#অন্তরালে_তুমি
#Part_22
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
?
জিসান এইবার এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে ইতস্তত সুরে বলে,
— তুই কি আসলেই ইহানকে ভালবাসিস?
জিসানের এমন প্রশ্নে আরিহা স্থির হয়ে যায়। চোখ দুটো নামিয়ে জিসানের দিকে স্থির করে। অতি শান্ত তার চাহনি। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই তাকিয়ে থেকে এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে সামনে থেকে তাকায়। জিসান এখনো আরিহার জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অপেক্ষার প্রহর গুনছে যে কখন আরিহা উত্তরটা দিবে। অবশেষে নিরতা কাটিয়ে আরিহা শান্ত কন্ঠে বলে,
— হয়তো বাসি আবার হয়তো বাসি না।
জিসান বিস্ময়কর দৃষ্টিতে আরিহার দিকে তাকিয়ে থাকে আর বলে,
— তাহলে ওকে বিয়ে করেছিলি কেন? তাও জোর করে? উদ্দেশ্য কি ছিল?
আরিহা হাল্কা হেসে বলে,
— স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম তখন। নিজ স্বার্থকেই তখন সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিলাম। দিন রাত শুধু একটা কথায় পুরো মস্তিষ্ক বেয়ে বিচরণ করছিল যে, “যে কোন মূল্যেই হোক ইহান নামক ব্যক্তি আমার চাই এই চাই।”
কথায় আছে,” নিজের মঞ্জিল যখন হাতের মুঠোয় হয় তখ মানুষ উন্মাদ হয়ে যায়।” আমার বেলায়ও তাই হয়েছিল। সকল হেদায়েত জ্ঞান ভুলে গিয়েছিলাম যার জন্য আজ ইহানের জীবনও অন্ধকার। আমি নামক কালো ছাঁয়াটা ওর জীবনের আলো কেড়ে নিয়েছি। ধীরে ধীরে হ্রাস করে দিচ্ছি ওকে। তাই তো আজ আমি প্রথম অনুতাপের আগুনে জ্বলছি।
জিসান মলিন হাসি হেসে বলে,
— বিয়ের করার সময় কোন অনুভূতি নিয়ে বিয়েটা করেছিলি শুনি?
আরিহা উদ্দেশ্যহীন চোখে আকাশের পানে তাকিয়ে বলে,
— কিছুটা আশা, কিছুটা চাওয়া, কিছুটা রাগ, কিছুটা জিদ –এই সকল অনুভূতির সংমিশ্রণ চলছিল তখন। এক্সেক্টলি কোন অনুভূতিটা মেইন ছিল তা আমি জানি না। কিন্তু ঘৃণা ছিল না তা জানি।
জিসান এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
— বেশির ভাগই কিন্তু ভালবাসার দিকে ইঙ্গিত করছে। কেন না এইসব ভালবাসারই কয়েকটি অংশবিশেষ। কিন্তু কথা হচ্ছে এইগুলা কি এখনো অংশবিশেষ রুপে আছে নাকি ভালবাসার মিষ্টি রুপে পরিনত হয়েছে। এখন তুই এই বল ভালবাসিস ইহানকে?
