অন্তরিন প্রণয় পর্ব-২৮+২৯

0
456

#অন্তরিন_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২৮

ঘুমন্ত অবস্থায় মুখমন্ডলে কারো হাতে বিচরনে ধড়ফড়িয়ে উঠে সেহেরিশ।সামনে আফীফকে দেখে কিছুটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে আবার শুয়ে যায়।
গায়ের কাঁথাটা সরিয়ে নিভুনিভু চোখে বলে,
– ওহ আপনি?
– কাকে আশা করেছো তুমি?আমি ছাড়া কি তোমার আশেপাশে আর কেউ আসে?
– হ্যা আসে আমার বাবা-মা আসে,আমার ভাই আসে, ফুফি আসে,তুন্দ্র, কে…

কেইনের নামটা মুখে আসলেও আর বললো না।আফীফ এক গাল হেসে তার পাশে মাথার নিচে দু’হাত দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে যায়।ঠোঁট বাঁকিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
– হাহ,তারা আসে তোমার বাস্তবে নয় বরং কল্পনায় সপ্নে আর কোন দিন বাস্তবে আসবে কি না আমি নিজেও শিওর না।

আফীফের কথায় প্রত্যুত্তর করলো না সেহেরিশ।বরং অন্যপাশে শুয়ে নিঃশব্দে চোখের জল বিসর্জন দিতে থাকে।আফীফ তার অবস্থা বুঝতে পেরে উঠে দাঁড়িয়ে তারপাশে যায়।সেহেরিশ তাকে দেখে ঘুরে যেতে নিলেই আফীফ একটানে নিচে দাঁড় করায়।
– আরে করছেন কি?
– যাও ফরজের আযান শেষ ওজু করে আসো।
– পারবো না আমি।
– কিন্তু আমি পারবো কানের নিচে দুইটা চড় দিতে সেকেন্ডো ভাববো না।

সেহেরিশ মুখ কুচঁকে হেলেদুলে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।আফীফকে এখন আর বিশ্বাস নেই গত ‘দেড় বছরে’ সে অনেক পাল্টে গেছে।সে ভালোবাসা যদি দিয়ে থাকে ৬০% তবে বাকি ৪০% শাস্তি দিয়ে উসুল করে নেয়।সেদিন সেহেরিশ আফীফের সাথে একটু তর্কে জড়ায়।তারপর ওয়াশরুমে গোসল করার উদ্দেশ্য ঢুকলে ঝটপট তার পেছনে আফীফো ঢুকে যায়।কিন্তু আফীফের ওয়াশরুমে আসার কারনটা বুঝলো না সে।হুট করেই আফীফ তার মাথাটা বার্থ টবের পানির মধ্যে চেপে ধরে।সেহেরিশ ছোটাছুটি করলেও সে ছাড়ে না এক মিনিট পর সেহেরিশের মাথাটা তুলে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে।সেহেরিশের মাথায় চুমু খেয়ে বিড়বিড় করে বলে,

– ভালবাসতে চাই কিন্তু অতীত আমায় বিষিত করে।তোমার করা ভুলে আজ মাসুল দিতে হচ্ছে সবাইকে।তবুও ভালোবাসি ভীষণ ভাবে ভালোবাসি।
.
সেহেরিশ ওজু করে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই আফীফের দেখা পায়।জায়নামাজ মেঝেতে বিছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেহেরিশের অপেক্ষায় এটা তাদের প্রতিদিনের রুটিন দুজনে একসাথে ফজরের নামাজ আদায় করে।সেহেরিশ আফীফের পাশে দাঁড়িয়ে যায়।
.
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বেলা এগারোটা দেখে বিছানা থেকে উঠে বসে সেহেরিশ।তার দুনিয়া এখন পালটে গেছে। তার দুনিয়া জুড়ে এখন আফীফ ছাড়া আর কেউ নেই।গত দেড় বছরে পালটে গেছে সেহেরিশ,আফীফ এবং তাদের জীবন।ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সেহেরিশ নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত।ফর্সা সেহেরিশ আগের থেকেও সাদা হয়ে গেছে।হবেই তো দেড় বছর যে পৃথিবির আলো দেখেনি, সূর্যের রোদ পায়নি বন্দি হয়ে ছিল আফীফের এই বাসগৃহে।

দেড় বছর আগে…..

সেদিন বিয়ের কাজে যখন আফীফ ব্যস্ত তখনি তার ফোনকল আসে পুলিশ স্টেশন থেকে।অফিসার জানায় আফীফের গ্রামে কোন এক মেয়ে ধ-র্ষ-ন হয়েছে।তাই আফীফকে এই মূহুর্তে স্টেশনে একবার আসতে হবে।এমন হৃদয়বিদারক ঘটনায় আফীফ থেমে থাকতে পারেনি তাই মুহিফ সহ বাড়ির বাকিদের দায়িত্ব দিয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে স্টেশনের উদ্দেশ্য বেরিয়ে যায়।সিকিউরিটি হিসেবে তার সঙ্গে ছিল চারজন লোক।অন্যদিকে আফীফ গাড়িতে বসেও সেহেরিশের কথা ভাবছে ভালোবাসা মোহে সে এতটাই বিভোর হয়েছে যত যাই হোক সেহেরিশকে ছাড়তে পারবে না আফীফ।অন্তত আট বছরের নিদ্রাহীন দিন গুলো উসুল করতে হলেও সেহেরিশকে তার চাই।সেহেরিশ ক্রমশ তার ঘুমের মেডিসিন হয়ে গেছে।যাকে ছাড়া দুচোখের পাতা এক করলেই নিজেকে নিঃসঙ্গ লাগে।তাই সেহেরিশ যদি কোন চালাকি করেও তবে যেন মাঝ পথে আটকে যায় তাই সেহেরিশের পাসপোর্ট আফীফ নিজের দখলে নিয়ে নেয়।বিষয়টি সেহেরিশের অজান্তে করেছে আফীফ।

