অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী ২ পর্ব-০৭

0
174

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_০৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

বাসার সামনে গাড়ি এসে থামলো। মিঠু নিচুস্বরে ডাকলো,
“শুনছেন, সুহা শুনছেন? আপনার বাসা এসে গিয়েছে।”

সুহা নড়েচড়ে ফের ঘুমে তলিয়ে গেল। তার মাঝে জেগে ওঠার প্রবণতা দেখা গেল না। মিঠু খানিক গলার স্বর উঁচু করে ডাকলো,
“সুহা আপনার বাসা এসে গিয়েছে।”

আচানক চমকে উঠলো সুহা। ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসলো। বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারলো তার বাসা এসে গিয়েছে। শরীর কাঁপছে অনবরত। মিঠু দরজা খুলে দিতেই সুহা নামতে গেল। শরীর দুর্বল থাকায় গাড়ির দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে গেল। মিঠু চিন্তিত স্বরে বলল,
“কত তলায় বাসা আপনার?”

“দোতলায়।”

“আপনার পরিবারের কাউকে নিচে আসতে বলুন। এমন অসুস্থ শরীর নিয়ে উপরে যাবেন কীভাবে? এখনই তো গাড়ি ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন।”

সুহা তড়িঘড়ি করে বলল,
“না না দরকার নেই। আমিই যেতে পারবো।”

মিঠু রিয়াজকে বলল,
“যা তো রিয়াজ। উনার বাসা থেকে কাউকে ডেকে নিয়ে আয়।”

রিয়াজ দুই সিঁড়ি গ্যাপ রেখে দ্রুত দোতলায় উঠে পড়লো। সুহা বাঁধা দেওয়ার সুযোগই পেল না। কিছুক্ষণের মাঝেই নেমে এলো রিয়াজ। বলল,
“ভাই উনার ফ্ল্যাটে তো তালা। পাশের ফ্ল্যাটে নক দিয়েছিলাম প্রথমে। ভেবেছি ওটাতে থাকেন। তারা বলল উনি না-কি একা থাকেন বাসায়। অফিস থেকে ফেরেন নি বলে দরজায় তালা।”

মিঠুর কপালে ঢেউ খেলে গেল। প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে সুহাকে শুধালো,
“আপনি একা থাকেন? আপনার হাজবেন্ড?”

সুহা বলল,
“ধন্যবাদ। আপনারা এখন আসতে পারেন।”

ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন করে ফেলায় মিঠু নিজেই লজ্জিত হলো। নম্র স্বরে বলল,
“আপনাকে উপরে পৌঁছে দেব?”

“আমি পারব।”
শক্ত গলায় উক্ত কথাটি বলে সুহা পা বাড়ালো সামনে। দুর্বল শরীরটাকে টে*নে*হিঁ*চ*ড়ে সিঁড়ি পর্যন্ত নিয়ে গেল। মিঠু রিয়াজকে নিয়ে উল্টো পথে ফিরে গেল। রিয়াজ বলল,
“ভাই, উনার মনে হয় কোন সমস্যা আছে! দেখছেন না কিছুই বলতে চাইছে না। ”

মিঠু সামনের রাস্তায় দৃষ্টি রেখেই জবাব দিলো,
“ব্যক্তিগত সমস্যা সবারই থাকে। তাই বলে কেউ জিজ্ঞেস করলেই বলে বেড়াতে হবে?”

“আমি তেমনটা বলিনি ভাই। আপনি তো সবাইকেই সাহায্য করেন। উনি হয়তো লজ্জা থেকেও নিজের সমস্যার কথা বলতে চাইছেন না। কিংবা সমাজের ভয়। নিজেকে কেমন লুকিয়ে রাখতে চাইছেন। আপনি চাইলেই সাহায্য করতে পারেন।”

মিঠু তেমন কিছুই বললো না। রিয়াজ একটুখানি সাহস পেল।

পরদিন নিজ থেকেই সুহার ব্যাপারে টুকটাক তথ্য কালেক্ট করে আশ্চর্য হয়ে গেল। মিটিং শেষ করে বের হলো মিঠু। গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে পড়লো রিয়াজ। মিঠুর সাথে সাথে পেছনের সিটে বসে পড়লো। অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলার জন্য আকুলিবিকুলি করছে। মিঠু গম্ভীর মুখে বলল,
“কিছু বলবি?”

