অন্তরালে তুমি পর্ব-২৫

0
2304

#অন্তরালে_তুমি
#Part_25
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

?১৩ বছর আগে?

মি. এন্ড মিসেস আজমির হক হচ্ছেন আমার বাবা-মা। তাদেরই একমাত্র মেয়ে ছিলাম আমি। একমাত্র মেয়ে ছিলাম বলে যে তারা আমায় মাথায় তুলে রাখতো তা কিন্তু না। বেশ শাসনই করতো আমায়। যাকে বলে অতিরিক্ত শাসন।কিন্তু সময় মতো আমার সকল চাওয়া-পাওয়া ঠিকই পূরণ করেছে তারা। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়াটাই পূরণ করতে পারে মি তারা। তাদের ভালবাসাটাই আমি পাই নি।

মি. হক শুরু থেকেই কাজের মধ্যে মগ্ন থাকতেন। বেশির ভাগ সময়ই তাকে ঘরের বাইরে থাকতে হতো। যার জন্য তার ভালবাসা পাওয়ার এত সৌভাগ্য আমার হয় নি। কিন্তু যখনই ফিরতেন আমার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন। দুই একসময় কোলে উঠিয়ে আদর করে দিত। এই স্বল্প আদরই ছিল আমার কাছে বিশাল কিছু। কেন না আমি এই স্বল্প আদরটুকু মিসেস হকের কাছ থেকে পাই নি। ছোট থেকেই ছোট খাটো কোন ভুল করলে শ’খানেক বকা শুনতে হতো আমায়। আর যদি ভুলটা বড় হতো যেমন, কোন জিনিস ভেঙ্গে ফেলেছি এমন কিছু তাহলে দুই-তিনটা থাপ্পড় তো ভাগ্যে ছিলই। অতি ছোট হতেই তিনি আমাকে আলাদা নিজস্ব প্লেট, গ্লাস ধরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে একা হাতে খাবার খেতাম আমি। টিভিটাও দেখতাম মিসেস হকের নির্ধারিত করা সময় অনুসারে। এর ব্যতীত না। খেলার জন্য বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। ঘরের এক কোনেই খেলতাম। মাঝে মধ্যে মিনাজ আঙ্কেল মানে ফুপার সাথে জিসান আসলে সে হয়ে উঠতো আমার খেলার সাথী। জিসানের ২ বছর বয়সে ফুপি ক্যান্সারে মারা যায়। এরপর থেকে ফুপা একা হাতেই জিসানের খেয়াল রাখা শুরু করে। আমার কাছে ফুপা ছিল অতি রহস্যজনক একজন মানুষ। তার কথা-বার্তা সবই ছিল অন্যরকম। যার জন্য আমার বেশ পছন্দ হতো অনাকে। অবশ্য তিনি আমায় বেশ ভালবাসতেনও বটে।