আফীফ স্টেশনে গিয়ে বেকুব বনে যায়।এমন কোন কল যে স্টেশন থেকে আসেনি তার প্রমান পুলিশ অফিসার নিজে দেয়।তবে তাকে ফোন কে করেছিল?নিশ্চয়ই আততায়ী দলের সদস্যরা।ভাবতেই আফীফের দম বন্দ লাগছে।আফীফ যানে আততায়ী তার পরিবারের কোন ক্ষতি করবে না কেননা, করার হলে আগেই সুযোগ বুঝে করতো।কিন্তু সেহেরিশ আসার পর থেকে বিপদ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।আততায়ীরা যে সেহেরিশকে নিশানা করেছে তা আফীফের আগেই বুঝতে বাকি নেই।তাই গাড়ির সর্বোচ্চ গতি দিয়ে চালিয়ে দেওয়ান বাড়িতে পৌছে যায় আফীফ।পুরো বাড়ি জুড়ে গান বাজছে কিন্তু মানুষের শোরগোল নেই।দ্রুত গাড়ি থেকে বের হতেই আফীফ থমকে যায় মাটিতে রক্তাক্ত একটি ছেলে পড়ে আছে।আফীফ ধীরে ধীরে বাড়ির অবস্থা দেখতে দেখতেএগিয়ে যায়।কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক নেই বাড়ির গেটের সামনে ছয় জনের রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে আছে।তাদের দেখে আফীফ চোখ বন্ধ করে নেয়।কোন জানোয়ার তাদের নির্ঘাত কুড়াল দিয়ে কোপ দিয়েছে।আফীফ তার সাথে থাকা সিকিউরিটিদের পুরো বাড়ি তল্লাশি করতে পাঠিয়ে দেয় এবং সে নিজেও বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।আফীফ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সবার দিকে।যে যার মত লুটিয়ে ঘুমিয়ে আছে।এক দৌড়ে আফীফ সেহেরিশের রুমের দিকে যায়।সারা রুম জুড়ে সেহেরিশকে না পেয়ে মাথার চুল টেনে পেছনে ঘুরতেই চমকে যায়।আয়নায় লাল লিপস্টিকে লেখা,
“মাফ করবেন আফীফ আমি চলে গেলাম।আমি ভালোবাসায় কাঙ্গাল হলেও, পরিবার আমার কাছে সর্বোচ্চ মর্যাদা পাবে সেই হিসেবে বিদায়।”

আফীফের রাগ লাগছে ভিষণ।তার সারা শরীর কাঁপছে।সহসা আফীফ তর্জনীর দুই আঙুল দিয়ে কপাল বুলিয়ে ভাবতে থাকে এটা আততায়ীর চাল নয়তো হয়তো বা সেহেরিশকে অপরাধী সাজানো হচ্ছে।আফীফ ছুটে নিচে যায় বাড়ির সবাইকে পানি ছিটিয়ে তোলার চেষ্টা করে কিন্তু কেউ চোখ সম্পূর্ণ মেলতে পারছে না।তখনি হু হু করে কান্নার আওয়াজ কানে আসে আফীফের।মৌ সোফার পেছনে ঠেস দিয়ে বসে কাদঁছে তার পাশে দ্রুত ছুটে যায় আফীফ।

– ক..কি রে কি হয়েছিল?
– আমি জানিনা বিশ্বাস করো আমি তখন বাইরে ছিলাম।ঘরে ডুকে দেখি সবাই ঘুমিয়ে আছে ডাকার চেষ্টা করি সবাইকে কেউ উঠেনা। একপর্যায়ে উপর থেকে সেহেরিশ আপু সহ তাদের সবাইকে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখি আমিও তাদের পেছনে ছুটি তারা ব্লাক হাউজে গিয়ে থেমে যায়।তাদের মাঝে বেশ কিছুক্ষণ ঝগড়া হয় তারপর সেহেরিশ আপুকে নিয়ে কেইন ভাইয়া ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় আমি কিছু বলার আগেই।তারা চলে যাওয়ার পর আমি ছুটতেই দেখি একদল লোক এসে বাড়ি ঘিরে ধরে। বাড়ির দৌবারিক গুলো ততক্ষণে মাথা নুইয়ে উঠে বসছে।কিন্তু হঠাৎ লোক গুলো কুড়াল দিয়ে বিশ্রি ভাবে তাদের কোপাতে থাকে।জানো ভাইয়া ঘুমন্ত দৌবারিক গুলোকেও ছাড় দেয় নি।
আমি চুপচাপ দেখছিলাম সবটা।আমি লুকিয়ে ছিলাম ঝোপের আড়ালে।কিছুক্ষণ পর তারা ব্লাক হাউজে ঢুকে একজন মহিলাকে নিয়ে জান।
– ওহ শিট!তার মানে সেহেরিশ সেচ্চায় চলে যায়?
– হ্যা ভাইয়া।আপু আবারো চলে গেছে।

আফীফ উঠে দাঁড়ায়।মৌয়ের মাথাটা বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।মৌয়ের কান্না ফালাফালা করে দিচ্ছে আফীফের বুক।অন্যদিকে সেহেরিশের প্রতারণা!

