#অন্তরালে_তুমি
#Part_31
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
?
ডাক্তার বেশ গুরুগম্ভীর হয়ে বসে আছেন। কপালে তার চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। তার চেহেরা দেখে মনে হচ্ছে যেন তিনি অপ্রত্যাশিত কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ডাক্তার কিছুক্ষণ স্থির থেকে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলেন,
— রিপোর্ট দেখে যা বুঝতে পারছি আরিহার প্রেগন্যান্সির মধ্যে অনেক কমপ্লিকেশন আছে। কারণ রক্তের চলাচল একদমই স্বাভাবিক নয়। উনার রক্ত চলাচল হুট করে বন্ধ হয়ে যায় তো কখনো ওভার ফ্লো করতে শুরু করে। আমি যতটুকু ধারণা করতে পারছি যে উনার হয়তো বা শরীরের কোন অংশে ব্লাড ক্লোট আছে। সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে তার ধমনির কোন একটা অংশে জমাট বেঁধে গিয়েছে। যার ফলে তার রক্ত স্বাভাবিক চলাচলে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। সরি টু সে বাট যদি এমনই চলতে থাকে আমার মনে হয় না তার গর্ভে থাকা বাচ্চাটি বেশিদিন বাঁচবে। ইট উইল সুন কোস এ মিসকেরাজ। আর যদি এমনটা হয় তাহলে হয়তো পেশেন্টকেও বাঁচানো আমাদের পক্ষে দুষ্কর হয়ে পড়বে।
কথাগুলো যেন ইহানের কানে ঝংকারের মত বেজে উঠে। ক্ষণে ক্ষণে মাথায় টনক খেলে যাচ্ছে যে আরিহা আর তার বাচ্চা সুরক্ষিত না। তারা মৃত্যুর পথে ধীর গতিতে এগুচ্ছে। এইটা ভাবতেই এক চাপা আর্তনাদ বেড়িয়ে আসছে ওর বুক চিরে। নিজের বোধ শক্তি ধীরে ধীরে লোভ পাচ্ছে। হৃদয়টা যেন চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। সে ছলছল চোখে একবার ডাক্তারের দিকে তাকায় তারপর চোখ তার থেকে ঘুরিয়ে আরিহার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকায়। আরিহার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। সে আগের ন্যায় সর্বশান্ত। শুধু দুইহাত দিয়ে নিজের পেট চেপে ধরে আছে সে। আরিহা আকার ভঙ্গিতে কিছু প্রকাশ না করলেও তার সেই হাতদুটোই আরিহার মনের অবস্থা বুঝিয়ে দিচ্ছে। ইহান এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে ধরা কন্ঠে বলে,
— হঠাৎ করে এমন একটা সমস্যা কেন হলো?
ডাক্তার তা শুনে এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলেন,
— তার যে সমস্যাটা সেটা হলো ব্লাড ক্লোট/রক্ত জমাট বাধা। ব্লাড ক্লোট শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হতে পারে। ব্লাড ক্লোট কিছু স্পেসিফিক কারণে হয়ে থাকে। যেমন লং টাইম জার্নি করা, অতি ছোট বয়সে কোন বড় ধরনের ট্রোমার মধ্য দিয়ে যাওয়া, ডিপ্রেশন, অতিরিক্ত পরিমাণে চিন্তা করা, কোন বড় ধরনের অপারেশন, দীর্ঘসময় ধরে বার্থ কান্ট্রোল পিল সেবন করা, ক্যান্সারে আক্রান্ত, হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, ব্রেস্ট ক্যান্সারের ওষুধ সেবন। মাঝে মাঝে পরিবারের মেডিকেলহিস্ট্রির ওপর ভিত্তি করেও হতে পারে। অর্থাৎ, বংশগতও বলতে পারেন। পরিবারে আগে কারো হয়ে থাকলে পরবর্তীতে অন্যকারো হওয়ার সম্ভবনাটা বেশি থাকে।
কিন্তু এর লক্ষণ গুলো অতিসাধারণ। তাই মানুষ ব্যাপারটাকে তেমন আমলে নেন না। এমনও হতে পারে আগে থেকেই উনার ব্লাড ক্লোট ছিলো কিন্তু বুঝতে পারেন নি।
ইহান কিছুটা কৌতূহলী সুরে বলে,
— এর লক্ষণ গুলো কি কি ডাক্তার?
