#অন্তরালে_তুমি
#Part_20
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
?
সময়ের স্রোতে অতিবাহিত হয়ে চলেছে। এই যেন চোখের পলক ফেলতেই দিন শেষ। সময়ও বড় অদ্ভুত। একে বুঝা বড় দায়। তাই তো দেখতে দেখতে যে কখন রোজার মাস চলে আসলো বুঝাই গেল না। আজ রমজান মাসের প্রথম দিন। মানে প্রথম রোজা। বাইরে সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি। ভ্যপ্সা গরম ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। আজকের উত্তাপটাও যেন অনেক বেশি। সকলেই এতে যেন হাঁপিয়ে উঠেছে। সাধারণ প্রতিবারই প্রথম রোজায় তুলনামূলক বেশিই গরম হয়। কেন তার ব্যাখ্যা কাউরো কাছেই নেই। কিন্তু এই গরম যেন রোজাদার ব্যক্তির মধ্যে কোন প্রভাবই ফেলতে পারে না। যত যাই হোক না কেন রোজাদার ব্যক্তি কিছুতেই রোজা ভঙ্গ করিতে পারিবে না।
আজ আরিহার বাসায় সকলের ইফতারের দাওয়াত। যার জন্য আরিহা সকাল থেকেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। সকালে রান্নার ঝামেলা নেই বলে ঘর সব গুছিয়ে নিয়েছে। এরই মধ্যে জিসান বাজার নিয়ে আসে। আরিহা বাজারগুলো নিয়ে রান্না ঘরে যায় সব ঠিক আছে কি না দেখার জন্য।
এইদিকে ইহাম আড়মোড়া ভেঙে মাত্র উঠে বসলো। ঘুমে এখনো চোখ দুটো ছোট হয়ে আছে। ইহান কোন মতে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। চারদিকে চোখ বুলিয়ে আরিহাকে খুঁজতে থাকে। হাল্কা আওয়াজ কানে ভেসে আসতেই ইহান সতর্ক দৃষ্টিতে তাকায় অতঃপর আওয়াজটা অনুসরণ করে রান্না ঘরে গিয়ে পৌঁছায়। রান্নাঘরে গিয়ে দেখে জিসান আর আরিহা মিলে সব কিছু গোচ্ছাছে। সাথে টুকিটাকি গল্প করেই চলেছে। হুট করে জিসান অতি মধুর সুরে আরিহাকে ডেকে উঠে,
— আরু বেবি!!
আরিহা জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে বলে,
— তোর চিকেন চপ তুই ইফতার টাইমে পেয়ে যাবি।
জিসান এইবার খুশি হয়ে বলে,
— আহা তুমি আমায় কত ভালো করে বুঝিস। তোর মত করে আমায় কে বুঝবে বল। ইশশ! কত বছর ধরে তোর হাতের চিকেন চপ খাই না।
আরিহা এইবার ভ্রুকুঞ্চন কুঞ্চিত করে বলে,
— চাপা একটু কম মার। গত বছর যখন লন্ডন গেলাম তখন না তোকে বানিয়ে খেয়েছিলাম।
জিসান এইবার দাঁত কেলিয়ে বলে,
— পেট ভরে কিন্তু মন যে ভরে না। এই মনটা যে বড্ড বেহাইয়া। মনটা আজীবনই শুধু তোকে চায় থুরি তোর হাতের চিকেন চপ চায়।
এমন কথা শুনে ইহান বিষম খায়। সাথে সাথে আরিহা আর জিসান ইহানের দিকে তাকায়। আরিহা ইহানের কাছে গিয়ে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। জিসান ইহানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— কি গো সতীন মশাই কে আবার তোমায় ভালবেসে মনে করলো গো?
আরিহা বিরক্তি মাখা চোখে জিসানের দিকে তাকায়। তা দেখে জিসান বলে,
— আমাকে না কাউয়া ডাকতাসে আমি গেলাম।
এই বলে জিসাম দ্রুত কেটে পড়ে। ইহান একবার জিসানের যাওয়ার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আরিহার দিকে তাকায়। অতঃপর আরিহার হাত শক্ত করে ধরে বলে,
— আমি ইফতারে তোমার হাতের কাচ্চি খেতে চাই।
এই কথা শুনে আরিহা কিছুক্ষণ ইহানের দিকে ভ্রু কুচকিয়ে তাকিয়ে থাকে। হুট করে এমন আবদার করার মানে খুঁজতে থাকে। আরিহার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে ইহান বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলে উঠে,
— কি? পারবা না নাকি?
আরিহা কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
— হয়ে যাবে। এখন রুমে যাও।
ইহান এইবার খুশি হয়ে আরিহার গাল টেনে বলে,
— কিউট বউটা আমার।
এই বলে রুমে চলে যায় আর আরিহা বিস্মিত নয়নে ইহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
?
