অন্তরিন প্রণয় পর্ব-২৪+২৫

0
445

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২৪

পিনপতন নীরবতা মাঝে কুকুর গুলোর কান্না দেওয়ান বাড়িটাকে আরো ভীতগ্রস্ত করে তুলছে।ফাহমিদার হেচঁকি তোলা কান্নায় হুট করেই আবার নীরবতা লুপ্ত হয়।তার পাশে অচেতন হয়ে পড়ে আছে খুরশীদ আনওয়ার।মাথায় ব্যান্ডেজ।আফীফ নিজের মাথায় হাত দিয়ে আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকালো, রাতের দুইটা বাজতে এখনো দশ মিনিট বাকি।ফাতেমা আফীফের পাশেই বসা ছিলেন।কুকুর গুলোর কান্নায় তিনি বিড়বিড় করে সুরা-কালাম পড়তে শুরু করেন।
আফীফের দিকে একবার তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সরিয়ে সুউচ্চ স্বরে বলেন,
– জানো নি দাদুভাই কুকুর কাদঁলে বিপদ আসে।

ফাতেমার কথা শেষ হওয়ার আগেই সহসা জবাব দিলেন ফাহমিদা।
– আর কি বিপদের বাকি আছে বলবেন?একমাত্র মেয়ের খোঁজ নেই।আজ আবার স্বামী মাথা ফাটিয়ে এই অবস্থা।এরা ছাড়া ব্যাক্তিগত জীবনে আমার আর কেউ নেই।তবে আমার আর কি বিপদের বাকি আছে বলবেন?

ফাহমিদার হতাশ কন্ঠ।আফীফ ঘাড় ঘুরিয়ে ফাতেমাকে ইশারা করে চুপ থাকতে।হুট করেই যেন দুই তিনটা কুকুরের ডাক আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
– ওই দেখ দেখ তোরা বিপদ আশেপাশে খালি ঘুরতাছে।
– দাদী তুমি থামবে।তোমার কুসংস্কার কথাবার্তা তা তুমি তোমার কাছে রাখো।

আফীফের রুষ্ট কন্ঠ।সহসা সবার মাঝ থেকে উঠে চলে আসে।বাড়ির বাইরে দৌবারিকদের ইশারায় ডেকে প্রশ্ন করে,
– সমস্যা কি?কুকুর গুলোকে দূর করছো না কেন?
– দূর করেছি ভাইজান কিন্তু ঘুরে ফিরে এদিকেই আসছে।

আফীফ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে।বাগানের দিকটায় হাটা শুরু করে ভাবতে থাকে সেহেরিশের কথা।কে এমনটা করেছে, কী উদ্দেশ্য করেছে? যদি আফীফের কোন শত্রু হতো তবে কোন না কোন বার্তা ঠিকি প্রেরণ করা হতো কিন্তু আফীফের কাছে কোন বার্তা পৌঁছেনি।একরাশ চিন্তা নিয়ে আফীফ ব্লাক হাউজের দিকে রওনা হলো।পুরো বাড়িটি কেমন গম্ভীর হয়ে আছে।বাড়ির পেছনের দিকটায় দরজা খুলে ঘরে প্রবেশ করলো সে।

দরজা খোলার শব্দে ব্লাক হাউজে বন্দি থাকা মানবটি সহসা চোখ খুলে নিলো।গায়ে থাকা কাঁথাটা ভালোভাবে মুড়িয়ে উঠে বসতেই আফীফকে দেখে তিলার্ধেক হাসে।আফীফ একটি চেয়ারে বসে তাকে সহসা প্রশ্ন করে,
– কেমন আছেন আপনি?
– যেমন রেখেছো।

আফীফ ফস করে শ্বাস ছাড়লো।পকেট থেকে মোবাইল নিয়ে সামনে বসে থাকা ব্যাক্তিটির দিকে ধরে গম্ভীর স্বরে বলে,
– চিনতে পারছেন আশা করি?
– হ্যা এটা তো সেই পুতুলটা তাকিয়া।তোমাদের বিয়ে হবে কবে?
– সে নিখোঁজ!
– ন…ন…নিখোঁজ? তবে কি বিয়ে হবে না?
– হাহ!মানুষের রঙ কত পালটে।স্বার্থের রঙ পালটে।নিজ স্বার্থে মানুষ কি না করতে পারে।এখন তাকিয়া আর আমার বিয়ে চাইছেন?এই কথাটা আগে কেন ভাবেন নি?
– আমি কিছু জানি না।আমি কিছু জানি না।

