অন্তঃকরণে তোরই পদচারণ পর্ব-০২

0
736

#অন্তঃকরণে_তোরই_পদচারণ
#পর্ব-২
#লেখিকা-মেহরুমা নূর

★অতীত,
♬ উড়তি ঘাটায়ে হে কাজাল মেরা
♬ মেহকি হাওয়ায়ে হে আঁচাল মেরা
♬ মৌসাম হে মেরি হাসি

♬ আয়ই রে আয়ই রে খুশি
♬ খুশি খুশি খুশি,খুশি খুশি খুশি
♬ লায়ই রে লায়ই রে খুশি

মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে প্রফুল্লচিত্তে নিজ রুম থেকে বেড়িয়ে এলো চঞ্চলময়ী কন্যা খুশি। সিড়ির কাছে এসে সিড়ির রেলিঙের ওপর বসে স্লিপারের মতো স্লিপ করে নিচে আসছে আর গাইছে।
♬ হে মেরে সাথী, এ গুলবুটি
♬ মে জো নেহি তো সারে ঝুটি
♬ বানকে বাহারো কি পরি

♬ আয়ই রে আয়ই রে খুশি
♬ খুশি খুশি খুশি, খুশি খুশি খুশি

সোফায় খুশির বাবা রাকিব হাসান, আর ছোট ভাই নিভান বসে আছে। খুশি সেখানে এসে ওদের হাত ধরে দাঁড় করিয়ে ওদের সাথেও নাচতে লাগলো আর গান গাইতে লাগলো। খুশির বাবা ভাইও হাসিমুখে খুশির সাথে নাচতে লাগলো। এদের এই মহানন্দের মাঝে হঠাৎ কেউ কর্কশ গলায় বলে উঠলো।
–কি হচ্ছে এসব?

ব্যাস সবার নাচগান বন্ধ হয়ে গেল। সবকয়টা মিনি বিড়ালের মতো চুপচাপ সোফায় ভদ্রলোকের মতো বসে পড়লো। যেন দুনিয়ায় এদের মতো নম্র আর ভদ্রলোকের ভার মেলা দ্বায়। সাহেলা বেগম ওদের সামনে এসে কোমড়ে হাত রেখে বলে উঠলেন।
–সকাল সকাল কি হচ্ছে এসব হ্যাঁ? বাড়িটা নর্তক মঞ্চ করার ইচ্ছে জেগেছে নাকি? ভালো কাজ কি তোমাদের থেকে বিদায় নিয়ে পরপারে চলে গেছে নাকি?

রাকিব হাসান একটু সাহস যুগিয়ে মুখ খুলে বলে উঠলেন।
–আরে রাগ করছ কেন? আমরা তো খুশি মামুনির সাথে এই সামান্য একটু মজা করছিলাম।

নিভানও এবার বাবার সাপোর্টে বলে উঠলো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ আম্মু। আমরা তো আপুর সাথে মজা করছিলাম।

কিন্তু তাদের এই দূর্বল দলিলপত্র সাহেলার বেগমের মনোভাবে কোন প্রভাব ফেলতে পারলোনা। বরং তার পূর্বের মেজাজ টাকে আরও এক লেভেল বাড়িয়ে দিল।তিনি দাঁতে দাঁত চেপে বললেন।
–চুপ করো তোমরা। খুশিকে শাসন করার বদলে ওকে আরও মাথায় চড়াচ্ছ?

