অন্তঃপুরে দহন পর্ব-০৮

0
158

#অন্তঃপুরে_দহন (পর্ব-8)

#আরশিয়া_জান্নাত

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের র*ক্তা*ক্ত বুকটা দেখছে ওমর। একটু আগেই সে চা*কু দিয়ে ক্ষ*ত বি*ক্ষ*ত করেছে নিজেকে। ফর্সা শরীরটা চিড়ে র*ক্ত গলে পড়ছে। এই র*ক্ত এই শরীর এই যে ওমরের অস্তিত্ব সবটাই তার বাবা অনীলের ডিএনএ বহন করে। সে একটা নিকৃষ্ট লোকের সন্তান, তার শরীরে বইছে তার রক্ত। এইসব ভাবলেই পুরো শরীরে এলোপাথাড়ি আঘাত হানে সে। শরীরের জ্বালাপোড়ার চেয়ে মনের অশান্তিই বেশি প্রকট হয়। মন শান্ত হতেই টের পায় কত যন্ত্রণাময় ক্ষ*ত ই না সৃষ্টি করে ফেলেছে! হাউমাউ করে কেঁদে ওঠতে গিয়েও মুখ চেপে ধরে। ও যে সেই ছোট বয়সেই শিখেছিল ছেলেদের কাঁদতে নেই। ওমর ওয়াশরুমের ফ্লোরেই বসে পড়ে। নিরবে অশ্রুবর্ষণ চলে। মানসপটে ভেসে ওঠে এক ভয়ঙ্কর স্মৃতি।
স্কুল থেকে ফেরার পথে ওমর দেখেছিল ওর বাবা রিকশায় করে এক মেয়েকে নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে। ওরা খুব হাসিঠাট্টা করছিল। অথচ ওমর কখনোই দেখেনি তার মায়ের সাথে এমন হাসিখুশি থাকতে। তাই অনেকটা অভিমান জমিয়ে বাসায় এসে বলেছিল, মা বাবা তোমার সঙ্গে হাসে না কেন? জানো আজ বাবাকে দেখেছি এক আন্টির সাথে রিকশায় হাসতে হাসতে যাচ্ছে।
শামীমা তেলে মাছ দিতে দিতে বলেছিল, অফিসের কলিগদের সাথে মানুষকে হাসিখুশিই থাকতে হয়। তুই যখন বড় হবি অফিস করবি তখন তুইও হাসবি!
ওমর গাল ফুলিয়ে বললো, মোটেও না। আমি আমার মায়ের সামনেই হাসবো। আমার বৌয়ের সামনে হাসবো। বাইরের মানুষের চেয়ে আমার ঘরের মানুষের কাছে হাসিটা বেশি দামি। আমি স্কুলে হাসলে টিচাররা বকা দেয় কিন্তু তুমিতো বকো না। তাই আমার হাসি ঘরের লোকই দেখবে।
শামীমা হেসে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, আমার সোনা ছেলের হাসি সবচেয়ে বেশি দামি। তুই সবসময়ই মায়ের সামনে হাসবি কেমন?
হ্যাঁ সেই কথাটা সে সবসময় পালন করে। মনে যাই ঘটুক সবসময় হাসিমুখে থাকে। ওকে দেখলে কেউ বুঝবেনা ওর মনে কি সব যন্ত্রণা লুকিয়ে থাকে।
এই যে গত পরশু সে জানতে পারলো তার বাবার এক জঘন্য কুকীর্তির কথা। কত নিরবেই না মেনে নিলো! আচ্ছা অন্য কেউ হলে কি মেনে নিতো?

ফোনে নোটিফিকেশনের শব্দ পেয়ে হুশ ফেরে তার। সেটা ওপেন করতেই ভেসে ওঠে সেই মহিলার ছবি। চেহারায় সেই লাবণ্য নেই। বয়সের ছাপ পড়ে গেছে। বর্তমানে মানুষের বাসায় কাজ করে খায়। স্বামী সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ছেলেকে নিয়ে আগে কলোনিতে থাকতো। তখন ছেলেই সংসার চালাতো।কিন্তু জটিল অসুখের কারণে এখন সে শয্যাশায়ী। এই মহিলার সঙ্গে ওমরের সেদিন দেখা হয়েছিল মিরপুরে রাস্তার পাশে। ওমর তাকে চিনতে পারলেও মহিলাটি তাকে চিনেনি। ওমরকে দেখেই আকুতি ভরা কন্ঠে বললো,বাবা আমার ছেলেটার মরণব্যাধি রোগ হয়েছে। অনেক টাকা লাগবে। একটু সাহায্য করবেন?