“জি ভাই, যদি অনুমতি দেন!”

“বল।”

“সুহা নামক মেয়েটা মি*থ্যা বলেছিল। তিনি অবিবাহিত।”

মিঠুর মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো। রিয়াজের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে জিজ্ঞেস করলো,
“মানে?”

“উনি বিয়ে-শাদি করেন নি। তিনি গর্ভে থাকাকালীন উনার বাবা মা*রা যান। এরপর উনার জন্ম হয়। মাকে মামারা অন্যত্র বিয়ে দিয়ে সুহাকে নিজেদের কাছে রেখে দেন। কিন্তু কোন একটা কারণে তিনি মামার বাড়ি ছেড়ে এখন একা একাই থাকেন। সেজন্যই কাল দরজায় তালা ছিল।”

“তুই কীভাবে এতকিছু জানলি?”

“উনি যেখানে কাজ করেন, সেই অফিসেই উনার একটা বান্ধবী আছে। এত কিছু বলতো না। আপনার নাম বলাতে আমাকে এতটুকু তথ্য দিয়েছেন।”
শেষ কথাটি বলতে গিয়ে মাথানিচু করে নিলো রিয়াজ।

মিঠু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বলল,
“বান্ধবীর খোঁজ কোথায় পেলি?”

“মিস সুহাকে উনার সাথেই একদিন কথা বলতে বলতে অফিস থেকে বের হতে দেখেছি।”

মিঠু কথা বাড়ালো না। গাড়ি চললো নিজ গতিতে। গতকাল রামি বাসায় এসেছে। অথচ এখন পর্যন্ত দেখা করতে পারলোনা।

★★★

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সকলেই বাসায় আছে। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে শুক্রবারে পড়ে পড়ে ঘুমানো যাবে। আয়েশা সুলতানা ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তরী, ইরা দুজন ভাজাপোড়া নিয়ে এলো। সাদাদ আর মাহমুদের পাশে ইরা, তরী বসে পড়লো। রামি একবার বড়ো ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে আবার মেজো ভাইয়ের দিকে। মাহমুদ জিজ্ঞেস করলো,
“কী হলো? কিছু বলবি?”

রামি তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বিরস গলায় বলল,
“তোমাদের পাশে তাকাও আর আমার পাশেও তাকাও।”

সাদাদ ব্যাপারটা খেয়াল করে বলল,
“তোকে তো আমরা ধরে রাখিনি। তুই নিজেই তো মিঠুর মতো সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করছিস। ভাই দড়ি খুঁজে দ্রুত আমার আর মাহমুদের মতো ফাঁ*সি*র দড়িতে ঝু*লে পড়। আমি তোর ম*র*ণ দ*শা দেখে বসে বসে হাততালি দেওয়ার অপেক্ষায় আছি।”

ইরা কটমট চোখে তাকালো। সাদাদ অপ্রস্তুত হেসে বলল,
“আমি তো ওঁকে ঝু*লে পড়তে বলেছি। বিয়ে করতে বলিনি। বিয়ে করা খুবই ভালো কাজ।
তাই না মাহমুদ?”

