#অন্তরালে_তুমি
#Part_32
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
[ প্রথমেই আমি দুঃখিত কেন না গত পর্বে আমি একটা কথা ভুলবসত একটু ভুল লিখেছি। একজন পুরুষের জীবনে ৩ জন নারী না বরং ৪ জন নারীর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। চতুর্থ নারীটি হচ্ছে তার বোন। আসলে কথাটা আমার নোলেজে ছিল না। ভুল লিখার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। ❤️]
?
— আ’ম সরি আরু! আ’ম এক্সট্রেমলি সরি। আমি ভালো মত তোর খেয়াল রাখতে পারি নি।বাবা আমাকে তোর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিল কিন্তু আমি সেই দায়িত্ব ঠিক মত পালন করতে পারি নাই রে। পারি নি! আমি যদি তোর প্রতি আরেকটু যত্নশীল হতাম তাহলে হয়তো আজ এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।
বলতে বলতে জিসানের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। জিসানের কথা শুনে আরিহা মুখ তুলে জিসানের দিকে তাকায়। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
— এতে তোর কোন দোষ নেই জিসান। তুই সবসময়ই আমার জন্য বেস্টটা করেছিস। আমার যত্ন নিতে কোন কমতি নিস নি। ইউ আর নোট গিল্টি।
যা হচ্ছে সব ভাগ্যের লিখা। আমার ভাগ্যে সুখ শব্দটা নেই তা আমি ভালো করেই জানি। একটা কথা তো শুনেছিস,
“কপালে সুখ লিখা না থাকলে সে কপালে পাথরে ঠুকেও লাভ নেই। এতে কপাল যথেষ্ট ফোলে, কিন্তু ভাগ্য একটুও ফোলে না।”
আমার বেলায়ও তাই। যার ভাগ্যে ছোট থেকেই কষ্ট তার ভাগ্যে আর যাই হোক সুখ শব্দটা অতি বেমানান। আমি আমার ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি কিন্তু নিজের সন্তানকে তা মানতে দিতে পারি না রে। ওকে এইসব কষ্ট থেকে বাঁচাতে যদি আমাকে নিচের প্রাণও দিতে হয় তাহলে আমিও রাজী।
শেষের কথাটি শুনে জিসান আর ইহান কিছুটা চেঁচিয়ে উঠে। ইহান আরিহাকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে বলে,
— একদম বাজে বুকবে না তুমি। তোমার কিছু হবে না। তোমার জন্য বেস্ট থেকে বেস্ট ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করবো আমি। না তোমার কিছু হবে না আমাদের বেবি এর। বুঝেছো তুমি?
আরিহা কিছু না বলে ইহানের শার্টটা খামচে ধরে। কিছুক্ষণ পরেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠে সে। হ্যাঁ আরিহা আজ কাঁদছে। নিজ থেকে নিজ ইচ্ছায় কাঁদছে। কেন কাঁদছে তা কেউ বুঝতে পারছে না। আরিহা তো সহজে ভেঙ্গে যাওয়ার মত মেয়ে না তাহলে? ইহান আরিহার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আরিহা ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলে,
— আমার নিজের জীবন নিয়ে আমার কোন ভয় নেই। মৃত্যুকে আমি কখনই ভয় পাই নি। সেই ছোট থেকে নিজের মৃত্যুই কামনা করে এসেছি আমি। কিন্তু এখন যখন একটু বাঁচতে চেয়েছিলাম তখনই মৃত্যুর মুখে এসে পড়েছি আমি। সাথে আমার সন্তানও। আমার সন্তান কি দোষ করেছে শুনি? যার প্রাণের এখনো পূর্ণবিকাশই হয় নি তার প্রাণই এখন অনিশ্চিত। যদি আমার সন্তান বেঁচেও যায় আর আমি মারা যাই তখন? আমি তো মা থেকেও মার ভালবাসা পাই নি কিন্তু আমার সন্তান তো হয়তো আমার ছোঁয়াও পাবে না। ছোট থেকে আমি যে কষ্টে বড় হয়েছি সে কষ্ট আমার সন্তানও পাবে ভেবেই ভেঙ্গে যাচ্ছি আমি। আল্লাহ আমার প্রতি নিষ্ঠুর তা আমি জানি কিন্তু আমার সন্তানের প্রতি এত নিষ্ঠুর কিভাবে হতে পারলেন উনি। কিভাবে?