রাকিব হাসান বলে উঠলেন।
–ওমা, মাথায় কোথায় চড়ালাম? খুশি তো সোফায় চড়ে বসে আছে।

এবার সাহেলা বেগমের মেজাজ সপ্তম সীমায় পৌঁছে গেল। তিনি দাঁত কিড়মিড় করে বললেন।
–চুপ করো। সবগুলো বদমায়েশের হাড্ডি।এই নিভান টা তো হয়েছে বোনের চামচা। বোন দিন বললে দিন, রাত বললে রাত। আর সবার নাটের গুরু হলো এই খুশি। পড়ালেখার তো ধারে কাছেও যাবে না। সারাদিন শুধু হৈ হুল্লোড় করে বেড়ানোই কাজ। এসএসসি টেনেটুনে কোনরকমে পাশ করেছে। এখন কলেজে ভর্তি হয়েও সেই একই অবস্থা। এভাবে চলতে থাকলে টেনে হিঁচড়েও পাশ করতে পারবিনা।

এতক্ষণে জনাবা খুশি বলে উঠলো।
–আরে আম্মু এতো পড়াশোনা করে কি হবে? সেই তো তোমার মতো বিয়ে করে হাসব্যান্ডের যমরাজ হয়ে বসে থাকতে হবে। তো এরজন্য এতো পড়াশোনা করার কি দরকার?
কথাটা বলে হাসতে হাসতে নিভানের হাতের সাথে হাই ফাই দিল। ব্যাস এবার তো সাহেলা বেগমের মেজাজ প্রেসার কুকারের মতো ব্লাস্ট হয়ে উঠলো। ধমকের সুরে বললেন।
–চুপ কর বদমাইশ। বলার আগে একটু চিন্তা ভাবনা করে বললে কি হয় শুনি? আমি জাস্ট ফেড আপ হয়ে যাচ্ছি তোর ওপর।সত্যি বলছি আমার তো মাঝে মধ্যে সন্দেহ হয় নিশ্চয় হাসপাতালে আমার বাচ্চা বদলে গেছে। নাহলে তোর মতো এমন উড়নচণ্ডী মেয়ে আমার গর্ভে কিভাবে এলো?
কথাটা বলে সাহেলা বেগম হনহন করে কিচেনের দিকে চলে গেল।

সাহেলা বেগম যেতেই খুশি এবার এক ভ্রু উঁচিয়ে ওর বাবার দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো। খুশির এমন চাহুনি দেখে ওর বাবা বলে উঠলেন।
–কি হয়েছে এভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস?

খুশি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো।
–আম্মু এভাবে বললো কেন? সত্যি করে বলতো কাহিনি কি?

রাকিব হাসান ভীতু স্বরে বললো।
–কা কাহিনি? কিসের কাহিনি?

–আম্মু কেন বললো আমি যে তার মেয়ে এটা নিয়ে তার সন্দেহ আছে? আসল ঘটনা কি বলোতো? সত্যি সত্যিই আমি অন্য কারোর মেয়ে নাতো? কারণ আম্মুর মতো আমারও মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় যে,আমি তার আসল মেয়ে না। দেখ না আম্মু কেমন সবসময় শুধু আমাকে বকাঝকা করে। আর চেহারায় তো কোন মিল নেই। আম্মু কেমন ধবধবে ফর্সা। আর আমি শ্যামলা। তাই সত্যি করে বলো তুমি অন্য কারোর সাথে ইটিস পিটিস করে আমাকে পয়দা করোনি তো? পাশের বাড়ির ওই আন্টির সাথে কোন লাফরা নেই তো তোমার? আমি অনেক বার দেখেছি তুমি ওই আন্টিকে দেখলেই কেমন দাঁত কেলাও। বাই এনিচাঞ্চ ওই আন্টি আমার বায়োলজিকাল মা নয়তো?

রাকিব হাসান ভীতু স্বরে বললেন।
–কি বলছিস মা এইসব? তোর মা শুনলে প্রলয় শুরু করে দিবে। আরে এই অভাগা ঘরের ডালই ঠিকমতো পায়না। সে আবার বাইরের মুরগী কিভাবে খাবে?

