অন্তরালে তুমি পর্ব-৩০

0
2871

#অন্তরালে_তুমি
#Part_30
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
?
— আমি আপনাকে ভালবাসি।

কথাটা জিসানের কান বরাবর পৌঁছানোর সাথে সাথে জিসান ঘাড় ঘুরিয়ে নীরার দিকে তাকায়। চোখে মুখে তার বিস্ময়কর ভাব। নীরা মাথা নিচু করে ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটি দিয়ে মাটি ঘেষেই চলেছে। নার্ভাসনেস কমাতে দুই হাত কচলাচ্ছে বার বার। নীরার এমন নার্ভাসনেস দেখে জিসান নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে তুলে। তারপর শান্ত কন্ঠে বলে,

— তুমি যা বলছো তা বুঝে বলছো তো?

জিসানের প্রশ্নে নীরা মাথা তুলে উপরে তাকায়। অসহায় চাহনিতে জিসানের দিকে তাকায়। জিসানকে এই কথাটা বলতে নীরার এতদিন একটু একটু করে সাহস জুগিয়েছিল। আর আজ সুযোগ বুঝে বলে দেয়। কিন্তু এখন জিসানের এমন প্রশ্নে সে থমথম খেয়ে যায়। কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। জিসান এখনো স্থির চোখে নীরার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ সে নীরাকে নিখুঁত ভাবে দেখছে। পড়নে গাড় খয়েরী রঙের কামিজ। লম্বা চুল গুলো এক পাশে এনে বেনুনী করা। চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা। শীতের আভায় তার ফর্সা গালগুলো একদম লাল হয়ে আছে। মুখখানিটা থেকে মায়াবতী মায়াবতী একটা ভাব আসছে। জিসানের মনেও আজ ভালো লাগার ঢেউ খেলে যায়। সে হাল্কা হেসে বলে,

— কি হলো বল?

নীরা একটু নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে বলে,
— ভালবাসার কথা কি কেউ বুঝে বলে? এইটা তো একটা অনুভূতি যেটা অনুভব করার সাথে সাথে বলা দেওয়াটা শ্রে।

নীরার এমন সোজাসাপটা উত্তরে জিসান হাল্কা হাসে। মেয়েটা বড্ড সহজসরল। জিসান ঠোঁটের কোনে একটা হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলে,
— যদি তোমার ভালবাসাটা গ্রহণ না করি তখন?

জিসানের কথাটা নীরার বুকে তীরের মত বিঁধে। সে আহত চোখে জিসানের দিকে তাকিয়ে ধরা কন্ঠে বলে,
— ভাববো আমার ভাগ্যে আপনি কখনো ছিলেনই না।

জিসান এইবার ঘাড় ঘুড়িয়ে আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর শান্ত কন্ঠে বলে,
— নিজের দায়ভার নিজে বয়ে বেরাতে বেরাতে আমি এখন বড্ড ক্লান্ত। নিজেকে সামলানো দুষ্কর হয়ে উঠেছে আমার জন্য। ছন্দহীন হয়ে যাচ্ছি আমি।
তাই এখন আমার এমন একজনকে চাই যে আমাকে সামলে নিবে, আমার দায়ভার গুলোর মধ্যে ভাগ বসাবে, আমাকে ছন্দের তালে নিয়ে আসবে। আর আজ হয়তো আমি তেমনই একজনকে পেয়ে গিয়েছি।

নীরা প্রশ্নবোধক চাহনিতে জিসানের দিকে তাকায়। জিসান নীরার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দিয়ে বলে,
— ভালবাসার প্রস্তাব তুমি রেখেছ আর বিয়ের প্রস্তাব রাখছি আমি। মানে সহজসাপটা ভাষায় বলছি, “উইল ইউ মেরি মি?”

কথাটা শুনেই নীরা স্তব্ধ হয়ে যায়। অবিশ্বাস্য চোখে জিসানের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে এমনটা কখনো আশা করে নি। জিসান নীরার বিস্ময়কর ভাব বুঝতে পেরে হাতটা বাড়িয়ে দেয়। নীরা তা দেখে কতক্ষণ স্থির হয়ে থাকে অতঃপর হাতটা ধরে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
— ইয়েস আই উইল!

জিসান কিছু বলতে যাবে তার আগেই চারপাশ থেকে হৈ হুল্লোড়ের শব্দ কানে ভেসে আসে। জিসান চারদিকে তাকিয়ে দেখে সকলেই ওদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সকলের মুখেই খুশির ছাপ স্পষ্ট। জিসান এইবার মাথা চুলকিয়ে বলে,
— কি হলো!

সবাই চেঁচিয়ে বলে,
— জিসান আর নীরার বিয়ে হলো।

এই বলে সকলেই হৈ হুল্লোড়ে মেতে উঠে।

_________________________________________________

আরিহা ইহানের বুকে মাথা রেখে চুপটি মেরে শুয়ে আছে। ইহান আরিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দুইজনের মধ্যেই পিনপিন নিরবতা। এই নিরবতা পেরিয়ে ইহান বলে উঠে,

— অবশেষে সকলেই সকলের ভালবাসা পেল। তাই না! তোমার আর আমার সাথে সাথে এখন সকলের ভালবাসাও পূর্ণতা পাবে।

আরিহা মলিন হেসে বলে,
— অনেক সময় অনেক কিছু পূর্ণতা পেয়েও অপূর্ণ রয়ে যায়। আর সেটি অপূর্ণতায় পূর্ণতা পায়।

ইহান কিছুটা বিস্ময়কর ভাব নিয়ে বলে,
— সবসময় এমন ডাবল মিনিং কথা কেন বলো হ্যাঁ? সত্যিকার অর্থে কোনটা বুঝাতে চাও তাই বুঝা দুষ্কর হয়ে উঠে।

আরিহা মুচকি হেসে বলে,
— সময় মানুষকে সব বুঝিয়ে দেয়। আমার এই কথাগুলোর আসল মানে এখন না বুঝলেও পরে একটা সময় ঠিকই বুঝবে৷

ইহান কৌতূহলী কন্ঠে বলে,
— মানে?