আপনার স্বামী বা আত্মীয় কেউ নেই যে সাহায্য করবে?

থাকলে কি আর মাইনষের ধারে ভিক্ষা চাইতাম বাবা?

ওমর পাঁচশত টাকার নোট হাতে গুঁজে বললো, আপনার ছেলে সুস্থ হয়ে উঠুক!

মহিলাটির চোখ ভিজে ওঠে। কৃতজ্ঞতায় তাকিয়ে থাকে ওমরের দিকে।

কিন্তু ওমর ওতে তৃপ্ত হয় না। কারণ ওমর জানে এই ছেলেটা আর কারো না তারই বাবার অবৈধ সন্তান!
আচ্ছা এমন কয়টা সন্তান আছে তার বাবার?


শামীমা তার ছেলের শিয়রে বসে বললো, অন্তরার জন্য একটা সম্বন্ধ এসেছে বলেছিলাম না তোকে? ওদের অন্তরাকে অনেক পছন্দ হয়েছে। অন্তরাও হয়তো পছন্দ করেছে। এখন ওরা চাইছে এই মাসেই বিয়েটা সেরে ফেলতে। তুই কি বলিস?

এখানে আমার মতামতের গুরুত্ব নেই মা। না কেউ তোমায় বলেছে আমাকে জিজ্ঞাসা করতে। তুমি নিজেও জানো সেটা তাও অযথাই এসব বলছো।

তুই ওর বড় ভাই না? বোনের কার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে খোঁজখবর নিবি না?

সেটা কন্যার পিতাই ভালো করে নিয়েছেন।

এভাবে বলিস কেন?

তো কিভাবে বলবো?

হ্যাঁ রে তোর মনমেজাজ খারাপ থাকে আজকাল? অফিসে অনেক চাপ যাচ্ছে?

নাহ

তোর ঐ বান্ধবীর কি খবর? আর কথা হয়েছে?

কার কথা বলছো?

কি মনে করিস আমি জানি না? তোরা ছেলেমেয়েরা ভাবিস মায়েরা কিছু জানেনা। টের পায় না। আসলে সব টের পায়। তোরা যে আমার নাড়ি ছেড়া ধন তোদের ভালোমন্দ আমি ঠিক টের পাই।
তোর কলেজে একটা মেয়ে ছিল যার গানের গলা তোর অসম্ভব পছন্দের। সেই মেয়েটার সঙ্গেই সেদিন দেখা হয়েছিল তোর তাই না?

ওমর হতভম্ব হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। শামীমা হেসে বললো, এতো অবাক হবার কিছু নেই। অন্তরা সেদিন প্রথম তোর টাকা নেয় নি। ও সবসময় তোর টাকা ধরে। কিন্তু তুই কিছুই বলিস না। তোর বন্ধু কলিগ সবাইকেই মোটামুটি চিনি আমি। ওদের বেলা বিল পে নিয়ে তোর কোনো অস্বস্তি থাকার কথা না। তখনই বুঝেছি এ আর কেউ নয় আমার ছেলের জীবনের একমাত্র বান্ধবী,,,ছেলেরা সবচেয়ে বেশি লজ্জা পায় তার অতি বিশেষ মানুষটার সামনে ছোট হতে।আমার ছেলেতো এই দিকে আরো দু কদম এগিয়ে। মাঝেমধ্যে আমি ভাবি আমার ছেলেটা বুঝি মেয়ের ভাগের লজ্জাটাও নিয়ে বসেছে। অন্তরার লাজলজ্জা কম কিন্তু তোর টইটম্বুর হয়ে আছে।

ওমর মুহূর্তেই রক্তিম হয়ে বলল, ওর নাম তাইয়্যেবা। অনেক বছর পর দেখা হলো সেদিন। মোহাম্মদপুরে থাকে।ওখানের হাই স্কুলে পড়ায়।

একদিন বাসায় আসতে বলিস?