–সত্যি বলছ তো? কারণ ওই আন্টি দেখি বিনা কারনেই আমার ওপর অনেক মেহেরবান হয়। আমাকে দেখলেই তার মমতা উতলে পড়ে।

এবার নিভান মাঝখান থেকে বলে উঠলো।
–দেখ আপু তুমি ওই আন্টির মেয়ে হলে আমিও তার ছেলে। তুমি যেখানে আমিও সেখানে।

খুশি নিভানের গাল টেনে দিয়ে আদুরে গলায় বললো।
–অওওওও… আমার কিউটি পাই টা। অফকোর্স বাবু,আমি যেখানে তুইও সেখানে। তুই তো আমার কলিজা।

রাকিব হাসান বলে উঠলেন।
–দয়া করে এসব ফালতু কথা বাদ দে তোরা। তোর মা শুনলে আমরা কেউ আর দুনিয়ার মুখ দেখতে পাবো না।

ওদের বাবার এমন করুন মুখশ্রী দেখে দুই ভাইবোন খিলখিল করে হেঁসে দিল।
____

ফাল্গুন মাস পড়ে গেছে। চারিদিকে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে। গাছে গাছে গজিয়ে উঠছে নতুন কচি পাতা। শিমুল, পলাশ, কুসুম সহ নতুন নতুন ফুলের আগমন ঘটেছে। বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে খুশির মনেও।বসন্ত বাতাসে মন নেচে উঠছে। কোন এক অজানা কারনেই মনটা আজ উৎফুল্ল হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে আজ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে ওর সাথে। যার প্রভাবে ওর সঁজীবনী নব্য রঙে রঞ্জিত হবে।

আজ খুশির কলেজের প্রথম দিন। প্রচুর উৎসাহ আর উদ্দীপনার সহিত কলেজে পা রাখলো সে। মনের মাঝে অনাবিল আনন্দের ঘনঘটা বইছে।দুই হাতে কাঁধের ব্যাগটা ধরে থেকে, আবেশিত হাসির সহিত কলেজের চারপাশ দেখছে সে।দৃষ্টিনন্দিত কলেজের সবকিছুই তার চঞ্চল মনকে আনন্দ দিচ্ছে। আরেকটু এগিয়ে যেতেই দেখলো ওর প্রিয় বান্ধবী দিয়া বট গাছের নিচে মুখ লটকিয়ে বসে আছে। খুশি হালকা হেঁসে এগিয়ে গেল। নীরবে দিয়ার পাশে বসে স্বাভাবিক সুরে বলে উঠলো।
–কয় নাম্বার হলো?

দিয়া নাক টেনে মলিন সুরে বললো।
–তেরো নাম্বার। ইয়ার আমার সাথেই এমন কেন হয়? আমার ক্রাশ গুলোর কি আমাকে চোখে পড়ে না।যার ওপরই ক্রাশ খাই সেই সবসময় আমাকে রেখে অন্যের প্রেমে পড়ে যায়। এইডা কোন কথা?

খুশি দিয়ার ঘায়ে নূনের ছিটা দিয়ে দুষ্টু স্বরে গলা ছেড়ে গাইতে লাগলো।
♬ বন্ধু যখন বউ লইয়া আমার বাড়ির সামনে দিয়া
♬ রঙ্গো কইরা হাইট্টা যায়।
♬ ফাইট্টা যায়, ওরে বুকটা ফাইট্টা যায়।

দিয়া আশাহত চোখে তাকিয়ে বললো।
–ইয়ার তুই আমার বান্ধবী নাকি দুশমন? আমিতো প্রেমের কথা বলছিলাম। তুই তো সোজা বিয়ে পড়িয়ে দিলি।

খুশি হেঁসে উঠে বললো।
–আচ্ছা সরি। আমার মনে হয় কি জানিস? তুই বোধহয় ব্রাশ না করেই ক্রাশ খেয়ে ফেলিস। তাইতো বারবার তোর বদহজম হয়ে যায়।

দিয়া বিস্ময়কর কন্ঠে বললো।
–তুই সত্যিই বলছিস? এমন হয় নাকি?