মানবটি কাঁথা মুডিয়ে শুয়ে পড়ে।আফীফ ঘৃণা ভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে উঠে যায়।এবং সহসা সেখান থেকে বের হতেই দৌবারিকদের কলহ শুনতে পায়।আফীফ এক ছুটে বাগান পেরিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।
– কি হয়েছে এখানে এত শোরগোল কিসের?
– ভাইজান কে আইছে একবার দেহেন।

আফীফ মাথা উচু কথা তাকায়।হাটু মুড়িয়ে বসে থাকা সেহেরিশকে দেখে এক মূহুর্তের জন্য তার অনুভূতিরা থমকে যায়।মস্তিষ্ক তার অচল হয়ে গেছে এই মূহুর্তে কী করতে হবে?কি করতে হবে তার?হুট করেই কানে আসে সেহেরিশের চাপা কান্নার আওয়াজ।আফীফের যেন সৎবিৎ ফিরে এসেছে।সহসা সেহেরিশের সামনে হাটু মুড়ে বসে।সেদিনের সাজ আজ এলোমেলো।গালের লাল রঙটা রক্তিম আভায় ছড়িয়ে আছে।মেয়েটাকে দেখতে একদম বিদস্ত লাগছে।

– স..সেহেরিশ!
সেহেরিশ মাথা তুলে আফীফের দিকে তাকায়।আফীফের ডান হাতটা আকড়ে ধরে আরেকটু শব্দ করে কেঁদে দেয়।আফীফ দেরি না করে ঝটপট সেহেরিশকে কোলে তুলে নেয় এবং বাড়ির ভিতরে হাটা শুরু করে।
.

– মারে তুই কোথায় ছিলি?
ফাহমিদার প্রশ্নে প্রত্যুত্তর করলো না সেহেরিশ।তুন্দ্র,কেইন,মারুফা সহ বাকি সবাই তাকে ঘিরে বসে আছে।আফীফ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে পরখ করছে।পায়ে, হাতে শক্ত কোন মোটা দড়ি দিয়ে বাঁধার ফলে চামড়া ছিড়ে রক্ত শুকিয়ে দাগ লেগে আছে।আফীফ সেদিকে তাকিয়ে ফস করে শ্বাস ছাড়লো।

– আমি রুমে যাবো মামনি আমাকে নিয়ে যাও আমি হাটতে পারছি না।

সেহেরিশের কথায় কেইন তুন্দ্র এগিয়ে এসে সেহেরিশকে তুলে দাড় করায়।কিন্তু এক কদম এগোতেই পায়ের ব্যথায় চাপা আর্তনাদ করে উঠে।আফীফ ডানে বায়ে না তাকিয়ে কাউকে পরোয়া না করে আবারো সেহেরিশকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়।এবং সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে সেহেরিশের রুমে নিয়ে যায়।লজ্জা, সংশয়, ভয়ে নুইয়ে আছে সেহেরিশ।বার বার ঠোঁট কামড়ে কান্না দমন করছে।আফীফের চিন্তা মগ্ন চেহেরাটার দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।আফীফ তাকে বিছানায় বসাতেই বালিশ টেনে সহসা কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ে।সেহেরিশের কান্ডে অবাক না হয়ে পারলো না আফীফ।
– কোথায় ছিলে তুমি সেহেরিশ?
– আমি জানি না।
– কে নিয়ে গেছিলো তোমায়?
– আমি জানি না।
আফীফ মাথা নত করে সেহেরিশের হাত কাছে টেনে নেয়।ফর্সা হাত যুগলে রক্তের ছাপ লেগে আছে।চোখের কোনে কান্নার ফলে গালেও দাগ লেগে আছে।
– তুমি জানো পাগলের মতো খুঁজে ছিলাম তোমায় কিন্তু তোমার কোন হদিস পাইনি।প্লিজ সেহেরিশ কি হয়েছিল আমাকে খুলে বলো।
– আমি জানি না কিছু। আমার হাতে পায়ে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিল।মুখে কাপড়।নিরিবিলি একটা রুমেই বন্দি ছিলাম।মাঝে মাঝে এক দুইজন পুরুষের কন্ঠ পেতার আর হ্যা একজন মহিলা!
– মহিলা?
– হ..হ্যা সে এই বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যেত।ছেড়ে দেওয়ার আগে আমাকে একটা কথা বলেছিল “দুইপক্ষের কারনে রেষারেষি আজ এতদূর।” কিন্তু কি বললো আমি তার অর্থ খুঁজে পেলাম না।আমাকে গাড়ি করে পুকুর পাড়ের সামনে নামিয়ে দিয়ে যায় আর বাকিটা আমি নিজেই চলে আসি।

