অনুবদ্ধ প্রণয় পর্ব-১৭

0
668

#অনুবদ্ধ প্রণয় 💛
#ইবনাত_আয়াত
পর্ব: ১৭

রাত ২ টা কী ৩ টা। মুরুব্বিরা ঘুমে মগ্ন। বাহিরে হৈ-হুল্লোড় চলছে। সাউন্ড বক্সে গান বাজিয়ে নাচানাচি করছে বাচ্চা কাচ্চা থেকে শুরু করে যুবক যুবতিরা। তাহমিদ আর ভাইয়ার ফ্রেন্ড রাও নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। তাহমিদও ফ্রেন্ডদের সঙ্গে হাসাহাসি, এটা ওটা নিয়ে কাড়াকাড়ি তে ব্যস্ত। আজ তাকে পাক্কা কিশোর বলে মনে হচ্ছে আমার। এক কোণে বসে এক নজরে তাকেই দেখতে ব্যস্ত আমি।
ফর্সা গায়ে সাদা পাঞ্জাবী। ঘেমে একাকার সে। পাঞ্জাবী টা গায়ের সঙ্গে ঘামের কারণে লেপ্টে আছে। চুলগুলোও ললাটে লেপ্টে আছে। পাঞ্জাবীর হাতা ফোল্ড করে স্প্রে নিয়ে মা’রা’মা’রি করছে। মুখে এক মোহনীয় হাসি। মুখ হলুদ লাগানো। হাসি পেল। তখন ভাইয়াকে তার ফ্রেন্ড রা হলুদ মাখাতে গিয়ে সবাই নিজেদের মধ্যেই মাখামাখি করে ফেলেছে। এর মধ্যে সবার মুখেই হলুদ। আমি বাদে। আমি তখন বহুদূরে ছিলাম। ভাইয়াকেও হলুদ লাগাইনি সামনে থেকে। পেছন থেকে লাগিয়েই দৌড়ে পালিয়েছিলাম।
এই সুপুরুষটা আমার? মানে আমার? হ্যাঁ! সে আমারই! আর আমারই রবে।
হঠাৎ তার সাথে চোখাচোখি হতেই সে ভ্রু কুঁচকে মাথা উপর নিচ দুলাল। যার অর্থ ‘কী?’। আমি ডানে বামে মাথা দুলিয়ে ‘না’ বুঝিয়ে নজর সরিয়ে নিলাম।

ফুল সাউন্ডে গান বাজছে। সবাই নাচছে। এর মাঝে রুবি আর সীমা এসে হাত ধরে টানাটানি শুরু করল, ‘আপু আসো, আজ তোমাকে নাচতেই হবে। আসো আসো বলছি। আসো!!!’

‘আরে.. কী করছিস ছাঁড়! তোরা নাচ আমি নাচবো না। প্লীজ যা..’

‘না তোমাকে আসতেই হবে চলো বলছি। আপু চলো…’

আজ আমারো মন টা নেচে নেচে উঠছে। বার বার তাহমিদের বলা বাক্য গুলো মাথায় আসছে। খুব খুশি খুশি লাগছে। তাই খুশিমনে উঠে নাচের আসরে গেলাম। আমি আসতেই সবাই নিজেদেত নাচ থামাল। ছোট থেকেই নাচে পারদর্শী আমি। আমার নাচের ব্যাপারে সবাই জানে। আমি নাচতে গেলে সবাই আমার তালে তালে নাচা শুরু করে। বহুদিন পর আমায় এভাবে নাচের আসরে আসতে দেখে বেজায় খুশি তারা। ফুল ভলিউমে ‘জুলফো সে বাঁধ লিয়া দিল’ গানটা বাজছে। গানের তালে তালে নাচছি সবাই মিলে। তাহমিদ হা করে তাকিয়ে আছে। তা দেখে ভীষণ হাসি পেল।