আফীফ ব্লাক হাউজ চেক করে যা ভেবেছে ঠিক তাই হয়েছে পারভিন নেই। তাকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।কিন্তু অন্য একজনের হদিস কেউ পায়নি সে এখনো নিরাপদ ভাবেই ব্লাক হাউজে আছে।

পুলিশদের সহ গ্রাম বাসিকে সেহেরিশের খোঁজার জন্য পাঠিয়ে দেয় আফীফ।চনন্দপুরের শেষ সীমানায় সবাই টহলে ব্যস্ত।দেওয়ান বাড়ির সকলের হুশ ফিরে এসেছে।

সর্বশেষ এগারোটা লাশ পাওয়া যায়।তাদের মৃত্যুর কারন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ।দেওয়ান মঞ্জিলের বিয়ে বাড়িটা বর্তমানে প্রিয়জন হারানোর আহাজারিতে ভরপুর।আফীফের চোখে রক্তিম ভাব ধারন করে আছে।একদিকে সেহেরিশের প্রতারণা অন্যদিকে আফীফের বহুপুরোনো দৌবারিক গুলোর মৃত্যু।কে নেবে এই মৃত্যুর দায়।আফীফ সবার পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছে।কিন্তু এই পরিবারের মানুষগুলোর কান্না কোনদিন থামবেনা।
তবে আফীফ বুঝে নিয়েছে এই মৃত্যুর পেছনে সেহেরিশের কিছুটা হলেও দায় আছে।কেননা যদি তাদের ঘুমের ওষুধে কেউ ঘুমিয়ে না যেত তবে আজ আততায়ী গুলো বাড়িতে হামলা করার সাহস পেতনা।পেলেও তখন যে করেই হোক তাদের দমন করার ব্যবস্থা থাকতো।আর মিথ্যা ধ-র্ষ-নের কথা বলে যে আফীফকে আততায়ীরা কৌশলে বাড়ি থেকে বের করেছে তা আফীফের কাছে এখন সম্পূর্ণ পরিষ্কার।

আফীফ আর দেরি করলো না রাত তিনটায় সেই এগারোটা লাশের জানাজা সম্পূর্ণ করে কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করে।দেওয়ান বাড়ির এই কলঙ্ক চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে অনন্তপুর থেকেও এই শীতের রাতে লোক আসা যাওয়া করছে।ফজরের আযানের সুর ধ্বনি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আফীফ বসার ঘরে কপালে হাত দিয়ে ভাবনায় ব্যস্ত।কিছুক্ষণ আগে খবর এসেছে সেহেরিশ এবং তার পরিবারের সবাইকে পাওয়া গেছে।তারপর তাদের ধরে আনার ব্যবস্থা করে গ্রামবাসী।আর আফীফ সেই অপেক্ষায় আছে।আফীফ দু’চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে সেহেরিশের কথা।তার জন্য সে কি না করেছে।অনন্তপুরের মতাব্বর রমিজ মিয়াকে সৌদি পাঠিয়ে দিয়েছিল কেননা জমির ঝামেলাটা আফীফ সমাধান চায় না আর সমাধান না হলে তাদের থেকে যেতে বাধ্য করবে দেওয়ান মঞ্জিলে।ধীরে ধীরে সবটা ঠিক ছিল কিন্তু প্রাপ্তির দিন তার পাওনা খাতা সম্পূর্ণ শূণ্য!

আফীফের ভাবনা মাঝেই তার পায়ের সামনে ধম করে কিছু পড়ার শব্দ পেলো।মাথা তুলে তাকাতেই
সেহেরিশকে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।সেহেরিশের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সেঁজুতি।তার চোখে যেন আগুন জ্বলছে আর সেই আগুনে ভস্ম করতে প্রস্তুত সেহেরিশকে।তখন সেহেরিশকে দরজার সামনে দেখে চুলের মুঠি টেনে আফীফের পায়ের সামনে ফেলে।

– আম্মা কি….
আফীফকে কিছু বলতে না দিয়ে সেঁজুতি গমগম সুরে বলে,
– চুপ!একটা কথা শুনতে চাই না।এই মেয়ের কারনে আমার ছেলের জীবন অতীতে মরণাপন্ন ছিল আর এখন,এখন তো এতবড় একটা বেইমানি করলো।কোন কথা নয় আফীফ আজ এই মূহুর্তে বিয়ে হবে তোদের।
আফীফ ক্ষীণ হাসে।সোফা ছেড়ে নিচে বসে সেহেরিশের থুতনিতে হাত রেখে বাকা হেসে বলে,

– বিয়ে তো করবো আম্মা।অবশ্যই করবো।কিন্তু আমার সাথে বেইমানি করার শাস্তি যে বাকি আছে।এত গুলো মানুষের মৃত্যুর কারনের জন্য হলেও প্রতিশোধ নিতে হবে আমায়।

সেহেরিশ চোখ তুলে তাকায় আফীফের দিকে।আফীফ তার থুতনিটা আরো জোরে চেপে ধরে একগাল হাসি দিয়ে বলে,
– ভয় নেই ফুলপরী,ব্যাক্তিগত মানুষগুলোর প্রতিশোধ নিতে হয় প্রণয়ের আঙ্গিকে।আমার প্রণয়ের আগুনে তুমি জ্বলে যাবে কথা দিলাম।