সেহেরিশ থামে।অনবরত তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে।আফীফ উঠে যায় দরজা খুলে বের হতে নিলেই বাড়ির সবাইকে এক সঙ্গে দেখতে পেয়ে মুনিফকে ইশারা করে তার সাথে যেতে।

– কি রে সেহেরিশ কি বলেছে?
– এই বাড়ির কারো সাথে আততায়ীদের যোগাযোগ রয়েছে।
– ম..মানে ক..কি বলছিস।
– হুম ঠিক বলছি।আমি আগেই সন্দেহ করেছিলাম।তা না হলে প্রত্যেক টা টোপ কি করে এত সুক্ষ্ম ভাবে সফল হয়।এই সব কিছুর পেছনে মেইন লিডারশীপ একজন মহিলা।
– কি সব অদ্ভুত কথা বলছিস তুই?
– যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি।তোর দায়িত্ব বাড়ির সকল কর্মচারীদের মোবাইল চেক করা।
– এখন রাত সাড়ে তিনটা বাজে এতরাতে এইসব করার কি মানে?
– আমি করতে বলেছি করবি।এত প্রশ্ন করবি না।সব কিছুর ডিটেইলস আমি চাই।

মুনিফ মাথা নামিয়ে চলে যায়।আফীফ মাথা নুইয়ে নিজের রুমে প্রবেশ করে।

____

কেটে গেছে প্রায় তিন দিন।সেহেরিশ চুপচাপ গম্ভীর হয়ে গেছে।খুরশীদ আনওয়ার এখন মোটামুটি সুস্থ।মারুফা এবং ফাহমিদার সঙ্গে আলাপচারিতা শেষে তারা সিধান্ত নেন আজকের মধ্যেই এই গ্রাম ছড়ে চলে যাবেন।প্রয়োজন নেই তাদের জমি। যেখানে জানের ভয়,জীবন মরণের প্রশ্ন আসে সেখানে আর এক মূহুর্তেও থাকা যায় না।আহনাফ দেওয়ান বসার ঘরে কপালে হাত দিয়ে চিন্তায় মগ্ন।তৎক্ষণাৎ খুরশীদ আনওয়ারের উপস্থিতি টের পেয়ে নড়ে নড়ে বসেন।
– কিছু বলবেন?
– জি।আমরা সিধান্ত নিয়েছি আজি এই গ্রাম ছেড়ে যাবো
– সে কি কথা আপনাদের জমি….
– যেখানে নিরাপত্তা নেই সেখানে জমি জামার আমার প্রয়োজন নেই।
খুরশীদ আনওয়ারের কথার মাঝে আফীফ তাদের সামনে দাঁড়ায়।ততৎক্ষনাৎ আহনাফ দেওয়ান উস্খুস করে খুরশীদ আনওয়ারের হাত জড়িয়ে ধরেন।
– আমার একটা প্রস্তাব আছে যদি রাখতেন।
– প্রস্তাব!বেশ বলুন।
– আপনার মেয়ে সেহেরিশকে আমরা এই বাড়ির বউ হিসেবে চাই।আপনি এভাবে যাবেন না।অন্তত…
– মাফ করবেন আমায়।আমি আপনার এই প্রস্তাবটি রাখতে পারলাম না।আমার মেয়ের বিয়ে অন্যত্র ঠিক হয়ে আছে আশা করি বুঝতে পারছেন।
খুরশীদের কথায় চমকে তাকায় আফীফ এবং আহনাফ।
– ক… কি বলছেন আপনি?
– আমি ঠিকি বলছি।আমরা বরং আজ ফিরে যাবো।