আমি মারা গেলেও আমার আফসোস থাকবে না ইহান কিন্তু আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় আমার সন্তানের কিছু হলে আমি সহ্য করতে পারবো না। আমি এতটাও শক্ত নই ইহান। এতটা শক্তও আমি নই। আজ সত্যি মনে হচ্ছে এই প্রথম আমার দেওয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়ে যাবে। আমিও মিসেস হকের মতই মা হয়ে যাব। সেই নিকৃষ্ট মা যার জন্য আমার সন্তান প্রচন্ড কষ্ট পাবে। প্রচন্ড!
ইহান আরিহাকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিবার ব্যর্থ হচ্ছে। একজন মার কাছে তার সন্তান আসলে কি তা শুধুমাত্র একজন মা এই জানে। সন্তানের উপর আশা সকল আঘাত সে নিজের নিয়ে নিবে কিন্তু নিজের সন্তানের গায়ে সামন্য আঁচড় পড়তে হবে না। সন্তানের অমঙ্গলের কথা ভাবলেই তাদের বুক হু হু করে কেঁপে উঠে। কিন্তু এমন কিছুও মাও আছে যাদের কাছে সন্তান বোঝা। তাদের শত প্রচেষ্টা সন্তানদের এড়িয়ে চলার। তাই তো কথায় আছে, “সকলে সকল জিনিসের মর্ম করিতে জানে না।”
___________________________________________________
আরিহার ব্রেনে ক্লোটটা ধরে পড়েছে। সাধারণ অবস্থা হলে হয়তো ডাক্তাররা যথাদ্রুত সম্ভব অপারেশনটা করিয়ে নিত কিন্তু আরিহা প্রেগন্যান্ট এই মূহুর্তে অপারেশন করা একদমই সম্ভব নয়।
গর্ভাবস্থায় ক্লোটটি শিশুর উপর প্রভাব ফেলবে না যতক্ষণ না গুরুতর জটিলতা রয়েছে। আর আরিহার অবস্থা আপাত গতিতে স্বাভাবিক, তার মধ্যে তেমন জটিলতা দেখা দিচ্ছে না। শুধুমাত্র আরিহার লো প্রেশার নিয়ে তারা ভয়ের মধ্যে আছে। কারণ তাদের ভয় বাই এনি চান্স যদি আরিহা প্রেশার একবার ফল করে তাহলে তখন হয়তো ব্রেনে অনেক বেশি প্রেশার পড়বে। আর যদি এমন হয় তাহলে ওর ক্লোটটা বেলুনের মত ফুলে ব্লাস্ট হয়ে যাবে আর রক্তনালি লিক হয়ে যাবে। এর পরবর্তী ৬ ঘন্টার মাঝে আরিহা চিরতরে পারি দিয়ে দিবে না ফিরার দেশে। তাই আরিহাকে স্পেশাল টেককেয়ার করা হচ্ছে। এছাড়া ডাক্তাররাও তাদের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে।
?