মাহমুদ ঠোঁট টি*পে হাসছে। তরী আড়ালে খোঁ*চা দিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকালো। মাহমুদ গলা ঝেড়ে নাক চুলকে বলল,
“বিয়ে কর। কোন প্যারা তো দেখছিনা। আমাকে দেখ্, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাসায় ফিরে তরীর হাসিমুখ দেখলেই সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।”

ইরা ফিসফিস করে বলল,
“দেখলে তো! মাহমুদকে দেখে কিছু শেখো।”

সাদাদ হাসতে হাসতে বলল,
“তুমি তো দেখনি ব্যাটা চা*পে পড়ে বলেছে। পেছনে একবার তাকালেই নজরে পড়তো তরীর খোঁ*চা দেওয়ার দৃশ্য।”

ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“পুরুষ মানুষ তো, তাদের বউ ভালোলাগবে না। ভালোলাগবে অবিবাহিত মেয়ে।”

সাদাদ জানে কথা বললেই আজ আর তার রক্ষে নেই। তাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে রইলো।
রামি গম্ভীর স্বরে বলল,
“আমি যার কথা বলব, তার নাম শুনে তোমরা না করে দিতে পার।”

ইরা বলল,
“নাম বল আগে। তোকে বিয়ে দেওয়ার জন্য আমি সেই কবে থেকে মরিয়া হয়ে আছি। না পারলি আমার বোনকে বিয়ে করতে, আর না পারলি তরীকে!”

“আমি অরুকে বিয়ে করতে চাই।”

রামির এমন বাক্যে সকলেই হতভম্ব হয়ে রইলো। জমজমাট আড্ডায় পরিপূর্ণ ঘরটি শান্ত হয়ে পড়লো। কোথাও বিন্দুমাত্র শব্দ নেই। কেউ কল্পনা করেনি এখানে অরুর কথা উঠে আসবে। মাথা নিচু করে আছে রামি। ইরা, সাদাদ আর মাহমুদ রামির পরিবর্তে তরীর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য মুখিয়ে আছে। তরী শান্ত রইলো। মাহমুদ রামির উদ্দেশ্য বলল,
“তুই যা চাইছিস, তা সম্ভব নয়।”

সাদাদ মাহমুদের কথায় বাঁধা দিয়ে বলল,
“কেন সম্ভব নয়? অরু, রামি দুজনই ঘরের ছেলেমেয়ে। এমন তো নয় যে অরুকে এখন বিয়ে দেবে না। তাহলে আবিরের সাথে কীভাবে বিয়ের কথা হয়েছে?”

মাহমুদ বলল,
“অরুকে বিয়ে দেবে না ব্যাপারটা তেমন নয়। এখানে ওর পরিবার, বড়ো কথা ওর নিজের মতামতের প্রয়োজন আছে। আমরা সবসময় নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে থাকি। সে ক্ষেত্রে অরুরও নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে।”

“মতামত ছাড়া কি আর বিয়ে হবে না-কি? আমার মনে হচ্ছে আঙ্কেল বা মিঠু কেউ না করবেনা। শুধু অরুর মতামত জানা জরুরী। আমি পাইনি তো কী হয়েছে আমার ভাই ঠিকই অরুকে পাবে। যা ভাই অরুকে বিয়ে করে জি লে আপনা জিন্দেগী।”

তরী চুপচাপ বসে রইলো। কিছুই বলছেনা। তা দেখে মাহমুদ ভড়কে গেল। সে কীভাবে রামির কথাটাকে নিয়েছে? রামিও তাকিয়ে রইলো তরীর মুখপানে। থেমে থেমে ডাকলো,
“আপু।”

তরী চোখ তুলে তাকালো। বলল,
“বাবাকে বলে দেখ্। আমি আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে চাইনা।”

রামি জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কী চাও?”

“অরুর মত থাকলে আমার এতে কোন আপত্তি নেই। বরং আমার চোখের সামনেই থাকবে।”

প্রলম্বিত শ্বাস ছাড়লো রামি। এতক্ষণ তার প্রাণটা যেন ঝু*লে ছিল। সবাই মিলে আরও কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রাতের খাবারের জন্য উঠে পড়লো। আজ আর রাত জাগা হবেনা।

সকাল সকাল মাহমুদের ফোন বেজে উঠলো। অমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে বাবাকে না পেয়ে কল রিসিভ করে কানে চাপলো। তরী তাকে শিখিয়েছে কল ধরেই সালাম দিতে।
সেও মায়ের শেখানো বুলি আওড়ালো।
“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”

“তুমি কি অমি?”