আমার জীবনই ছিল সময়ের হিসাব বেঁধে। কড়া শাসনের মধ্যে ছিলাম আমি। তাই বলে যে আমি শান্ত ছিলাম তা কিন্তু না। বেশ চঞ্চলই ছিলাম। নতুন জিনিস সম্পর্কে জানার আগ্রহ আমার মধ্যে বরাবরই ছিল। তাই সারাদিন মিসেস হকের পিছে ঘুর ঘুর করতাম নতুন নতুন জিনিস জানার জন্য। এতে তিনি বিরক্ত হতেন কিনা জানি না কিন্তু উত্তর গুলো ঠিকই দিতেন।
আমার যখন বয়স ৬ তখন মিসেস হকের ভাই মি. হারুন বিলাত থেকে দেশে ফিরে আসে।আমার নানা-নানু না থাকায় তিনি আমাদের সাথে থাকতে শুরু করেন। তখন শুধু এতটুকুই বুঝতাম যে তিনি সম্পর্কে আমার মামা হয়। প্রথম দিনই তার সাথে আমার সাথে বেশ ভাব জমে যায়। এর মোক্ষম কারণ আমার প্রতি তার ব্যবহার। তিনি সবসময় আমায় বেশ আদরই করতেন। কোলে উঠিয়ে গাল টেনে দিতেন, দুই এক সময় খায়িয়ে দিতেন, ঘোরাতে নিয়ে যেতেন, মিসেস হকের মার থেকেও বাঁচাতেন। যার ফলে কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আমার প্রিয় একজন ব্যক্তি হয়ে উঠে।
মিসেস হক ছোট থেকেই আমার উপর পড়ার চাপটা বেশি দিতেন। এইভাবে তো তিনি আমার সাথে স্ট্রিক্ট ছিলেনই কিন্তু পড়ার সময় এই স্ট্রিক্টনেস আরও তিন গুন বেড়ে যেত। কিন্তু তা হওয়া সত্ত্বেও আমি একদমই পড়ালেখা কর‍তে চাইতাম না। এমন না যে পড়ালেখা আমার ভালো লাগতো না বলে বরং মিসেস হকের জন্য। তিনি পড়ায় ভুল হলে স্কেল দিয়ে মারতেন, ঘন্টা ধরে এক পায়ে দাঁড়া করিয়ে রাখতেন। যার জন্য আমি পড়তে চাইতাম না। অতঃপর আমার সাথে মি. হারুনের এত ভালো সম্পর্ক দেখে মিসেস হক তাকে আমার পড়ালেখার দায়িত্ব দেন। তার ভাষ্যমতে আমি মি. হারুনের কাছে ভালো মত পড়বো। কিন্তু এর পরও আমি পড়তে চাইতাম না। কেন না ততোদিনে পড়ার প্রতি অনিহা জমে যায়। এরই মধ্যে চিত্রাঙ্কণের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। আমি সারাদিন ওইটা নিয়ে পড়ে থাকতাম। তা দেখে মিসেস হক প্রচন্ড রেগে যান আর আমার চিত্রাঙ্কন করার সকল সরঞ্জাম ফালিয়ে দেন। সেইদিন অনেক কেঁদেছিলাম আর বলেছিলাম সেইগুলা না ফেলতে। কিন্তু তিনি শুনেন নি। তখন মি হারুন বলে যদি আমি তার সকল কথা ঠিক মত শুনি তাহলে তিনি আমায় সেইসব সরঞ্জাম আবার কিনে দিবে।
আমিও বিনা বাক্যে রাজি হয়ে যাই। এর পিছে তার আসল উদ্দেশ্য কি ছিল তা বুঝতে পারি নি। বয়সেই ছিল মাত্র ৭ বছর কি ৮ বছর। এই বয়সে কি আর নিজের ভালো মন্দ কেউ বুঝে? আমি চুপচাপ তার সকল কথাই শুনতাম।
সেইদিন থেকে তার পরিবর্তন হতে শুরু করে। সাথে তার স্পর্শ গুলোও। তিনি আমায় কোলে বসিয়ে আপত্তিকরভাবে বিভিন্ন জায়গায় স্পর্শ করতেন। প্রথম প্রথম সেগুলো আদর হিসাবে নিলেও আস্তে আস্তে আমার এইসব কেমন যেন লাগতে শুরু করে। তার স্পর্শে অস্বস্তি হতে শুরু করে। কিন্তু কিছু বুঝতাম না বলে কাউকে কিছু সঠিক ভাবে বলতেও পারতাম না। অবশ্য আমার কথাগুলো বলতাম কাকে? শুনার মত আদো কি কেউ ছিল?
দেখতে এইভাবেই দেড় বছর পার হয়ে যায়। তখন আমার বয়স ১০ বছর। দিনে দিনে মি হারুনের আচরণ কেমন রুক্ষ হচ্ছিল সাথে তার স্পর্শ গুলো বাজে থেকে বিশ্রীতে। নিজেরই কেমন উদ্ভট অনুভূতি হতো। ভালো লাগতো না তার স্পর্শ। কেমন ঘেন্না হতো। আস্তে আস্তে বুঝতে পারি স্পর্শ গুলো বাজে। ভালবাসাপূর্ণ স্পর্শ আর বাজে স্পর্শ বুঝতে পারি। বুঝতে পারি মি হারুন একজন পঁচা মানুষ। ভালো না। তাই একদিন সাহস জুগিয়ে আমি মিসেস হকের সামনে গিয়ে বলি,

— মামা না অনেক পঁচা আম্মু। তাকে আমার একদমই পছন্দ না। তার স্পর্শ আমার পছন্দ না।

তখন মিসেস হক আমার দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলেছিল,
— তোমার মামা এমন কি করেছে শুনি যে তাকে তোমার পছন্দ না? আর কিভাবে স্পর্শ করেছে শুনি?