খুব নাচলাম। এর মাঝে ছেলেরাও এসে যোগ দিল। তাহমিদ এগিয়ে এসে কোমড় স্পর্শ করলেন। কাঁপুনি ধরল সর্বাঙ্গে৷ আমায় নিয়ে কাপল ড্যান্স শুরু করেছেন। গানের তালে তালে নাচছি সবাই মিলে।
নাচানাচির এক পর্যায়ে তাহমিদ কোমড় ধরে উল্টো ঘুরিয়ে গালে কিছু লাগিয়ে দিলেন। হাত দিয়ে স্পর্শ করে তা চোখের সামনে আনতেই বুঝলাম হলুদ। সে আমায় ছলচাতুরী করে লাগিয়ে দিয়েছে। তার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতেই সে হেসে কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, ‘স্বপ্ন ছিল প্রেয়সীকে হলুদ লাগাব, কিন্তু সে তো আর হয়নি। আজ নাহয় পূরণ করে নিলাম। তা ছাড়া! আমি চাই না আমার আগেই অন্য কেউ আমার হৃদস্পর্শিনী কে হলুদ লাগিয়ে দিক। তা ছাড়া, গায়ে হলুদ তো তোমার হয়নি, তাই আজ নাহয় তোমার-আমার গায়ে হলুদ টা হয়ে যাক।’

অধরের কোণে হাসির রেখা ফুঁটে উঠল। এ যেন স্বপ্ন! আচ্ছা এটা কী সত্যি?

‘ঠিক আছে। আমিও নাহয় লাগালাম আপনাকে।’

হলুদ মুঠোয় পুরে ছুটলাম তার পেছনে। সে হাসতে হাসতে পালাতে থাকে। হঠাৎ কোথাও মিলিয়ে গেল ভীরে। মন টা বিষন্নতায় ভরে গেল। নির্জনে মন খা’রাপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলে উঠল, ‘হৃদস্পর্শিনী’র মন খা’রাপ?’

মুখ ফুলিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ খা’রাপ তো হবেই। আপনি নিজে আমায় হলুদে ভরিয়ে দিয়েছেন। আমি লাগাতে গেলাম তো লুকিয়ে গেছেন।’

তিনি সামনে এসে আমার দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘এইতো আমি এখানেই আছি।’

এই সুযোগে দ্রুত মুঠোয় থাকা হলুদ তার মুখে মেখে দিলাম। খিলখিল করে হেসে ফেললাম। সে অপলক চেয়ে রইল। ফিচেল গলায় বলল, ‘নাও তোমায় তো মাখতে দিলাম। এবার আমাকেও তো কিছু দিতে হবে।’

হাসি থামিয়ে বললাম, ‘কী দিতে হবে?’

তিনি ভাবনার ভঙ্গি করে বললেন, ‘সে তো আমি অনেক আগেই তোমার কাছে খুঁজেছিলাম। কিন্তু পাই নি।’

কণ্ঠ নিচু হয়ে এলো, ‘ক-কী?’

তিনি চোখ সরু করে বললেন, ‘কিস্ মি!’
বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলাম তার দিকে। আশাপাশ টা লক্ষ করলাম। সবাই নাচানাচি আর লাফালাফিতে ব্যস্ত। তারপর তার দিকে তাকালাম, ‘ক-কী বলছেন এসব? পাগল হলেন নাকি?’

‘ওমা! পাগল হবো কেন? জাস্ট কিস্-ই তো করতে বললাম। অন্য কিছু বলেছি নাকি?’

‘ম-মানে? এত লোকের সামনে আপনি বলছেন আমায় কিস্ করতে? ছিঃ বড্ড অসভ্য আপনি।’

‘হ্যাঁ সে তো তোমার কাছে হৃদপ্রিয়া।’

উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে নিলেই সে হাত টেনে ধরল, ‘নো নো! কোথায় যাচ্ছ? কোথাও যাওয়া হবে না মহারাণী। অ্যাট ফার্স্ট কিস্, দেন ইউ ক্যান গো অ্যানিহোয়ের।’

‘দেখুন.. এভাবে লোকজনের সামনে আমি আপনাকে…’

‘লোকজন? দেখো, এদিকে কেউ নেই। আর ওদিকে সবাই নিজেদের কাজে মত্ত।’

ঠোঁট উল্টে চেয়ে রইলাম তার দিকে। সে হেসে ফেলল। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে। চোখ বন্ধ করুন।’

সে অবাক হয়ে বলল, ‘চোখ বন্ধ করব? তুমি পালিয়ে যাওয়ার জন্য?’