খুরশীদ বাড়ির বাইরে বেরিয়ে যায়।আফীফ আহনাফ দেওয়ানের দিকে কিড়মিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে সহসা সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে যায়।
– আরে দাদুভাই শুন আমার কথা।

আহনাফ দেওয়ানের কথা শেষ হতেই তার কানে আসে দরজা বন্ধ করার বিকট শব্দ।এই শব্দ শেষ বার শুনেছিল আট বছর আগে যখন সেহেরিশ পালিয়ে যায় এই বাড়ি ছেড়ে।

#চলবে…

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২৫

বিছানার উপর পড়ে থাকা নুপুরটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেহেরিশ।তার চোখে মুখে বিরক্তের আভাস।এই নুপুরটা দেখলেই মনের সূক্ষ্ণ কোন হতে কোথাও যেন বিরক্ত আছড়ে পড়ে।কিন্তু কেন?তার ব্যাখ্যা সেহেরিশ যানেনা।আলমারি থেকে প্রতিটা জামা ভাজে ভাজে বের করে ব্যাগে সাজিয়ে রাখছে সে।জানলা দিয়ে আসা হিমেল হাওয়া গায়ে কাটা তুলছে।এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে আজ মুক্তি।হ্যা চিরতরে মুক্তি।আফীফের জন্য আজ তার একটুও খারাপ লাগছে না।একটুও না।জমতে থাকা অনুভূতিরা কি তবে বিদায় জানিয়েছে।

– আসবো সেহেরিশ?
কেইনের কথায় চমকে তাকায় সে।গলাটা ঝেরে কেশে কেইনকে আসতে ইশারা করে।
– তোর ব্যাগ গোছানো শেষ?
– হুম।এই বাড়িটার জন্য বড্ড কষ্ট হচ্ছে রে সেহেরিশ।মানুষ গুলো একদম ভালো।
– তো থেকে যা। আমরা বরং চলে যাই।
– তোকে ছেড়ে থাকতে পারবো না।

কেইনের কোমল কন্ঠ সেহেরিশ ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে মনযোগ দেয়।কেইন সেহেরিশের সামনে আরো কয়েক কদম এগিয়ে নরম সুরে বলে,
– তোকে একটা কথা বলি সেহেরিশ?একদম মন থেকে।
– হুম বল।তোর কন্ঠ এমন লাগছে কেন?
– না কিছু না।
– কি বলবি বল।
কেইন সেহেরিশ দু’হাতে নিজের মুঠোয় নিয়ে নেয় যার কারনে সেহেরিশ কিছুটা অপ্রস্তুয় হয়ে যায়।তবুও নিজেকে ধাতস্ত করে শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়।
– যদি বলি তোকে ভালোবাসি তবে কি খুব বেশি অন্যায় হয়ে যায়?
– এটা আর নতুন কি তুই আমাকে ভালোবাসিস আমি তোকে।বন্ধু বন্ধুকে ভালোবাসতেই পারে।
– নো!
– মানে? না কেন?
– আমি তোকে সারাজীবনের জন্য পেতে চাই সেহেরিশ।উইল ইউ ম্যারি মি সেহেরিশ?
সেহেরিশ থমকে যায়।দু পা পিছিয়ে আলমারির সঙ্গে ঠেসে দাঁড়ায়। তার অনুভূতি থমকে গেছে।সব কিছু পাগল পাগল লাগছে।কেইন নিতান্তই তার বন্ধু এর বেশি আর দু-অক্ষরও সেহেরিশ ভাবতে পারেনা আর কেইন কি না তাকে স্ত্রী হিসেবে চাইছে।

– দেখ কেইন আমি তোকে ওই চোখে কোন দিন দেখিনি।তুই শুধুই আমার বন্ধু এর বেশি না।একটা কথা ভাব তোর সাথে আমার ধর্মের দিক দিয়ে যায় না।তুই খ্রিস্টান আমি মুসলিম।আর আমি তোকে…
– দেখ সেহেরিশ আমার ব্যাক্তিগত জীবনে কেউ নেই।আর ধর্ম তুই চাইলে আমি তোর জন্য মুসলমান হতে পারি।শুধু তুই একবার রাজি হয়ে যা।প্লিজ সেহেরিশ আই নিড ইউ।

সেহেরিশ চমকে যায়।তার শরীর কাটা দিয়ে উঠছে।কি বলছে এই ছেলেটা।যে করেই হোক কেইনকে বুঝাতে হবে।
– দেখ কেইন তুই আমার বন্ধু।আমি বন্ধু হিসেবে তোকে ভীষণ পছন্দ করি কিন্তু একজন স্বামী হিসেবে তোকে মেনে নিতে পারবো না।
– তবে কাকে পারবি আফীফ দেওয়ান কে?
– কেইন!