আরিহা এইবার জিসানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— এই প্রশ্নের সঠিক উত্তরটা আমার জানা নেই। এই প্রথম আরিহা আহমেদের কাছে কোন প্রশ্নের উত্তর নেই। স্ট্রেঞ্জ! জানিস এই প্রশ্নটা প্রায়ই আমার মস্তিষ্কে উঁকি দেয় কিন্তু এর উত্তরটা মেলে না বলে তাকে মস্তিষ্ক হতে ছুঁড়ে ফেলে দেই।
আরিহার কথা শুনে জিসান হাল্কা হেসে বলে,
— উত্তরটা তোর পাওয়ার কথাও না।
জিসানের এমন কথায় আরিহার ভ্রু দুটো কুঞ্চিত হয়ে আসে। সে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে জিসানের দিকে তাকাতেই জিসান বলে উঠে,
— ভালবাসা মন থেকে হয়, ওই বা পাশে থাকা হৃদয়টা দিয়ে হয়। মস্তিষ্ক দিয়ে নয়। তুই ইহানকে ভালবাসিস কিনা তার জবাব শুধু মাত্র তোকে তোর মন বলতে পারবে, মস্তিষ্ক নয়। মস্তিষ্ক ভেবে চিন্তে কথা বলে কিন্তু মন চিন্তাহীন ভাবে উত্তর দেয়। মস্তিষ্ক দ্বিধাগ্রস্ত আর মন দ্বিধাহীন। তাই প্রশ্নটা মনকে কর মস্তিষ্ককে না।
নিজের ডান হাতটা বুকের বা পাশে রাখ তারপর চোখ বন্ধ করে ভাব তোর অন্তরালে আসলেই কার বাস। দেখবি আপনা-আপনি উত্তরটা পেয়ে যাবি।
জিসানের এমন কথায় আরিহা অবিশ্বাস্য চোখে ওর দিকে তাকায়। জিসান চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে আর ওকে এমনটা করতে বলে। কিন্তু তাও আরিহার মধ্যে এক দ্বিধাগ্রস্ত ভাব দেখা দিল। আকাশ-কুসুম চিন্তা করে আরিহা আস্তে আস্তে বুকের বা পাশে হাত রাখে তার চোখ বন্ধ করে। সাথে সাথে ইহানের সাথে দেখা হওয়ার প্রথমদিনটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠে।
আরিহা দ্রুত চোখ খুলে ফেলে। জিসান তা দেখে হাল্কা হেসে বলে,
— উত্তরটা তোর জানা কিন্তু তাও তুই তার থেকে বার বার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিস। “জানি না” নামক বস্তুটিকে এর উপর জোড় করে বসিয়ে দিচ্ছিস। কিসের এত জড়তা? কিসের এত সংশয় শুনি?
আরিহা এইবার মুখ ঘুরিয়ে নেয় তারপর কর্কশ গলায় বলে,
— আমি নিজের অন্ধকার ভরা জীবনে অন্য কাউকে প্রবেশ করতে দিতে পারি না। তার জীবন অন্ধকার করে দিতে পারি না। নিজের কলঙ্কিত জীবনে অন্যকে কলঙ্কিত করতে চাই না।
শেষের কথা গুলো বলার সময় আরিহার গলা ধরে আসছিল। জিসান হাল্কা হেসে আকাশের পানে তাকিয়ে বলে,
— তুই কিন্তু ইতিমধ্যে তাকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে ফেলেছিস। এখন সে তোর অন্তরালে মিশে গেছে। তুই এখন চাইলেও তাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিতে পারবি না। কেন না সে সরবে না। ভালবেসে ফেলেছে সে তোকে।
জিসানের কথায় আরিহা চমকে উঠে। সে বিস্মিত নয়নে জিসানের দিকে তাকায়। জিসান দ্বীধাহীন ভাবে বলে,
— ইয়েস আরু! ইহান ইজ ইন লাভ উইথ ইউ।
এই কথা শুনেও আরিহা কোন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। মুখটা ঘুরিয়ে নিল। জিসানও আর কিছু বললো না। বেশ নিরবতা ছেয়ে যায় এক্স
চারদিকে। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই দুইজনের মাঝে নিস্তব্ধতা বোনে রইলো। অতঃপর জিসান নিরবতা কাটিয়ে বলে,
— ফুপা মানে আজমির আঙ্কেল ফোন করেছিল।
এই শুনার সাথে সাথে আরিহার মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে যায়। বিরক্তিকর একটা ভাব চলে আসে। আরিহা বিরক্তিকর সুরে বলে,
— কি বলেছে?
