অনির মনটা মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেলো!

তাজের মা বোনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–“আপা তুই কি সকাল-সকাল এইগুলো বলতে এখানে এসেছিস! তোকে না বললাম একটু চুপ থাকতে!”

–“হ্যাঁ আমাকেতো চুপ করাবিই! আমার ভাসুরের মেয়েটার কথা কতবার বললাম! সে খাছ পর্দা না করলেও বোরখাতো পড়তো! নামাজ-কালামও মোটামুটি পড়তো! তখনতো তুই বলেছিলি যে তার চেয়েও ভালো মেয়ের সাথে তোর ছেলের বিয়ে দিবি! এই সেই ভালো!”

এইকথা শুনে তাজের মা নিজের বোনকে টেনে নিজের রুমের দিকে নিয়ে যেতে-যেতে অনিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

–“তোমরা যাও মা! আমার আপার কথায় কিছু মনে করো না! আসলে তাজকে খুব ভালবাসেতো! এমন হুট করে বিয়ে করেছে তাই একটু মন খারাপ করেছে!”

অনি তাজকে বলল,

–“তুমি দাড়াও আমি বোরখাটা পড়ে আসছি!”

–“তুমি খালার কথা ধরে পড়ে আছো কেন! মাতো তোমাকে জোর করছে না! আমিতো তোমাকে জোর করছি না! বাদ দাওতো! চলো।”

–“খালার কথা বাদ দিলাম! বাসার অন্যসবাইও যদি খালার মতো কথা বলে তখন? মানুষের কথা শুনতে আমার ভালো লাগে না! ”

কথাটা বলেই অনি রুমে চলে গেলো। তাজ বাইরে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো। একটু পর অনি রুম থেকে বের হলে তাজ হাঁ হয়ে ওকে দেখছিলো!

চলবে…?