অনুবদ্ধ প্রণয় পর্ব-১২

0
695

#অনুবদ্ধ প্রণয় 💛
#ইবনাত_আয়াত
~ পর্ব. ১২

ইফা আপুর অ্যাক্সিডেন্টের খবর শুনে হাত আলগা হয়ে এলো। মোবাইল টাও পড়ে গেল হাত থেকে। শক্তি লোপ পেল যেন। থমকে বসে পড়লাম। পাশেই তাহমিদ তার কম্পিউটার চালাচ্ছেন। আমার এমন রিয়েক্ট দেখে তিনি ভ্রু কুঁচকালেন, ‘কী ব্যাপার ইয়ানাত? মোবাইল এভাবে পড়ে গেলে তো ভে’ঙে দু টুকরো হয়ে যাবে। তা ছাড়া এভাবে বসে আছো কেন?’

কিন্তু আমার কোন হেলদোল নেই। তা দেখে তিনি আবারো ভ্রু কুঁচকালেন। উঠে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে মলিন গলায় বললেন, ‘কী হলো ইয়ানাত? এভাবে বসে আছো কেন? কেউ কী কিছু বলেছে?’

আমি এবার আকস্মিক তার কোমড় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। তিনি থমকে গেলেন এভাবে আমায় কাঁদতে দেখে। স্বান্তনার হাত পিঠে রেখে করুন গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে প্লীজ বলো। না বললে আমি বুঝবো কীভাবে?’

টে’নে টে’নে বললাম, ‘ই-ইফা আ-আপু! অ্যা-ক্সি-ড-ডেন্ট ক-রেছে।’

তিনি নিজেও চমকে উঠলেন। অস্থির গলায় বললেন, ‘কীহ্? কী বলছো এসব? মানে.. কবে? কীভাবে হলো?’

‘আ-আমি জানি নাহ্!’

‘আচ্ছা আচ্ছা শান্ত হও। প্লীজ কেঁদো না। আমার ভালো লাগছে না। আমরা এখনি ওখানে যাব৷ তবু কান্না থামাও। এভাবে আমার সামনে কেউ কাঁদলে আমার ভালো লাগে না।’

কিন্তু আমার ফুঁপানো যে থামে না। তিনি যেভাবে ছিলেন সেভাবেই আমাকে নিয়ে রওনা হলেন।
_________

পাগলপ্রায় ইবনান। ওটির সামনে দাঁড়িয়ে একবার সেদিকে তাকাচ্ছে, একবার পায়চারি করছে। চোখের পানির বিরতি তো নেইই। তন্মধ্যে ইফার বাবা মা আর তার বাবা মা সঙ্গে দাদুও চলে আসেন। কিন্তু সেসবে ইবনানের খেয়াল নেই। সে তার কাজেই ব্যস্ত। দাদু বললেন, ‘দাদুভাই! দেখ আমরা এসে গেছি। ইফার কিছু হবে না। তুই শান্ত হয়ে বস।’

ইবনান থামে না। ইরহান সাহেব এসে তাকে ধরে বললেন, ‘বাবা শান্ত হ! প্লীজ শান্ত হ এমন পাগলামি করলে ইফা ঠিক হয়ে যাবে না।’

ইবনান এক ঝটকায় তার বাবা কে ছাড়িয়ে ভা’ঙা গলায় চেঁচিয়ে বলল, ‘তোমরা যাও প্লীজ। আমার ইফু, কষ্ট.. পাচ্ছে। আমার জন্যই কষ্ট পাচ্ছে। তোমরা কেন এমন করছো?’

‘এসব করলে ইফা কীভাবে ঠিক হবে বল?’

‘হবে। এমন ভাবে বলো না। ও ঠিক হয়ে যাবে।’
__________

‘প্লীজ তাড়াতাড়ি চলুন।’

তাহমিদ বললেন, ‘এমন করো না। আমি তাড়াতাড়িই চালাচ্ছি। ইফার কিচ্ছু হবে না চিন্তা করো না।’

‘একটু স্পিড বাড়ান।’

‘সমান স্পিডেই আছি।’

‘প্লীজ বাড়ান না।’

‘ইয়ানাত!!’