খুশি অতি কনফিডেন্সের সহিত বললো।
–হয় মানে! আলবাত হয়। তাই এখন থেকে ক্রাশ খাওয়ার আগে ভালো করে ব্রাশ করে নিবি। তাহলে দেখবি আর এমন হবে না।

দিয়া খুশির মহান উক্তি গুলো বিজ্ঞ জ্ঞানীদের বাণী মনে করে সরল মনে মেনে নিয়ে বললো।
–ঠিক আছে দোস্ত এবার থেকে তাই করবো। আচ্ছা তুই কখনো কারোর ওপর ক্রাশ খাস না?

খুশি মুচকি হেসে বললো।
–আরে না।এইসব ক্রাশ নামের কেরোসিন আমার জন্য না। তুই তো জানিসই আমি শুধু আমার ড্রিম ম্যানের অপেক্ষায় আছি। আর আমি আমার ড্রিম ম্যানের প্রতি অনেক লয়াল। আমার জীবনে সে ছাড়া আর কারোর জায়গা নেই।

–আরে হ্যাঁ আমিতো ভুলেই গিয়েছিলাম। তুই আবার তোর সেই মিঃ বাংলাদেশের জন্য পাগল।

খুশি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–মিঃ বাংলাদেশ?

–হ্যাঁ মিঃ বাংলাদেশ। মিঃ ইন্ডিয়ার বাংলাদেশী ভার্সন। মিঃ ইন্ডিয়ার মতো তোর ড্রিম ম্যানও অদৃশ্য। খালি চোখে দেখা যায় না। আর আমগো কাছে তো স্পেশাল চশমাও নাই দেখার জন্য।

–মজা নিচ্ছিশ নে। তবে আমিও একদিন তোকে দেখিয়ে দেব যে,আমার ড্রিম ম্যান আছে। আর বাস্তবেই আছে।

–হ্যাঁ হ্যাঁ দেখা যাবে। এখন চলনা আমরা একটু পাশের বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগে যাই। শুনেছি ক্যাম্পাস নাকি অনেক সুন্দর। চল ঘুরে আসি। হতে পারে তোর মিঃ বাংলাদেশও ওখানে পেয়ে যেতে পারিস।

খুশি উৎসাহিত হয়ে বললো।
–আরে নেকি অর পুচ পুচ। চল চল শুভ কাজ সেরে আসি।

অতঃপর দুজনে উৎসাহের সহিত পাশের ক্যাম্পাসের দিকে এগুলো। ক্যাম্পাসের মাঠে এসে ওরা আনন্দিত নয়নে ক্যাম্পাসের পরিদর্শন করছে। ক্যাম্পাসটাও অনেক সুন্দর। আজ এখানেও নতুন বর্ষের স্টুডেন্ট রা এসেছে।ছাত্র ছাত্রীর পদচারণায় মুখরিত চারপাশ। জায়গায় জায়গায় স্টুডেন্ট রা বসে আড্ডায় মেতেছে। কোথাও আবার লাভ বার্ডস বসে নিজেদের মাঝে কল্পনার জগতে ডুবে আছে। সবটাই উপভোগ করছে ওরা।

তবে হঠাৎই খুশির চিৎকার শুনে হড়বড়িয়ে গেল দিয়া। চমকে উঠে খুশির দিকে তাকিয়ে বললো।
–কিরে কি হয়েছে? চিল্লাস ক্যা? ভুত দেখেছিস নাকি?

খুশি চোখ বড়োবড়ো করে সামনের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু অতিরিক্ত এক্সাইটমেন্টে কিছু বলতে পারছে না সে। শুধু হাত উঁচিয়ে সামনের দিকে কিছু একটা ইশারা করছে। দিয়া কিছুই বুঝতে পারছে না। খুশি নিজের ইমোশন একটু নিয়ন্ত্রণে এনে নিয়ে বলে উঠলো।
–দোস্ত আমি পেয়ে গেছি। পেয়ে গেছি আমি।

–পাইছস? কি পাইছস? আর হারাইছে কি সেটা তো বলবি?

–আরে ইয়ার আমার ড্রিম ম্যান পেয়ে গেছি।

–কি বলিস? কই? কোথায়?

