অনুভবে তুমি পর্ব-০৯

0
437

#অনুভবে_তুমি
#পর্ব_৯
#লেখনীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি দেরি করার জন্য। আমি গভীরভাবে অসুস্থ। তাই লিখতে পারি নাই।
উপমার বাবার বাসায় বসে আছি। আমার পাশে উপমা বসে আছে এবং সামনে শ্বশুর-শাশুড়ি। শাশুড়ি বললে ভুল হবে! তিনি একজন অমানুষ। সবাই অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে আমি কিছু বলব বলে। আমি শুধু চেষ্টা করছি নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। একসময় উপমা বলেই ফেলল,
‘- কি হয়েছে মুগ্ধ তুমি এভাবে আমাকে না বলে বাবার বাসায় নিয়ে এসেছ কেন? আর বাবা-মাকে সামনে বসিয়ে রেখেছো কিছুই বলছো না যে।
এবার শ্বশুর মশাইও বলে ওঠে,
‘- জামাই বাবাজি তোমাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে আর তোমার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে তুমি রেগে আছো। কি হয়েছে বাবা বলো আমাকে! আমার মেয়ে কি কোন অপরাধ করেছে?
আমি একবার উপমার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে শ্বশুর মশাইয়ের দিকে তাকালাম।
সুষ্ঠুভাবে বললাম,
‘- অপরাধ আপনার মেয়ে নয় করেছে আপনার ঘরের বউ।
আমার মুখে এধরনের বাক্য শুনে সবাই কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছে বটে। শশুর মশাই হয়তো ভাবতে শুরু করেছে ছেলেটার বিয়ে হতে না হতেই বেয়াদবি শুরু করেছে।
উপমা আমার হাত টেনে বলল,
‘- এসব কি যা তা বলছ মুগ্ধ? উনি আমার মা হয় আর সম্পর্কে তোমার শাশুড়ি হয়! আর শাশুড়ির সঙ্গে এভাবে কেউ কথা বলে?
উপমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি উপহার দিলাম। মেয়েটা বড্ড অভিনয় করতে জানে।
‘- আর কত অভিনয় করবে ভালো থাকার, নিজেকে খুশি রাখার? আর কত মিথ্যা হাসি দেবে এই মুখ দিয়ে?
এবার উপমার মুখটা মলিন হয়ে গেল। শ্বশুর মশাই আমার কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল,
‘- তুমি কি বলছ আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না বাবা?
এবার শ্বশুরের দিকে এগিয়ে গেলাম।
‘- মেয়েকে জন্ম দিয়েই নিজের দায়িত্বটা গুটিয়ে নিয়েছেন। দিনশেষে যখন বাড়ি ফিরতেন, তখন কি একবারের জন্যেও মেয়েটার ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন “মা আজ তোর দিনটা কেমন কাটলো”? ঠিকমতো খাবার খেয়েছিস তো? জিজ্ঞেস করেছিলেন কখনো?
আমার সম্মানিত শ্বশুর মাথা টা নিচু করে নিলেন৷ আমি আবারও বলতে শুরু করি,
‘- উপমার জন্মের সময় নাকি ওর মা মারা যায়। তারপর উপমার দেখাশোনার জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করেন। সকালে কাজে যান নিশ্চিন্ত হয়ে, এই ভেবে যে আপনার বউ উপমার দেখাশোনা করবে। হুম দেখাশোনা করেছে ঠিকই। আর সেটা এমনভাবে দেখেছে, যে মেয়েটা মানসিক ভাবে পাগল হয়ে যায়। যতই বড় হতে থাকে তাকে ততই কষ্ট দেয়। যখন সে নিজের মানসিক শান্তির খোঁজে বাইরে যায় তখন শুনতে হয়, সে নাকি বাইরে ফষ্টিনষ্টি করে বেড়ায়। এরপরেও আপনার মেয়ে তার বিরুদ্ধে আপনাকে কিছু বলেনি! কেন জানেন? কারণ সে আপনাদের