এইভাবে দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে যায়। ইহান আর জিসান মিলে আরিহার খেয়াল রাখছে। ইহান আরিহার খাবার থেকে শুরু করে সকল জিনিসের প্রতি নজর রাখছে। আরিহার যাতে কোন অসুবিধা না হয় তাই বাসায় দুইটা সার্ভেন্টও রাখা হয়েছে। জিসান আরিহার সকল মুভমেন্ট খেয়াল করছে। সাথে প্রতিদিন ওকে ব্যায়াম করাচ্ছে। রক্তের স্বাভাবিক চলাচলের জন্য ব্যায়াম অত্যন্ত জরুরি। আরিহার এখন সাড়ে সাত মাস চলছে। পেটটা বেশ ফুলে উঠেছে। চোখে মুখে সারাক্ষণ আলাদা গ্লো কাজ করে। আরিহা সর্বদা আল্লাহ নিকট প্রতিবার নিজের সন্তানের সুস্থতা কামনা করছে। কিন্তু সময় যত যাচ্ছে আরিহার মনের মধ্যে থাকা ভয় গুলো যেন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতদিন সব ঠিক মত গেলেও ডেলিভারির টাইম যত ঘনিয়ে আসছে ভয় যেন আরও গাঢ় হচ্ছে। ইহান ও জিসান এই ভয়ে থাকে এই বুঝি কিছু হয়ে গেল। সারাক্ষণ এক আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তারা। এইভাবেই কাটছে সময়।
আরিহা সোফায় বসে আছে। পাশেই ইহান খাবারের প্লেট নিয়ে ভাত মেখে আরিহাকে খায়িয়ে দিচ্ছে। অন্য পাশে জিসান বসে আছে। ইঞ্জেকশনের সিরিজ গুলো ঠিক করছে সে। আরিহার প্রেগন্যান্ট বলে তাকে হাই ডোসের ঔষধ দেওয়া সম্ভব না। এতে বাচ্চার ক্ষতি হবে তাই ওকে দুই বেলা করে নিয়মিত কিছু ইঞ্জেকশন দেওয়া হচ্ছে ওর রক্তচলাচল স্বাভাবিক রাখার জন্য। যাতে বাচ্চার শ্বাস নিতে সমস্যা না হয় আর গর্ভে অবস্থিত বাচ্চাটি নির্দ্বিধায় বেড়ে উঠতে পারে। খাওয়া শেষে ইহান উঠে চলে যায়। জিসান ইঞ্জেকশন গুলো ঠিক করে যেই না আরিহাকে পুশ করতে যাবে ঠিক তখনই কলিংবেলটা বেজে ওঠে। ইহান রান্নাঘরে থাকায় সে কলিংবেলটা শুনতে পারে নি। তাই জিসান বাধ্য হয় নিজে যেতে। সে ইঞ্জেকশনটা রেখে চলে যায় দরজা খুলতে। দরজা খুলার সাথে সাথে সে চমকে যায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না তার সামনে কে এবং কারা দাঁড়িয়ে আছে। জিসানের সামনে মি. হক আর মিসেস হক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মুখে চোখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। জিসান এখন ঘামতে শুরু করে। আরিহা মি. হককে দেখলে এতটা রিয়েক্ট করবে না কিন্তু মিসেস হককে দেখলে কেলেঙ্কারি লেগে যাবে। আরিহা তখন নিজের মধ্যে থাকবে না। হাইপার হয়ে যাবে আর আপাতত ওর জন্য হাইপার হওয়া মানেই রিক্স। জিসান কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। জিসান কিছু বলতে যাবে তার আগেই মি. হক আর মিসেস হক সুরসুর করে ভিতরে ঢুকে পড়ে। আরিহা দরজার দিকেই তাকিয়ে ছিল। মি. হককে দেখে আরিহা তেমন কিছু প্রতিক্রিয়া না দেখালেও মিসেস হককে দেখার সাথে সাথে প্রচন্ড রেগে যায়। চোখ মুখ লাল হয়ে যায়। চোয়াল একদম শক্ত হয়ে যায়। চোখের সামনে সেই তিক্ত স্মৃতি গুলো ভেসে উঠে। আরিহা চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। তখন তার কানে মি. হকের কন্ঠে কানে বেসে আসে,
— তুমি এইটা কিভাবে করতে পারলে আরিহা? তুমি এতটা অসুস্থ তা আমাদের একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না। আমাদের কি এই অধিকারটুকু নেই যে তোমার ভালো মন্দ ব্যাপারে আমরা জানতে পারবো?