“হ্যাঁ আমি অমি। ভাত খেয়েছো?”

“সকালে কেউ ভাত খায়? তোমার পাপা কোথায়?”

“পাপা বাসায় নেই।”

“কোথায়?”

“ ভাতছিটাতে গিয়েছে।”

“ভাতছিটাতে মানে? শোন পিচ্চু স্যার আসলে বলবে তার ছাত্র কল দিয়েছে।”

খট করে লাইন কেটে যেতেই অমি বাইরে চলে গেল। নাস্তার টেবিলে তার মনে পড়লো পাপার কল এসেছে। বলল,
“পাপা ফোন এসেছে। বলল পাপা কোথায়?”

“তুমি কী বলেছো?”

“পাপা ভাতছিটাতে গিয়েছে।”

রামি খাওয়া ছেড়ে বলল,
“তোর পাপা ভাতছিটাতে নয় কলেজ ছিটাতে চাকরি করে।”

ঈশিতা হাসতে হাসতে বললেন,
“বো*কা অমি। ভার্সিটি বলতে পারেনা।”

অমি ক্ষে*পে গেল।
“ঈশু ভাইয়া মা*ই*র দেব। হাসবে না।”

“ইশ! এই টুকুন ছেলে আবার আমার ভাইয়া।”
মুখ ভেংচি কাটলো ঈশিতা।

★★★

ছুটির দিন। তবু কোথাও মিঠুর দেখা নেই। মাহমুদ জরুরী তলবে ওকে বাসায় আনলো। সে আর সাদাদই সকালে মায়ের সাথে কথা বলে রাজি করিয়েছেন মাকে। মিষ্টি, ফল হাতে সকলে অরুর বাসায় ঢুকলো। তরীর বাবা এত আয়োজন দেখে উৎসুক হয়ে তরীকে জিজ্ঞেস করলেন,
“সবাই এই বাসায় আবার ফল-মিষ্টি। কোন কারণ আছে?”

তরী বাবাকে একপাশে টে*নে বলল,
“এখানে সবাই এসেছে তোমার কাছে কিছু চাইতে। রামির জন্য অরুকে চাইতে এসেছে। উত্তেজিত হয়ে যেওনা। ঠান্ডামাথায় সিদ্ধান্ত নিও। কেউ তোমার উপর জোর করবেনা। আমাদের অরু না চাইলে আরও আগেই জোর করার সুযোগ নেই। ”

তরীর বাবা ভাবলেন কিছু একটা। পরক্ষণে মেয়ের কথায় শান্ত হয়ে বসলেন। তরী ও বাসা থেকে মেহমান হয়ে এলেও এ বাসায় এসে কাজে লেগে পড়লো। সকলের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতে রান্নাঘরে ছুটলো।
মাহমুদের সময় যেমন আয়েশা সুলতানা তরীর হাত চেয়েছেন, তেমনই রামির ক্ষেত্রেও তিনিই কথা বললেন।

“আমি আজ আবার আপনার কাছে কিছু চাইতে এসেছি ভাই। আশা করি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না! অরু আমার হাতের উপর বড়ো হয়েছে। রামিকেও ছোটো থেকেই দেখে এসেছেন আপনি। আমি বেশিকিছু বলবো না। শুধু রামির জন্য অরুর হাত চাইছি আপনার কাছে।”

তরীর বাবা ঝটপট জবাব দিলেন,
“আমি প্রথমবারের মতো ভু*ল করতে চাইনা। আমার মেয়ের মতামত সবার আগে। অরুর মতের উর্ধ্বে আমি আপনাকে কথা দিতে পারছি না।”

রামি মিঠুর চোখের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল।

#চলবে……..