কেইনের শান্ত কন্ঠে ধমক দিয়ে উঠে সেহেরিশ।কখনো কেইনের মুখে এমন কথা শুনবে বলে আশা করেনি।তবে কেইন হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন করলো?
– আফীফ দেওয়ানের কথা এখানে আসছে কেন কেইন?
– কেন তুই জানিস না?আজ সকালেই আফীফের দাদা তোকে এই বাড়ির বউ হিসেবে প্রস্তাব রেখেছে।কিন্তু আঙ্কেল বারন করেছেন।
– ক.কই আমি তো জানিনা।
– আঙ্কেল আজকেই ঢাকায় ব্যাক করতে চেয়েছে কিন্তু হঠাৎ তিনি অসুস্থ হওয়ায় কাল সকালে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
– আমায় কেউ কিছু বলেনি।শুধু তৈরি থাকতে বলেছে কাল ঢাকায় ফিরবে।
– কেন যদি জানতি তবে বুঝি আফীফকে বিয়ে করতে…

কেইন কথা শেষ করার আগেই সেহেরিশ দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায়।বর্তমানে কেইনকে তার বড্ড তিক্ত লাগছে।
.
অন্ধকার মিশ্রিত রুমটায় বসে নেশায় বুদ আফীফ।হঠাৎ নিজের মনের বিরুদ্ধে নিজেই সিদ্ধান্ত নিলো সেহেরিশকে ভুলে যাবে।তার কাছে থাকলে সেহেরিশ সবসময় বিপদে আচ্ছন্ন থাকবে।কি দরকার এমন অনিশ্চিত জীবনের।আফীফ উঠে দাঁড়ায়।টাল সামলাতে না পেরে আবারো হেলে পড়ে যায়।ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে আবারো উঠে দাঁড়ায়।দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে সেহেরিশের ছবিতে চুমু খায়।

– ইসস কি ভুলটাই না করলাম আমি।আট বছর,আট বছর তোমাতে আচ্ছন্ন থেকে এখন সিদ্ধান্ত নিলাম তোমার আর আমার রাস্তা আলাদা।আমি এত শত ভুল করি কেন বলতে পারবে?ভুল দিয়েই আমাদের সম্পর্ক শুরু।প্রথমে ভুল করে তোমার কাকাতুয়াকে আঘাত করলাম এরপর এরপর আবার ভুল করে তোমাকে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে তোমার মোহে পড়লাম।আবারো ভুল করে অন্যর উপর বিশ্বাস করে আমার আমানত তোমাকে ওই পারভিনের কাছে রেখে গেলাম।কিন্তু ওই কু*টা আমার আমানত খেয়ানত করেছে।আর ভুল নয় সম্পর্ক শেষ এখানেই সমাপ্তি।

আফীফ থামে তার চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরছে।হঠাৎ দরজার করাঘাতে সৎবিৎ ফিরে তার।
– আব্বা তুই সকালে দরজা দিয়েছিস এখনো কেন বের হলি না।তুই চাইলে তোর দাদাজান তোর আব্বা ওই মেয়েকে এনে দেবে তুই বের হ আব্বা।আম্মাকে এমন কষ্ট দিস না।

সেঁজুতির কথায় কিঞ্চিৎ হাসে আফীফ।বিড়বিড় করে বলে,
– চাইলে তো আমিও জোর করে আটকা পারি।পুরো পরিবারটাকে বশ করতে পারি কিন্তু জোরাজোরি আমি চাই না।

আফীফ উঠে দাঁড়ায়।অন্ধকার বারান্দায় পা বাড়াতেই কাকাতুয়া পাখিটি ঝটপট উড়ে এসে তার কাঁধে বসে এক সুরে বলতে থাকে,

