অন্তর্দহন পর্ব-১৩

0
548

#অন্তর্দহন_১৩
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি

ভোরের আলো একটু একটু করে ফুঁটছে। পূর্ব দিগন্তে নববধূর ন্যায় রাঙা সূর্য উঁকি দিয়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। আঁধার সরিয়ে প্রকৃতি আলোকিত হলেও উদ্দিন বাড়িতে অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার বিরাজমান।
রাত শেষ হতে চললেও একজোড়া চোখও বিশ্রাম পায়নি। সদর দরজার মুখে তমিজ উদ্দিন মাথা উঁচু করে চিন্তিত চোখে তাকিয়ে রয়েছেন, মনে মনে খুঁজে চলেছেন অভ্রকে। মিথুন উদ্দিন ডাইনিং টেবিলের উপর মাথায় হাত রেখে চুপচাপ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে রয়েছে। খোকন উদ্দিন একবার বড় ভাইয়ের কাছে যাচ্ছে, একবার ছোট ভাইকে স্বান্তনার বাণী শোনাচ্ছে। বড় চাচী আর নাসরিন দু’জনেই ঘরের দরজা আঁটকে থম মেরে গেছেন। শুধু শিখা খানিক বাদে বাদে আক্রোশপূর্ণ চাপা চিৎকারে বাড়ির নিরবতা কাটিয়ে কান্নার সুর ভাজছে। আর শায়লা? সে যেন জনমের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বড় জানালার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে আকাশপানে মুখ করে তাকিয়ে রয়েছে সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, ঝড়ের আঘাতে আহত এক পাখি, যার ডানাজোড়া ভেঙে গিয়েছে। চিরজীবনের জন্য উড়ার সাঁধ মিটে গিয়েছে।
খোকন উদ্দিন শিখাকে একটা রাম ধমক লাগালেন। বললেন,
-“এত কান্নাকাটি কীসের হ্যাঁ? যাও ভেতরে যাও।”
শিখা থামলেন না বরং সমান তেজ নিয়ে গলা বাড়ালেন,
-“আমাকে থামতে বলছো তুমি? আমার মেয়ের এতবড় সর্বনাশ হয়ে গেল, আর তুমি আমাকে থামতে বলছো? চেয়ে দেখো,আমার মেয়েটা কেমন হয়ে গেছে। আর তুমি বাপ হয়েও কী করে এত চুপচাপ থাকতে পারো? হ্যাঁ?”
খোকন উদ্দিন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন। সে তো আগেই বলেছিলেন, শায়লা আর অভ্রর বিয়ে যেভাবেই হোক, ছাড়াছাড়ি করিয়ে দিতে। অথবা দু’জনের পরিপূর্ণ মত নিয়ে তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিতে। শিখাই তখন বাড়াবাড়ি করে খোকন উদ্দিনকে থামিয়ে রেখেছিলেন। আর শায়লারও মত পেয়ে তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো অভ্রও এই বিয়েতে রাজী আছে। তাই আর কথা বাড়াননি। অথচ আজ শুনলেন, শায়লাকে কোনোদিন ভালোবাসা তো দূর, অন্যরকম চোখেই দেখেনি অভ্র! তার সম্পর্ক আর কারো সাথে নয়, তাদেরই পরিবারের মেয়ে পড়ন্তর সঙ্গে! শেষমেশ কী হলো? একই পরিবারের তিন-তিনটে জীবন নষ্ট হয়ে গেল! আজ শায়লা থমকে গিয়েছে, অভ্র-পড়ন্ত ঘরছাড়া হয়েছে… এরপর আর কী কী ঘটবে! কে জানে!
খোকন উদ্দিন নিতুকে বললেন,
-“ওকে ঘরে নিয়ে যা তো। ওরে একটু ঘুমোতে বল।”
নিতু দু’কদম এগোতেই শায়লা পেছন ফিরে তাকালো। খোকন উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“আমার ঘুম আসবে না বাবা। আমি এখানেই থাকি না.. ও আসবে। আমি জানি বাবা, ও আসবে।”
নিতু চমকে উঠল। শায়লার কথার ধরন এবং সুর, কোনোটাই ভালো ঠেকলো না তার কাছে। শায়লার ব্রেইনে অতিরিক্ত চাপ পেয়ে পাগল টাগল হয়ে যাবে না তো! ইশ, কী যে হবে… নিতুর চিন্তা হলো। মনে মনে উপর ওয়ালার কাছে প্রার্থনা করলো, ‘সবকিছু ভালোভাবে ঠিকঠাক হয়ে যায় যেন খোদা। এই তিনটি জীবনকে তুমি গুছিয়ে দাও।’

