অন্তরালে তুমি পর্ব-২৯

0
2665

#অন্তরালে_তুমি
#Part_29
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
?
সকলের দৃষ্টি দরজার দিকে যেতেই সকলেই শকড হয়ে যায়। দরজার দিকে স্থির হয়ে যায় সকলের দৃষ্টি। বিশেষ করে জিসানের। নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করাতে পারছে না। হুট করেই জিসানের চোখ ছলছল করে উঠে। দরজার সামনে আরিহা দাঁড়িয়ে আছে তার পাশেই জিসান। বিষয়টা স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও এর মধ্যে এক অস্বাভাবিক বিষয় বিদ্যমান। কারণ আজ আরিহার পরিধানে রঙহীন পোশাক নয় বরং শীতল এক রঙে রঙিত পোশাক। আরিহার পরনে আজ হাল্কা নীল রঙের একটি কামিজ। কামিজের মধ্যে ছোট ছোট সাদা পাথর দিয়ে সুরু কাজ কাজ করা। চুল গুলো এক পাশে সিধি কেটে উন্মুক্ত বাতাসে দোল খাওয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁটে হাল্কা গোলাপি রঙের লিপস্টিক। এর বাহিরে মুখে বাহ্যিক কোন সাজসজ্জা নেই। ঠোঁটের কোনে ঝুলে থাকা মিষ্টি হাসিটা যেন আজ সকলের চোখে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর মধ্যে শুধু মাত্র দুইজনের কাছে আরিহার হাসিটা ভিন্ন। সেই দুইজন হচ্ছে ইহান আর জিসান। ইহানের কাছে আরিহার হাসিটা কাব্যে লেখিত সেই সর্বনাশী হাসির মত আর জিসানের কাছে মায়াভরা এক মিষ্টি হাসি। দুইজনের দৃষ্টি ভঙ্গি আলাদা কিন্তু প্রেক্ষাপট এক।

জিসান আজ প্রায় ১২ বছর পর আরিহাকে রঙের আবরণে রঙিত হতে দেখেছে। সেই ছোট আরিহার হারিয়া যাওয়া মিষ্টি হাসিটি দেখতে পারচ্ছে। সেই কলঙ্কিত অধ্যায়ের আগমনের পর যখন আরিহা কিছুটা স্বাভাবিক হয় তখন থেকেই সে নিজেকে এবং নিজের জীবনকে বেরঙের বেরাজালে আটকে ফেলে। নিজের জীবনের সকল রঙহীন করে ফেলে। টিনএজ বয়সেই আরিহা হয়ে উঠে অতি বুদ্ধিমতি আর শান্ত প্রকৃতির। যেসময় ওর বয়সী মেয়েরা বিভিন্ন ধরনের কল্পনা-জল্পনা নিয়ে আর নিজের সেই বানানো কাল্পনিক রাজ্যে রাজত্ব করতে ব্যস্ত তখন আরিহা নিজেকে চারদেয়ালে বন্দী করতে ব্যস্ত। যে সময় ওর বয়সী মেয়েরা নিজের শখ আহ্লাদ পূরণ করতে ব্যস্ত তখন আরিহা নিজের দায়িত্ব নিজে নিতে ব্যস্ত। যেই বয়সে সকল মেয়েদের আবেগ নিয়ন্ত্রিত করে ফেলে সেখানে আরিহা ছিল অনুভূতিহীন। আরিহার জীবন বাকি ৮-১০ টা মেয়ের মত কাটে নি বরং তিক্ত ঘেরা এক নিস্তব্ধতায় কেটেছে। যার ফলে হারিয়ে যায় আরিহার সেই মিষ্টি হাসিটি। কিন্তু আজ সেই হারিয়ে যাওয়া হাসিটিই জিসান আরিহার মধ্যে দেখছে। নিজের মনের মধ্যে বয়ে চলছে হাল্কা শীতল বায়ু। আজ জিসান সত্যি স্বার্থক। ইহানের প্রতি তার বিশ্বাসটি ভুল ছিল না তা ইহান আজ সম্পূর্ণ রুপে প্রমানিত করে দিয়েছে।