ধমকে উঠলেন তাহমিদ। কেঁপে উঠলাম। তিনি আমার মাথা বুকে চেঁপে বললেন, ‘প্লীজ চুপ করো। ইফার কিছু হবে না আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখো।’

আমি নিঃশব্দে কাঁদতে থাকলাম।
প্রায় কিয়ৎক্ষণ বাদে একটি হসপিটালের সামনে এসে দাঁড়ালেন তিনি। বেরিয়ে এলাম দু’জন। দ্রুত চার তলায় উঠলাম। সেখানে যেতেই ওটির সামনে ভাইয়া, আঙ্কেল-খালামণি, আব্বু-আম্মু আর দাদুকে দেখতে পেলাম। ছুটে গেলাম সেদিকে। খালামণিকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘এসব ক-কী করে হ-হলো খালা-ম-ণি?’

তিনি উত্তরে কিছু বলেন না। উড়নায় মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকেন। ভাইয়ার দিকে ফিরতেই অবাক হলাম। ভাইয়া এমন করছে কেন? একবার এদিক থেকে সেদিক যাচ্ছে। চোখ দুটো ভেজা। সে…
এদিকে তাহমিদ ভাইয়ার দিকে এগিয়ে তাকে ধরে বলল, ‘ইবনান ইবনান, থাম তুই। এমন করিস না থাম!’

ভাইয়া তাকে ছাড়িয়ে আবারো পায়চারি করতে থাকে। কিছু বুঝতে পারছি না। তাহমিদ তাকে ধরে ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘ইবনান থাম বলছি!!! ভাই আমার এমন করলেই যে ইফা ঠিক হয়ে যাবে তা না। প্লীজ থাম! গিয়ে নামাজ পড়ে দোয়া কর। এতে আল্লাহ অবশ্যই শেফা দান করবেন।’

ভাইয়া এবার কেঁদে তাহমিদকে জড়িয়ে ধরলো, ‘ভাই! এসব আমার জন্যে হয়েছে। ই-ইফার আমার জন্যে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমিই ওকে রাস্তায় ফেলে কথা বলতে বলতে চলে এসেছিলাম। তাই এসব হয়েছে। আমার জন্যে এসব হয়েছে রে। তুই কী শাস্তি দিবি আমায় দে।’

তাহমিদ তাকে জড়িয়ে ধরে স্বান্তনা দিলেন, ‘নিজেকে দো’ষ দিয়ে লাভ নেই ভাই। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন ওকে কীভাবে সুস্থ করা যায় সেটা ভাব। নে চোখ মুছ। আর ওর জন্য দোয়া কর।’

অশ্রুসিক্ত নয়নে তাদের দিকে চেয়ে রইলাম।
_
অদূরে বেঞ্চিতে বসে আছি। আব্বু আম্মু আর ভাইয়া নামাজ পড়তে গেছে। দাদুও মসজিদে গেছেন। আঙ্কেল আর খালামণি ওটির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছি। এমন সময় কেউ পাশে বসল। বুঝতে পারলাম সে কে। সেদিকে তাকালাম না। সে বলল, ‘তুমি কাঁদছো? তোমাকে না কাঁদতে বারণ করলাম।’

‘কী করব বলুন? চোখের পানি কী আর বাঁধ মানছে?’

‘Don’t cry.’