আরিহা কথাটা ঘুরানোর জন্য বলে,
— বাকি রিপোর্টগুলো কবে আসবে?

ইহান কিছুটা ভেবেচিন্তে বলে,
— পরশু আসবে। তারপর সেই রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তার এর কাছে যেতে হবে। আমি বুঝি না ডক্টর তোমার প্রেগন্যান্সির টেস্ট করানোর পরও আবার এতটি টেস্ট কেন দিল?

আরিহা শান্ত কন্ঠে বলে,
— রিপোর্ট আসলেই জানতে পারবে। আপাতত আর কথা বলো না প্লিজ। মাথাটা প্রচন্ড পেইন করছে একটু হাত বুলিয়ে দাও।

ইহান কিছু না বলে আরিহার কপালে ভালবাসার এক স্পর্শ একে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

?

পড়ন্ত বিকেলের শেষ প্রহর। আকাশটা আজ কালো মেঘের আবরণে ঘেরা। বাইরে শো শো করে বাতাস বইছে। গাছের শুকনো ডালগুলো একে অপরের বারি খাচ্ছে। রাস্তায় মানুষের আনাগনা বেশ কমে এসেছে। কিন্তু যানবাহনগুলো ঠিকই শা শা শব্দ করে ছুটে চলে দূর-দূরান্তে। তার সাথে সাথে ধুলোবালিগুলো বাতাসের সাথে মিশে গোধুলির রুপ দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। রাস্তার পাশে কিছু পথিক শিশু শীতল বায়ুর ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কুকুরটাও যেন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। শীতের প্রকোপ যে সকলের মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছে তা বেশ বুঝা যাচ্ছে। বেশকিছু ক্ষণ পরে একটা সাদা গাড়ি এসে থামলো ধানমন্ডির একটি নাম করা হাসপাতাল “ইবনে সিনার” সামনে। গাড়িটি থেকে বেড়িয়ে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত চেহেরা গুলো।

ইহান আর আরিহা রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে ডাক্তারের কেবিনের বাইরে বসে আছে। আরিহা চারদিকটা খেয়াল করছে। তার থেকে দুই হাত দূরে একটা মহিলা বসে আছে। দেখেই মনে হচ্ছে ৭-৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তার পাশেই একজন পুরুষ বসে আছে। সে বার বার সেই মহিলাটাকে জিজ্ঞেস করছে তার কিছু লাগবে কিনা। বুঝতে দেরি নেই যে সেই পুরুষটা তার স্বামী। আরিহার বরাবরই একজন মহিলা ৬-৭ মাসের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে আছে। তাকে কোলে নিয়ে ঝুলাচ্ছে আর এইটা সেটা বলছে। কিছুক্ষণ পরেই মহিলাটার স্বামী এসে বাচ্চাটা কোলে নেয় আর খেলা করতে থাকে।
আরিহা সেইদিকে কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। নিজের সিরিয়াল নাম্বার আসতেই ইহান ওকে তাড়া দিল ভিতরে যাওয়া জন্য। আরিহা এইবার সেইদিক থেকে চোখ সরিয়ে অগ্রসর হয় ডাক্তারের কেবিনের দিকে।

___________________________________________________

ডাক্তার বেশ গুরুগম্ভীর হয়ে বসে আছেন। কপালে তার চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। তার চেহেরা দেখে মনে হচ্ছে যেন তিনি অপ্রত্যাশিত কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ডাক্তার কিছুক্ষণ স্থির থেকে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলেন,

— রিপোর্ট দেখে যা বুঝতে পারছি আরিহার প্রেগন্যান্সির মধ্যে অনেক কমপ্লিকেশন আছে। কারণ রক্তের চলাচল একদমই স্বাভাবিক নয়। উনার রক্ত চলাচল হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় তো কখনো ওভার ফ্লো করতে শুরু করে। যা তার প্রেগন্যান্সির জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। আমি যতটুকু ধারণা করতে পারছি যে উনার হয়তো বা শরীরের কোন অংশে ডিভিটি বা ব্লাড ক্লোট আছে। সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে তার ধমনির কোন একটা অংশে জমাট বেঁধে গিয়েছে। যার ফলে তার রক্ত স্বাভাবিক চলাচলে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। সরি টু সে বাট যদি এমনই চলতে থাকে আমার মনে হয় না তার গর্ভে থাকা বাচ্চাটি বেশিদিন বাঁচবে। ইট উইল সুন কোস এ মিসকেরাজ। আর যদি এমনটা হয় তাহলে হয়তো পেশেন্টকেও বাঁচানো আমাদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে পড়বে।

#চলবে