ইহান আরিহার বা হাতটি ধরে সকলের মাঝে নিয়ে আসে। সকলের মাঝেই বিষ্ময়কর ভাব বিরাজমান সাথেই কৌতূহলও। কেন না এইখানে অবস্থিত সকলেই আরিহাকে সাদা রঙটি বাদে অন্য কোন রঙ পরিধান করতে দেখে নি। পুষ্পিতা আর নীরার চোখে বিষ্ময়কর ভাব হলেও ঠোঁটের কোনে ঝুলছে মিষ্টি হাসি। আরিহাকে এইভাবে দেখে তাদের নিজেরও বেশ ভালো লাগছে। জিসান নিজের চোখের কোনে জমে থাকা পানিটুকু সকলের আড়ালে মুছে নিয়ে দুষ্টুম সুরে বলে,

— কি গো সতীন মশাই এই অসম্ভব কাজকে কিভাবে সম্ভব করিলা? অনন্ত জলিলের আত্মা আবার এসে ভর করে নি তো তোমার উপর?

তখন পাশ থেকে নীরা বিভ্রান্তি সুরে বলে,
— অনন্ত জলিল মারা কবে গেল? মারা গেল তো গেল তার আত্না যে মানুষের উপর ভর করে তা আপনি কিভাবে জানলেন?

নীরার এমন কথায় সবাই হু হু করে আর জিসান আড়চোখে নীরার দিকে তাকায়। এই মেয়েটা সবসময়ে ওর প্রেস্টিজের রফাদফা করে। এইদিকে নীরা এখনও বিভ্রান্তিমূলক চাহনিতে সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। পুষ্পিতা পাশ থেকে নীরার বা হাতে চিমটি কেটে চুপ করতে বলে। পুষ্পিতা এইবার একটু সুর তুলে বলে,

— কি গো ভাইয়া আমাদের ভোলা-ভালা বোনটার উপর কি যাদু- টোনা করলেন বলুন তো? এতটা বছর ধরে ওর কানের সামনে ঘ্যানঘ্যান করে ওর কানের পোকা মেরে ফেললাম অথচ আমাদের কথায় গায়েই মাখে নি এই বেয়াদব মাইয়া। আর আজকে জামাই এর এক কথায় রঙে রঙিন হয়ে সং সেজে হাজির। বাহ! এইটা নিশ্চয়ই যাদু-টোনা ছাড়া সম্ভব না।

তীব্র এইবার গানের সুর তুলে বলে,
— কি যাদু করেছ বলো না…
ঘরে আর থাকা যে হলো না…

পাশ দিয়ে রাহুল আরেক গানের সুর তুলে ধরে,
— কি যাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা..
থাকিতে পারি না ঘরেতে…

সোহেলও অন্য গানের সুর তুলেধরে,
— কি যাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে..

সব দেখে জিসান বাচ্চাদের মত ঠোঁট উল্টিয়ে বলে,
— ভাই তোমরা সবাই তো সব গান বলে ফেললা আমার জন্য একখানি রাখলাও না। আমি এখন কি গান গাইতাম?

সবাই এইবার হো হো করে উঠে। ইহান হাসতে হাসতে বলে,
— সব কয়টা একেকটা বাদর হয়েছিস। উফ! তোরা পারিসও বোটে।

তীব্র ভাব নিয়ে বলে,
— কার বন্ধু দেখতে হবে না? কথায় আছে না, “সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”

সোহেলও গলা ঝেড়ে তাল মিলিয়ে বলে,
— বাদরই আসল বাদরদের চিনে।

ইহান একটু চেঁচিয়ে বলে,
— তবে রেএএএ!!