আমি তখন কিছু বলতে যাব তখন কোথ থেকে মি হারুন এসে বলে,
— আমি বলছি কেনো? আরিহা আজকে পড়া পড়ে নি বলে হাল্কা বকেছিলাম আর শাস্তি হিসাবে স্কেল দিয়ে হাতে মেরেছিলাম। তাই তো রাগ করে মুখ ফুলিয়ে এসে পড়লো। যেহেতু ওকে বকেছি আর শাস্তি দিয়েছি সেহেতু আমি তো এখন পঁচা আর অপছন্দের মানুষ হবোই। তাই না? আর মেরেছি বলে আমার স্পর্শ তার পছন্দ না।

আমি পড়া পরি নি কথাটা শুনে মিসেস হক রেগে গেলেন। আমার কোন কথা না শুনেই গালে এক থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। পড়া নিয়ে হেলামি করেছি তা তার একদম সহ্য হয় নি। এ নিয়ে অনেক বকেছিলেন আমায়। তারপর মামাকে খারাপ আর পঁচা বলেছি বলে আরও কতক্ষণ বকলেন। সেইদিন হেঁচকি তুলে কান্না করেছিলাম আমি। কান্না করতে করতে চোখ, গাল, নাক সব লাল হয়ে ফুলে উঠেছিল কিন্তু আমার প্রতি মিসেস হকের মায়া হয় নি। আসল মা হওয়া সত্ত্বেও তার ব্যবহার ছিল সৎ মার চেয়েও নিকৃষ্ট। শাসন ভালো কিন্তু অতিরিক্ত না।

সেইদিন রাতে মি হারুন আমায় অনেক ধমকান আর ভয় দেখান। আমার গাল দুটো চেপে ধরে তিনি বলেন যে, আমি যাতে চুপচাপ থাকি। আমি যদি আবার এমন করি তাহলে তিনি আমায় বেল্ট দিয়ে পিটাবেন। তার উপর আমাকেই মিসেস হকের হাতে এমন মার খাওয়াবেন। ব্যাস! বাচ্চা একটা মেয়েকে আর ভয় দেখানোর জন্য কি লাগে?
তারপর থেকেই আমি একদম চুপসে যাই সাথেই মি. হারুনকে বেশ ভয় পেতাম আমি। এতে যেন সে এক আলাদাই পৈচাশিক আনন্দ পেতো। দিন যত যাচ্ছিল তার স্পর্শ গুলো আরও বিশ্রী হতে থাকে। সাথে যোগ হয়েছিল আমায় চুমু দেওয়াটা। হুটহাট আমায় ধরে চুমু খেত সে। তখন কেমন এক বিশ্রী অনুভূতি হতো আমার তা শুধু আমি এই জানি। দম বন্ধ হয়ে আসতো আমার। ধীরে ধীরে ট্রোমাতে চলে যাচ্ছিলাম আমি।

