অনুভবে তুমি পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
962

#অনুভবে_তুমি
#পর্ব_১১_শেষাংশ
#লেখমীতে_মুগ্ধ_ইসলাম_স্পর্শ
এই মুহূর্তে আমরা দাঁড়িয়ে আছি শিখার ঘরের সামনে৷ পাশে রয়েছে শিখার মা। ভিতরে যাওয়ার জন্য মনটা ছটফট করলেও পা দু’টো এগোতে চাইছে না। কোন মুখে তার সামনে দাঁড়াবো আমি? স্বার্থপরের মতো তাকে একলা ফেলে পালিয়ে গিয়েছিলাম। এখন বউসহ এসেছি তার সাথে দেখা করতে।
অবশেষে উপমা আমাকে ধরে নিয়ে গেল ঘরের ভিতরে। এতবছর পর শিখাকে দেখে মনটা কেমন উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
শিখা সিলিং ফ্যানের দিকে একপলকে তাকিয়ে রয়েছে। আর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে নিশ্বব্দে। আমরা ঘরে প্রবেশ করেছি এখনো টের পায়নি সে। শিখার দু’টো পায়েই ব্যান্ডেজ পেঁচিয়ে রেখেছে।
শিখার মা শিখার পাশে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘- দেখ মা শিখা! তোর সাথে কারা দেখা করতে এসেছে।
এবার শিখা চোখের পলক ফেলে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালো। আমাকে দেখেই শিখা ফোপাঁতে শুরু করে কিন্তু চোখে পানি নেই। একটু পর চোখ দিয়ে আবার পানি পরতে শুরু করে। শুনেছি কথাও বলতে পারে না ঠিকমত। শিখা তার একটা হাত আমার দিকে বাড়িয়ে ইশারায় ডাকে।
শিখার চোখের পানিগুলো আমার একদম ভেঙে দিচ্ছিল। এ কোন দোটানায় পড়লাম আমি? নিয়তি কেন এত নিঠুর? শিখা তখনই যদি বলতো সবকিছু। তাহলে হয়তো কিছু করতে পারতাম না। তবে তাকে নিয়ে চুপিসারে পালাতে তো পারতাম দুজনের জীবন বাঁচাতে। আজ ওর বোকামির কারণে,,,,
মানুষ বিপদে পড়লে আপনাআপনিই নির্বোধের মত কাজ করে বসে।
আফসোস করেই বা কি হবে। এখন আফসোস করলে খামোখা ভবিষ্যৎটাকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার মত বোকামি করা হবে। কারো জীবনকে একেবারে বিষিয়ে দিতে আফসোস শব্দটাই যথেষ্ট। আফসোস যারা করে তারা কখনো জীবনের স্বাদ পায় না৷ তারা ভাবে ইশ জিনিস টা কেন যে ছেড়ে আসলাম। যদি চাইতাম তাহলে পাইতাম। এই ভেবেই সেখানেই নিজেকে গুটিয়ে নেয়। কিন্তু চিন্তা করে না যে আমি যেটা পারিনি সেটাকেই আবার অর্জন করতে চেষ্টা করব।
আমি শিখার এমন নিরব আর্তনাদ দেখে উপমার দিকে তাকালাম। উপমা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল,
‘- যাও। যাকে কাঁদিয়েছ তার চোখের পানি মুছে দাও।
আমিও আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম। শিখার পাশে বসে তার চোখের পানি মুছে দিলাম। আজ কতদিন পর শিখাকে স্পর্শ করলাম। শিখা আমার গালে হাত বুলিয়ে ভাঙা কণ্ঠে বলল,
‘- কেমন আছো গুড্ডু?
আজও তার মুখে তার দেওয়া নামটা শুনতে পাবো ভাবতে পারিনি।
‘- আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?
শিখাও উপমার মতই মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,
‘- হুম ভালো।
আশ্চর্য হতে বাধ্য হই আমি। শিখার কথায় এতটুকুও অভিমানের ছাপ নেই। অথচ আমিই তাকে ফেলে গিয়েছিলাম। সত্যিকারের ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়। পাই বা না পাই! সে সুখী হোক।
এবার উপমা এসে শিখাকে ধরে বসিয়ে দিল।
শিখা কৌতূহলী দৃষ্টিতে উপামকে দেখছে। জিজ্ঞেস করেই বসলো,
‘- তুমি কে?