সকলে আবার একই সাথে হেসে উঠে। আরিহা এতক্ষণ শান্ত চোখে ওদের দিকে সবকিছু বেশ উপভোগ করছিল। বেশ ভালোই লাগছিল ওর। ঠোঁটে তার মিষ্টি হাসি। আজ সত্যি তার জীবনে রঙের মিষ্টি আবরণ ছেয়ে গিয়েছে।
পুষ্পিতা এইবার মিষ্টি সুরে বলে,

— ভাইয়া সত্যি কিভাবে করলেন এইসব? ও তো সহজে রাজী হওয়ার পাত্রী না।

ইহান স্মিত হেসে বলে,
— শালিকা সাহেবা ওকে কঠিন ভাবেও রাজী হওয়ার পাত্রী না। এই কর্ম করিতে আমার যে কি পরিমাণ কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে তা শুধু আমিই জানি। এত কাঠখড় আমি আমার পুরো জীবনে পুড়াই নি।

আরিহা এইবার কিছুটা গম্ভীর সুরে বলে,
— তাহলে এখনই যাই আবার চেঞ্জ করে আসি?

এই কথা সকলের কানে পৌঁছাতে দেরি হলেও সকলের প্রতিক্রিয়া দিতে না। সকলেই একসাথে চেঁচিয়ে উঠে,
— নায়ায়ায়ায়ায়া!!

আরিহা দ্রুত নিজের কানে হাত দিয়ে রেখে বলে,
— আরেহ! আমি কি এখন একটু মজাও করতে পারবো না?

আরিহার কথা শুনে সকলেই এইবার স্বস্থির নিঃশ্বাস নেয়। ইহান নিজের বুকে হাত দিয়ে বলে,
— তোমার এই মজা আমার হার্ট ফেল করাতো। একটুর জন্যই এই ফিল হতে নিয়েছিল যে,
“গায়ি ভেস পানি ম্যায়।”

ইহানের কথায় সকলেই হু হু করে হেসে দেয়। অতঃপর হাসি মজা শেষে সকলে আরিহাকে অভিনন্দন জানায় আর তাদের আনা উপহারগুলো আরিহাকে দেয়।

?

চারদিকে হিম শীতল বায়ু বইছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে অলস ভঙ্গিতে গাছে পাতা দোল খেয়ে চলেছে। তারা বিহীন আকাশ আজ। দূর আকাশে চাঁদের সরু অবয়ব দেখা যাচ্ছে। আজ চাঁদটা আবছা প্রকৃতি। তার আকৃতি সকলের কাছে স্পষ্ট না হলেও বেশ শোভনীয় লাগছে। মেঘগুলো দল বাঁধিয়ে ভেসে চলেছে দূর-দূরান্তে। ছাদের একটি কোনে ফুটে উঠেছে বেলি ফুলের কচি ফুল গুলো। চারদিকে নিজের ঘ্রাণ ছড়িয়ে দিয়ে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে সে। সুইপিমিং পুলের ডান পাশে ইহান জোরপূর্বক আরিহাকে খাওয়াচ্ছে। আরিহার মধ্যে খাওয়ার কোন ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও ইহানের জোড়াজুড়ি সব সাবার করতে হচ্ছে। ছাদের এক কোনে অর্পি দাঁড়িয়ে আছে আর রাহুল ওর ছবি তুলে দিচ্ছে। অন্যপাশে তীব্র আর পুষ্পিতা খুনসুটিতে মেতে উঠেছে। দরজার এক কোনে দাঁড়িয়ে সোহেল কথা বলছে তার প্রিয়তমার সাথে। অন্য এক পাশে জিসান আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবলেশহীন দেখাচ্ছে তাকে। এমন সময় কোথ থেকে নীরা এসে ওর পাশে দাঁড়ায়। নিজের পাশের কাউরো অস্তিত্ব অনুভব করতে পেড়ে আড়চোখে নীরাকে দেখতে পেয়ে চোখ সরিয়ে নেয় সে। নীরা তা দেখে কিছুটা সাহস সংচয় করে বলে উঠে,

— আপনাকে কিছু বলার ছিল আমার।

জিসান ভাবলেশহীন হয়ে বলে,
— বলো।

নীরা এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
— আমি আপনাকে ভালবাসি।

#চলবে