তারপর সেহেরিশ এবং আফীফের বিয়ে হয়ে যায়।কিন্তু সেহেরিশকে দেওয়ান মঞ্জিলে বরণ করে তোলার পরিবর্তে আফীফ তাকে নিয়ে যায় ব্লাক হাউজে যায়।আর সেখানে শুরু হয় তাদের বিবাহিত সংসার।ব্লাক হাউজে বন্দিনি সেহেরিশ দেখেনি আর পৃথিবির আলো,অনুভব করেনি সূর্যের তাপ,বৃষ্টি,কুয়াশা।আর দেখা হয়নি পরিচিত কোন মানুষজনের সাথে।তার জীবন জুড়ে আছে শুধু আফীফ দেওয়ান।আর ব্লাক হাউজের বিশাল একটি রুম জুড়ে সব ব্যবস্থা থাকলেও নেই কোন জানালা।একটি দরজার মাধ্যেমে আফীফ সবসময় যাতায়াত করে।এভাবে আফীফের অন্তরিন প্রণয়ে কেটে যায় সেহেরিশের জীবন থেকে দেড় বছর।

___বর্তমান___
অতীত ভাবতে ভাবতে সেহেরিশ যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে তার হেলদোল নেই।ঘুমন্ত অবস্থায় ঘাড়ে তীব্র ব্যাথা অনুভব হতেই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সেহেরিশ।সামনে আফীফকে দেখে দুটো ঢোক গিলে মিনমিনিয়ে বলে,

– আ..আপনি?
– এখানে কি কেউ আসার কথা ছিল নাকি?
সেহেরিশ প্রত্যুত্তর করলো না বরং সটান হয়ে আবার শুয়ে পড়ে আফীফ তার উপর শুয়ে দুগাল চেপে দাঁত খিচে বলে,
– তুমি বড্ড জ্বালাও আমায় সেহেরিশ।রোমাঞ্চের সময় শুধু ডিস্ট্রাব করো।বলেছিনা আমার রোমাঞ্চে বিঘাত ঘটালে ফলাফল ভালো হবে না।
– আপনার এটাকে রোমাঞ্চ বলে না অত্যাচার বলে।
– সে যাই বলো।একটু আদর করছি আর একটু কষ্ট দিচ্ছি এটাই তো কথা ছিল তাই না?
– আমি মুক্তি কবে পাবো বলবেন আমায়?
– হাহ,মুক্তিটা নির্ভর করে তোমার প্রশ্নের উপর কোন মুক্তি চাইছো এই ব্লাক হাউজ থেকে নাকি আফীফের জীবন থেকে।

সেহেরিশ এবারো কিছু বললোনা।আফীফ তার নীরবতা বুঝতে পেরে ঠোঁটের কাছে স্লাইড কর‍তে থাকে,
– মুক্তি কোন দিন পাবে না গো ফুলপরী।না আফীফের জীবন থেকে আর না ব্লাক হাউজ থেকে।অবশ্য ভাগ্য কখন কি করে বলা যায় না।
– আমার ভাইটাকে একবার দেখতে দিন আফীফ।সে তো নিস্পাপ তার দোষ নেই।
– কিন্তু তুমি তো নিস্পাপ নও।তোমার কারনে এগারোটি পরিবার এখনো মোনাজাতে কাঁদে।স্বামী,বাবা,সন্তান হারানোর কষ্টে।
– আমি তো অনুতপ্ত সেদিন আমার কিচ্ছু করার ছিল না।পাপা আমায় গায়ের হলুদের দিন রাতে কসম কাটায় পারভিনকে ছাড়তে পারলেই আমরা পালিয়ে যাবো আর….,

সেহেরিশ আরো কিছু বলার আগেই আফীফ উঠে দাঁড়ায়।তাকে ছুড়ে দূরে সরিয়ে ক্লজেট থেকে জামা কাপড় নিতে নিতে বলে,
– তোমার শরীর বেশ কয়েকদিন দূর্বল। টি-টেবিলে স্যুপ রাখা আছে চুপচাপ খেয়ে নাও আমি এসে যেন দেখি সবটা শেষ।

আফীফ জামা নিয়ে গোসল করতে চলে যায়।অন্যদিকে সেহেরিশের রাগ লাগছে।সব কিছু এলোমেলো লাগছে তার কাছে।যার দরুনে
স্যুপের বাটিটা হাতে তুলে ছুড়ে ফেলে দেয় মেঝেতে।বাটি ভাঙ্গার শব্দে সহসা দরজা খুলে আফীফ।খাওয়ার নষ্ট হতে দেখে তার মাঝে রাগটা আরো দিগুন বেড়ে যায় সেহেরিশের দিকে এক পা দু পা এগিয়ে এসে চুলের মুঠি টেনে ধরে,

– বলেছি না খাবার অপচয় আমার পছন্দ না তবে ফেলে দিলি কেন?
– আমার মন যা চাইবে আমি তাই করবো।
সেহেরিশের রুষ্ট কন্ঠ।কিন্তু তাতে দমে যায়নি আফীফ বরং আরো জোরে টেনে স্থির হেসে বলে,
– তাই বুঝি?ঠিক আছে তবে আমার যা ইচ্ছে আমিও তাই করবো।

আফীফ সেহেরিশকে টানতে টানতে কাঁচ ভাঙ্গা স্থানে হাটিয়ে ছাড়ে।সেহেরিশের চিৎকারেও কোন লাভ হয়নি।এদিকে দুপায়ের রক্ত দেখে জ্ঞান হারানোর অবস্থা সেহেরিশের কেননা ছোট থেকেই তার রক্তে ফোবিয়া। আফীফের দুহাত আকঁড়ে ধরে সেন্সলেস হয়ে যায় সে।তখন আফীফের হুশ ফিরে সেহেরিশকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দেয়।দুপায়ের তালু পরিষ্কার করে দ্রুত ব্যান্ডেজ করে দেয়।সেহেরিশের গলায় মুখ ডুবিয়ে অঝোরে কাদঁতে থাকে আফীফ।তার বুকের ভেতরটায় কেউ যেন চাকু দিয়ে ফালাফালা করছে।