তার কাঁধে মাথা রাখলাম। চোখের পানি বেয়ে তার টি-শার্ট পুরো ভিজিয়ে দিচ্ছে। এতে তার কোন হেলদোল নেই। এবার আমি নিজেই অবাক হলাম। এত কিছু.. কী করে করতে পারলাম আমি? এখানে আসার পূর্বে তাকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, এখন আবার তার কাঁধে মাথা রেখেছি.. আর সে কোন রিয়েক্ট করল না? কেন? হয়তো ইফা আপুর বিষয়টা নিয়ে আমার অনুভূতি বুঝতে পেরেছে। স্বান্তনার সহিত কিছু বলেনি। আচ্ছা আপনি কী আমার অনুভূতি গুলো কখনোই বুঝতে পারবেন না তাহমিদ?
_________

‘পেশেন্ট ইজ আউট অব ডেঞ্জার৷’

ডক্টরের কথায় সবাই স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলল। বিশেষ করে ভাইয়াই বেশি আনন্দ পেয়েছে। তাহমিদ তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘দেখলি? বলেছিলাম না ওর কিছু হবে না?’

ভাইয়া মাথা নাড়াল৷ তার জ্ঞান ফিরেনি এখনো। আঙ্কেল বললেন, ‘আমরা কী ওকে একটু দেখতে পারব ড.?’

‘হ্যাঁ পারবেন তবে কোন শব্দ যেন না হয়। আর দু’জন দু’জন করে যাবেন।’

একে একে সবাই গিয়ে দেখে এলো তাকে। অবশেষে আমি আর তাহমিদ গেলাম। ইফা আপু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। তার মাথায় হাত বুলালাম। তাহমিদ বললেন, ‘এবার অন্তত কেঁদো না। ইফা ঠিক আছে। ওর কিছুই হয়নি দেখো। ও ঠিক হয়ে যাবে।’

মাথা নাড়লাম। আগের মুহুর্ত গুলো খুব মনে পড়ছে, যখন হেসে খেলে দিন কাটাতাম। গল্প করতাম, গানের কলি খেলতাম। এক অপূর্ব স্মৃতি ছিল সেসব।

‘চলো। বাহিরে চলো। ইবনান ওকে দেখবে। ওকে একটু একা ছাঁ’ড়া উচিত ইয়ানাত।’

‘হম।’
___________

‘কী রে? আমায় চিন্তায় ফেলে তুই নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছিস? এত স্বার্থপর কেন রে তুই? দেখ! আমার দিকে একটু তাকা। চোখ টা খোলে দেখ তোর অপরাধীকে। ক্ষমা করে দিস আমায়। আমার তখন কথা টা বলা উচিত হয়নি। তাই তো তুই বুঝতে দাঁড়িয়ে পড়েছিলি। ইশ! কেন যে ওসব বললাম? তাহলে আজ তোর এই হাল হতো না। খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবি তুই।’

ঘুমন্ত ইফার হাত ধরে বাণীগুলো ব্যক্ত করল ইবনান। আজ নিজেকে বড্ড একা লাগছে। অপরাধী মনে হচ্ছে। প্রায় আঁধঘন্টা কেঁ’টেছে। ইফার হাত পা নড়চড় করতে দেখে ইবনান উত্তেজিত হয়ে দ্রুত ড. ডেকে নিয়ে এলো৷

ইফার জ্ঞান ফিরেছে৷ সবাই একে একে দেখা করে এলো তার সাথে। অবশেষে প্রিয় কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি টি গেল কেবিনে। ইফা আঁধশোয়া হয়ে বসে ছিল। ইবনান আচমকা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল, ‘তুই ঠিক আছিস ইফু? মাফ করে দিস আমায় এসব আমার জন্যে হয়েছে।’

ইফা অবাক হয়ে বলল, ‘ইবনান ভাই… আমি ঠিক আছি দেখুন। একদম ঠিক আছি। আর আপনার জন্যে হয়েছে মানে? আপনার জন্য কিছুই হয়নি। কী হবে? এটা হয়তো হওয়ারই ছিল।’

ইবনান শান্ত হয়ে বসল। ইফা হেসে বলল, ‘আর আপনি কাঁদছেন কেন? আমি তো একদম ঠিক আছি। ফিটফাট!’

ইবনান তার দিকে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখেও হেসে ফেলল। ইবনান তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠ। তোকে কিছু বলতে চাই।’

ইফা প্রশ্ন করল, ‘কী?’
ইবনান মুচকি হাসল। কিছু বলল না।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]