আরিহা এইবার চেঁচিয়ে উঠে,
— না কোন অধিকার নেই। যেখানে অনেক আগেই আপনাদের চোখের সামনে আমি তিলে তিলে মরে গিয়েছি সেখানে নতুন করে মৃত্যু সংবাদ আমি আর কি দিব? তখন তো আপনারা কোন অধিকার দেখান নি তাহলে এখন কিসের অধিকার দেখাচ্ছে?
আরিহার চেঁচামেচি শুনে ইহান দ্রুত রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসে। ড্রয়িং রুমে আসতেই দুইজন মধ্য বয়স্ক পুরুষ আর মহিলাকে দেখে স্থির হয়ে যায়। বুঝার চেষ্টা করে এরা কারা। সে জিসানের দিকে তাকাতেই দেখে জিসান অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর বুঝতে পারে এরাই আরিহার বাবা-মা। বিষয়টি বুঝতে পেরেই ইহানের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। ইহান দ্রুত আরিহার কাছে গিয়ে ওকে শান্ত হতে বলে। তখন মি. হক বলে উঠে,
— মা দেখো আমরা জানি তোমার সাথে অন্যায় হয়েছে। হয়তো এর জন্য আমরাই দ্বায়ী কিন্তু বিশ্বাস করো মা আমরা কখনো তোমার খারাপ চাই নি।
তখন আরিহা কিছুটা চেঁচিয়ে বলে,
— খারাপ চাননি বলছেন? খারাপ যদি নাই চাইতেন তাহলে আজ এইখানে আসতেন না। আপনা একা আসলে তাও আমি মানিয়ে নিতাম কিন্তু সাথে এনেছেন আমার জীবন ধ্বংসকারিকে। এনাকে এনে আমার কোন দিক দিয়ে ভালো চেয়েছেন শুনি? আবার ধ্বংস করতে নিয়ে এসেছেন আমার জীবনকে?
মিসেস হক এইবার মুখ খুলে বলেন,
— মা আমার কথা…..
আরিহা এইবার শতগুণ চেঁচিয়ে বলে,
— আপনার সাথে আমি কথা বলছি? বলছি না। তাহলে কেন আপনি কথা বলছেন? কেন এসেছিন আপনি? কেন? আর কি কষ্ট দেওয়া বাকি আছে আমায় যার আজ এই পর্যন্ত এসে পড়েছেন? ভালোই তো ছিলাম আমি তাহলে কেন আবার সেই অতীত গুলো খুঁড়ে বেড়িয়ে এসেছেন। আমার জীবন নষ্ট করে শান্তি হয় নি যে এখন এসেছেন আমার বাচ্চার জীবন নষ্ট করতে।
মিসেস হক ছলছল চোখে বলে,
— একজন মা হয়ে আমি কিভাবে সন্তানের অমঙ্গল চাইবো? আমাকে এতটা ঘৃণা করো না আমি সইতে পারবো না। একবার আমাকে সব কিছু বুঝানো সুযোগ তো দাও। আমরা এমন কেন করেছি।
আরিহা রাগে থরথর করে কাঁপছে। দুই হাত দিয়ে পেটটা জড়িয়ে ধরে আছে সে। ইহান তা দেখে দ্রুত ওকে সোফায় বসায়। ইহান বেশ বুঝতে পারছে এইখানে আজ কোন অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে। এইদিকে জিসান মি. হক এন্ড মিসেস হককে বলছে চলে যেতে। এরা থাকলে আরিহার অবস্থা খারাপ হবে। আরিহা চোখ বন্ধ করে বসে আছে। মি. এন্ড মিসেস হক কাতর চোখে দুইজন দুইজনকে দেখছে। অতঃপর আরিহার কোন রেসপন্স না পেয়ে তারা চলে যেতে নেয়। তখন আরিহা বলে উঠে,
— আপনাদের ১০ মিনিট সময় দেওয়া হলো আপনাদের বক্তব্য রাখার জন্য। আমি আপনাদের শিক্ষায় বড় হয়নি যে আপনাদের মত এতটাই পাষাণ হয়ে যাবো যে একবারের জন্য অন্যের কথা আমলে নিব না বা নিজের বক্তব্য রাখার সুযোগ দিব না। আমি আঙ্কেলের শিক্ষায় বড় হয়েছি আর আঙ্কেল প্রতিবারই বলেছে সবাই নিজের বক্তব্য রাখা একটা সুযোগ দিতেই হয়। এখন সে যেই হোক। তার জন্য আপনারও সুযোগ পাবেন।