– আমি কি করবো সেহেরিশ?তুমি আমার আসক্তি ভালোবাসা।তোমায় নিজ হাতে কষ্ট দেওয়ার পর প্রতিবার আমার মনে হয় আরেকবার তোমায় কষ্ট দেওয়ার আগে আমার যেন মৃত্যু হয়।কিন্তু তোমার আচরণে আমায় রাগিয়ে দেয়।বার বার চোখের সামনে এগারোটা লাশ ভেসে উঠে।তখনি নিজেকে দমাতে পারিনা।বিশ্বাস করো আমি তোমায় ক্ষমা করে দিয়েছি কিন্তু বার বার কেন যেন মনে হয় আমাদের ভালোবাসার উপর সেই এগারোটা লাশের এবং তাদের পরিবারের অভিশাপ জড়িয়ে আছে।আমি জানি না কিছু, আমি শুধু জানি আমার ফুলপরী আমার কাছে থাকবে।
.
অন্যদিকে নিজের মেয়েটাকে একবার দুচোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে দেখার জন্য রাত দিন বেশির ভাগ সময় দেওয়ান মঞ্জিলের বাইরের গেটে পড়ে থাকেন, খুরশীদ,মারুফা,ফাহমিদা এবং সামী।কিন্তু এই বাড়ি গেটে যে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে আফীফ দেওয়ান।শতবার অনুরোধেও মন গলেনি আফীফের।জীবনের তাগিদে ইতালি শহরে ফিরে গেছে কেইন,তুন্দ্র।আগের মতো তাদের হাসিখুশি জীবন নয় বরং চুপচাপ গম্ভীর থাকে সবসময়। এই দেড়বছর সময়টা অভিশাপের কাতারে চালিয়ে দিয়েছে তারা দুজনে।

#চলবে…

#অন্তরিণ_প্রণয়
#পলি_আনান
#পর্ব_২৯

সারা রুম জুড়ে পাইচারি করে একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে সোফায় বসে যায় সেহেরিশ।হাতে থাকা উপন্যাস বইটা নেড়ে দেখে ছুড়ে মারে বিছানার উপর।একা থাকতে যেন সমস্যা না হয় তার জন্য একগাদা বই কিনে এনেছে আফীফ।প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলেও একটা পর্যায়ে বই পড়ার উপর নেশা লেগে যায়।কিন্তু বর্তমানে আবার তার কেমন যেন অসহ্য লাগছে সবকিছু।অল্পতেই ক্লান্তি নেমে এসে ভর করেছে শরীরে।আজ সেই দুপুরে আফীফ বেরিয়েছে এখনো আসেনি।কি অদ্ভুদ সে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাত নয়টা দেখে উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে যায়।ধীরে ধীরে তার চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম।

– স..সেহেরিশ!

পরিচিত কারো কন্ঠো কানে আসতেই সেহেরিশ দু’চোখ চমকে খুলে তাকায়।তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে চিরচেনা সেই প্রিয় মুখ।
– সেহেরিশ!
সেহেরিশ উঠে বসে।তার দু’চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না।জুহি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।তার বেস্ট ফ্রেন্ড জুহি।
সেহেরিশ উঠে দাঁড়িয়ে যায়।চোখে মুখের বিস্ময় কাটিয়ে ঝাঝালো গলায় বলে,

– তুই এখানে কি করছিস?বেইমান।
– সেহেরিশ আমার কথাটা শুন।
সেহেরিশ জুহিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
– আরে তুই রেগে যাস না প্লিজ সেহেরিশ আমার কথাটা শুন।
– কি শুনবো?কি শুনবো বেইমানের কথা শোনার ইচ্ছা আমার নেই।
– তোর সাথে আমি কি করেছিলাম।প্লিজ সেহেরিশ মাথাটা ঠান্ডা কর।
– কি করতে বাকি রেখেছিস? তোর ভাইকে দিয়ে এবার আমাকে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করে দে।আমার আর ভালোলাগছেন না এইসব।
– সেহেরিশ রাগের মাথায় এইসব বলে লাভ নেই তুই প্লিজ আমার কথা শুন।

সেহেরিশ শুনলোনা।জুহি এগিয়ে এসে তার হাত ছুঁয়ে দিতেই রাগ দেখিয়ে আবারো ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়।টি-টেবিলের উপর থাকা কাচের গ্লাসটা নিয়ে ছুড়ে মারে জুহির মাথায়।সেহেরিশের এতটাই রেগে গেছে যে তার মাঝে হিতাহিত জ্ঞান নেই।শেষ বার কফির মগটা ছুড়ে মারতেই মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত ঝরতে থাকে জুহির।কিন্তু জুহি এখনো সেহেরিশের ভুল ভাঙ্গাতে ব্যস্ত।
.
ব্লাক হাউজের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পাইচারি করছে মুনিফ।আফীফ তাকে আজ বলেছে আসতে তার দেরি হবে তাই জুহির রিকুয়েষ্টে মুনিফ রিক্স নিতে রাজি হয়।ব্লাক হাউজের চাবি বর্তমানে একমাত্র আহনাফ দেওয়ান এবং আফীফের কাছে থাকে।আহনাফ দেওয়ানের পায়ে ধরে মিনতি করায় এক পর্যায়ে তিনি চাবি দিতে রাজি হন।