আমি উপমার দিকে তাকালাম আর উপামাও৷
‘- ও উপমা। আমার বউ।
শিখা মুখে হাসির রেখা রেখেই বলল,
‘- বাহ কি মিষ্টি একটা মেয়েকে বিয়ে করেছ।
কথাটি বলেই উপামার মাথায় এবং মুখে হাত বুলিয়ে দিল। শিখা আবারও বলে ওঠে,
‘- শুনো বোন! মুগ্ধর মতো সুন্দর মনের মানুষ খুব কম পাবে। ও যাকে ভালোবাসে তাকে একেবারে মনের গভীর থেকে ভালোবাসে৷ আমার মতো ওকে কখনো কষ্ট দিও না।
এতক্ষণ শিখার কথায় অভিমানকে খুঁজে না পেলেও এখন স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আমার বিয়ের কথা শুনে সে একটু হলেও অভিমান করেছে। মানুষ অনেক কিছু সইতে পারলেও ভালোবাসার মানুষের পাশে কাউকে খুব সহজে সইতে পারে না।
উপমা শিখাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘- আপু তুমি একটু বসো আমরা আসছি।
উপমা আমাকে এবং আন্টিকে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো। ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়ালো। উপমার এরূপ কাজের কোনো মানেই বুঝলাম না।
‘- কি হলো উপাম এভাবে এখানে নিয়ে এলে কেন?
‘- বলছি। আচ্ছা আন্টি আপনি বলেন তো শিখা আপুর জন্য ছেলে দেখেছেন?
আন্টি উপমার কথায় একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।
‘- এসেছিল দু’টো সমন্ধ। কিন্তু ভাঙা পা দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আর তাছাড়া আমিও চাইনা আর কোথাও বিয়ে দিতে। এমনিতেই মেয়েটা আমার মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে প্রতিনিয়ত। তারউপর যদি ওকে আবার বিয়ে দিই, সেখানে যে ওকে কষ্ট দেবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই মা।
‘- আন্টি আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। যদি আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে বলতে পারি।
‘- হ্যাঁ বলো!
‘- আমি আসলে চাচ্ছি আমি আর শিখা আপু একসঙ্গে থাকতে।
উপমার কথা শুনে আন্টি এবং আমি দু’জনেই অবাক হই।
‘- একসঙ্গে থাকতে মানে?
‘- মানে হচ্ছে মুগ্ধ শিখা আপুকে বিয়ে করবে।
উপমার কথা শুনে আমার মাথা ভনভন করে ঘুরতে শুরু করে।
উপমাকে আমার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললাম,
‘- উপমা তোমার মাথা ঠিক আছে? এসব কি আবোলতাবোল বকছো? শিখাকে বিয়ে করলে তুমি কোথায় যাবে?
‘- তোমার মাথায় কি সমস্যা আছে? আমি কখন বললাম কোথাও যাব? বলেছি একসঙ্গে থাকবো। আর যেই মানুষটা শুধুমাত্র তোমার জন্য নিজের জীবনটা শেষ করে দিল তাকে বিয়ে করতে তোমাকে হবেই। আমি এখনো শিখা আপুর চোখে তোমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি৷
‘- কিন্তু উপমা,,,,
‘- কোনো কিন্তু নয়। যেখানে আমার আপত্তি নেই সেখানে তুমি আপত্তি কেন করছো? আন্টি আপনার কি আপত্তি আছে?
আন্টি একটা হাসি দেয়,
‘- আমি জানি মুগ্ধ অনেক ভালো একটা ছেলে। ওর কাছে গেলে আমার মেয়েটা অনেক ভালো থাকবে। কিন্তু আমি জেনেশুনে তোমাদের সংসারটাকে এভাবে নষ্ট হয়ে যেতে দিতে পারি না।
‘- আন্টি আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমরা দুই বোন মিলেমিশে থাকবো। এটুকু বিশ্বাস আপনি আমার উপর রাখুন। স্বামীর ভাগ যখন দিতে পারছি তখন মিলেমিশেও থাকতে পারবো। আর বাকি রইলো মুগ্ধ। ওর কথার ধার কে ধারে? বেশি ত্যাড়ামি করলে সোজা হাজতে ঢুকিয়ে দেব৷
বাহ, পরিস্থিতি যেমনই হোক। উপমার ফাপরের ঠেলায় হাসি আসতে বাধ্য।
‘- শিখার দেখাশোনা করবে কে তাহলে?