নীরা বাদে সকলেই এসে পড়েছে। ইহান, জিসান তীব্র, সোহেল, অর্পি ও রাহুল সকলেই সোফায় গোল হয়ে বসে আছে। আরিহা আর পুষ্পিতা রান্নাঘরে সব গুছিয়ে নিচ্ছে। সোহেল আর ইহানের কথা বলছে। রাহুল আর অর্পি খুনসুটিতে ব্যস্ত। তীব্র আর জিসান দুই এক কথা বলছে। মানে পরিচিত হচ্ছে আর কি।
অতঃপর আরিহার ডাকে সকলেই টেবিলে গিয়ে বসে। টেবিলে যেতেই সকলের চোখ চড়কগাছ। পুরো টেবিল বিভিন্ন ইফতারের আইটেম দিয়ে ভরা। সকলের মনেই একটাই প্রশ্ন আরিহা একা হাতে এত কিছু কিভাবে সামলে নিয়েছে? কিন্তু সেটা কেউ প্রকাশ করলো না। একেক করে সকলেই বসে পড়লো। আযান দিতে ৮ মিনিট বাকি। এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠে। আরিহা উঠতে নিলে জিসান হাতের ইশারায় ওকে বসতে বলে আর নিজে যায় দরজা খুলতে। জিসান দরজা খুলতেই এক মায়াবতীর চেহারা ভেসে উঠে। সেই মায়াবতী আর কেউ না বরং নীরা। নীরা নিচে তাকিয়ে জুতা খুলছে আর বলছে,
— সরি রে লেট হয়ে গেল। আসলে রাস্তায় যেই জ্যাম কি আর বলবো।
এই বলে উপরে মাথা তুলতেই সেই অনাঙ্ক্ষিত চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠে আর সাথে সাথে বুকের বা পাশটা ঢক করে উঠে। তার সামনে থাকা ব্যক্তিটি অর্থাৎ জিসান তাকে দেখে হাল্কা হাসলো। নীরা এইবার স্থির দৃষ্টিতে জিসানের দিকে তাকায়। পড়নে তার কালো পাঞ্জাবি আর সাদা ধুতি। চুল গুলো কপালের সামনে ঝুঁকে আছে। আর ঠোঁটের কোনে সেই মিষ্টি হাসি।
হুট করেই নীরার মনে একটা প্রশ্ন এসে নাড়া দেয় যে,” এই ব্যক্তিটি এইখানে কি করছে?” সাথে সাথে নীরা তার দিকে বিভ্রান্তিমূলক দৃষ্টিতে তাকায়। সে একবার জিসানের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার দরজা পাশে ঝুলিয়ে থাকা আরিহার নামটির দিকে তাকাচ্ছে। বুঝতে পারছে না সে কি ঠিক বাসায় এসেছে নাকি ভুল করে অন্য কাউরো বাসায়। জিসান হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পেরে বলে,
— হোয়াট আ প্লেজেন্ট সাপ্রাইজ! আপনি এইখানে?
জিসানের এমন কথায় নীরা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে স্মিত হাসার ব্যর্থ চেষ্টা করে। এরই মাঝে জিসানের দেরি হচ্ছে বলে আরিহা দরজার সামনে এসে পড়ে। নীরা দেখেই আরিহা বলে উঠে,
— দাঁড়িয়ে আছিস কেন ভিতরে আয়।
নীরা এইবার আবারও বিভ্রান্তিমূলক দৃষ্টিতে তাকায়। একবার জিসানের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার আরিহার দিকে। আরিহা তা দেখে বুঝতে পেরে বলে,
— আপাতত এতটুকু জেনে নে ও হচ্ছে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড জিসান। কিছুদিন আগেই লন্ডন থেকে এসেছে। বাকিটা ইফতারের পরে জেনে নিস।
নীরা মাথা দুলিয়ে “হ্যাঁ” সূচক উত্তর দেয় আর ভিতরে ঢুকে পড়ে। ঢুকার সময় সে আড়চোখে একবার জিসানের দিকে তাকায়। জিসানের ঠোঁটের কোনে এখনো সেই মিষ্টি হাসিটা স্থায়ী হয়ে আছে। নীরা এইবার দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে আরিহার পিছু পিছু চলে যায়।
?
ইফতার শেষে সকলেই সোফায় গোল হয়ে বসে আছে। এতক্ষণে সকলের কাছে জিসানের পরিচয়টা একদম পরিষ্কার হয়ে যায়। যার ফলে সকলের মাঝে এক ভাব জমে যায়। জিসান আর নীরাও দুইজন দুইজনের সাথে পরিচিত হয়ে যায়। কিন্তু কোন এক জড়তার কারণে তাদের মাঝে তেমন কোন কথাবার্তা এগোয়নি। এখন সকলেই মিলে টুকিটাকি কথা বলতে থাকে।
এইদিকে নীরা এখনো বিভ্রান্তিমূলক মুখভঙ্গি করে আছে। তার কাছে কয়েকটা জিনিস ধোঁয়াশা। সে আস্তে আস্তে পুষ্পিতাকে খোঁচা মারতে শুরু করে। নীরার এমন করায় পুষ্পিতা ভ্রুকুটি কুঞ্চিত করে নীরার দিকে তাকায় তারপর কর্কশ গলায় বলে,
— কি?