– রাজা তুমি ভালো নেই, রাজা তুমি ভালো নেই।
– না তোর রাজা ভালো নেই।ফুরপরী চলে যাচ্ছেরে তোর রাজা ভালো নেই।
– ফুলপরী তোমার,ফুলপরী তোমার।
– সেটা আমি আর তুই জানি বাকিরা তো জানে না।

আফীফেকের কথায় কাকাতুয়া পাখিটি কি বুঝলো কে জানে।ঝটপট বারান্দার গ্রিল দিয়ে উড়ে চলে যায় সেহেরিশের বারান্দায়।আফীফ সেদিকে তাকিয়ে গর্জে উঠে।
– তুই অন্তত আমাকে ধোকা দিস না।কোথায় যাচ্ছিস তুই?ফিরে আয়, ফিরে আয় বলছি।

আফীফের ফোন বেজে উঠে।একবার,দুইবার,তিনবার, ফোন বেজে বন্ধ হয়ে গেছে আফীফ ধরলো না।কে ফোন করেছে কে জানে?গুরুত্ব না দিয়ে বারান্দায় লেপ্টে বসে যায়।শীতের রাত কুয়াশায় বাড়ির গেটের লাইটগুলো ধৌয়াশা হয়ে আছে।হিমেল হাওয়ায় সারা শরীর কেঁপে উঠছে।আবারো ফোন বেজে উঠতে আফীফ দ্রুত রুমে যায়।মুনিফের নাম্বার দেখে রিসিভ করে,
– কি দরকার তোর এত কল করছিস কেন?
– তুই ছাইপাঁশ গিলেছিস আফীফ?তুই না ভালো ছেলে।
– ভালো হয়ে লাভ কি যদি নিজের চাওয়া পাওয়া অপূর্ণ থাকে।
– তাহলে খারাপ হয়ে যা।সবসময় বলতি আফীফ দেওয়ান নিজের স্বার্থ ঠিক রাখে তবে এখন এত নাটক করছিস কেন?তুই না সবসম বলতি সেহেরিশ তোর অন্তরিন প্রণয়।সে তোর বন্দি ভালোবাসা।ছোট থেকেই তোর কাছে বন্দিনি।তবে এখন ছেড়ে দিচ্ছিস কেন?
– আবার বন্দি করলে কি ভালোবাসা পাবো পাগলা?

আফীফ হাসতে থাকে।অন্যরকম হাসি।মুনিফ বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দেয়।
.

সেহেরিশ ঘুমিয়ে আছে।কিছুক্ষণ আগে যখন চিন্তায় সব কিছু যখন উলট পালট লাগছিল তখন মারুফার কোলে মাথা রেখে সব চিন্তা দূর হয়ে যায় তার।মারুফা আলতো হাতে সেহেরিশের চুলে বিলি কেটে দেয়।সে ঘুমিয়ে গেলে তৎক্ষনাৎ মারুফা কম্বোল মুড়িয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়।

দরজা ফাঁক করে নিঃশব্দ পায়ে রুমে ডুকলো কেউ।সেহেরিশের পাশে থেমে অপলক ভাবে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
– তুমি চলে যাও। চলে যাও তুমি।যেখানে আমি তোমায় পাবো না সেখানে তুমি থেকো না।আর আমি থাকতে দেবো না।যদি আমি তোমায় না পাই তবে কারো পাওয়ার অধিকার নেই।ভালো থাকো সেহেরিশ।আলবিদা!

অজ্ঞাত ব্যাক্তিটি আবারো নিঃশব্দ পায়ে বেরিয়ে যায়।তার চোখে মুখের খুশির ঝলক।
.
সকাল সকাল কারো কান্নার আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে সেহেরিশের।তার মাথার কাছে সেঁজুতিকে দেখে তড়াক করে উঠে বসে,
– আ..আন্টি আপনি?
– আমাকে তুমি বাচাঁও মা আমাকে তুমি বাঁচাও।আমার ছেলেটাকে আর প্রাণে মেরো না।
– আন্টি আপনি কি বলছেন এইসব।
– কাল সকালে দরজা বন্ধ করেছে আজ এখনো খোলে নি।
– এইসব কেন করছে আন্টি?
– তোমার জন্য।তোমার বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।এরপর সে রুমে ডুকে আবার বের হয় বাড়ির বাইরে গিয়ে কিসব ব্যাগে করে নিয়ে রুমে ঢোকে আর খোলেনি দরজা।
– আমি কি করতে পারি আন্টি?