কথাটা শুনা মাত্র মি. এন্ড মিসেসের মুখ চকচক করে উঠে। মিসেস হক এইবার বলতে শুরু করে,
— আমি জানি আমার জন্য তুমি ছোট থেকেই কষ্ট পেয়ে এসেছ। কিন্তু আমি তখন সেইগুলা বুঝতে পারি নি। আমি ভাবতাম ছেলে-মেয়েদের শাসন না করলে তারা বকে যাবে। তারা একদম ছন্দছাড়া হয়ে যায়। আর ভুল করে বসবে। তাই আমি তোমাকে এতটা শাসন করতাম। তার উপর আমি তোমাকে নিজের উপর নির্ভরশীল হতে শিখাতে চেয়েছিলাম যাতে তুমি মাথা উঁচু করে চলতে পারো। একদম পারফেক্ট হতে পারো। তাই তোমায় পড়ালেখার জন্য এত জোড় দিতাম। শাসন করতাম, মারতাম। ভাবতাম আমি ভালবাসলে তুমি একরোখা আর জেদি হয়ে যাবে। বিগড়ে যাবে তুমি তাই শাসনের উপর রাখতাম আমি তোমায় যাতে তুমি আমায় ভয় পাও আর আমার কথাগুলো সবসময় শুনে চল। ডিসিপ্লিন লাইফের চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি যে তোমারও ইচ্ছা থাকতে পারে। তোমারও কিছু বলার থাকতে পারে। তাই তো আমি তোমার কথা শুনতে চাইতাম। আর আজ তার ফল ভুগছি আমি। আমার জন্যই হয়তো তোমার জীবন পুরোপুরি ভাবে নষ্ট হয়ে যায়। আমাকে ক্ষমা করে দাও। ছোট থেকে অনেক কষ্ট দিয়ে দিয়েছি তোমায়। আমাকে আর ঘৃণা করো না। একজন মা হয়ে নিজের সন্তানের চোখে ঘৃণা সহ্য করতে পারছি না আমি।
এই বলে ফুঁপিয়ে উঠেন তিনি। মি. হক এইবার বলতে শুরু করে,
— আমি ভাবতাম ভালো একটা লাইফ লিড করার টাকাই দরকার। টাকার উর্ধ্বে কিছু নেই।টাকা মানেই সুখ। তাই তো খালি টাকার পিছনে ছুটতাম। টাকার পিছে ছুটতে ছুটতে আমি সংসারের মায়া থেকে শতদূর চলে যাই। ভাবতাম সংসারে টাকা দিলেই হয়ে যাবে৷ তাদের চাহিদা মিটলেই তারা সুখি হবে। কিন্তু আমি একটা কথা ভুলে যাই, “টাকা নিয়ে বাহ্যিক চাহিদা মিটে কিন্তু অন্তরের চাহিদা না।”
তাই তোমাদের কাউকে সময় দিতে পারতাম না। তোমার সাথে অন্যায় হয়েছে জেনেও চুপ ছিলাম মান-সম্মানের ভয়ে। তার উপর তোমার অবস্থা দেখে মনে হলো যে তোমাকে সামলানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না তার উপর তুমি থাকতেও চাচ্ছিলে না তাই তোমায় তোমার ফুপার সাথে পাঠিয়ে দেই। তোমাকে শক্ত ও মানুষ করা দায়িত্ব দিয়ে দেই তাকে। হয়তো দায়িত্বমুক্ত হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমি ভুলে যাই বাবা-মার কাছেই একমাত্র তার সন্তান ভালো থাকে।
আজ দেখ আমার এত এত টাকা কিন্তু সুখ নেই। বাবা বলার জন্য সন্তান থেকেও নেই। আমাকেও মাফ করে দিয়েও মা আমি সবসময় আমার দায়িত্বগুলো এড়িয়ে চলেছি।
আরিহা সব কথা শুনে ফুঁপিয়ে উঠে। তার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। আরিহা নিজের চোখ মুছে বলে,