নীরা এইবার পিপীলিকা কণ্ঠে বলে,
— তুই কি জিসানকে আগে থেকেই চিনতিস?
পুষ্পিতা দ্বিধাহীনভাবে বলে,
— হ্যাঁ।
নীরা এইবার বিভ্রান্তিকর কণ্ঠে বলে,
— তাহলে আমি চিনি না কেন?
পুষ্পিতা এইবার বলে,
— আরেহ ডাফার! জিসানের সাথে কি আগে তোর দেখা বা পরিচয় হয়েছি নি যে তুই চিনবি? আর আরিহাও তো আমাদের জিসানকে কখনো দেখায় নি। শুধু কয়েকবার তার কথা বলেছিল। তো চিনবি কিভাবে গাধী?
১-২ বছর আগে এককাজে আরিহার বাসায় এসেছিলাম তখনই জিসানের সাথে আমার পরিচয় হয়। আর তুই তো আরিহার বাসায় তেমন আসোস না। তার উপর সে তো কখনো অফিসে আসেই নি তাই তুই তাকে কখনো দেখিসও নি। বুঝলি!
নীরা এইবার মাথা দুলায়। পুষ্পিতা এইবার পাশ ফিরে তীব্রের সাথে কথা বলতে শুরু করে।
পুষ্পিতা আর নীরা বাদে সকলেই চলে যায়। পুষ্পিতা আর নীরা আরিহার সাহায্যের জন্য থেকে যায়। আরিহা নিজের ক্লান্ত শরীর সোফায় এলিয়ে দেয়। চোখ দুটো বন্ধ করে নিজের ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করতে থাকে। বেশ ধকলই গেছে আজ ওর উপর দিয়ে। মাথাটা বেশ ব্যথা করছে সাথে কেমন ঘুরাচ্ছেও। অন্য পাশে সব গুছিয়ে পুষ্পিতা আর নীরাও চুপচাপ বসে পড়ে। ইহান বসে বসে মোবাইলে গেমস খেলছে। এমন সময় কোথ থেকে জিসান এসে ধপ করে আরিহার পাশে বসে। আরিহা হাল্কা চোখ খুলে পাশে তাকাতেই দেখে জিসান বসে আছে। জিসান বিনয়ী সুরে বলে,
— নে পেশারের ঔষধটা খেয়ে নে। মাথা ব্যথাটা কমে যাবে।
জিসানের এমন কথায় সকলেই ওর দিকে তাকায়। ইহান গেমস থেকে চোখ তুলে বিস্মিত নয়নে জিসানের দিকে তাকিয়ে থাকে। আরিহা মুখ ফিরিয়ে বলে,
— ইচ্ছে করছে না।
হুট করেই জিসান কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠে,
— থাপ্পড় চিনোস একটা? এই বয়সে যে কি ভয়ংকর ধরনের প্রেশার বাধিয়েছিস তার কোন ধারণা আছে? তার উপর ঔষধ ও ঠিক মত নিস না। নিজের যত্ন নেওয়া তো দূরেই থাক।
এখন চুপচাপ ঔষধটা খা নাহলে আজকে তোর খবর আছে।
আরিহা এইবার বিরক্তিকর একটা ভাব নিয়ে ঔষধটা খেয়ে নেয়। আবার চুপচাপ শুয়ে থাকে। এইসব দেখে ইহান মনে মনে বলতে থাকে,
— আমার না জানার কথা গুলোও জিসান জানে। এমন কি আরিহাকে সবচেয়ে ভালো ওই জানে। আমি কি আদো আরিহাকে এত ভালো করে বুঝতে পারবো? জানতে পারবো?
এই ভেবেই ইহান এক দীর্ঘ শ্বাস নেয় আর আড়চোখে জিসানের দিকে তাকায়। কেন যেন আজ বেশ হিংসে হচ্ছে জিসানের থেকে। আরিহার এত কেয়ার করা, ওর খেয়াল রাখা ইহানের সহ্য হচ্ছে না। ইহান চায় আরিহার খেয়াল শুধু সে রাখবে। আর কেউ না? কিন্তু কি আদো সম্ভব?
পুষ্পিতা জিসানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— একমাত্র আপনার কথাই শুনে ও। আপনার বাধ্য বলতে গেলে। আর বাদ বাকি আমাদের কাউরো কথা তো গায়েই মাখে না।
জিসান প্রতিউত্তরে শুধু হাল্কা হাসে।
?
বেশ কিছুদিন পর ইহান ঘুমিয়ে আছে। এমন সময় ওর কানে মধুর এক ধ্বনি কানে ভেসে আসে। সম্ভবত কোরআন তিলাওয়াতের আওয়াজ। ধ্বনিটা প্রখর হতেই ইহানের ঘুমের ভাবটা কিছুটা কমে আসে। ইহান হাল্কা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। তারপর চোখ কচলাতে কচলাতে চারদিকে তাকায়। তারপর আরিহাকে দেখে তার চোখ চড়কগাছ। সে অবিশ্বাস্য নয়নে আরিহার দিকে তাকিয়ে থাকে।
#চলবে