সেহেরিশের গলা কাপছে।
– তুমি আফীফকে বাইরে আসতে বলো দেখবে সে বাইরে বের হবে।
– ঠিক আছে আন্টি আমি চেষ্টা করবো।

সেহেরিশ কথা শেষ করতেই হুড়মুড় করে রুমে ডুকেন ফাহমিদা।সেহেরিশকে উদ্দেশ্য করে তিনি শুধালেন,
– মামনি তৈরি হয়ে নাও।একঘন্টা পরেই আমাদের মাইক্রোবাস আসবে।

সেঁজুতির কান্নারত মুখটার দিকে তাকিয়ে ফাহমিদা এগিয়ে আসে।
– ভাবি আফীফ এসব করে কি হবে। আমারা তো আমাদের কথার খেলাপ করতে পারবো না।মেয়ের বিয়ে অন্যত্র ঠিক হয়ে গেছে।
– আপনাদের সমস্যাটাও আমি বুঝতে পারছি।তবে আপনাদের মেয়েকে আমরা কখনো ফেলবো না।
– হুম।

সেহেরিশ শূন্য হাতে আফীফের রুমের সামনে থেকে ফিরে আসে।বেশ কয়েকবার ডাকার ফলেও আফীফ দরজা খুলেনি।অন্যদিকে আহনাফ দেওয়ান সহ বাড়ির সকলের কান্নারত মুখটার দিকে তাকিয়ে সেহেরিশ নিজেকে বড্ড অসহায় ভাবছে।এই মূহুর্তে কেন যেন মনে হচ্ছে আফীফকে তার কাছে টেনে নেওয়া উচিত।এমন পরিবার এমন অন্ধ ভালোবাসা সে কখনো পাবেনা কিছুক্ষণেই উপলব্ধি করে যদি আফীফের কাছে নিজেকে একবার সমর্থন করে তবে পরিবার ছেড়ে নিজেকে অনেক দূরে থাকতে হবে।
সেহেরিশ নিজের পুরো রুমটাতে আরেকবার চোখ বুলিয়ে নেয়।ব্যাগপত্র নিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হতেই মোবাইলে মেসেজ টোন বেজে উঠে।আননোন নাম্বার থেকে মেসেজ দেখে সহসা ভ্রু যুগল কুচকে যায় তার।এতদিনের জানতে চাওয়া সত্যিটা তবে সেহেরিশের সামনে এসেছে।কিন্তু এখন কি করবে সে?

ব্যাগপত্র রেখে সেহেরিশ এক ছুটে তার বাবার কাছে যায়। তার শরীর কাপছে।নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে।
– পাপা পাপা প্লিজ আমি এখান থেকে যাবো না।
– যাবে না মানে কি?
– পাপা আমি আফীফকে বিয়ে করবো। প্লিজ পাপা।
– এসব কি কথা আমার সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে নিয়েছি।তোমার কথায় সবটা হবে না।
– প্লিজ পাপা আই নিড আফীফ।

সেহেরিশের এমন কথায় বাড়ির সকলেই চমকে তাকায়।কেইনের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে।তার বুকের ভেতরটায় কেমন উথাল-পাতাল ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
– আমার কথা শুনো সেহেরিশ এই মূহুর্তে আমরা চলে যাবো তোমার ব্যাগপত্র নিয়ে আসো।
– আমি যাবো না পাপা আমি যাবো না।

সেহেরিশ এক ছুটে আবারো দোতলায় চলে যায়।তার পেছন পেছন বাড়ির সকলেই আসতে থাকে।আফীফের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনবরত করাঘাত করছে সেহেরিশ।
– প্লিজ আফীফ দরজা খুলুন।আমি ফিরে এসেছি আপনি প্লিজ দরজা খুলুন।

রুমের ভেতর থেকে আফীফের সেহেরিশের কথা গুলো শুনলেও পাত্তা দিলো না।সে ভেবেই নিয়েছে হয়তো তাকে বের করার জন্য সেহেরিশ এমনটা করছে।
– আফীফ আপনি শুনতে পারছেন না?সেহেরিশ ফিরে এসেছে সে খুব শীঘ্রই আপনার হয়ে যাবে প্লিজ বেরিয়ে আসুন।
– মিথ্যা কেন বলছো সেহেরিশ?আমার অনুভূতি নিয়ে তামাশা আমি সহ্য করবো না।
– কসম আফীফ আমি ফিরে এসেছি। আপনি দরজা খুলুন।আপনার ভালোবাসার কসম!

