অনুবদ্ধ প্রণয় পর্ব-২২ এবং শেষ পর্ব

0
785

#অনুবদ্ধ প্রণয় 💛
#ইবনাত_আয়াত
পর্ব: ২২ [অন্তিম প্রহর]

থমকে তাকিয়ে আছি অবন্তীর নিষ্পাপ মুখখানার দিকে। সে কী বলে ডাকল আমায়? ইনুপাখি? এই নামে তো শুধু একজনই ডাকত আমায়। তবে.. অবন্তী কী করে জানল সেই নাম?

কাঁপা গলায় বললাম, – ‘ক-কী বললে তুমি?’

অবন্তীর চোখে পানি দেখা গেল।
— আমায় আজও চিনতে পারলি না? নিজের অবনী আপুকে আজও চিনতে পারলি না তুই? এত তাড়াতাড়ি আমায় ভুলে গেলি? কেন? এতটাই ঘৃ*না করিস আমাকে?

মাথায় বাজ পড়ল। মানে.. আমার সামনে যে শয্যাশায়ী সে আমারই প্রিয় অবনী আপু? কিছুক্ষণ থম মে*রে বসে রইলাম। হঠাৎ পুরনো দিন গুলো মনে পড়তেই ডুকরে কেঁদে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। মনে পড়ে গেল সেই সকল স্মৃতিময় মুহুর্ত!

__
‘ইনু! ওই ইনু! উঠ উঠ। স্কুলে যেতে হবে।’

বারংবার অবনী আপু আমায় ঠে’লেই যাচ্ছে। বিরক্ত হয়ে ঘুমঘুম কণ্ঠে বললাম, ‘ধুর আপু যাও তো। একটু পর উঠছি। প্লীজ প্লীজ যাও।’

আপু মানে না। ডাকতেই থাকল, ‘উঠ বলছি ইনু। নয়তো সত্যি পানি ঢেলে দিব। দাঁড়া তুই আসছি আমি।’

ফট করে চোখ খুলে দ্রুত উঠে বসলাম। এমন একবার করেছিল আপু। খুব দুষ্ট সে। বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘ধুর মিয়া। ভাল্লাগে না একদম।’

আপু হেসে ফেলল। উঠিয়ে আমায় ফ্রেশ করে খাইয়ে রেডি করিয়ে দিল। সবে মাত্র ক্লাস নিউ টেনে উঠেছি। আর আপু ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। ভাইয়া অনার্স সেকেন্ডে উঠেছে মাত্র।

অবনী আপু আমাদের একমাত্র বড় আপু। আমরা দুই ভাই-বোন না। আমরা তিন ভাই-বোন। অবনী আপু আমাদের মেঝ বোন/সন্তান।

কে জানতো আজই সেই দিন টা যে’দিন সে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাবে?

নিত্যদিনের মতোই আমাকে স্কুলে পৌছে দিয়ে সে ভাইয়ার সঙ্গে কলেজের উদ্দেশ্যে গিয়েছিল। কিন্তু স্কুল থেকে এসে শুনলাম আপু নাকি পালিয়ে গিয়েছে। এটা শুনে থমকে গেছিলাম আমি। আপু কী করে পারল আমায় ফেলে এভাবে চলে যেতে?

প্রায় ছয় টা বছর! সে নিখোঁজ! লা*পাত্তা! কোথায় গেল সে আমায় ফেলে? মনে মনে তার প্রতি খুব অভিমান জমা হতে থাকে। এই ছয়টা বছরের তাকে মনে পড়লেও কখনো তার ছবি দেখিনি। চেহারা টা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু? কী করে পারলাম আমি আমার প্রিয় আপু টাকে ভুলে যেতে? আর আমার সেই প্রিয় আপুটাই এতটা কষ্ট সহ্য করেছে? কেন?
__

সেই প্রিয় বোন টাকে এত বছর পর কাছে পেয়েছি। কিন্তু তাও যে সুখ সইল না। সে যে এখন মৃত্যু পথযাত্রী। কেন? কেন তাকে পেয়েও পেলাম না? চিৎকার করে কেঁদে ফেললাম তাকে জড়িয়ে ধরে,
‘কেন আপু? কেন তুমি আমায় ছেড়ে গেলে? কেন পালিয়ে গেলে? আমার কথা কী তোমার কখনো মনে পড়েনি? তুমি যদি না পালাতে তাহলে তো এত কিছু হতো না।’

আপু মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
— আমি পালাই নি রে বোন। আমি পালাই নি। আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল।

মাথায় বাজ পড়ল যেন। অবাক হয়ে বললাম, ‘কী বলছো এসব? কি*ডন্যাপ করা হয়েছে.. মানে?’