–আরে ওইযে দেখ ওখানে ক্যাফেটেরিয়াতে বসে আছে।

দিয়া খুশির হাতের ইশারা বরাবর তাকিয়ে দেখলো সত্যিই ওখানে দুটো ছেলে বসে আছে। দিয়া কৌতুহল নিয়ে বললো।
–ওখানে তো দুজন বসে আছে। তুই কার কথা বলছিস?

–আরে ওইযে এ্যাশ কালারের টিশার্ট পড়া ওইটা।

দিয়া ভালো আগে ছেলেটাকে পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর দুই গালে হাত দিয়ে আশ্চর্যের সাথে বললো।
–ইয়ার তোর মিঃ বাংলাদেশ তো ভিজিবাল হয়ে গেছে। বাই গড কেয়া চিজ হে ইয়ার। তোর আগে তো আমিই ক্রাশ খেয়ে ফিদা হয়ে গেলাম। আজ পর্যন্ত যতগুলো ক্রাশ খেয়েছি তারা তো এর সামনে দাঁড়ানোরও যোগ্য না।

খুশি এটিটিউডের সাথে বললো।
–খুশির ড্রিম ম্যান বলে কথা। সে কোন যেন তেন ব্যাক্তি হবে না।খুশি যেমন স্পেশাল, তার ড্রিম ম্যানও তেমন স্পেশাল। আর খবরদার আমার মালের ওপর কুনজর দিবি না। নাহলে চোখের মনি খুলে গুটি খেলবো বুঝেছিস। এখন চল যাই।

–যাই মানে? কই যাই?

–কই আবার? আমার ড্রিম ম্যানের কাছে। তার জীবনে যে খুশি এন্ট্রি করেছে। সেই সুখবর টা তো তাকে দিতে হবে তাইনা? বেচারা খুশিতে পাগলই না হয়ে যায়। চল চল..

খুশি দিয়ার হাত ধরে এক প্রকার টেনে নিয়ে গেল। সরাসরি এসে ছেলে দুটোর টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল। খুশির আখ্যায়িত ড্রিম ম্যান টেবিলে রাখা বইতে নজর গেঁড়ে বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এখানে ওরা দুজন মেয়ে আর পাশে থাকা চেয়ারের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। যেন ওদের কোন অস্তিত্বই নেই। ওদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য খুশি একটু গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো। এতে করে পাশের ছেলেটি ওদের দিকে তাকালেও, যার জন্য এতো কসরত তার কোন হেলদোলই নেই। পাশের ছেলেটা তখন বলে উঠলো।
–কি ব্যাপার আপুনিরা? কিছু বলবেন?

খুশি চোখের ইশারায় ছেলেটাকে বুঝালো সে তার সাথে না, বরং সামনের ব্যাক্তির সাথে কথা বলতে চায়। ছেলেটা তখন খুশির সেই ড্রিম ম্যানের দিকে তাকিয়ে বললো।
–প্রহর, ওরা তোর সাথে কথা বলতে চায়।

প্রহর…. নামটা শুনে খুশির মনে এক দমকা হাওয়া এসে লাগলো। তবে প্রহরের কথায় ভ্রু কুঁচকে এলো খুশির। প্রহর বইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলো।
–নট ইন্টারস্টেড।

ব্যাস এবার আর সহ্য হলোনা খুশির। হাত বাড়িয়ে টেবিলে থাকা বইটা ঠাস করে বন্ধ করে দিল সে। এবার প্রহর ভ্রু কুঁচকে তাকালো খুশির দিকে। আর সামনের ছেলেটা হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। আজ পর্যন্ত প্রহরের সামনে কেউ এমন দুঃসাহস দেখানোর গোস্তাখি করেনি।