এইদিকে মি. হক কাজের জন্য দীর্ঘ সময়ের জন্য বাসায় থাকতে পারতেন না। সপ্তাহে একদিন হয়তো আসতেন। তাও গভীর রাতের দিকে। পরেরদিন সকালে বা বিকালের দিকে আবার চলে যেতেন। তার কাছে নিজের বিজনেস ছিল সবার আগে। তাই তাকে এইসবের কথা বলতে পারতাম না। মিসেস হককে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সে তো আমার কথার কোন গুরুত্বই দিত না বরং মি হারুন যা বলতেন তাই বিশ্বাস করতেন। অতঃপর যখন মিসেস হক বাসায় না থাকতেন তখন সকলের আড়ালে সেই ভুল করার জন্য আমায় শাস্তি দিতেন। বেশি শাস্তি দিতেন না শুধু মাত্র এক-দুইটা বেল্টের বারিই দিতেন। কিন্তু এতেই আমার অবস্থা নাজেহাল হয়ে যেত। এই বারি গুলো যেন ছিল আমার কাছে মরণযন্ত্রনার সমান। সহ্য হতো না। ইচ্ছে মত গলা ছেড়ে চিৎকার করে কান্না করতাম তখন। কিন্তু সেই কান্না দেখার কেউ ছিল না। তখন থেকেই এই বেল্টের বারিটা বড্ড ভয় পেতাম আমি। এতটাই যে রাতেও দুই একসময় এইসব নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে কেঁদে উঠতাম আমি। কিন্তু সেই কান্না চার দেয়ালের মধ্যেই রয়ে যায়। এক বিশাল রুমে একা থাকতাম যে আমি। দেখতে দেখতে এইভাবেই সময় অতিবাহিত হতেথাকে। আমি আমার মামা নামক নিকৃষ্ট প্রাণীর কাছ থেকে প্রতি নিয়ত শোষিত হতে থাকি। ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছিলাম আমি। পারছিলাম না এইসব সহ্য করতে। আমার যে ঠিক কি করা উচিৎ তাও বুঝতে পারছিলাম না। অবশ্য ১১/১২ বছর বয়সী এক মেয়ের জন্য এইসব বুঝার কথাও না।
এরই মধ্যে একদিন আমাকে মি হারুনের সাথে রেখে মিসেস হক এক কাজে ঢাকার বাইরে চলে যান। সেইদিন তাকে অনেক রিকুয়েষ্ট করেছিলাম আমাকেও তার সাথে নিতে কিন্তু সামনে পরিক্ষা থাকায় তিনি না বলে দেন। একসময় কান্না করে বলেছিলাম আমাকে তার সাথে নিয়ে যেতে কিন্তু সে মুখ ঘুরিয়ে সেইদিন চলে যায়। সেই থেকেই তার জন্য মনে ঘৃণা জন্মাতে শুরু করলো। প্রচন্ড ঘৃণা! আমি সেইদিন সারাক্ষণ নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে বসেছিলাম। মি হারুন অনেকবার দরজা ধাক্কিয়েছিলেন কিন্তু আমি খুলি নি। অতঃপর যখন গভীর রাত্রি তখন খুদার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে রুম থেকে বের হই। আর সেটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আমি বের হতেই মি. হারুন আমার উপর হামলে পড়ে। তিনি যেন এই সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। আমার সাথে তিনি জোরাজোরি শুরু করেন। সেইসময় পুরোটা না বুঝলেও বুঝতে পারচ্ছিলাম ভয়াবহ কিছু হতে চলেছে আমার সাথে। তাই তো নিজের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা দিতে থাকি আর ছুটাছুটি লাগিয়ে দেই। কিন্তু কই আমার মত বাচ্চা মেয়ের শক্তি আর কই সেই বিশাল দৈত্য দেহের পশুর শক্তি। তার এক থাপ্পড়েই আমার দেহ নেতিয়ে পড়ে। ছিটকে পড়েছিলাম ফ্লোরে। তা দেখে সে বিশ্রী হাসি হাসে আর হামলে পড়ে আমার উপর। নিজেকে বাঁচানোর মত কোন পথই ছিল না আমার কাছে। অতঃপর যা হওয়ার ছিল তাই হলো। সেই পশুটা আমাকে দ্বারা তার নিজের কামনাটা মিটিয়ে নিল আর আমি ওইসব সহ্য করতে না পেরে বিধস্ত অবস্থায় জ্ঞানহীন ভাবে সেখানেই পড়ে রইলাম। রক্তের সরু ধারা বয়ে যেতে থাকে মেঝেতে। হয়ে গেলাম আমক কলঙ্কিত, অপবিত্র। আমার নামের পাশে লাগিয়ে দেয় ধর্ষিতা ট্যাগটি। ১২ বছরের সেই বাচ্চা মেয়েটি পরে যায় ধর্ষিত নারীদের দলে।
?

