অনুরিমা পর্ব-০৩

0
165

#অনুরিমা
#পর্ব_৩
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

ভয় পেয়েছো? জানতাম, ভয় পাবে। তাই আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিলাম দেখার জন্য তুমি কি করো?

অনুরিমা অতর্কিত ফারিজের আগমনে আৎকে উঠলো। তার সমস্ত কায়া এখনো কাঁপছে। অল্পের জন্যই সে জ্ঞানশূন্য হয়নি। এভাবে কেউ সামনে আসে। থাকবেই যখন এত ডং করে যাওয়ার কি দরকার ছিল? সে শুধু শুধু এতক্ষণ ভয় পাচ্ছিলো। ভয়ের ছোটে তার মুখে কোনো রা’ নেই। কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছেনা। দৈবাৎ মুখ ফসকে বললো,

আচ্ছা, আপনাকে কে বলেছে আমি সর্দার বাড়িতে।

ফারিজ অনুরিমার প্রশ্ন শুনে নিশব্দে হাসলো। এই মেয়ে এক বিষয় নিয়েই পড়ে আছে। সে বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দু’হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে আছে। এবার সে অনুরিমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বললো,

তোমার দেখি অনেক কৌতুহল। তা জানা’টা কি খুব জরুরি।

অনুরিমা ছোট্ট করে বলল হু।

আমি নিজেও জানি না কে কল করেছে? কিন্তু তোমাকে বোন বলে সম্মোধন করছে। অ্যাই থিঙ্ক তোমার বোন হতে পারে। তোমার বোন আছে?

হুম। আমার ছোট বোন একটা আছে। আচ্ছা, আপনি সর্দার চাচার এত কিছু কেমনে জানলেন?

অনেক খাটতে হয়েছে। কালকে পুরো দিন বাইরে ছিলাম। অনেক আগেই থেকেই তিনি আমার টার্গেটে ছিলেন। তবে তোমার বিয়েতে হাতে-নাতে ধরেছি। তোমার মত এরকম আরো অনেক মেয়ের সাথে অবিচার হয়েছে। এবার তাদের ন্যায় পাওয়ার পালা। তবে আফসোস আমি তাদের বিয়ের আগে উপস্থিত হতে পারেনি। হয়তো ভাগ্যক্রমে তোমার বিয়ে বন্ধ করতে পেরেছি। জানি না এরকম সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারবো কি’না? ফারিজ মাটির দিকে তাকিয়ে তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ে। কিছুক্ষণ নিরাবতা পালন করে পুনরায় বলে উঠে তুমি কিসে পড়ো?

দশম শ্রেণীতে পড়তাম। গত দু’মাস স্কুলে পা’ রাখেনি আমি। মা’ আমার পড়ালেখার খরচ দিতে পারে না। তার উপর গ্রামের পোলাপান আমারে পথে-ঘাটে বিরক্ত করে। এর মধ্যে সর্দার চাচা আমারে বিয়ে দেয়ার জন্যে উঠে পড়ে লাগছিল। সেই থেকে রাগে দুঃখে পড়ালেখা ছাইড়া দিছি।

ফারিজ ভীষণ অবাক হলো। এই মেয়ে পড়ালেখা ছেড়ে দিছে। তার মুখে উৎকন্ঠার ছাপ। সে মলিন মুখে বললো,

যদি আমি তোমাকে পড়াশোনা করায় তুমি পড়বে?

অনুরিমা এহেন বাক্য শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো। খুশি হবে না’কি কাঁদবে সে বুঝতে পারছে না। কম্পিত গলায় বললো,

সত্যিই আপনি আমারে পড়াবেন? কিন্তু আমি তো গত দু’মাস স্কুলে যাই নাই। এখন স্কুলে কেমনে পা রাখমু। আমার তো মেলা লজ্জা করতেছে। সবাই আমারে নিয়া হাসাহাসি করবো এখন।

তুমি চিন্তা করো না। কালকে আমি তোমাকে নিয়ে স্কুলে যাবো। স্যারদের সাথে কথা বলবো। তাহলে কেউ আর হাসাহাসি করবে না।

সত্যিই আপনি আমার সাথে যাবেন। এ কথা বলে অনুরিমা দু’চোখের জল ছেড়ে দিয়েছে। কান্নামিশ্রিত স্বরে বললো,