কিন্তু তাতে খুশির কি। সেতো নিজের কর্ম সিদ্ধিতে ব্যাস্ত। প্রহর খুশির দিকে তাকাতেই খুশি বিন্দাস বলে উঠলো।
–আরে কি বইয়ের মাঝে ঢুকে বসে আছেন। বইয়ের মাঝে কি রকেট সায়েন্স আবিস্কার করছেন নাকি? আরে আপনার জীবনের টার্ন পয়েন্ট চলে এসেছে। এইযে দেখুন আপনার সামনে স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছে। তাই আপনাকে আর মেহনত করতে হবে না। আপনি যেমন আছেন তেমনই আমি গ্রহণ করবো।

খুশির প্রলাপবাক্য শুনে প্রহরের কুঁচকানো ভ্রু টা আরও কুঁচকে গেল। আর সামনের ছেলেটা কেমন যেন কৌতুহলি হয়ে উঠলো। অত্যাশ্চর্য কিছু একটা যে ঘটতে চলেছে সেটার আভাস পাচ্ছে সে। তাই সে কৌতুহলী কন্ঠে বলে উঠলো।
–এক্সকিউজ মি মিস। আপনি কি বলতে চাইছেন একটু ক্লিয়ারলি বলবেন?

খুশি এবার একটু অঙ্গভঙ্গি বদলে নিয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে কিছুটা গর্বিত ঢঙে বলে উঠলো।
–হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। এটা বলতেই তো এসেছি।
তারপর প্রহরকে উদ্দেশ্য করে বললো।
–আপনি জেনে খুশি হবেন যে। আমি, দ্যা গ্রেট খুশি আপনাকে ভালোবাসে। আর আজ থেকে আমাদের প্রেম ইশটাট (স্টার্ট)।

পাশের ছেলেটা টাস্কি খেয়ে পুরো স্টাচু হয়ে গেল। বেচারা এতবড় শক নিতে পারছে না। বিষম উঠে গেল তার। তবে প্রহরের মাঝে তেমন কোন ভাবাবেগ দেখা গেল না। যেন খুশি এইমাত্র ভালোবাসার কথা না বরং কফির অর্ডার নিতে এসেছে। প্রহর বুকের ওপর দুই হাত ভাজ করে চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে স্বাভাবিক সুরে বলে উঠলো।
–ইন্টারেস্টিং। তা আপনার কেন মনে হলো যে এটা আমার জন্য অতীব খুশির সংবাদ?

খুশি গর্বিত সুরে বলে উঠলো।
–ওমা, আবার জিগায়। আরে দ্যা গ্রেট খুশি আপনাকে ভালোবেসেছে। এর চেয়ে বড়ো খুশির সংবাদ আর কি হতে পারে আপনার জন্য? আরে আপনি জানেন না আপনি কতো সৌভাগ্যবান ব্যাক্তি, যে এই খুশি আপনাকে চয়েস করেছে, আপনাকে। জানেন আমার জন্য কতজন লাইন ধরে ছিল। আরে আমাদের মহল্লার আক্কাসের ভাই মোকলেস আমার জন্য দিওয়ানা ছিল। নিজের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখতো আমাকে। তবুও আমার মন পাই নি। এমন আরও পাগল ভক্ত আছে আমার। কিন্তু সবাইকে বাদ দিয়ে আপনাকেই চুজ করেছি আমি। তাহলে ভাবুন কতো লাকী আপনি।

পাশের ছেলেটা হাতে তালি বাজিয়ে দুষ্টু হেসে বলে উঠলো।
–বাহ্ ভাই তুই তো রিয়েলি অনেক লাকী ইয়ার। যাকে বলে এক্কেরে সোনায় সোহাগা কপাল। এমন কপাল আমগো ক্যান হয়না।
কথাটা বলেই হাসতে লাগলো সে। তবে প্রহরের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হাসি বন্ধ হয়ে গেল তার। প্রহর এবার উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে খুশির দিকে বলে উঠলো।
–হুমম বুঝলাম। তা কবে ছাড়া পেয়েছেন শুনি?

খুশি ভ্রু কুঁচকে বললো।
–ছাড়া পেয়েছেন? কোথা থেকে ছাড়া পাবো?