তাদের কথার মাঝে আমি প্রশ্নটি করলাম।
উপমা স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল,
‘- আমি। হ্যাঁ চাকরি ছেড়ে দেবো। ছোটবেলা থেকেই তো একাকিত্বে সময় পার করেছি। এখন থেকে নাহয় শিখা আপুর সাথে সময় কাটালান। তুমি যতকিছুই বলো না কেন? আমি কোন কথা শুনছি না। আজ তোমার জন্য শিখা আপুর এই অবস্থা। ভালোবাসো অথচ মুখ আর চোখের পানি দেখে তার মনের অবস্থা বুঝো না।
আমি আর বলার মত কিছু খুঁজে পেলাম না। তাই চুপ করে রইলাম।
উপমা তো ঠিকই বলেছে। সেদিন যদি শিখার মনের অবস্থা টা বুঝতাম তাহলে আজ হয়তো এ দিনটি দেখতে হতো না।
আমি ভাবতেই পারিনি উপমা এমন একটা সারপ্রাইজ দেবে। আমি তো দ্বিতীয় বিয়ের কথা মাথাতেই আনতে পারিনি। আর সেখানে উপমা নিজেই জোর করছে আমাকে৷
অগত্যা শিখার সাথে আমার বিয়ে হয়। উপমা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের বিয়ে দেয়। মেয়েটা বড়ো অদ্ভুত। সবসময় মানুষের কথাই ভাবে। লোক খুব কম ছিল। শিখার মা বাবা আর আমার মা বাবা। উপমা অনেক কষ্টে তার বাবাকে রাজি করিয়েছে। আশ্চর্য বিষয় হলো আমাদের বিয়ের সময় উপমার মুখে হাসি লেগেই ছিল। এক মুহূর্তের জন্যেও মুখটাকে মলিন করেনি। শিখাও বিয়েতে রাজি ছিল না। কিন্তু উপমার পাগলামির কারণে সেও রাজি হয়েছে। যাক এখন একটু হলেও নিজের ভুলের বোঝা কমে গেল।
আমাদের বেডরুমেই শিখাকে নিয়ে গেছে উপমা। শিখা হাটতে পারে না। ওকে ধরে হাঁটাতে হয়৷
(আহ কি শান্তি কি শান্তি 🥱। দু’টো বউ।)
আজও একটা বিরিয়ানির প্যাকেট সঙ্গে নিয়ে ঢুকলাম। শিখা আর উপমা দুজনকেই খাইয়ে দিলাম। শিখাকে ধরে বসে আছে উপমা।
‘- শুনো আপু! আমি যেমন অধিকার খাটাই মুগ্ধর উপর ঠিক তেমনি অধিকার তুমিও খাটাবে। কখনো এতটুকুও কমবেশি করবে না। দু’জন ওকে সমানভাবে ভালোবাসবো। আমাকে কখনো সতীন ভাববে না। ভাববে মায়ের পেটের বোন। নাহলে খবর আছে বলে দিলাম। আর এইযে মিস্টার! আপনিও আমাদের দুই বোনকে সমানভাবে ভালোবাসা দেবেন৷
উত্তর স্বরুপ একটা মুচকি হাসি দিলাম।
সত্যিই তোমার তুলনা হয় না উপমা। শিখা উপমার কপাল টেনে সুন্দর করে শব্দ করে একটা চুমু দেয়।
‘- ছোটবেলায় মাকে বলতাম করতাম! মা আমার একটা ভাই বা বোন নেই কেন? বড়ো আফসোস হতো অন্যান্য ভাইবোনের খুনসুটি দেখে৷ তবে আজ আমি একটা বোন পেলাম।
ওদের দেখে সত্যিই আনন্দে আমার মনটা ভরে ওঠে। কতো তাড়াতাড়ি নিজেদের আপন করে নিল।
আমি তাদের পাশে বসলাম। প্রথমে শিখাকে কাছে টেনে নিলাম। যখন শিখাকে কাছে টানলাম তখন উপমা উঠে যাচ্ছিল। উপমাকেও টেনে কাছে নিলাম। শিখার কপালে ছোট্ট একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে উপমার দিকে তাকালাম।
‘- কোথায় যাও হুম?
‘- আজ আপুকে সময় দাও। আমি পাশের রুমেই আছি।
উপমার কপালেও একটা আদর দিলাম।
‘- কোথাও যাওয়া হচ্ছে না। তুমি শিখার সাথে ঘুমাও। শিখা এখন অসুস্থ। আমি সোফায় ঘুমাচ্ছি৷
‘- না কেউ আলাদা থাকবো না। সবাই একসাথেই ঘুমোবো৷
শিখার কথায় উপমা আর কিছু বলল না। তিনজন শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে অফিসে যাইনি বলে স্যার কল দিল। সালাম বিনিময় করে জিজ্ঞেস করে,
‘- কি ব্যাপার তুমি ডিউটিতে আসোনি কেন?
‘- স্যার আসলে আজ আসতে পারবো না।
‘- কেন?
‘- বিয়ে করেছি তাই।
‘- কিহ তুমি আবার বিয়ে করেছ? এতবড় সাহস উপমাকে ছেড়ে,,,
‘- আরে স্যার রাগ করবেন না। উপমা নিজেই দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের বিয়ে দিয়েছে।
‘- বাহ তোমারই কপাল। আমার বউটাই আর বুঝলো না। সুখে থাকো ভাই।
কল কেটে গেল।
হাহাহা স্যারের জ্বলছে।
কয়েকদিন পর দুই বউকে নিয়ে ওমরাহ করতে যাই৷
সমাপ্ত।
লেখার পরে চেক করা হয়নি। বানানে ভুল থাকতে পারে। তাই ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
নামাজ কায়েম করুন।
ধন্যবাদ সবাইকে।