এতটুকু বলেই আরিহা নিঃশব্দে কেঁদে উঠে। না চাইতেও পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে অজস্র জল। সেই পুরানো ক্ষতগুলো যে আবার জেগে উঠেছে। ইহানের চোখেও পানি চিকচিক করে উঠে। রুমে অবস্থিত লাইটের কৃত্রিম আলোয় বারান্দায় আশার ফলে আরিহার কান্না মাখা চেহারা একদম স্পষ্ট। তারই সাথে আরিহার দুইটি কালো গভীর নয়নে এসে ভীর করেছে হাজারো কষ্ট, বেদনা, কিছু তিক্ত স্মৃতি। যা হয়তো কখনো ভুলার মত না। ইহান পারছে না আর সইতে। এতটা কষ্ট একটা মানুষ কিভাবে বয়ে বেরাতে তা তার জানা নেই। সান্তনা দেওয়ার মত ভাষাও খুঁজে পাচ্ছে না ইহান। আসলেই বলবে টা কি? আদো কি এইটাতে সান্তনা দেওয়ার মত ভাষা থাকে?
আরিহা নিজের চোখ মুছে এক দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করে।

?
— সেইদিন হয়তো আমার মৃত্যু নিশ্চিত ছিল কিন্তু ভাগ্যবসত সেইদিন রাতেই মি. হক বাসায় ফিরেন। তার কাছে এক্সট্রা চাবি থাকায় তিনি নিরদ্বিধায় তার গৃহস্থলে প্রবেশ করেন। নিজের গৃহস্থলে প্রবেশ করেই তিনি দেখতে পান চারদিকটা অন্ধাকারের আচ্ছন্ন। তিনি লাইট জ্বালিয়ে সামিনে এগুতেই আমার আমার বিধস্ত হওয়া দেহটি তার সামনে ভেসে উঠে। পাশ দিয়ে রক্তের সরু রেখা বয়ে চলেছে। সাথে সাথে সে আমার নাম ধরে চিৎকার করে উঠেন। আমার কাছে এসে আমাকে ডাকতে থাকেন। কিন্তু আমি কোন রেসপন্স করি নি। করবোই বা কিভাবে আমি তো আর সজ্ঞানে নেই। মি. হকের চিল্লানিতে মি. হারুন ঘুমু ঘুমু চোখে বেরিয়ে আসে। মি. হারুন তখন নিজের মধ্যে এতটাই মশগুল ছিলেন যে তিনি ঠিক কোন অবস্থায় আছে তার দিকে তার কোন ধ্যান ছিল না। সে যে বস্ত্রহীনভাবেই বাইরে চলে এসেছেন। মি. হারুনকে এইভাবে দেখে মি. হকের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে আমার এই অবস্থার পিছনে দায়ী কে আর আমার এই অবস্থাই বা হলো কিভাবে। কিন্তু সে তখন চেয়েও কিছু বলতে পারলো না কেন না আমার অবস্থা অনেক বাজে ছিল। কোন মতে মি. হারুনকে থ্রেড দিয়ে তিনি আমার গায়ে তার কোর্টটা জড়িয়ে দিয়ে আমায় কোলে করে নিয়ে হসপিটালের দিকে ছুটলেন।