— সন্তান জন্ম দিয়ে দিলেই মা হওয়া যায় না। সন্তানের প্রতি তার টান, মায়া, ভালবাসা থাকতে হয়। একজন মা নাকি সন্তানের চেহেরা দেখেই তার সমস্যার কথা বুঝে যায় কিন্তু আপনি তো চোখের সামনে সব দেখেও বুঝতে পারেন নি। সন্তানকে শাসনের চেয়ে বেশি ভালবাসা দরকার হয়। যা আপনি বুঝেন নি। একটা কথা জানেন কি অতি কোন জিনিসই ভালো না। অতি জিনিসটা খুবই ভয়ানক। এইটি মূহুর্তেই একজনের জীবন নষ্ট করে দিতে পারে। যেমন আপনার অতিরিক্ত শাসন আমার জীবন নষ্ট না বরং কলঙ্কিত করে তুললো। আমি আপনার জন্য সবসময়ই বিরক্তির কারণ ছিলাম। যার জন্য আমাকে আপনার তেমন সহ্য হতো না। কথায় আছে, “দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা থাকে না।”
তেমনি এখন যখন সন্তান হারা হয়ে সন্তানের মর্ম বুঝতে পেরেছেন তখন অনুতাপের আগুনে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে গিয়েছেন আপনি। যদি আমি আগের আরিহা হতাম তাহলে হয়তো আমার ঘৃণা থেকে কখনো মুক্তি পেতেন না আপনি। কিন্তু আমি সেই আগের আরিহা নই। আমি এখন একজনের স্ত্রী আর নবসন্তানের মা। তাই মা হয়ে আপনার কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারছি। তাই আজ আপনি আমার ঘৃণা থেকে মুক্ত দিলাম কিন্তু ক্ষমা করতে পারবো কি না জানি না।
এই বলে এক দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে মি. হকের উদ্দেশ্যে বলে,
— টাকা কখনো সুখের কারণ হতে পারে না। এইটা অবশ্য ঠিক একটা ভালো জীবনযাপন করার জন্য টাকা অনেক প্রয়োজন কিন্তু সুখের জন্য টাকা নয় বরং ভালবাসা প্রয়োজন। বড় বড় দালানের চারদেয়ালে আপনি সেই সুখ খুঁজে পাবেন না যেটা একটা কুঁড়ে ঘরে থেকে আপনি পাবেন। অভাবের মধ্যেও সুখ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু আফসোস আপনি তা বুঝেন নি।
আপনি সবসময় আপনার দায়িত্ব এড়িয়ে চলেছেন। শুধু টাকাই করে চলেছিলেন। কিন্তু তাও সামান্যটুকু ভালবাসা পেয়েছিলাম আমি আপনার কাছ থেকে। তার উপর সেইদিন আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছিলেন তাই আপনাকে চেয়েও কখনো ঘৃণা করতে পারি নি। কৃতজ্ঞতার ভারে চাপা পড়ে ছিলাম আমি। কিন্তু ক্ষমা করতে পারি নি।
আপনাদের দুইজনের জন্য আমার শৈশব তিক্ততায় কেটেছে। তিলে তিলে মরেছি আমি। আমি যে কষ্ট সহ্য করেছি তার দাম আপনারা কখনো দিতে পারবেন না।
এই বলে আরিহা বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। অতঃপর বলে,
— যান ক্ষমা করলাম আপনাদের কিন্তু শাস্তি আপনারা অবশ্যই পাবেন। আর আপনাদের শাস্তি হলো আপনারা আর কখনো আমার খোঁজ খবর নিতে পারবেন না। না দেখা করতে পারবেন না আমার সামনে আসতে পারবেন। আজ এই মূহুর্ত থেকে আপনাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আপনারা আমার জন্য একদমই অপরিচিত। আমি মরি আর বাঁচি তাদের আপনাদের কিছু যায় আসবে না। আমার মরার মুখ দেখার অধিকারও আপনারা পাবেন না।