জিসান ইতস্তত কণ্ঠে বলে উঠে,
— তোকে একবার বাসায় যেতে বলেছে। অনেক রিকুয়েষ্ট করছিল আমায় তোকে নিয়ে আশার জন্য। আন্টি…
জিসানের কথা শেষ করতে না দিয়ে আরিহা হুংকার দিয়ে উঠে,
— জাস্ট শার্ট আপ! নাম নিবি তুই তার। তা না হলে আমি ভুলে যাব তুই আমার জন্য কি।
আরিহার হুংকারে পুরো পরিবেশটা শিউরে উঠে। গাছের পাতাও যেন এই হুংকারে কাঁপছে। পানিতেও কেমন শিহরণ তৈরি হয়ে গিয়েছে। জিসান আরিহার এমন হুংকারে অসহায় দৃষ্টিতে আরিহার দিকে তাকায়। তারপর ধরা কন্ঠে বলে,
— আর কত আরু? আর কত? অতীতের তিক্ততা নিয়ে এইভাবে কত দিন থাকবি? অতীতকে ভুলে সামনে এগুনোর চেষ্টা কর প্লিজ। দেখ বাবা তোকে আর আমায় একই শিক্ষায় বড় করেছে। কিন্তু তাও আমরা ভিন্ন। আমি হাসিটাকে বেছে নিয়েছি আর তুই বিষন্নতাকে। যার জন্য তুই হার্টলেস হয়ে উঠেছিস। ভুলে যাস না বাবা কিন্তু আমাদের হার্টলেস বানান নি বরং শক্ত বানিয়েছিলেন। সব ভুলে আগে এগিয়ে যাওয়া শিখিয়েছিল। তাহলে তুই কেন পারছিস না সব ভুলতে?
আরিহা এইবার ধরা কন্ঠে বলে,
— এত সহজে কি সব ভুলা যায়? সেই তিক্ততা পেরিয়ে আসা যায়? যতই অতীত ভুলে এগুতে চাই না কেন অতীতের তিক্ততা আমায় আবার আঁকড়ে ধরে। পুরানো ক্ষত তাজা করে দেয়। ভুলতে পারি না সেই সব কিছু।
আর যার জন্য আমি আজ কলঙ্কিত তাকে তো একদমই না। তার জন্য তো ঘৃণা শব্দটা কম মনে হয় আমার কাছে। এর চেয়ে নিকৃষ্ট শব্দও তার কাছে অতি নগ্ন। কলঙ্ক কখনো মুছে যায় না জিসান বরং সেটি হয়ে ওঠে কলঙ্কিত অধ্যায়। যা চেয়েও ভুলা যায় না।
শেষের কথাগুলো বলার সময় আরিহার চোখ চিকচিক করে উঠে। জিসান এইবার আরিহাকে বলে,
— তাহলে যাকে নিজের অন্তরালে জায়গায় দিয়েছিস তাকে ধরে বাঁচতে শিখ। নতুন করে সব শুরু কর আরু। লাইফ হ্যাস গিভেন ইউ আ সেকেন্ড চান্স। ইহানের সাথে মিলে নিজের দুনিয়া নিজের মত সাজা প্লিজ।
আরিহা এইবার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
— চাইলে কি সব নতুন করে শুরু করা যায়? আমার অতীত জানলে ইহান কখনো আমার সাথে থাকতে চাইবে না। সব কিছু নতুন করে শুরু করা তো দূরে থাক। সবাই আলোকিত অধ্যায় চায় কলঙ্কিত অধ্যায় না। সব সময় কিছু পূর্ণতা পায় না। অনেক কিছুই আছে যার পরিহাসই হলো অপূর্ণ রয়ে যাওয়া।
আরিহার এমন কথা শুনে জিসান তেতে উঠে বলে,
— নেগেটিভ কেন ভাবছিস তুই? একবার নিজের ভিতরে অন্যকে প্রবেশ করেই দে না। নিজেকে এক বইয়ের পাতার মত খুলে রেখেই দেখনা ইহানের সামনে। নিজের মনের মধ্যে দমিয়ে রাখা সুপ্ত কষ্টগুলো বলে দেখই না। নিজের কষ্টগুলোর মধ্যে ভাগ বসাতে দে ওকে। আমার বিশ্বাস এইসবের পর ইহান তোকে দূরে নয় বরং আগলে নিবে। আমার থেকেও অনেক ভালো বুঝবে তোকে। একটা সুযোগ দে ওকে। আমার জন্য হলেও দে।