‘হ্যাঁ রে৷ কি*ডন্যাপ করেছিল আমাকে ফাহাদ। সে.. আমায় ভালোবাসে বলে আমায় বিয়ে করতে চেয়েছিল। পরে না মানায় কি*ডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করল। কিন্তু.. সে যে আমায় তার ব্যবসার জন্য নিয়ে গিয়েছিল এটা কে জানতো? আচ্ছা.. আব্বু আম্মু আর ভাইয়া কই? তাদের যে বহুদিন দেখিনি। প্লীজ.. একটু ডাক না ওদের।’

তাহমিদকে ইশারা করতেই সে ফোন বের করে কোনরকম ভাইয়া কে কল করল,
— হ্যালো ইবনান! ইবনান.. প্লীজ একটু হসপিটালে আয়।
…..
— হ্যাঁ। এই *** হসপিটালে। দেখ খুব ইমার্জেন্সি।
…..
— না না আমার কিছু হয়নি। তুই একবার আয়। বাবা মা-কেও সাথে নিয়ে আয়।

____
কিয়ৎক্ষণ যাবৎ আমি আর তাহমিদ কেবিনের বাহিরে বসে আছি। পনেরো মিনিটের ব্যবধানে তারা এসে হাজির। ভাইয়া অস্থির হয়ে বলল, ‘কী হয়েছে তাহমিদ। তোরা ঠিক আছিস? আর ইয়ানাত! সেও তো ঠিক আছে। তাহলে.. কার কী হলো?’

তাহমিদ কিছু না বলে কেবিনের দিকে ইশারা করলেন। ভাইয়া ভ্রু কুঁচকাল। ইফা আপু বলল, ‘কী হয়েছে বল না ইয়ানাত। তাহমিদ ভাই কী হয়েছে? কার কী হয়েছে প্লীজ বলুন।’

আমি তাদের ইশারা করে কেবিনে ঢুকলাম। তারাও ঢুকল। অবনী আপুকে দেখেও কিছু বুঝল না। চিনতে পারল না। ব্রেইন ক্যা*ন্সার। শরীর আর চেহারা অবস্থা এমন যে সেই আগের গুলুমুলু আপুটাকে কেউ চিনতেই পারল না। ভাইয়া বলল,
— ইয়ানাত এটা কে?

— ওকে চিনতে পারো নি ভাইয়া? সে.. আমাদের অবনী আপু!

_________
কবরস্থানের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছি একটা কবরের দিকে। নেইম প্লেটে জ্বলজ্বল করছে একটা নাম ‘অবন্তীকা বিনতে ইরহান’। চোখে নোনাজল জমা হলো। হাতে একগুচ্ছ ফুল। পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন তাহমিদ। আর আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে অবনী। তাকে দেখেই মনে পড়ে গেল সে-দিনের কথা,

__আপু আমার হাত ধরে অনুরোধ করে বলেছিল, — ‘ইনু! তাহমিদ। তোমরা আমার মেয়েটা কে দেখে রেখো প্লীজ। ওর আমি ছাড়া কেউ নেই। ওর কোন আশ্রয়স্থল নেই। প্লীজ ওকে তোর মেয়ের মতোই দেখে রাখিস। এটা তোর আপুর অনুরোধ।’__

চোখের নোনাজল মুছে গিয়ে আস্তে করে ফুল টা কবরের উপর রাখলাম। কবরের মাটি টা ছুঁলাম। পরক্ষণেই কেঁদে উঠলাম। তাহমিদ আমায় সরিয়ে নিয়ে শান্ত করলেন। বললেন, ‘প্লীজ এভাবে কেঁদো না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। সে এভাবে কষ্ট নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে উপারে ভালো থাকাই শ্রেয় হৃদপ্রিয়া।’

তবু নিজেকে শান্ত করতে পারি না। সে-দিনই আমার প্রিয় আপু টা চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। বাবা মা আর ভাই সত্যি টা জেনে নিজেদের-ই দো’ষী ভাবছে। তারা একটু খেয়াল রাখলেই পারতো আপুর।

কিন্তু আমি যে কোন রকম নিজেকে সামলাতে পারি না। ছয় টা বছর পর নিজের বোনকে কাছে পেয়েছি, কিন্তু তাও ক্ষণিকের জন্য?