‘পালিয়ে যাব না তো। চোখ বন্ধ করুন না।’

‘আচ্ছা করলাম।’

সে নেত্রপল্লব একত্র করল। পা-জোড়া উপরে তুলে তার ললাটে অধর ছুঁইয়ে তাকে সেভাবে রেখেই দৌড়ে যেতে নিলাম। কিন্তু হঠাৎ শাড়ির আঁচলে টান পড়তেই পিছিয়ে তার বুকে গিয়ে পড়লাম। সে আঁচল টেনে ধরেছিল আমার। ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘পালিয়ে যাওয়া হচ্ছে না?’

‘আ.. কোথায়?’

‘কোথায় আবার, আমার থেকে দূরে।’

‘পাগল হলেন নাকি। আর হা আপনার ইচ্ছে পূরণ করলাম। এবার আমায় যেতে দিন।’

‘কেন? কোথায় যাবে?’

‘এই যে এই খানে…’

‘কেন আমার কাছে একটু থাকা যায় না?’

‘আপনি আজ এভাবে কথা বলছেন কেন বলুন তো? এত বড় প্রেমিক কবে হলেন?’

‘এইতো তোমাকে দেখার পর থেকেই।’

‘ফালতু কথা ছাড়ুন তো। ওখানে চলুন।’

‘আর ধুর সুন্দর মুহুর্ত টা মাটি করতে উঠে পড়ে লেগেছো কেন?’

‘আরে.. দেখুন তাহমিদ সাহেব, আপনি এভাবে আমায় এখানে আটকে রাখলে বাকিরা কী বলবে?’

‘যে যা বলবে বলুক। আমি আমার বউকে আমার কাছে রেখেছি এতে কার কী প্রবলেম?’

চোখ বড় বড় করে নিলাম। এবার তাকে ‘ওই যে জুঁই ফুল দেখুন!’ বলতেই সে ওদিকে ফিরতেই চলে যেতে নিলেই আবারো তার বুকে গিয়ে পড়লাম। সে তখনও আমার আঁচল ধরে রেখেছিল যার দরুন এই অবস্থা। সে হেসে বলল, ‘কী আমার থেকে পালানোর চেষ্টা করছো?’

‘দেখুন..’

‘সে তো দেখছিই তোমাকে। সারাজীবনই দেখে যাব।’

‘প্লীজ যেতে দিন!’

‘ধুর! আনরোমান্টিক। চলো!’

বলেই সে হাঁটা ধরল। হেসে ফেললাম। হাঁটায় তার সঙ্গে তাল মেলালাম। চলতে চলতে তার কাঁধে মাথা রাখলাম। এক মুহুর্তের জন্য ভুলে গেলাম আগের হওয়া হৃদয় দহনগুলো।
_________

বিয়ের ঝামেলা শেষ। কেটেছে প্রায় দু’দিনের বেশি। বাসায় ফিরেছি। এর মাঝে মা বাবা আর তাহমিনা আপুও ফিরে এসেছে।

তাহমিদ অফিসে গেছেন। যাওয়ার পথে আমায় ভার্সিটি নামিয়ে দিয়ে গেছেন। ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় তাহমিদই এসে নিয়ে যাবেন। তাই দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ ছবিতে দেখা একটা পরিচিত মুখ বাস্তবে দেখতেই থমকে গেলাম। থেমে গেল আমার পুরো পৃথিবী। তবে কী সেই সুপুরুষ আর আমার হলো না? সে কী সব কেড়ে নেবে আমার থেকে?

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]