ডাক্তার টেবিল থেকে পানিভর্তি গ্লাসটা হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দেন। নিজের গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে একটু শান্ত হয়ে বসেন। হাতের গ্লাসটা টেবিলে রেখে ধীর গলায় বললেন,
— ব্লাড কোথায় অবস্থিত তার উপর নির্ভর করে লক্ষণগুলি পৃথক। যদি জমাটি আপনার বাহুতে বা পায়ে থাকে তবে আপনি ব্যথা অনুভব করতে পারেন (এটি একটি তীব্র ক্র্যাম্পের মতো মনে হয়), ফোলাভাব এবং কোমলতা অনুভব করতে পারে। ক্লটটি যেখানে অবস্থিত সেখানে আপনার স্পর্শটি লাল এবং উষ্ণ হতে পারে। ব্লাড ক্লোট যদি আপনার পেটে থাকে তবে আপনি পেটের তীব্র ব্যথা, বমি বমিভাব এবং ডায়রিয়ার অভিজ্ঞতা পেতে পারেন। আপনার হৃদয়ে ভ্রমণকারী ব্লাড ক্লোটগুলি আপনার বুকে ভারী অনুভূতি বা ব্যথা, আপনার ওপরের শরীরে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, ঘাম, বমি বমি ভাব এবং হালকা মাথাব্যথার কারণ হয়ে থাকে। যদি ব্লাড ক্লোট আপনার ফুসফুসে চলে যায়, আপনি বুকের তীব্র ব্যথা, রেসিং হার্ট, শ্বাসকষ্ট, ঘাম এবং জ্বর অনুভব করতে পারেন। আপনি রক্ত কাশি হতে পারে। মস্তিষ্কে ব্লাড ক্লোট যদি হয়ে থাকে তাহলে এর কারণে মাথা ব্যাথা, শরীরের দুর্বলতা, চোখে বেশি দেখা নয়তো কম দেখা, শরীরের অসাড়তা, কথা বলা অথবা মনোযোগ দেওয়ায় সমস্যা ইত্যাদি। তা আপনার এইসবের মধ্যে কোন প্রবলেম গুলো বেশি করতো মিসেস আরিহা।
আরিহা এতক্ষণ মাথা নিচু করে বসে ছিল। ডাক্তারের কথা শুনে সে মুখ তুলে তাকায়। কিন্তু কিছু বলে না। তা দেখে ইহান আরিহার কাধে হাত রেখে তাকে চোখের ইশারায় রিকুয়েষ্ট করে বলতে। আরিহার ইহানের কথাটা ফেলতে পারে নি। তাই সে এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে,
— শেষের লক্ষণগুলো আমার মধ্যে আমি পেয়েছি ডক্টর। যেমন মাথা ব্যাথা, শরীরের দুর্বলতা, চোখে বেশি দেখা নয়তো কম দেখা, শরীরের অসাড়তা, কথা বলা অথবা মনোযোগ দেওয়ায় সমস্যা এইগুলা আমার প্রায় ২ বছর ধরে আমার মধ্যে লক্ষিত। আমার প্রেশার লো বিধায় আমি এইগুলো এইটারই ইফেক্ট ভাবতাম।
ডাক্তার এই চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠেন,
— অহ নো! দিস কেস ইজ বিকামিং মোর কমপ্লিকেডেট। যদি আপনি সত্যি বলে থাকেন তাহলে আমার ধারণা অনুযায়ী ব্লাড ক্লোটটা আপনার ব্রেইনে অবস্থিত। সকল জায়গায় ব্লাড ক্লোটটা এতটা ইফেক্ট করে না যতটা নাকি ব্রেইনের ক্লোটটা ইফেক্ট করে। ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া দ্যাট ইন ইউর প্রেগন্যান্সি ইউ হ্যাভ টি ফেস সো মাচ কমপ্লিকেশন।
আরিহা শান্ত কন্ঠে বলে,
— আমার জীবনে কখনোই কোন কিছু সহজ ছিল না ডাক্তার। মাই লাইফ ওয়াস ফুল অফ কমপ্লিকেশন। আমার জীবনে এমন একটা সময় ছিল না যেখানে কমপ্লিকেশন শব্দটা ছিল। তাই সেটা নিয়ে কথা না বাড়িয়ে প্রসেসগুলো বলুন।
ডাক্তার এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলেন,
— আগে আপনাকে একটা ডিসিশন নিতে হবে। সেই ডিসিশনের উপর ডিপেন্ড করে নেক্সট প্রসেস কি হবে।
আরিহা আর ইহান একই সাথে বলে উঠে,
— কি?
