#অন্তরালে_তুমি
#Part_28
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
?
চারদিকে পিন পিন নিরবতা। নিস্তব্ধ এক পরিবেশ বিরাজমান করছে পুরো রুম জুড়ে। বিছানায় শুয়ে আছে আরিহা। আরিহার পায়ের দিকে বসে আছে ইহান। পাশেই চেয়ার টেনে বসে আছে জিসান। বেশ কিছুক্ষণ পর আরিহা পিটপিট করে চোখ খুলে অতঃপর চারদিকে চোখ বুলায়। নিজের রুমটি আরিহার বেশ বেগ পেতে হলো না। আরিহা আস্তে আস্তে উঠে বসার চেষ্টা করতে নিলে ইহান দ্রুত ওকে ধরে। তারপর ওকে ধরে পিছনে বালিশ দিয়ে ওকে আধশোয়া করে বসিয়ে দেয়। একটু পর ইহান আরিহার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয়। আরিহা পানিটা খেয়ে জিসান আর ইহানের দিকে তাকায়। যেখানে তাদের চিন্তিত থাকার কথা সেখানে দুইজনের মুখেই গাম্ভীর্য এক ভাব ছেঁয়ে আছে। আরিহা বুঝে উঠতে পারছে না এত গাম্ভীর্যের মানে কি? আরিহা কিছু বলতে নিবে তার আগেই ইহান কিছুটা কাঠ কাঠ গলায় বলে,
— তুমি ঠিক আছো তো? খারাপ লাগছে এখন?
আরিহা কিছুক্ষণ ইহানের দিকে তাকিয়ে থেকে হাল্কা একটু কেশে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,
— হুম ঠিক আছি। খারাপ লাগছে না আর। কিন্তু হয়েছিল টা কি?
জিসান গম্ভীর গলায় বলে,
— অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলি।
আরিহা এইবার হাল্কা হেসে বলে,
— নিশ্চয়ই আজ আবার প্রেশার ফল করেছে। ঔষধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।
আরিহার কথা শুনে জিসান কর্কশ কন্ঠে বলে,
— এইবার ঔষধ খেলেও ঠিক হতো না। তুই এখন ক্ষণে ক্ষণে অজ্ঞান হওয়া আর বমি করার জন্য রেডি হো। এ থেকে তুই আর নিস্তার পাচ্ছিস না। আর এর জন্য দ্বায়ী আমার অতিপ্রিয় সতীন মশাই।
জিসানের কথা শুনে ইহান বা হাতের কুনোই দিয়ে জিসানের পেটে গুতো মারে। জিসান কিছুটা ব্যর্থ চোখে ইহানের দিকে তাকায়। ইহান ডোন্ট কেয়ার একটা ভাব নিয়ে আবার মুখে গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে আসে। জিসানের কথা শুনে আরিহার ভ্রুকুটি কুঞ্চিত হয়ে আসে। সে কৌতূহলী কন্ঠে বলে,
— মানে? কি বলছিস এইসব?
জিসান এইবার গলা ছেড়ে বলে,
— যা বলছি সব সত্য। আর শুধু তাই? কয়েকদিনের মাঝেই তুই এলিয়ানের মত উদ্ভট আচরণ করা শুরু করবি। সাথে রাক্ষসনীর মত খেতেও শুরু করবি। একটুতেই প্রেসার কুকারের মত ফুসফুস করবি। ঝাল ও টকের বন্যায় ভেসে যাবি। টেডিবিয়ারের মত সফট সফট হয়ে যাবি। নিজের মধ্যে আরেকটা টেডিবিয়ার নিয়ে ঘুরে বেড়াবি। আর এইসবের জন্য একমাত্র দ্বায়ী আমার সতীন মশাই। তারই অবদানের ফলে তোর এই দূর্দশা আসতে চলেছে।
জিসানের এমন বিবরণ শুনে আরিহা সরু চোখে জিসানের দিকে তাকায়। ও কি বুঝাতে চাচ্ছে তা বুঝার চেষ্টা করছে। এইদিকে ইহান নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসি থামানোর চেষ্টা করছে। জিসানের কথাগুলো যে সেই পরিমাণে হাস্যকর লাগছে তার কাছে। আরিহা কিছু বুঝতে না পেরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জিসানের দিকে তাকায়। জিসান আরিহার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে হেসে দেয়। সাথে ইহানও হেসে উঠে। জিসান এইবার হাসতে হাসতে বলে,
— আরেহ গাধী তুই মা হতে চলেছিস। ইউ আর প্রেগন্যান্ট।
জিসানের কথাটি কান বরাবর পৌঁছাতেই আরিহা বিস্ময়কর চোখে জিসানের দিকে তাকায়। আপনা-আপনি নিজের হাতটা পেটে চলে যায়। সবই যেন ধোঁয়াশা লাগছে আরিহার কাছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করাতেও কষ্ট হচ্ছে। আরিহা এইবার কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
— আর ইউ সিরিয়াস জিসান? তুই মজা করছিস না তো?