মতো নির্বোধ নয়। জন্ম দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বাচ্চাদের ভালোবাসতে হয়! নাহলে তারা বখে যায়। কিন্তু উপমা নিজেকে সঠিক রাস্তায় ঠিকই রেখেছে। আপনারা তো পিতামাতা নামের কলঙ্ক। ( আপনারা যারা আমার গল্প পড়েন। তাদের মধ্যে অনেকেই আছে আমার মায়ের বয়সের। প্লিজ আপনারা পৃথিবীতে টাকা নামক মরিচীকার পিছনে না ছুটে সন্তানের একটু খোঁজ রাখুন৷ অনেক সন্তান আছে যারা মানসিকভাবে ভেঙে যায়। গভীরে রাতে নিশ্বব্দে গিয়ে দেখবেন সে কাঁদছে। হোক সেটা আপনাদের কারণে বা ভালোবাসার মানুষের কারণে। একেবারেই স্বার্থপর হয়ে যাবেন না। হাজারো বাবা মা আছে যারা ভাবে টাকা কামাই, পরে সন্তানের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। এই চিন্তা যারা করে তারা আসলে বাবা মা হওয়ার যোগ্য নয়৷ এভাবে চললে একদিন সন্তানকে দেখতে হবে নেশা করা অবস্থায়। শুনতে হবে আপনি নেশাখোরের মা বাবা! আরে রিজিক আপনার আমার, আল্লাহ, ভগবান, গড দেবে। {এখানে তিনটি নাম বললাম কারণ হিন্দু এবং খ্রিস্টান ভাই বোনেরাও পড়ে। খ্রিস্টান ভাইরা আল্লাহকে কি বলে জানি না। তাই গড দিলাম। মনে হয় তাই }৷ আমিও এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলাম। কারো সাপোর্ট পাইনি। তখন নিজেকে একাই উঠতে সাহায্য করেছি। তাকিয়ে দেখেছি মায়ের চোখের পানি এবং হাসি৷ আলহামদুলিল্লাহ মায়ের মুখের হাসি এবং পানি আমাকে একেবারেই তুলে নিয়ে এসেছে। আর কিছুর প্রয়োজন হয়নি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রমণী যখন চোখের সামনে হাসি দেয় তখন কোন ছেলেটা পারে সেটাকে এড়িয়ে যেতে? আমার মা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রমণী। যার হাসিতে কেটে যায় আমার ডিপ্রেশন।
আমার কথাগুলো শুনে শ্বশুরের চোখ দিয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। আর আগুনঝরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তার বউয়ের দিকে।
মিসেস হাসান একটু চুপসে গেছে। শ্বশুর মশাই মিসেস হাসানের কাছে গেলেন।
‘- মুগ্ধ যেগুলো বলেছে সেগুলোমকি সত্যি?
মিসেস হাসান চুপ করে রইলেন।
“- কি হলো চুপ করে আছো কেন?
‘- এখন চিৎকার করে লাভ নেই। এখনো তো আসল কথা বলিই নাই।
এবার সবাই আরও ভ্রু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে।
উপমা আমায় প্রশ্ন করল,
‘- আসল কথা মানে?
‘- তুমি ক্লিয়ার করে বলো তো বাবা?
শ্বশুরের কথায় তার সামনে গেলাম।
‘- আমাদের বাসর রাতে আপনার মেয়ের ইচ্ছে ছিল তাকে নিয়ে বাইরে হাঁটতে। গিয়েও ছিলাম। আর সেখানেই উপমাকে মারার চেষ্টা করে গাড়ি চাপা দিয়ে। সেটা আর কেউ নয়, করেছে আপনার স্ত্রী। শুধুমাত্র আপনি আপনার সম্পত্তি আপনার মেয়ের নামে দিয়েছেন বলে।
আমার কথা শুনে সবাই অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।। সঙ্গে সঙ্গে মিস্টার হাসান মিসেস হাসানকে সর্বশক্তি দিয়ে একটা থাপ্পড় মারে। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পরে গেলেন।
উপমা দৌড়ে গিয়ে মিসেস হাসানকে তুললেন।
‘- বাবা এটা কি করছো তুমি?