ডাক্তার একটু নড়েচড়ে বসে বলে,
— আপনারা কি বেবিটা রাখতে চান নাকি না? যদি বেবি না চান তাহলে যতদ্রুত সম্ভব এবোর্শন করাতে হবে তারপর চিকিৎসা শুরু করা হবে। আর যদি বেবিটা চান তাহলে আগে কিছু পরিক্ষা করাতে হবে তারপর চিকিৎসা শুরু করা হবে। আই হাইলি রিকামেন্ড ইউ সুড এবোর্ট দিস চাইল্ড।
কথাটা কানে আসতেই আরিহা রেগে যায়। চোখগুলো লাল হয়ে আসে। রাগে গা রি রি করে কাঁপতে থাকে। সে চোয়াল শক্ত করে বলে,
— একজন রক্ষক হয়ে ভক্ষকের মত কথা আপনার মুখে শোভা পায় না ডাক্তার। তাই বুঝে শুনে কথা বলুন। এমন কথা দ্বিতীয় বার মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলে খুব ভয়ংকর কিছু হবে বলে আশ্বস্ত করছি আপনাকে। আর আশা করি আমার উত্তরটা আপনি পেয়ে গিয়েছেন।
আরিহার এমন থ্রেড ভরা কন্ঠে ডাক্তার কিছুটা নড়েচড়ে বসে। কপালের তার বিন্দু বিন্দু ঘাম। আরিহার সম্পর্কে সে হাল্কা পাতলা জানে। আফটার অল ঢাকার ওয়ান ওফ দি বেস্ট ডিজাইনার বলে কথা। সাথে আরিহার রাগের কথাও শুনেছে। ডাক্তার টেবিল থেকে বাকি অর্ধেক পান করা পানির গ্লাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পানিটুকু খেয়ে ফেলে। তারপর এক লম্বা শ্বাস নিয়ে বলে,
— প্রেগন্যান্সির মধ্যে ক্লোটটা সহজতর ভাবে দেখা দেয় না। স্পেশিয়ালি ব্রেইন ক্লোটটা। আপনার কেসটা প্রচন্ড রেয়ার। তাই আপনাকে আমরা স্পেশাল ভাবে ট্রিট করবো। প্রেগন্যান্সির সময় ক্লোটটি বাচ্চার ক্ষতি করে না কিন্তু সেটা অবস্থা জটিল না হলে। এখন আপনারটা কেমন বলতে পারছি না।
তাই আপনাকে কিছু টেস্ট করাতে হবে। আপনার ক্লোটের আসল অবস্থান না জানা পর্যন্ত কোনকিছু করাই সম্ভব না। সাথে বুঝতে পারবো আসলে কেসটা কতটা জটিল। আমি টেস্ট গুলো লিখে দিচ্ছি যতদ্রুত সম্ভব করিয়ে নেন।
___________________________________________________
সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসে জিসান। একটু আগেই ইহানের মুখে সব শুনেছে সে। জিসানের চোখ দুটো ছলছল করছে। মনের মধ্যে এক ঝড় বইছে। এমন একটা নিউজ শুনে সে নিজেই এমন ভেঙ্গেচুরে পড়েছে না জানি আরিহা আর ইহান ঠিক কি পরিমাণ ভেঙ্গে পড়েছে। তাদের মনের অবস্থা ঠিক কতটা করুণ তা হয়তো জিসানের ধারণার বাইরে। জিসান বার বার আল্লাহ এর কাছে বিচার দিচ্ছে কেন সে আরিহার সাথে এমন করলো। মেয়েটা শুরু থেকে কষ্টই পেয়ে এসেছে। কষ্ট, বেদনা বাদে কিছু পায় নি সে। যেই না মাত্র নিজের সুখ খুঁজে নিয়ে খুশির আবরণে নিজেকে ঢাকতে নিল তখনই আবার ওর জীবনে কষ্ট নামক বস্তুটা আবার বাঁধা হয়ে গেল। কেন? ওর সাথেই এমন কেন হবে? আরিহা কি সুখী হওয়ার যোগ্য না? কি দোষ ওর?