জিসান এইবার মিষ্টি হাসি হেসে বলে,
— আরেহ না আমি কোন মজা করছি না। আ’ম সিরিয়াস। তোর মধ্যে আরেকটা সত্তা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে। আমি ভালো মতই চেকাপ করেছি।
আরিহার চোখ এইবার খুশিতে ছলছল করে উঠে। আরিহা কিছু বলতে যাবে তার আগে জিসান বলে উঠে।
— তাও তোকে কাল একবার ক্লিনিক গিয়ে কনফার্ম হওয়ার জন্য কিছু টেস্ট করিয়ে নিতে হবে।
আরিহা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। জিসান মুচকি হেসে বলে,
— সতীন মশাই বউয়ের দিকে এখন একটু বেশি খেয়াল রাখতে হবে কিন্তু। আর সব একবারে কনফার্ম হলে কিন্তু ট্রিট চাই।
ইহান হাল্কা হেসে বলে,
— আল্লাহ এর রহমতে সব ঠিক হলে ট্রিট কেন পার্টি দিব সবাইকে।
জিসান মুচকি হেসে ধীর পায়ে রুম থেকে চলে যায়৷ আপাতত ইহান আর আরিহাকে একান্ত কিছু সময় কাটানো উচিৎ এই ভেবে। জিসান যাওয়ার আগে দরজা দিয়ে যায়। ইহান এইবার আস্তে করে গিয়ে আরিহার পাশে বসে। আরিহা তখনও পেটে হাত দিয়ে স্থির বসে আছে। ইহান আরিহার দুই গালে হাত রাখতেই আরিহা ইহানের দিকে তাকায়। তারপর আরিহা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
— আমি সত্যি মা হবো? আমার মধ্যেই কেউ বেড়ে উঠবে। আদো আদো কন্ঠে মা বলবে? আমাকে তার ছোট ছোট আদরমাখা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিবে? এইসব সত্যি সত্যি হবে?
ইহান মিষ্টি হাসি হেসে বলে,
— হ্যাঁ আরু! এইসব সত্যি সত্যি হবে। তোমার আমার একটা ছোট প্রিন্স বা প্রিন্সেস আসবে যে কি না আমায় বাবা আর তোমায় মা বলে ডাকবে। তার আদরমাখা হাতে আমাদের ছুঁয়ে দিবে। আমাদের অস্তিত্ব হয়ে আসবে। পরিপূর্ণ হবে আমাদের জীবন।
আরিহা এইবার খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়। আজ আরিহা সত্যি মন খুলে হাসছে। ওর জন্য আজকের দিনটা সবচেয়ে খুশির দিন। নিজেকে আজ ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে আর ইহানকে ওর জীবনের বেস্ট ডিসিশন। ইহানকে আজ ওর জীবনের ম্যাজিশিয়ান মত লাগছে। সেইদিন যদি সে ইহান একটা সুযোগ দিয়ে আপন করে না নিত তাহলে হয়তো আজকের এই খুশিটা সে উপলব্ধি করতে পারলো না। ইহানও আজ বেশ খুশি। কেমন এক অন্যরকম অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে ওর মধ্যে।
হুট করেই আরিহা ফুপিয়ে উঠে। আরিহার এমন করায় ইহান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। বুঝতে পারে না কি হয়েছে। ইহান চোখের পলকেই অস্থির হয়ে উঠে। আরিহাকে বার বার জিজ্ঞেস করতে থাকে সে কান্না কেন করছে। আরিহা ইহানের কাধে মাথা রেখে বলে,
— আমিও যদি মিসেস হকের মত মা হই? তখন তো আমার বাচ্চাও আমার মত কষ্ট পাবে। আমার মত নিজের মনের মধ্যে কষ্ট বয়ে বেড়াবে। হয়তো ওর জীবনও আমার মত কলঙ্কিত হয়ে যাবে। আমি মোটেও মিসেস হকের মত মা হতে চাই না। চাই না তার মত বাজে মা হতে। চাই না!