– কি রে তুই এখানে?
আফীফের কন্ঠে শুনে মুনিফ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।তার বুকের ভেতরে লাফালাফি করা হৃদপিন্ডটা এবার যেন লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে।
– ক. কিছু না ভাই।
– কিছু না মানে?একি সেহেরিশের দরজার তালা খোলা কেন?
আফীফ রেগে যায়। দ্রুত দরজার ছিটকিনি খুলে রাগান্বিত সেহেরিশকে দেখে চমকে যায়। ডানে তাকাতেই রক্তাক্ত জুহিকে দেখে আপনা আপনি মুখটা হা হয়ে যায়।
– জিউ!জিউ তোর এমন হলো কি করে?
– ভাইয়া আমি সেহেরিশের সাথে কথা বলতে চাই।প্লিজ তুই ওকে শান্ত থাকতে বল।
– বললাম তো তুই বেরিয়ে যা এখান থেকে আমার কিছু জানার নেই আর কিছু শোনার নেই।

সেহেরিশের কথায় আফীফের বুঝতে বাকি নেই জুহিকে প্রহার সেহেরিশ করেছে।আফীফ জুহিকে টেনে কাছে আনে, সেহেরিশের দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ সুরে বলে,
– বারবার তোমার ভুল আমাদের মাঝে দূরত্ব তৈরি করে আর তা তুমি বুঝেও বোঝোনা।

.
জুহির পাশে অপরাধী মুখ করে বসে আছে আফীফ।তার ভেতরটায় নিংড়ে যাচ্ছে লজ্জায় নত হচ্ছে সবার কাছে বার বার।ফাতেমা তার দিকে তাকিয়ে রুষ্ট কন্ঠে বলে,
– এই মাইডার মাঝে কি আছে বুঝিনা আমি।একটা গেলে দুইডা আইবো।তবুও এই মাইয়াডার সব কীর্তি ভুইলা তারে নিয়া থাকস তুই।আমগো কোন দাম নাই তোর কাছে এহন তো আমরা পর।ওই মাইয়ার কারনে আজ আমার নাতিনডার মাথাডা ফাটলো এর জবাব তোরে আজ দিতেই হইবো।

ফাতেমার কথায় চোখ তুলে তাকায় আফীফ।

জুহি তার দাদী ফাতেমার দিকে তাকিয়ে বলে,

– দাদীজান সেহেরিশকে নিয়ে বাজে বকবে না।সেহেরিশ আমার কি তা তোমরা জানো না।ইতালিতে আমার আরেক পরিবার ছিল তারা।আঙ্কেল আন্টি কখনো আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি বরং তারা সবসময় নিজেদের মেয়ের মতো আমাকে দেখে রেখেছে।আমার নিজের কাছে বর্তমানে অপরাধী লাগছে।

জুহির কথায় তাল মেলায় তার মা তাহিরা,

– হ্যা জুহি ঠিক বলেছে।বলি কি আফীফ এবার সেহেরিশকে ছেড়ে দাও।তোমাদের বিয়ের দেড় বছর প্রায় হয়ে গেছে এখন সুস্থ ভাবে সংসার চালিয়ে যাও।

আফীফ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে।সেঁজুতি তখনি গমগমে সুরে বলেন,

– কার দোষ দেবো আমি?আমার ছেলের নাকি ওই মেয়ের।ছেলে মেয়েটাকে ভালোবেসেছে আর মেয়েটাও শেষ পর্যায়ে সম্মতি দিয়েছে তবে শেষ ভেজালটা লাগালো তার বাপ।এবার বলুন বাপ বেটির রেষারেষিতে এগারো জন মরলো।সেই পরিবার গুলোর অভিশাপ কি নেই?নাকি সেই মৃত মানুষগুলোর অভিশাপ নেই।তবে চিরতরে এই দেওয়ান বাড়ির গায়ে কলঙ্ক লেপ্টে গেছে।যাই হোক আমি এবার চাই তোরা সংসার গুছিয়ে নে আফীফ।

সেঁজুতির কথায় আফীফ কিঞ্চিৎ হাসে।কিন্তু তার হাসিটা অদ্ভুত।
– আম্মা আমি সংসার করছি আর আমার সংসারে সুখ আছে।কিন্তু সুখের মাঝে অতীতের কালো ছাঁয়াটা নেমে এসে সব তছনছ করে দেয়।

আফীফ উঠে দাঁড়ায়।জুহির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
– জিউ মাফ করে দিস।সেহেরিশের সুখ মানে আমার সুখ।সেহেরিশের দুঃখ মানে আমার দুঃখ।আর সেহেরিশের অপরাধ মানে আমার অপরাধ মাফ করে দিস বোন।
.
সেহেরিশ অস্থির ভঙ্গতি পা দোলাচ্ছে।জুহির জন্য খারাপ লাগা সৃষ্টি হচ্ছে মনে।তবে আবার মনে হচ্ছে সে যা করেছে বেশ করেছ।আফীফকে রুমে ডুকতে দেখে দাড়িয়ে যায়।আফীফ কাছে এসে তার থুতনি চেপে ধরে।