‘- এটা অনেক আগেই করা উচিৎ ছিল আমার। টাকার লোভ মানুষকে এতটা নিচে নামাতে পারে? আমার ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে।
মিসেস হাসানের প্রতি এই ব্যবহারে আমার এতটুকুও খারাপ লাগছে না। আমি আরও তার সামনে গিয়ে বললাম,
‘- আপনার ভাগ্য ভালো যে উপমার কোন ক্ষতি হয়নি। তাই শুধুমাত্র শাশুড়ি বলে ছেড়ে দিলাম। আর যদি উপমার শরীরে এতটুকু আঁচড় লাগতো না, তাহলে ভুলে যেতাম আমি আইনের লোক। নিজ হাতে আপনাকে মেরে ফেলতাম। আর পরবর্তী সময়ে যদি এই ভুল করার চেষ্টাও করেন, তাহলে আমার থেকে নিকৃষ্ট আর কেউ হবে না।
আমার এই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে মিসেস হাসান এবং উপমা দুজনেই ভয় পেলো।
উপমা আমার কাছে এসে আমার দুই চোয়ালে হাত রেখে বলল,
‘- প্লিজ তুমি শান্ত হও। দেখো আমার তো কিছুই হয়নি।
উপমার কাঁধ জড়িয়ে ধরে শ্বশুরকে বললাম,
‘- বাবা আপনার যা সম্পত্তি আছে সব আপনার স্ত্রীকে দিয়ে দিন৷ দু’জনে চাকরি করি। আলহামদুলিল্লাহ সুখেই কাটাতে পারবো আমরা আমাদের জীবন। আর শাশুড়ি মা আপনাকে বলছি। মানুষকে কিভাবে ভালোবাসতে হয় সেটা আপনার মেয়েকে দেখে শিখে নিন৷ আপনি তাকে এতো কষ্ট দেওয়ার পরেও সে আপনাকে শ্রদ্ধা করতে ভোলেনি৷ নিরবে ভালোবেসে গেছে।
যখন চলে আসতে যাব তখনই উপমা আমাকে টেনে ধরে। পিছনে তাকিয়ে দেখি শাশুড়ি মা উপমার পা জড়িয়ে ধরেছে। আর হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেছে।
‘- মা তুই আমাকে ক্ষমা করে দে। বিশ্বাস কর আমি টাকার লোভে অন্ধ হয়ে গেছিলাম। তুই আমাকে ক্ষমা না করলে তোর বাবা আমাকে বাড়ি বের করে দেবে।
তার চোখ দিয়ে অনর্গল পানি গড়িয়েই চলেছে। উপমা জানে এখন তার প্রতি সহানুভূতি দেখালে আমি রেগে যাব। তাই সে আমার দিকে তাকালো মায়ায় ভরা দৃষ্টি নিয়ে।
আমিও ইশারায় বললাম তাকে সামলে নাও। উপমা আমার অনুমতি পেয়ে মিসেস হাসানকে তুলে বুকে জড়িয়ে নিল। মানুষ ভুল করতেই পারে সেটা হোক বড় বা ছোট ভুল। প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করে দিন। দেখবেন আপনার প্রতিপক্ষ নিজেই লজ্জিত হয়ে যাবে। আপনি যদি তার সাথে লড়াই না করেন তাহলে সে জিতবে কিভাবে? আর যদি লড়াই না হয় তাহলে সে একা একা কিভাবে লড়াই করবে? সে যদি চেয়েও লড়াই করতে না পারে তাহলে সে নিজেই লজ্জিত হয়ে যাবে। হার মেনে নিতে বাধ্য সে।
সেখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি আসছিলাম। মাঝরাস্তায় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়। ভিড় ঠেলে গিয়ে দেখলাম আর কেউ নয় দুর্ঘটনা হয়েছে আমার ভাইয়ের সাথে। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে রাস্তায় অথচ আশেপাশের লোকজন তামাশা দেখতে ব্যস্ত। কেউ কেউ করছে ভিডিও আবার কেউ গেছে লাইভে। ভাই আমাদের সমাজটা এমনই। তাদেরকে আপনার বিপদে পাশে পাবেন না, পাবেন সুখের সময়। ভাইয়া আমাকে দেখে হাত দিয়ে ইশারা করল। হয়তো ডাকছে।
আমি সব রাগ অভিমান ঝেড়ে ফেলে দৌড়ে গেলাম ভাইয়ের কাছে। তার মাথাটা আমার কোলে তুলে নিলাম। ভাইয়া আমার হাত দুটো মুঠো করে নিয়ে ভাঙা কণ্ঠে অনেক কথা বলল।
ভাইয়ার কথা শুনে আমার কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে। পৃথিবীটা শুধু ঘুরছে। শিখা আমার জন্য নিজের জীবনটা এভাবে শেষ করে দিল। আর আমি স্বার্থপরের মতো তাকে একলা ফেলে চলে এসেছিলাম।
চলবে ইনশাআল্লাহ,,,,,