ইহান আরিহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ইহান বেশ বুঝতে পারছে আরিহার ভয়ের কারণটা কি। ইহান শান্ত কন্ঠে বলে,
— তুমি এই দুনিয়ার বেস্ট মা হবে বুঝলে। কারণ জানো কি? যে ছোট থেকে যেইসব কষ্ট পেয়ে আসে সে কখনোই অন্যকে সেইসব কষ্ট দিতে পারে না। তুমি আর আমি জানি বাবা-মার ভালবাসা না পেলে কেমন লাগে। তো আমরা কখনোই নিজের সন্তানকে সেই ভালবাসা থেকে বঞ্চিত করতে পারবো না। বরং সবসময় ওকে ভালবাসায় ভরিয়ে রাখবো।
আরিহা তাও ফুঁপিয়ে চলেছে। ইহান এইবার চিন্তিত কন্ঠে বলে,
— আবার কি হলো? কান্না করছো কেন?
আরিহা কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে,
— আমার যদি মেয়ে হয়? আমি মেয়ে চাই না ইহান। চাই না! ওকে ওইসব নরপশুদের শিকার বানাতে চাই না। আমি যা সহ্য করেছি ওকে ওইসব সহ্য করতে দিতে পারি না।
ইহান এইবার ধমক দিয়ে বলে,
— সবসময় বাজে চিন্তা। তোমার এমন কেন মনে হয় যে, সবসময় খারাপই হবে? ভালোও হতে পারে। আর দেখবে সব ভালোই হবে।
আরিহা নিজের কান্না মুছে শান্ত কন্ঠে বলে,
— যার সাথে শুরু থেকেই খারাপ হয়ে আসছে সে কিভাবে পরবর্তীতে ভালো আশা করতে পারে? যার জীবনে কষ্ট, বেদনা,তিক্ততা বাদে কিছুই নেই সে কিভাবে সুখ কামনা করতে পারে।
ইহান আরিহার দুই গালে হাত রেখে বলে,
— একই পয়সার এপিঠ ওপিঠ কিন্তু কখনোই এক হয় না। দুইটি ভিন্ন সত্তা বহন করে। তেমনই জীবনেরও দুইটি দিক আছে। একদিকে থাকে কষ্ট,দুঃখ আরেকদিকে থাকে সুখ। জীবনের যাত্রায় কখনো কখনো কষ্টের পাল্লা ভারি হয় তো কখনো সুখের। কিন্তু এইটা আশা করা একদমই বোকামি যে যার জীবনে শুরু থেকে কষ্টের পাল্লা ভারি হয়ে এসেছে তার জীবনের সুখের পাল্লা কখনোই ভারি হবে না।
আচ্ছা তুমি কি এখন খুশি না? আমার সাথে কি তুমি সুখী না?
আরিহা হাল্কা হেসে কিছু না বলে ইহানকে জড়িয়ে ধরে আর ইহান তার উত্তরটা পেয়ে যায়। ইহান আরিহাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
— খারাপ চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। ইনশাল্লাহ যা হবে ভালোই হবে।
আরিহা মনে মনে বলে,
— থেংক্স ফোর কামিং ইন মাই লাইফ।
?
টেস্ট করিয়ে ডাক্তার দেখানোর পর ডাক্তার কনফার্ম করে যে আরিহা প্রেগন্যান্ট। তাই তো ইহান এই খুশিতে একটা অনুষ্ঠান আয়োজন করে। কিন্তু এই অনুষ্ঠানটা শুধু নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাইরের কেউ এইখানে আমন্ত্রিত না। নিজেদের মধ্যে বলতে তীব্র, সোহেল, নীরা, পুষ্পিতা, রাহুল আর অর্পি এ সকলকে বুঝানো হয়েছে। রাহুল আর অর্পি গতকাল রাতেই হানিমুন থেকে ফিরেছে তাই আজ তারা এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পেরেছে।
সকলেই এসে পড়েছে। অনুষ্ঠানটা ছাদে আয়োজন করা হয়েছে। চারদিকটা ফেরি লাইটের আলোয় ঝিকিমিকি করছে। ছাদের এক পাশে বুফে পদ্ধতিতে খাবারগুলো পরিবেষণ করা হয়েছে। এক কোন ফুটে উঠেছে লাল রক্ত গোলাপ। তার পাশেই ফুটে উঠেছে গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা। বেলি ফুলের গন্ধে চারদিকটা “ম ম” করছে। উত্তরা বাতাস বইছে। হিম শীতল পরিবেশ। উপস্থিত সকলেই পরিবেশটা উপভোগ করছে। সাথে আরিহা আর ইহানের আসার অপেক্ষাও করছে। হুট করে সকলের দৃষ্টি দরজার দিকে যায়। সকলেই সেইদিকে তাকিয়ে শকড হয়ে যায়। স্থির হয়ে যায় সকলের দৃষ্টি। বিশেষ করে জিসানের। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করাতে পারছে না। হুট করেই জিসানের চোখ ছলছল করে উঠে।
#চলবে