আমার অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। আইসিওতে নেওয়া হয় আমায়। আমার ইন্টারনাল ব্লিডিং থামছিলই না। তার উপর আমার পালস রেটও কমে আসছিল। ডাক্তাররা আশা ছেড়েই দিয়েছিল যে আমি বাঁচবো। কিন্তু আল্লাহ এর রহমতে বেঁচে যাই। তাও ডক্টররা রিস্ক না নিয়ে আমায় আইসিওতেই রাখে আর আমায় অবজারভ করে। তারা আমার জ্ঞান ফিরার অপেক্ষা করতে থাকলেন কিন্তু আমার আর জ্ঞানে ফিরে আসা হলো না। আমি ২ মাসের জন্য কোমায় চলে যাই।
এইদিকে মি. হক আমার ধর্ষণ হওয়ার কথাটা টাকার জোরে ধামাচাপা দিয়ে দেন। কেউ আর জানতে পারে নি বিষয়টা। মিসেস হক সব শুনে হতভম্ব হয়ে যায় আর কান্নায় ভেঙে পড়েন। কাজের সুবাদে মিনাজ আঙ্কেল জিসানকে নিয়ে তখন লন্ডনে শিফট হয়েছিল মাত্র। আমার এমন অবস্থার কথা শুনে তারা বাংলাদেশে চলে আসেন। অতঃপর বাংলাদেশে এসে আমার এই অবস্থার পিছে কে ছিল তা জানতে পারে সে। সব শুনে তিনি খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে মি. হারুন নিখোঁজ। যার অর্থ এই যে সে পালিয়েছে। তাই মিজান আঙ্কেল নিজেই তাকে খুঁজে বের করে এবং নিজ হাতেই মি. হারুনকে গুলি করে মারে আর তাকে নির্মম মৃত্যু দান করে। যেহেতু মিজান আঙ্কেল সিআইডি অফিসার ছিলেন সেহেতু তিনি ব্যাপারটা সামলে নিতে পারেন। তার কোন ঝামেলা হয় না।
অন্যদিকে ২ মাস পর যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন আমি পাগল প্রায় হয়ে উঠেছিলাম। যেই সামনে আসতো তাকে দেখে ভয়ে চিল্লিয়ে উঠতাম। বিশেষ করে মি এন্ড মিসেস হককে দেখলেই নিজের বোধশক্তি হারিয়ে ফেলতাম।হাতের সামনে যা পেতাম তাই ছুঁড়ে মারতাম। তখন ঘুমের ইনজেকশন ব্যতীত আমায় শান্ত করা সম্ভবই হতো না। একমাত্র মিজান আঙ্কেলই আমায় শান্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি ব্যতীত কেউ আমায় সামলাতে পারে নি। আমিও মিজান আঙ্কেল বাদে কাউকে সহ্য করতে পারতাম না। হয়তো তার উপর আমার একটু হলেও বিশ্বাস ছিল তার জন্য।
ডাক্তার আমার কান্ডিশন দেখে বলে, আমি অনেক বড় এক ট্রোমার মধ্যে আছি। এমন সময় আমি যার সাথে শান্ত আছি আমাকে তার সাথেই রাখতে। যাদের আমি সহ্য করতে পারি না তারা যেন ভুলেও আমার সামনে না আসে। তা না হলে আমি হয়তো বা ব্রেইন স্টোকও করতে পারি। সব শুনে মি. হক কিছু বলবেন তার আগেই মিজান আঙ্কেল আমায় তার কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। মি. হকও তখন বিনাবাক্যে রাজি হয়ে যান। আর আমাকে স্বাভাবিক আর মানুষ দায়িত্ব মিজান আঙ্কেলকে দিয়ে দেন। বলতে গেলে আমার পুরো দায়িত্বটাই দিতে দেন। মি. হক আমার এই অবস্থার জন্য মিসেস হককে দোষারোপ করে কিন্তু স্ত্রী বলে তাকে পরিহার করতে পারেন নি।