– তোমার ধারণা আছে তুমি কি করেছ?
– যা করেছি বেশ করেছি।জুহি আমার সাথে বেইমানি করেছে।
– না জেনে কথা বলবেনা একদম।
– না জেনে কথা বলা আমার স্বভাব না।আপনি প্রায় সময় জিউয়ের সাথে কথা বলেন তবে জিউ কে?আমি জানতাম না।আমার ইতালিতে থাকা কালীন এত এত ছবি আপনি কি করে পেলেন?দেয়ালের একটা ছবিও আমার তোলা নয় সব আমার অগোচরে তোলা।আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল উওর আমি পাইনি।সেদিন বিয়েতে রাতে আপনার ফোনের মেসেজটি দেখে আমার বিশ্বাসে আঘাত লাগে আফীফ।সেদিন স্পষ্ট জুহির নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছিল,

” ভাইয়া তুমি ব্লাক হাউজ থেকে পারভিন আন্টিকে ছেড়ে দাও।যেহেতু তোমার শর্ত ছিল যেদিন সেহেরিশ তোমার হবে সেদিন পারভিন মুক্তি পাবে।আর সেহেরিশকে প্লিজ তুমি বলার দরকার নেই আমি যে তোমার কাজিন জুহি।আমি দেশে এসে সেহেরিশকে বুঝিয়ে বলবো।সেহেরিশ আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সে অন্তত আমাকে ফিরিয়ে দেবে না।তোমাদের ভালোবাসার জয় হোক!”

ওইদিনে মেসেজটা পড়ে আমার মূহুর্তে জুহিকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে হয়েছিল।এদিকে বাবা আমায় আগে থেকে তার কসম দিয়েছিল যদি পারভিন আন্টিকে মুক্ত করতে পারি তবে আমি যেন ইতালি ফিরে যাই।গায়ে হলুদের আগের দিন রাতে পাপা আমায় বলেছিল তোমার সাথে সংসার বাধঁলে আমি তার মরা মুখ দেখবো।একদিকে বাবা অন্যদিকে তুমি।জীবনটা নরক লাগছিল।তাই সেদিন জুহির বিশ্বাস ঘাতকতায় হুট করে সিধান্তটা নিয়ে নিলাম।তোমায় বিয়ে করে ছেড়ে যাওয়ার চেয়ে না হয় বিয়ে না করেই পালিয়ে গেলাম।

আফীফ চুপচাপ ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।সে জানে সব দোষ খুরশীদ আনওয়ারের।বেচারি সেহেরিশ তো খেলার পুতুল।একবার খুরশীদ নাচায় আবার আফীফ।ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আফীফ সেহেরিশকে একপলক দেখে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।বাইরে দাঁড়িয়ে কাউকে ফোন করে জানতে চায়,

– পারভিন, পারু কারো খোঁজ পেয়েছো তোমরা?
– সরি ভাইজান।পেলাম না।তবে আমরা থেমে নেই সব জায়গায় লোক সেট করা আছে।
– কুত্তার বাচ্চা গুলোকে খুঁজতে এতটা সময় লাগে কেন তোদের?পারভিন আর পারুকে খুজতে যতটা দেরি করবি আমার ঘরের বউ তত কষ্টে থাকবে।আমি যাস্ট তোদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দেবো যদি খোঁজ না পাস।দুইবোন ভেবেছেটা কি?তাদের একজন ১৩ বছর নিখোঁজ অন্যজন দেড় বছর।সব তল্লাশি কর আমার এইসব গোলমাল আর ভালো লাগছেনা।
– ভাইজান আমি লোক বাড়িয়ে দিচ্ছি ইনশাআল্লাহ ভালো সংবাদ পাবেন।
– হুম।

আফীফ আবারো রুমে প্রবেশ করে।সেহেরিশ এখনো দাঁড়িয়ে আছে এসির মাঝেও সে ঘামছে।আফীফ তার পাশে দাঁড়িয়ে গায়ের শার্ট খুলে সোফায় ছুড়ে মারে।আফীফের অঙ্গভঙ্গি দেখে সেহেরিশ ঘাবড়ে যায়।এই ছেলে রাগের মাথায় আবার কিছু করবে না তো।সেহেরিশ ঢোক গিলে আরেকটু চেপে দাঁড়ায়।তখনি কানে বজ্রের ধ্বনির মতো ছুটে আসে আফীফের কন্ঠ।

– চিন্তা ধারা পাল্টাও সেহেরিশ।শাট খুলে ফেলেছি মানে এই নয় যে তোমার সাথে ইয়ে করবো।

আফীফের কথায় সেহেরিশ থতমত খেয়ে যায়।আফীফের লোমশ বুকের দিকে তাকিয়ে সহসা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।আফীফ তার দিকে তাকিয়ে আড় চোখে বলে,
– আমি তো তোমারি তাকাও যত ইচ্ছে।
– হ্যা আমার তো খেয়ে দেয়ে আর কাজ নেই।
– নেই তো তুমি জানো না,তোমার কাজ আফীফকে সঙ্গ দেওয়া।এই ছাড়া আর কাজ নেই।

আফীফ উদাম দেহে ল্যাপটপ নিয়ে বিছানায় বসে যায়।সেহেরিশ সেদিকে তাকিয়ে মূহুর্তেই গলে যায়।
– আল্লাহ এই ছেলে এমন কেন?