আসবে না। ও কারো বাসায় যায় না।

তাহলে বাইরে কোথাও দেখা করা! আমার অনেক ইচ্ছে ওকে দেখার।

ওর ফোন নাম্বার নেই আমার কাছে।

কি বলিস? সেদিন না দেখা হলো নিলি না?

ফোন নাম্বার চাইতে লজ্জা করছিল!

হাহা তোর থেকে এটাই আশা করা যায়।

মা তুমি হাসলে অনেক সুন্দর লাগে।

আমার সোনা ছেলেটার চোখে তার মা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষ। আমি জানি সেটা। আমার ছেলেটা তার মায়ের কোনো খুঁত পায়না।

ওমর মনে মনে বলে, তোমার একটাই খুঁত মা, তুমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারো না।

পাখি মুখে লেবু ঘসতে ঘসতে বললো, তাহলে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলি? অবশেষে বান্ধবীর বিয়ের দাওয়াত খাওয়ার সৌভাগ্য হলো?

অন্তরা চুলে চিরুনি করতে করতে বলল, বাবার আগ্রহ অনেক এখানে। আর ছেলেকেও খারাপ লাগে নি। তাই আর কি!

বললেই পারিস তোর পছন্দ হয়েছে আঙ্কেলকে টেনে শাক দিয়ে মাছ ঢাকিস না তো।

আমার জীবনে বাবার মতামতের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। উনি যাকে চুজ করবেন আমি তাকেই বিয়ে করবো এমনটাই সবসময় ভেবে রেখেছি বলেই প্রেম করিনি আজ পর্যন্ত। এই পৃথিবীতে আমি সবাইকে কষ্ট দিতে পারলেও উনাকে দিতে পারবোনা।

তুই খুব লাকি বুঝলি! আঙ্কেল তোকে অনেক ভালোবাসে।

হুম এটা ঠিক। জানিনা বর ভালোবাসবে কি না!

আলবাৎ বাসবে। যেভাবে নাক ঘামে তোর! দেখিস এমন বরসোহাগী হবি প্রতিবছর খালামণি হমু!!
হেহেহে

শয়তান তুই দোআ করোস নাকি বদদোআ দেস?

বেবী তুমি যেই আমি মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে নিশ্চিত তোরেই বিয়ে করতাম।

তোর মতিগতি ভাল্লাগেনা। এই তুই মেয়ে তো!

আয় তোরে দেখাই আমি কি।

উফফ তোর আসলেই লজ্জাশরম নাই।

লজ্জার কি আছে তোর যা আমারো তা।

আপনার রূপচর্চার আর কতক্ষণ আজকে বের হবি নাকি এখানেই দিন কভার দিবি।

দাঁড়া আর পাঁচমিনিট। মুখ ধুয়ে এসেই বের হবো।

তোর পাঁচ মিনিট পাঁচ ঘন্টা হতে সময় লাগবেনা। তাড়াতাড়ি রেডি হ আমি আন্টির সাথে গল্প করে আসি।

যাইস না এখন। তোর বিয়ের খবর শুনছে তোরে পাকাইবো এখন।

হাহ। এইটাও শুনাই দিছোস। তোর পেটে আসলেই কথা থাকেনা।

পেটে খাবারই বেশিক্ষণ রাখি না আর কথা রাখমু পাগল?

হাহাহা তাও ঠিক।

হেহেহে
_____________

সকাল থেকেই মহাব্যস্ত শামীমা। আজ সন্ধ্যায় অন্তরার আংটিবদল হবে। তাই বাসায় আত্মীয়স্বজনরা এসেছে। মোটামুটি জমজমাট অবস্থা। তাদের আতিথেয়তা আর সন্ধ্যার উৎসবকে ঘিরে আয়োজনের যোগারযন্ত্র সব নিয়ে দম ফেলবার ফুরসত নেই তার। অনীল অবশ্য চেয়েছিল কোনো রেস্টুরেন্টে সব আয়োজন করতে। পরে ভাবলো বাসায় তো একবারও এলো না সবসময় বাইরে বাইরেই সব হলে কেমন দেখায়। তাই বাসায় সব এরেঞ্জ করছে।
এখন সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটলেই হয়।

চলবে,,,