মিজান আঙ্কেল ঠিক করেন যে উনি আমায় নিয়ে লন্ডন চলে যাবেন। কেন না বাংলাদেশে আমি ভালো থাকবো না। এইখানে আমায় সেইসব তিক্ত স্মৃতি গুলো তাড়িয়ে বেড়াবে। তাই পরবর্তী এক সপ্তাহের মধ্যেই মিজান আঙ্কেল আমায় আর জিসানকে নিয়ে চলে আসে লন্ডনে। পারি জমাই আমি লন্ডনে। কিন্তু সেখানে এসেও তেমন পরিবর্তন ছিল না। আমি সারাক্ষণ চুপ করে থাকতাম। হুট করেই কেঁদে উঠতাম। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতাম। পাগলের মত আচরণ করতাম। অতঃপর ঘুমের ইনজেকশন দিতেই শান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতাম। আমার এই অবস্থা দেখে মিজান আঙ্কেল আর জিসানের চোখ ছলছল করে উঠতো।
আস্তে আস্তে আমার পাগল ন্যায় আচরণ কম হয় কিন্তু তাও আমি তখন কাউকে সহ্য করতে পারতাম না। এমনকি জিসানকেও না। জিসান আমার থেকে বেশি না ২ বছরের বড় কিন্তু আমাদের মধ্যে বন্ধু সম্পর্ক ছিল। তাও কেন জানি তখন ওকেও ভয় করতো। প্রচন্ড রকমের ভয়। তাই ও আমার কাছে আসতে নিলেই জিনিস ছুঁড়ে মারতাম। ওকে আঘাত করার জন্য নয় বরং ও যাতে আমার কাছে না আসে সেই জন্য। একদিন এইভাবেই জিনিস ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে পাশে থাকে ছুরি ওর দিকে ছুঁড়ে মারি। যার জন্য ওর হাতে গভীর ক্ষত হয়ে যায়। সাথে সাথে ও ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে আর মেঝেতে পড়ে যায়। টপটপ করে রক্ত পড়তে থাকে। সেই দেখে কেন জানি ওর প্রতি ভয়টা চলে যায়। আমি দ্রুত ওকে গিয়ে দেখতে থাকি। তখনই আঙ্কেল আসে আর জিসানের দ্রুত ট্রিটমেন্ট করায়। এরপরও জিসান আমায় কিছু বলে নি বরং প্রতিবার এর মতই আমায় সামলাতে এসেছিল। তখন বুঝেছিলাম ওর থেকে আমার ক্ষতি নেই। ওকে ভয় পাওয়ার কারণ নেই। পরবর্তীতে আমি আস্তে আস্তে ওর সাথেও স্বাভাবিক হয়ে উঠি। বন্ধু হয়ে যাই আগের মত।
আমাকে পুরোপুরি ভাবে স্বাভাবিক আর মনের মধ্যে থাকা ভয়টা দূর করার জন্য মিজান আঙ্কেল আমাকে সাইকেট্রিসের কাছে নিয়ে গেলেন। প্রায় দীর্ঘ এক বছর আমায় সাইকেট্রিসের কাছে নিয়ে যান। প্রোপার ট্রিটমেন্ট করান তিনি আমার। আমি কিছুটা স্বাভাবিক হতেই মিজান আঙ্কেল আমায় তার মত করে গড়ে তুলতেন। করে তুললেন আমায় একদম শক্ত, নির্দয়। আঙ্কেল জানতেন হয়তো আমায় এমন না বানালে আমি ভালো থাকতে পারবো না। পারবো না বেঁচে থাকতে। তিনি আমায় অন্ধকার ভরা জীবনে আলো নিয়ে আসলেন। মিজান আঙ্কেল না থাকলে ওইসব ভুলে মুভ অন করা আমার পক্ষ কখনোই সম্ভব ছিল না। মিজান আঙ্কেল আমায় পুরোপুরি ভাবে স্বাধীন বানালেন। আমাকে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর পথ দেখিয়ে দিলেন। আমাকে পরিপূর্ণ বানালেন যাতে আমি একাই এই সমাজের মাঝে বাস করতে পারি আর মানুষের চোখ দিকে চোখ রেখে কথা বলতে পারি। ছোট থেকে বড় সকল ধরনের সকল কাজ আমাকে শিখালেন তিনি। কিভাবে কাঁদতে হয় সেটাই ভুলিয়ে দিলেন। সকল পরিস্থিতিতে শক্ত ও শান্ত হতে শিখালেন। আমার মাইন্ডটা তার মত করে সেট আপ করলেন। আমার শুরু থেকে শেষ তিনিই দেখেছেন। আজ আমি যা সবই মিজান আঙ্কেলের দান। তিনি না থাকলে হয়তো আমি সেই কলঙ্কিত অধ্যায়ের অন্তরালে ডুবে যেতাম। তিলে তিলে মরে শেষ হয়ে যেতাম।
আমি অনেক আগেই মি. এন্ড মিসেস হকের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। তাদের সারনেম নিজ নাম থেকে সরিয়ে ফেলি আর মিজান আঙ্কেলের সারমেন ব্যবহার করতে শুরু করি৷ হয়ে উঠি আমি “আরিহা আহমেদ।”
অতঃপর পরবর্তীতে জানতে পারি মি. হকই আমার জান বাঁচিয়েছিলেন। যার জন্য আমি তার কাছে ঋণী হয়েছিলাম। তাকে চেয়েও আর ঘৃণা করতে পারি নি, সম্পর্কে ছিন্ন করতে পারি নি। কিন্তু মিসেস হককে আমি চিরতরের জন্য ঘৃণা করি। তিনি যদি আমার কথাগুলো শুনতেন তাহলে হয়তো আমার জীবনটাও বাকি ৮-১০ মেয়েদের মত হতো। সেইদিনও যদি আমাকে তিনি সাথে নিতেন তাহলে হয়তো আমার সেইসব সহ্য করতে হতো না। তার নাম পর্যন্ত নিতে আমি অপছন্দ করি। সহ্য হয় না আমার।