–কেন পাগলা গারদ থেকে। পাগলা গারদ থেকে কবে ছাড়া পেলেন। নাকি পালিয়ে এসেছেন?

এতক্ষণে খুশির ভেতরের মনোদেবি এসে হাজির হলো। সে ওপর থেকে বলছে।
–আরে খুশি ইয়ার হেতি তো তোরে পাগল ভাবতাছে। অহন কি করবি? মান ইজ্জতের নুডলস করে ফেললো তোর।

খুশি ওপরের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো।
–আরে তুই আবার এখানে কেন চলে এলি? আমি সব হ্যান্ডেল করছিতো। তুই যা এখান থেকে।

খুশিকে এভাবে উপরের দিকে তাকিয়ে থেকে বিরবির করতে দেখে প্রহর আর ওর বন্ধু বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। মেয়েটা যে সত্যিই পাগল তার প্রমান পেয়ে গেল ওরা। তাই খুশির সাপোর্টে এবার দিয়া বলে উঠলো।
–আরে আপনারা অবাক হবেন না। আসলে এটা খুশির অন্তর আত্মা। যে মাঝে মধ্যে হঠাৎ করে এসে পড়ে। আর খুশিকে নানান উপদেশ দিয়ে থাকে।

প্রহর কিঞ্চিৎ তাচ্ছিল্যকর হেসে বিরবির করে বললো।
–ক্রেজি গার্ল।

বিরবির করে বললেও খুশির কানে কথাটা ঠিকই পৌঁছালো। খুশি এবার একটু তেজী সুরে বলে উঠলো।
–এক্সকিউজ মি! হু ইজ পাগল? অ্যাম নট পাগল। আই অ্যাম ভেরি বুদ্ধিমান।ওটাতো আমি কখনো নিজের মুখে নিজের প্রসংশা করিনা। তবে আমি সর্বগুন সম্পূর্ণা বুঝেছেন। এমন গুন নেই যা আমার মাঝে নেই। রুপের কথা আর নিজের মুখে কি বলবো? আপনারা তো দেখতেই পাচ্ছেন। আর গুনও আমার মাঝে ভরপুর।আমার হাতের রান্ন যে একবার খায়। সে আর একমাস অন্য খাবার খেতে পারে না।

পাশের ছেলেটা কৌতুহলী কন্ঠে বললো।
–কেন? এতো টেস্টি খাবার বানান বুঝি?

–হ্যাঁ সেটাও আছে। তবে আমার রান্না করা খাবার খেয়ে কেন যেন সবাই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যায়। তাই আর অন্য খাবার খেতে পারে না।হয়তো এতো টেস্টি খাবার কখনো খাইনি তাই এমনটা হয়। আচ্ছা যাক সে কথা।আরও এমন মহৎ গুন আছে আমার। আমার মধুর কন্ঠ শুনলে সব দিওয়ানা হয়ে যায়। রাস্তার কুকুর গুলোও তখন ঘেউ ঘেউ করে আমার প্রসংশা করে। দাঁড়ান আপনাদেরও একটু সুমধুর কন্ঠের গান শোনাচ্ছি।
♬ওওরে হ্যান্ডসাম বয়টা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা
♬ তুই আমারে তুই আমারে তুই আমারে
♬ করলি দিওয়ানা রে হ্যান্ডসাম বয়টা📢

খুশির এই সুমধুর কন্ঠের গান শুনে প্রহরদের মিনিস্ট্রোক হওয়ার উপক্রম। কানের ভেতর মনে হচ্ছে কেও ফাটা বাঁশ ঢুকিয়ে দিয়েছে। এতো মধুর সুর আর সহ্য করতে না পেরে প্রহর রাগী কন্ঠে বলে উঠলো।
–স্টপ ইট।

খুশি গান থামিয়ে দিয়ে বললো।
–দেখলেন তো কতো গুন আমার? শুধু দেখলেই হবে না কোয়ালিটি আছে বস।