সেহেরিশের ভাবনার মাঝেও আফীফ ডেকে উঠে,

– টুনটুনি বউ চুপচাপ পাশে এসে বসে যাও।

সেহেরিশ অবাক হয়।একটু আগে তুফান বয়ে গেছে অথচ এই ছেলের কোন হেলদোল নেই।সেহেরিশ আফীফের পাশে বসতেই আফীফ তাকে টেনে বুকে জড়িয়ে নেয়।এক হাতে সেহেরিশের চুলে বিলি কাটছে অন্য হাতে ল্যাপটপে তাদের পুরোনো ছবির ফোল্ডার বের করে।সেহেরিশ আফীফের বুকে লেপ্টে আছে চুপচাপ।এই মূহুর্তে তার মাথায় কোন চিন্তা নেই,নেই কোন হতাশা।

– দেখো সেহেরিশ এটা আমাদের ছোট্ট জুহি।আর জুহি আমার ছোট চাচার মেয়ে।
– কিন্তু আপনি তো তাকে জিউ বলে ডাকেন?
– আদর করে ডাকি।ছোট বেলায় মজার ছলে ডাকতে ডাকতে এখন অভ্যাসে পরিনত হয়েছে।
– আমি যখন এই বাড়িতে ছিলাম তখন তারা কোথায় ছিল?
– চাচার কাজের উদ্দেশ্য ঢাকায়।তুমি তাকে একটুও দোষী ভেবো না সেহেরিশ।যা করেছে আমার জন্য করেছে।আমি তখন রাত দিন ঘুমের মেডিসিন নিতাম।যার ফলে আমার অবস্থা করুন।সেদিন পারভিনের উপর ভীষণ ভাবে রেগে যাই তাই তাকে ব্লাক হাউজে বন্দি করি এবং ওয়াদা করি যেদিন আমি তোমায় পাবো সেদিন তাকে মুক্তি দেবো।পারভিনকে শারীরিক, টর্চার আমি করিনি।শুধুমাত্র তোমার মতো বন্দি রেখেছি।যখন তোমার কথা মনে পড়তো তখন ইচ্ছে হতো চাবুকের বারি দিয়ে তাকে রক্তাক্ত করতে কিন্তু আমি তখনো নিজেকে দমিয়ে রাখি।কারন সে বেইমানি করেছে আমাদের সঙ্গে আর আমার বিশ্বাস ছিল আমি তোমায় পাবো।সবচেয়ে বড় বেইমান তো পারভিন আমাদের খেয়ে আমাদের সঙ্গ দিয়ে বেইমানি করেছে।
আর জুহি আমার অবস্থা দেখে ইতালিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।তোমাদের খোঁজ খবর শিওর ভাবে পেয়ে জুহি তার পরিবার নিয়ে ইতালি চলে যায়।আর এইভাবে তোমায় নজরে নজরে রাখে।

সেহেরিশ দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।এই মূহুর্তে নিজেকে অপরাধী লাগছে।জুহিতাকে কোন দিন কষ্ট দেয় নি তবে সে আজ কি করলো?মূহুর্তে সেহেরিশ ঠোঁট কামড়ে কেঁদে দেয়।
– আমি ভুল করে ফেলেছি আফীফ।প্লিজ আমায় জুহির সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিন।আমি দেখতে চাই তাকে।
– সম্ভব না।বাদ দাও সেসব কথা।তোমার পারভিন আন্টির বন্দি দশার ছবিটা দেখো,

সেহেরিশ চোখ মুছে ল্যাপটপে তাকিয়ে মুখ কুচকে নেয়,
– এটা পারভিন আন্টি হলেও কিন্তু আন্টির গালে তো এত বড় তিল ছিল না।
– কি বলছো এইসব?
– হ্যা আমার মনে আছে আন্টির গালে কোন তিল ছিল না।
আফীফ চমকে যায় দ্রুত ফোন হাতে নিয়ে সেঁজুতির নাম্বারে কল করে,
– আম্মা একটা কথা জানার ছিল।
– কি কথা?
– পারভিন আন্টির গালে কি কোন তিল ছিল?
– না তিল ছিল তার জমজ বোন পারুর গালে।

আফীফের শ্বাস আটকে গেছে এত বড় ভুল!সেদিন তবে পারভিনের পরিবর্তে দৌবারিকরা ভুলে পারুকে ধরে এনেছিল।কিন্তু আফীফ পারুকে তখনো পাচঁ বছর আগ থেকে খুজে যায়।আর এদিকে পারু তার কাছেই বন্দিনি ছিল।তবে পারভিন কোথায়?জমজ দুই বোন হওয়ার কারনে সবাই চেহারা নিয়ে সংশয়ে ডুবে যায়।

আফীফের চিন্তিত মুখ দেখে সেহেরিশ ভ্রু কুচকে বলে,
– কি হয়েছে?
– কিছু না।
আফীফ সেহেরিশের মাথাটা টেনে কপালে চুমু খায়।
.
কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। দিন দিন সেহেরিশের দূর্বলতা বেড়ে গেছে।হুট হাট ঘুরে যায় মাথা।মাঝে মাঝে বেশ বুমি পায় আফীফ তার অবস্থা বুঝতে পেরে কিট এনে দেয় এবং সেহেরিশকে বলে প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট করতে।কিন্তু প্রেগ্ন্যাসির ফলাফল দেখে সেহেরিশ বাকরুদ্ধ।
– কি হয়েছে তোমার চোখ মুখ এমন লাগছে কেন?
– আমি প্রেগন্যান্ট!

সেহেরিশের মুখে হতাশার ভাব এদিকে আফীফ খুশির ঝোকে তার সামনে হাটু মুড়ে বসে কেঁদে দেয় শব্দ করে।
– ইয়েস আমি বাবা হতে চলেছি সেহেরিশ আমাদের সংসারের পূর্ণতা পাবে আর তুমি মা হবে।
– কিন্তু আমি হতে চাই না।
– মানে?
– আমার বাচ্চার প্রয়োজন নেই।

সেহেরিশের এমন কথায় আফীফ প্রত্যুত্তর করার মতো শক্তি পেল না সে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
#চলেবে…..