৪ বছর আগে মিজান আঙ্কেল মারা যান। সেইদিনটা যেন ছিল আমার জন্য আরেক কালো অধ্যায়। সে যে আমার জন্য ঠিক কি ছিল তা শুধু আমি জানি। কিন্তু আজব করার বিষয় আমি সেইদিন কাঁদি নি। কাঁদতে ভুলেই গিয়েছিলাম তাই হয়তো আমার চোখ দুটো ছিল শুষ্ক। তাই তো একমাত্র এইদিনের আমি কালো পরিধান করি। এইদিনটিতেই যে আমার জীবন উজ্জ্বলকারী বহুদূরে চলে গিয়েছিল। পারি জমিয়েছিল পরপারে।
?

এতটুকু বলে আরিহা থাকে। চোখ দিয়ে এখনো পানি বিরতিহীনভাবে ঝরছে। আজ দ্বিতীয় বারের মত আরিহা কাঁদছে। মন খুলে কাঁদছে। নিজের তিক্ত স্মৃতি গুলো এই অশ্রুমালার সাথেই বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছে। ইহান নির্বাক হয়ে বসে আছে। তার যে এত কিছু বলার নেই। মানুষ এতটা নিকৃষ্ট কিভাবে হতে পারে যে নিজেরই আপন ১২ বছরের ভাগ্নিকে ধর্ষণ করতে পারে। কিভাবে ৭/৮ বছরের বাচ্চাকে আপত্তিকর ভাবে স্পর্শ করতে পারে? ওইরকম বাজে দৃষ্টিতে তাকাতে ও ছুঁতে পারে? এইখানেও কি সমাজ এই ছোট অবুঝ বাচ্চা মেয়েদেরকেই দোষ দিবে? তাদের কেই বলবে তাদের পোশাকে দোষ? তাদের চালচলনে দোষ?
যদি তাই বলা হয় তাহলে তাদের কি বিবেক বলতে কিছু নেই? হাইরে সমাজ! যত যাই হোক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দোষ সব মেয়েদের ঘাড়েই আসে চাপে। আরিহার কাছে তো তার মিজান আঙ্কেল ছিল কিন্তু অন্যদের কাছে তো তাদের আপন বাবা-মা পর্যন্ত থাকে না। কলঙ্কিত হয়েছে বলে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয় রাস্তার সেই নর্দমায়। যেন তারাই সর্বদোষে দুষিত। মানে কথাটা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে নারীরাই কাল্প্রিট আর নারীরাই ভিকটিম। দুইপক্ষই সে আর মাঝ দিয়ে ধর্ষক হচ্ছে তৃতীয় পক্ষ। হয়তো সমাজের এই চিন্তাধারাটি একদিন বদলাবে কিন্তু তা হতে হতে যেন খুব দেরি না হয়ে যায়।

ইহান এইসব ভেবে এক দীর্ঘ শ্বাস নেয়। বলার মত কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না সে। আরিহা আস্তে আস্তে নিজের চোখের জল মুছতে থাকে আর তাচ্ছিল্যের সুরে একেক করে ইহানের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে মারতে থাকে ,

— তো এখন বলো মেনে নিতে পারবে আমায়? পরিচয় দিতে পারবে আমায় সকলের সামনে নিজের স্ত্রী বলে? পাশে দাঁড়াতে পারবে আমার? আমার কষ্টে ভাগ তো বসালে এখন তার দায়ভার নিতে পারবে? পারবে আমার মত কলঙ্কিত এক নারীকে আপন করে নিতে? নিজের অন্তরালে আমার মত ধর্ষিতাকে জায়গা দিতে?

আরিহার সকল প্রশ্ন শুনেও ইহান নির্বাক হয়ে বসে আছে। মুখ নেই তার কোন কথা। মুখভঙ্গিও কেমন নিস্তেজ হয়ে আছে। মাথাটা নিচু করে দুই হাত হাটুর উপর ভর করে বসে আছে সে। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে থেকেই হুট করেই ইহান বিনাবাক্যে দাঁড়িয়ে যায় আর রুমের দিকে অগ্রসর হয়। তা দেখে আরিহা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।

#চলবে