আরিহা কিছু না বলে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে থাকে। সেই অতীতের তিক্ততা আবার তাকে হ্রাস করে দিচ্ছে। জিসান বুঝতে পেরে আরিহাকে ঝাঁজালো কন্ঠে বলে,
— আজকে মন খুলে কাঁদ আরু। কাঁদ! মনের কষ্টগুলো বের হতে দে। আর কত নিজের মধ্যে কষ্ট গুলো দমিয়ে রাখবি? কষ্টগুলো তোকে পুড়িয়ে ফেলছে রে। তাই কষ্ট গুলোকে বের হতে দে। কেঁদে মন হাল্কা কর। আজ তোকে কাঁদতেই হবে আরু।
আরিহা এইবার না পেরে কেঁদে দেয়। অঝোরে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে দুই নয়ন বেয়ে। আজ নিজেকে সামলে রাখা বড্ড দায়ভার হয়ে উঠেছে ওর জন্য। জিসান আরিহাকে আগলে নিতে গিয়ে দরজার পাশে ইহানকে দেখে থমকে গেল। ইহান আরিহার খোঁজেই উপরে এসেছিল কিন্তু উপরে এসে আরিহাকে কাঁদতে দেখে থমকে গেল। তার জানা মতে আরিহা কখনো কাঁদে না। তাকে কখনোই কেউ কাঁদতে দেখে নি।
ইহান মূর্তির ন্যায় দাড়িয়ে আছে তা দেখে জিসান উঠে গিয়ে ইহানের সামনে দাঁড়ায় আর তাকে আরিহার কাছে যেতে বলে। আপাতত তার কাঁদার জন্য একটা কাধ খুব প্রয়োজন। জিসান ইহানকে চাঁপা কন্ঠে বলে যে,
— এখন কোন প্রশ্ন করো না। কালকে সকালে ছাদে এসে,আমার সাথে দেখা করো আমি বুঝিয়ে দিব তোমায়। আপাতত ওকে একটু আগলে নাও।
ইহান কিছু না বলে মাথা দুলিয়ে আরিহার কাছে চলে যায়। জিসানও আর দেরি না করে নিচে নেনে যায়। ইহান আরিহার পাশে বসে ওকে নিজের বুকে আগলে নেয়। আরিহা হয়তো এতক্ষণ এমনই এক ভরসা খুঁজছিল যার বুকে মাথা রেখে সে একটু কাঁদতে পারবে। ইহান আগলে নিতেই আরিহা ইহানকে খামছে ধরে। আর বিরবির করতে থাকে,
— কেন হলো আমার সাথে এমন? কেন? কি দোষ ছিল আমার। কেন হলো? কেন! পারছি না আমি এইসব সহ্য করতে। পারছি না!
কথাগুলো ইহানের কাছে অস্পষ্ট হলেও সে বুঝতে পারছে কোন কালো অতীত আরিহাকে তাড়া করে বেরাচ্ছে। যা আরিহা নিজের মধ্যে দমিয়ে রেখেছে। কান্না করতে করতে আরিহা একসময় ইহানের বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে। ইহান তা দেখে ওকে কোলে করে রুমে নিয়ে যায়৷ তারপর অপলক দৃষ্টিতে আরিহার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ দুটো একদম ফুলে গিয়েছে। নাক ও গাল লাল হয়ে আছে। ঠোঁট জোড়া অনাবরত কাঁপছে আর ফুঁপাচ্ছে। ইহানের বড্ড মায়া হচ্ছে আরিহার জন্য। সাথে নিজের মধ্যে কৌতূহল বাড়ছে আরিহাকে জানার জন্য৷ কি এমন কষ্ট আরিহা মনের মধ্যে দমিয়ে রেখেছে সে? কি তার অতীত।
এইসব ভাবছে আর আরিহার মুখপানে তাকিয়ে আছে।
#চলবে