জানেন কেউ কোনোদিন এভাবে আমারে বলে নাই তুমি পড়াশোনা করবা। তোমার চিন্তা করতে হবে না আমি আছি। বাবা থাকতে আমার বাবা মাঝে মধ্যে স্কুলে যাইতো। কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর আর কেউ যাই নাই স্কুলে আমার সাথে। আপনে এত ভালো কেনো? আমার জন্য কতকিছু করতেছেন।

ফারিজ সামনে এগিয়ে এসে অনুরিমার মাথায় আলতো করে হাত রাখলো। তারপর সান্ত্বনা স্বরূপ বললো,

তুমি কখনো দেখেছো সবল’রা সবলদের উপর জুলুম করতে। অনুরিমা আলতোভাবে ডানে বামে মাথা নাড়ায়। ফারিজ কিঞ্চিৎ মুখ প্রশস্ত করে বলে উঠে কিন্তু সবল’রা চিরকাল দুর্বলদের উপরই জুলুম করে। আমার কথার তাৎপর্য বুঝতে পেরেছো। সে নিজের হাত ত্বরিত অনুরিমার মাথা থেকে সরিয়ে নেয়। তারপর পুনরায় প্রশ্ন করে বলো তো আমি কি বুঝিয়েছি?

অনুরিমা ছলছল চোখে ফারিজের কথার মর্মার্থ বুঝার চেষ্টা করে। তারপর আচমকাই বলে উঠে,

নিজের দুর্বলতা অন্যেকে দেখানো যাবে না। কিন্তু সবল করতে হলে তো টাকা-পয়সা লাগে। আমাদের তো টাকা নেই।

ফারিজ এবার নিশব্দে হাসলো। মেয়েটা এবার লাইনে এসেছে। সে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলল,

সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচতে নিজের পরিচয় তৈরি করবে। যাতে কেউ তোমাকে দুর্বল ভেবে জুলুম করতে না পারে। পারবে তো নিজের পরিচয় তৈরি করতে যাতে আজকের মত দিন তোমার জীবনে দ্বিতীয়বার না আসে।

আমাদের তো কেউ ছিল না, যে আমাদের সবকিছু থেকে রক্ষা করবে। বাবা নামক ছায়া তো দু’বছর আগেই হারাই গেছে। পুরুষ বলতে আপন কেউ আমাদের ছিলো না। আপনার মত করে কেউ কোনোদিন আমাদের বুঝাইনি। কেউ বলেনি তোমরা বাঁচো, তোমাদেরও বাঁচার অধিকার আছে। নিজের পরিচয় তৈরি কর। জানেন আজকের আগে কেউ বলেনি আমাকে?

ফারিজ মলিন মুখে তৃপ্তির হাসি দিলো। সে এই সমাজ বদলাতে চাই। সবার অধিকার আছে নিজের মত বাঁচার। ফারিজ আর কথা বাড়াই না। তারপর অনুরিমাকে বলে চলো তোমাকে বাড়িতে দিয়ে আসি অনেক রাত হয়ে গেছে। অনুরিমাও মাথা নাড়ায় হ্যাঁ বলে।

নিরবতার মাঝে দু’জন বাইকে করে অনুরিমাদের বাড়িতে আসে। এর মাঝে দু’জনের মধ্যে কোনো বাক্য বিনিময় হয় না। ফারিজ অনুরিমাদের বাড়ি পৌঁছাতে দেখে উঠোনের মাঝে তার মা’ দাদীরা জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে সবাই ছুটে আসলো। সবাই কেমন প্রশান্তির নিশ্বাস ছাড়ছে। জমিলা ত্বরিতবেগে নাতনিকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ফারিজকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

ভাই তোমারে আল্লাহ কোত্থেকে মিলাই দিলো। জানো আল্লাহর কাছে তোমারলাই কতবার দোয়া করছি। আল্লাহ তোমারে দীর্ঘজীবন বাঁচাই রাখুক ভাই।

ফারিজ জমিলারে সান্ত্বনা দিলো। দাদু চিন্তা করবেন না। আমি আপনার নিজের নাতির মতই। আমি আছি তো সব সময় আপনাদের পাশে। ফারিজ জমিলার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় তারপর অনুরিমার মায়ের কাছে যায়। তাকে গিয়ে বলে উঠে,