তাহমিদ হাত আঁকড়ে ধরে বললেন, ‘চলো। কোথাও ঘুরতে যাই। এতে তোমার মন ফ্রেশ হবে মহারাণী।’

মাথা নাড়লাম। তিনি আমায় আর অবনীকে নিয়ে সেই পার্কে গেলেন। যেখানে আমায় নিয়ে তিনি ঘুরাঘুরি করেছিলেন।

অনেক্ষণ আমাদের নিয়ে ঘুরাঘুরি করলেন তিনি। ফেরার সময়! কিন্তু রাস্তায় ভিড় দেখে থমকে গেলাম দু’জন। তাহমিদ এগিয়ে গেলেন। যেখানে ভাইয়া আর ইফা আপুকেও দেখতে পেলাম। তাহমিদ তাদের দেখে প্রশ্ন করলেন, ‘কী রে ইবনান। কী হচ্ছে এখানে?’

ভাইয়া বললো,

‘ জানি না ইয়ার। কার নাকি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। বড় ট্রাক এসে মে*রে দিয়েছে।’

‘ কী বলিস? কোথায়? চল তো।’

চারজন মিলে কোনরকম ভিড়ের মাঝে একটা লা*শ দেখতে পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে ইফা আপু চেঁচিয়ে উঠল,
‘ ওহ মাই গশ!’

ভাইয়া বললো, ‘ কী হয়েছে ইফা? চিৎকার করলি কেন?’

‘ ইবনান! তাহমিদ ভাইয়া এটা তো.. ফাহাদ!!!’

সবাই চমকে উঠলাম, ‘ কীহহ?’

লাশ টার এমন ভয়া*নক অবস্থা দেখে গা গুলিয়ে আসছিল। দ্রুত তাহমিদকে বললাম, ‘ আ-আমার খারাপ লাগছে তাহমিদ। আমায় নিয়ে চলুন এখান থেকে।’

তাহমিদ দ্রুত ইবনান ভাইয়া আর ইফা আপুকে বলে অবনীকে নিয়ে পাঁচজনই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

__
‘ কী ভয়ানক একটা অবস্থা দেখেছিস?’
ভাইয়ার কথায় তাহমিদ বললেন,

‘ হুম। কী বা*জে অবস্থা লা*শ টার। মাথায় রড ঢুকে গেছে। গায়ে সব চামড়াই উঠে গেছে। শরীর আর মাথা পুরোই থে*তলে গেছে।’

আমি অকপটে বলে উঠলাম,

‘ প্লীজ এভাবে বলবেন না আমার ভালো লাগছে না।’

লা*শ টা দেখে প্রায় পাঁচ বারের মতো বমি করেছি। এমন একটা বা*জে অবস্থা! ইফা আপু বলল,

‘ সে অনেক পা*প করেছিল। আর পা*পের ফল সে পেয়েছে। সে আমায় ধোঁ***কা দিয়েছিল, সেটা খুব-ই ছোট। সে যে অবন্তীর সাথে যা করেছে তা সবচেয়ে বড় পা*প। আর অবন্তীর অভিশাপ-ই তার উপর পড়েছে। আল্লাহ তাকে ছাড়েনি। দেখেছিস? ইয়ানাত! তোর অবনী আপুর সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি সে পেয়েছে।’

মাথা নাড়লাম। খারাপ লাগলেও মনে মনে খুশি হলাম। আমার আপুর পা’পি টা শাস্তি পেয়েছে। এমন ভয়া*নক মৃত্যু যেন আর কারো না হয়!

__________

কে/টেছে প্রায় দু’বছর। অবনী আর তাহমিদকে নিয়ে ভালোই আছি। মেয়ে হয়েছে আমাদের। এক বছর বয়স! নাম রেখেছি তার অবন্তীকা। অবন্তীই ডাকি। আমার আপুটার নামে। তার স্মৃতিটাকেও ধরে রেখেছি। অবনী যেন আমাদেরই নিজের মেয়ে।

বহুদিন পর আমি আর তাহমিদ সেই পার্ক টাতেই যাচ্ছি। এখানেই তো সুন্দর মুহুর্ত গুলো কে/টেছিল আমাদের।

খুব ঘুরলাম দু’জন। অবনী অবন্তীকে ইফা আপুর কাছে রেখে এসেছি। তারও ছেলে হয়েছে। ইফাজ নাম তার। সব মিলিয়ে খুব ভালোই আছি সবাই। মাঝে শুধু অবনী আপু নেই। সে এসেছিলই তো শুধুমাত্র দু’দিনের জন্য আমাদের কাছে।

ফেরার পালা! কাঁধে মাথা রাখলাম তার। সে ফিচেল গলায় মোহনীয় স্বরে বলল,

___ ‘ এক খোলা আকাশ পরিমাণ প্রেম তোমার জন্য সাজিয়েছিলাম আমি।
কোন অনুবদ্ধ প্রণয়ে বাঁধতে চাই না তোমায়, খোলা প্রণয়ে ভালোবাসতে চাই হৃদস্পর্শিনী।’ 💛
— ইবনাত আয়াত 🍂

~ সমাপ্ত… 🌸