প্রহরের ফ্রেন্ড অনেক কষ্টে নিজের হাসি চেপে রেখে, আবারও প্রসংশায় পঞ্চমুখ হয়ে বলে উঠলো।
–ওয়াহ্ ওয়াহ্ কেয়া বাত কেয়া বাত। লা জবাব। অ্যাম জাস্ট স্পিচলেস। আপনি সত্যিই মহান। আমার বন্ধু সত্যিই লাকী আপনাকে পেয়ে। আমার তো খুশিতে চোখে পানি চলে এলো।

খুশি গর্বে গদগদ হয়ে বললো।
–থ্যাংক ইউ,থ্যাংক ইউ। তা আপনার নাম টা কি? আপনি কি উনার বন্ধু।

–হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি ওর বন্ধু ফাহিম।

–ওও তাহলে তো আপনি আমার দেবর হলেন। তো আজ থেকে আপনি আমাকে ভাবি বলবেন কেমন?

–জ্বি জ্বি অবশ্যই। এটাতো আমার সৌভাগ্য ভাবিজী।

প্রহরের থার্মোমিটারের ডিগ্রি হাই হয়ে গেল। প্রহর টেবিলের ওপর সজোরে একটা চাপড় মেরে রাগী কন্ঠে বলে উঠলো।
–এনাফ। স্টপ দিজ ননসেন্স রাইট নাউ। ইউ আর ক্রসিং লিমিট নাও।
প্রহর খুশির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শক্ত কন্ঠে বললো।
–অনেক হয়েছে।পিচ্চি মেয়ে দেখে কিছু বলছি ন। তবে এখন এইমুহূর্তে এসব স্টুপিট ড্রামা বন্ধ করো। এন্ড গেট লস্ট ফ্রম হিয়ার। এখনো ডাইপারের ভেতর থেকেই বের হলোনা। আর আসছে প্রেম ভালোবাসার কথা বলতে।

আবারও খুশির মনোদেবি এসে হাজির হলো। ওপর থেকে বলতে লাগলো।
–আয় হায় এই খুশি হেতি তো তোর আবারও ইনসালাত করে দিল। সি কল্ড ইউ পিচ্চি। ক্যান ইউ ইমাজিন?

খুশি ওপরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–আমি শুনতে পেরেছি। তোর বারবার রিপিট করতে হবে না। তুই যাতো এখান থেকে।
তারপর প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো।
–পিচ্চি? কে পিচ্চি? আমিতো এখানে কোন পিচ্চি দেখতে পাচ্ছি না। আর আমাকে পিচ্চি বলছেন? জানেন আমার বয়সে আমাদের গ্রামের মেয়েদের বাচ্চা কাচ্চাও হয়ে গেছে। সেই হিসেবে দেখতে গেলে আমি অনেক বড়ো। তাই আমাকে পিচ্চি ভাবার ভুল করবেন না। আমি আপনাকে ভালোবাসি এটাই হলো ইম্পর্ট্যান্ট বিষয়। আর আমার মতে আপনারও আমাকে ভালোবাসা অতীব অবশ্যক।

খুশির উপর চরম বিরক্ত হয়ে প্রহর নিজেই ওখান থেকে হনহন করে চলে গেল।যেতে যেতে বিরক্তিকর কন্ঠে বলে গেল।
— রিডিউক্লাস।
ফাহিমও ওর পিছু পিছু গেল।

খুশি আর দিয়া ওদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। দিয়া বলে উঠলো।
–আরে ইয়ার তোর ড্রিম ম্যান তো তোকে পাত্তাই দিলোনা।

খুশি বাঁকা হেসে বললো।
–খুশির ড্রিম ম্যান বলে কথা। একটু এটিটিউট তো থাকবেই। আর সহজে পাওয়া কোন কিছুর গুরুত্ব থাকে না। তাই একটু মেহনত তো করতেই হবে। তবে ঘুরেফিরে তাকে আমার কাছেই আসতে হবে। খুশির জালওয়া থেকে বেঁচে যাবে কোথায়।

চলবে…..