চাচীম্মা আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো।

গ্রামের সহজ সরল মহিলা জায়েদা। গরীব বাবার মেয়ে ছিল সে। চৌদ্দ বছর বয়সে আকবরের মত একজন মধ্যবয়সী পুরুষের সাথে বিয়ে হয়েছিলো তার। ষোল বছর বয়সে আবার বাচ্চার মাও হয়ে যাই। কিন্তু বিধিবাম তার প্রথম বাচ্চা জন্মের পরপরই দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। এর দু’বছর পর তার ঘর আলো করে আসে আরেক সন্তান। কিন্তু সেই সন্তানও আল্লাহ তায়ালা নিজের কাছে নিয়ে নেন। কত কবিরাজী, কতকিছু করে বিয়ের আট বছর পর অনুরিমা তার গর্ভে আসে। এর ঠিক দু’বছর পর তার আরও একটি মেয়ে হয়। এরপর আর কোনো সন্তান হাজার চেয়ে আর হয়নি তাদের। ততদিনে আকবরও অনেক রোগা হয়ে গেছে। সিগারেটের মত বদ অভ্যাসে তার জীবন কেড়ে নিছে। তাই তো আজকে তাদের এহেন দুর্দশা।

জায়েদার চোখে মুখে মলিনতার ছাপ। তার মেয়েটার বিয়ে হলে সলিল তাদের সংসার দেখতো। এখন কে দেখবে? কীভাবে চলবে? আগে সর্দার তাদের দেখভাল করতো। তার তো চিন্তায় এখন হাত-পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে।ফারিজের কথা শুনে আমতা আমতা করতে লাগল। তার মুখ দিয়ে কথা বেরুতে চাইলো না। কি বলবে ছেলেটা তাকে? ভাঙা গলায় মিনমিনে বললো,

কি বলবে আমাকে?

ফারিজ অভয় দিলো তাকে। ভয় পাবেন না চাচীম্মা। আমি জরুরি কিছু কথা বলেই চলে যাবো। কাল আপনি আমার সাথে ইউনিয়ন পরিষদে যাবেন। আপনার বিধবা ভাতার কার্ড আর দাদুর বয়স্ক ভাতার কার্ড বানাতে হবে। কিন্তু চাচীম্মা আগে স্কুলে যাবো। আপনার মেয়ের শিক্ষকদের সাথে কথা বলবো। সে এবার থেকে নিয়মিত স্কুলে যাবে।

জায়েদা চমকে উঠলো ফারিজের কথায়। তার মেয়ে স্কুলে যাবে। কিন্তু কিভাবে যাবে? গ্রামের মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে না। সবাই কত কুৎসা রটাবে এখন। সে কিছু একটা বলতেই উদ্বত হতেই ফারিজ তাকে থামিয়ে দিলো।

চাচীম্মা আমি আছি চিন্তা করবেন না। সবকিছুই আমি দেখবো। আপনি শুধু ওর ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়াবেন। আপ্তি বোনের স্কুলে যাবার কথা শুনে খুশিতে লাফ দিয়ে উঠে। ফারিজের সামনে গিয়ে বলে উঠে,

ভাইয়া, সত্যিই আমার আপু স্কুলে যাবে।

ফারিজ হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ালো।

আপ্তি উচ্ছ্বসিত হয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। আপু কাল আমরা দু’জন একসাথে স্কুলে যাবো।

ফারিজ তাদের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার জন্য উদ্বত হলো। আচম্বিত তার মনে হলো এই মেয়ের নাম সে জিজ্ঞেসই করেনি। কিছুটা ইস্ততঃবোধ করছিল সে। তারপর ত্বরিত বলল,

তোমার নাম কি?

অনুরিমাসহ বাকিরাও চমকে উঠলো। এই ছেলে নামই জানে না এখনো। অনুরিমা বলার আগে আপ্তিই বলে উঠল,

আমার আপুর নাম অনুরিমা আর আমার নাম আপ্তি।

ফারিজ নিশব্দে হেসে উঠল। তারপর অনুরিমার দিকে তাকিয়ে বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বললো,

আসি ক্ষুদ্রকণা। কাল দেখা হবে।

চলবে,,,,,,,,,,,,,,,