আপনারা না পাবেন আমার ভালবাসা, না পাবেন আমার ঘৃণা, না শুনতে পারবেন বাবা-মা ডাকটি, না পাবেন আমায় মেয়ে ডাকার অধিকারটি, না পাবেন নিজের মেয়ের মুখ দেখার সুযোগ, না শুনতে পারবেন নানা-নানী ডাকটা। এর চেয়ে উত্তম শাস্তি আপনাদের জন্য কিছু হতে পারে না। শূন্য অনুভূতি নিয়ে বাঁচবেন আপনারা। এখন আপনারা আসতে পারেন।
মি. এন্ড মিসেস হক দুইজন দুইজনের দিকে কিছুক্ষণ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চলে যায়। চোখে আজ তাদের অনুতাপের পানি, বুক ভরা কষ্ট। হয়তো এইটাই তাদের নিয়তিতে ছিল। মি. এন্ড মিসেস হক চলে যেতেই আরিহা জোরে জোরে শ্বাস নেওয়া শুরু করে। প্রচন্ড হাইপার হয়ে গিয়েছিল এতক্ষণ। এখন তার শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অনাবরত। পেটেও হাল্কা ব্যথা করতে শুরু করেছে তার। ইহান এতক্ষণ আরিহাকে পাশ দিয়ে জড়িয়ে বসেছিল। আরিহার এমন অবস্থা দেখে সে ভয় পেয়ে যায়। জিসান আরিহার এমন অবস্থা দেখে দ্রুত ওর সামনে যায় আর পালস রেট চেক করতে থাকে। পালস রেট একদম অস্বাভাবিক। জিসান আর দেরি না করে ওকে হসপিটালে নিয়ে যায়। এতটা হাইপার হওয়ার জন্যই এমন হয়েছে। এখন যদি একটু দেরি হয় তাহলে হয়তো পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে।
___________________________________________________
ওটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইহান, জিসান, নীরা, পুষ্পিতা। সকলের মুখে এক রাশ ভয়। ভয়গুলো ধীরে ধীরে আতঙ্কে পরিনত হচ্ছে। কেন না ডাক্তাররা বলেছে আরিহার অবস্থা গুরুতর দেখা দিচ্ছে। একে তো সে আজকের ইঞ্জেকশন মিস করেছে তার উপর এতটা হাইপার হয়ে গিয়েছিল যার জন্য ওর ব্রেনে প্রেশার পড়েছে। যার ফলে রক্ত চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়েছে এবং রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে আসছে। এখনই সিজার করতে অথবা বাচ্চা বা পেশেন্ট কাউকে বাঁচানো তাদের পক্ষে সম্ভব না। তারা দ্রুত ওটি রেডি করে আর ১০ মিনিট আগেই অপারেশন শুরু করে। আরিহার রক্ত লাগতে পারে বলে জিসান আগে থেকে রক্তের ব্যবস্থা করে রেখেছিল।
ইহান স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি ওটির দরজার দিকে। চোখ দুটো অসম্ভব লাল। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। মুখটা একদম রক্তশূণ্য দেখা দিচ্ছে। বুকের ভিতরে চিনচিন ব্যথা করছে। অসহ্যনীয় ব্যথা হচ্ছে বুকের ভিতর। সকলের মুখও রক্তশূণ্য হয়ে আছে। সকলেই অপেক্ষা করছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলের আশায়।
#চলবে