জিসান আরিহার অবস্থার জন্য নিজেকে দ্বায়ী মানছে। সে আরিহার ভালো মত খেয়াল রাখে নি বিধায় এমন হয়েছে। সে নিজে একজন ডাক্তার হয়ে কিভাবে আরিহার সিম্পটমস গুলো ফলো করলো না। কিভাবে বুঝতে পারলো না আরিহা অসুস্থ। অনুতাপের আগুনে জ্বলে পুড়ছে সে। জিসান মাথা তুলে আরিহার দিকে তাকায়। আরিহা অন্য সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে। হাত দুটো পেটে চেপে বসে আছে। চেহেরা ভঙ্গি অতিশান্ত। অন্যপাশে ইহান মাথা চেপে বসে আছে। চোখ ছলছল করছে ওর। নিজের স্ত্রী আর বাচ্চার জীবন যে অনিশ্চিত তা যেনে কোন পুরুষের কাছে সহজলভ্য বিষয় নয়। একজন পুরুষের জীবনে ৩ জন নারীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রথম হচ্ছে তার জন্মধারনী মা যে তাকে জন্ম দিয়েছে। দ্বিতীয় হচ্ছে তার জীবনসঙ্গী যে তার জীবন পরিপূর্ণ করেছে আর তৃতীয় হচ্ছে তার নিজের মেয়ে যে তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর ধ্বনি বাবা ডাকটি ডেকেছে। এরা ৩ জন মিলেই একজন পুরুষের জীবন সার্থক করে। এর মধ্যে যেকোনো একটি যদি তার থেকে ক্ষয়ে যায় তখন সে একদম নিঃস্ব হয়ে পড়ে। কেন না সে যে জীবনের সবচেয়ে অমূল্য রত্ন হারিয়ে ফেলেছে।
আমরা ভাবি পুরুষদের হৃদয় নেই, আবেগ নেই, কষ্ট নেই। কারণ একটাই তারা সহজে কাঁদে না। নিজের কষ্ট চোখের পানি আকারে ভাসিয়ে দেয় না। তারা সকল পরিস্থিতিতে শক্ত থাকে। কিন্তু আসলে তাদের হৃদয়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকে মেয়েদের চাইতে বেশি কষ্ট। এর মুখ্য কারণ তারা মেয়েদের মত কেঁদে কষ্ট কমাতে পারে না। তাদের মনের মধ্যে একটু একটু করে কষ্ট জমতে জমতে একদিন বিশাল পাহাড় সমান হয়ে যায়। আর যখন সকল সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায় তখনই তারা কাঁদে৷ সেই একবারের জন্য কেঁদেই মনের সকলের কষ্ট বের করে ফেলে। কিন্তু ইহান আজ চেয়ে কাঁদতে পারছে না। কেন না এইটা যে সবে শুরু। এর পরিনতি কি তা এখনো অজানা। তার উপর যেখানে আরিহা একদম শক্ত হয়ে বসে আছে সেখানে ইহানের এত হাসফাস ভাব একদমই অমানানসয়ী। ইহান বার বার দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে।
ঠিক এমন সময় জিসান আরিহার সামনে হাটু গেড়ে বসে। আরিহা তখনও মাথা নিচু করে বসে আছে। জিসান কথা বলতে গিয়ে পারছে না। গলা ধরে আসছে ওর৷ জিসান কোন মতে ধরা কন্ঠে বলে,
— আ’ম সরি আরু!
#চলবে