আফীফ হুড়মুড় করে উঠে বসে। কেন যেন সেহেরিশের কথা এই মূহুর্তে মোটেও মিথ্যা মনে হচ্ছে না তার।

সহসা খুরশীদ আনওয়ার মেয়ের উপর ক্ষিপ্ত হোন।সেহেরিশের হাত টেনে নিয়ে যেতে চাইলে সেহেরিশ আফীফের উদ্দেশ্য আবারো ডেকে উঠে কিন্তু তখনো আফীফ দরজা খুলেনি।
– পাপা প্লিজ আমি এই প্রথম বার তোমার আবদাদ করছি তোমার কাছে আফীফকে আমি বিয়ে করতে চাই
– তোর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে।
– মিথ্যা কেন বলছো তুমি?

হুট করেই দরজা খোলার শব্দে সবাই চমকে তাকায়।সবার চোখের পলকে আফীফ সেহেরিশকে এক টানে রুমে নিয়ে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দেয়।দরজার বাইরে থেকে খুরশীদ আনওয়ার সহ বাকিরা আহাম্মক বনে তাকিয়ে আছে।

আফীফ সেহেরিশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে।এতটাই দৃঢ় ভাবে দুহাতের বেষ্টনীতে আকড়ে আছে সেহেরিশ এক বিন্দু পরিমানেও নড়তে পারছে না বরং তা নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
– আফীফ কি করছেন আপনি?আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
– আসুক এতক্ষণ যে আমার প্রাণ আটকে ছিল তোর মাঝে তখন কই ছিলি?
– এই যে আমি ফিরে এসেছি এবার ছাড়ুন।
– ছেড়ে যাবি কখনো?
– না এবার ছাড়ুন।
– সত্যি?
– সত্যি!

আফীফ সেহেরিশকে ছেড়ে দেয়।সেহেরিশ আফীফের বুকে মাথা রেখে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।এলোমেলো চুল গুলো কানের পেছনে গুজে সেহেরিশ ঘুরে তাকাতেই বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।

পুরো দেয়াল জুড়ে একটি মেয়ের ছবি।তার আশে পাশে ডায়রীর ছেড়া কাগজ লাগানো।ভালোভাবে দৃষ্টি রাখতেই বুঝতে পারে এগুলো তার ছবি।হঠাৎ ঘাড়ের কাছে তপ্ত শ্বাস অনুভব করতেই শিউরে উঠে সে।আফীফ তার ঘাড়ে মাথা রেখে দুহাত আকড়ে ধরে।সেহেরিশ অবাক কন্ঠে বলে,

– এ..এসব কি?
– কোন সব?
– দেয়ালে?
– আমার ছোট্ট তাকিয়ার ছবি।আমার ছদ্মবেশী সেহেরিশের ছবি আমার প্রাণপ্রিয় ফুলপরীর ছবি।
– এত ছবি?
– ভালোবেসে আগলে রেখেছি এই ছবি গুলো। আমার তোমাকে কাছে পাওয়া, সময় অসময় তোমাকে দেখেতে চাওয়া তৃষ্ণা মিটিয়েছে এই ছবিগুলো।ডায়রির হাজারটা পাতায় জড়িয়ে আছে তুমি নামক শব্দেরা।
– আর কি কি করেছেন আমার অবর্তমানে?

– তোমায় নিয়ে লেখা আমার অগনিত শব্দ ভান্ডারের ডায়রি’টি তোমার কাছে অমূল্যবান হলেও আমার কাছে তা চির মূল্যবান। সেই ডায়রির এক একটি পাতা যদি তুমি মনযোগ দিয়ে পড়তে তবে আমাকে আর সেই ডাইরির স্মৃতি নিয়ে দিন কাটাতে হতো না।

আফীফের কথায় সেহেরিশ কি বুঝলো কে যানে।সে শুধু শব্দ করে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।

#চলবে….