একটা চাপা নিঃশ্বাস নিতুর নাসিকা রন্ধ্র ভেদ করে বেরিয়ে আসলো। সে শায়লার কথাকে পাত্তা না দিয়ে তাড়া কণ্ঠে বলে উঠল,
-“আপা, চলো। ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও।”
-“আমি কী বললাম, তুই শুনিসনি? ও আসবে, আমি জানি। আমি কোত্থাও যাবো না, আমি এখানেই থাকবো।”
নিতু পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করল,
-“আচ্ছা, আসবে তো ভাইয়া। আমি কী বলছি যে আসবে না? আসুক আগে। আসলে তো তোমার কাছেই যাবে আগে তাই না? তুমি ভেতরে চলো। আসো..”
শায়লার একটা হাত চেপে ধরলে ঝটকা মেরে সেটা সরিয়ে নেয় সে। নিতুর দিকে কটমট করে তাকালে তমিজ উদ্দিন এগিয়ে আসেন। শায়লার মাথায় হাত রেখে বললেন,
-“তোর সংসার আমি ভাঙতে দিবো না মা। তুই চিন্তা করিস না। অভ্র যদি আমার কথা না শোনে, তাহলে এই বাড়িতে ওর আর কোনো জায়গা হবে না।”
মিথুন উদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
-“তাহলে আমার মেয়ের কী হবে ভাইজান? শায়লার কথা আপনি চিন্তা করলেন, আর আমার মেয়ের কথা চিন্তা করলেন না?”
-“বিয়ের আগে কেন সে পরিবারে জানায়নি এই কথা? এখন শায়লার সাথে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তামাশা করলে তো চলবে না। আর যদি অভ্রকে পড়ন্ত না ছাড়ে, তাহলে ওর-ও এই বাড়িতে কোনো জায়গা হবে না।”
কঠিন গলায় কথাটি বলতেই মিথুন উদ্দিন হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন। সেই সঙ্গে একরাশ ক্রোধ তাকে ঘিরে ধরল। বড় ভাইয়ের কথা শুনেই আজ পাপনকে হাতছাড়া করে ফেলেছে তিনি! এখন আবার নিজের মেয়ের জীবন নিয়েও টানাটানি!
-“পড়ন্ত তো মেয়ে মানুষ। আর মেয়েরা চাইলেই তো মুখ খুলতে পারে না তাই না?”
বললেন মিথুন উদ্দিন। তার জবাবে শায়লা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল,
-“অথচ অভ্রকে ভাগিয়ে নিয়ে যেতে পারে! তাই না?”
-“তুই চুপ থাক.. বড়দের মাঝখানে তোর কথা কীসের? ঘরে যা..” ডাইনিংয়ে পা ফেলতে ফেলতে বড় চাচী শায়লাকে ধমক লাগালেন। শায়লা চুপসে গেল। বড় চাচার কাছে প্রশ্রয় পেলেও বড় চাচী তাকে কোনোদিনই প্রশ্রয় দেইনি। এমনকি অভ্রর বউ হওয়ার পরেও বড় চাচী তাকে নামেমাত্র মেনে নিয়েছিল, মন থেকে নয়। শ্বাশুড়ি আর বউয়ের যে একটা সুন্দর বন্ধন থাকে, তা বড় চাচীর সঙ্গে কখনোই গড়ে উঠেনি।

শায়লাকে ধমকানো দেখে শিখা জ্বলে উঠলেন। তেজী গলায় বললেন,
-“ওরে ধমকান কেন ভাবী? ও তো সত্য কথাই বলছে। যে মেয়ে মুখ ফুঁটে কথা বলতে পারে না, সে কেমনে অভ্রকে ভাগিয়ে নিয়ে গেল?”
-“অভ্রকে ও কেন ভাগাতে যাবে? না জেনে শুনে একটা কথা বলে দিলেই তো হলো না। এমনও তো হতে পারে, এই পালিয়ে যাওয়ার পেছনের পুরো পরিকল্পনাটাই অভ্রর করা। কারণ, গতকাল সন্ধ্যায় পড়ন্ত আমাকে সব খুলে বলেছিল। ওর আর অভ্রর সম্পর্কের কথা..মাঝ দিয়ে কীভাবে শায়লা উড়ে এসে জুড়ে বসেছিল, সেটাও। এমনকি যখন আমরা গ্রামে গিয়েছিলাম, সেদিন অভ্রও আমাকে বলেছিল, আমরা নাকি ওর জীবনটা শেষ করে দিয়েছি। শায়লার সঙ্গে এক ছাদের তলায় বসবাস করা ওর পক্ষে সম্ভব না। সেদিন আমি পুরোটা না বুঝলেও পড়ন্ত গতকালকে আমাকে সবকিছু বিস্তারিত বলেছে। অভ্র আর ও যে কতটা কষ্ট পাচ্ছে ভেতরে ভেতরে তা আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি। আর শায়লা, আমার জানামতে তোদের দু’জনের বিয়েটাই হয়েছে শুধু, দাম্পত্য জীবন শুরু হয়নি…!”

উপস্থিত সবাই শায়লার দিকে চোখ ফেরালে চোখ কঠিন সুরে বলল,
-“আপনি কী রাতের বেলা আমাদের ঘরে উঁকি মেরে দেখেছেন যে এই কথা এত জোর দিয়ে বলতে পারলেন?”
বড় চাচী চিৎকারের সুরে বললেন,
-“কথাবার্তা সাবধানে বল শায়লা। তোমার মেয়েকে দেখছি শিক্ষাটাও দিতে পারোনি শিখা। শুধু সেজেগুজে পুতুল সেজে থাকলেই হয় না… ন্যূনতম আদবটা অবধি নাই! অভ্র তো আমার পেটের সন্তান, আমি চিনি ওকে.. ওর চোখে তোর জন্য যে ঘৃণা আমি দেখেছি, তারপরও তুই বলছিস তোদের দাম্পত্য জীবন শুরু হয়েছে?”
শায়লা দাঁত দিয়ে দাঁত ঘঁষলো। প্রত্যুত্তর করতে পারল না।

তমিজ উদ্দিন বললেন,
-“গলা বাড়ানো শিখে গেছো দেখছি।”
বিয়ের প্রথম থেকেই স্বামীর সঙ্গে কখনো কোনোপ্রকার তর্কে যাননি তিনি। তমিজ উদ্দিন যা বলেছেন, তাই মেনে নিয়েছেন। সেটাকেই সঠিক ভেবে জীবনে এগিয়েছেন। বিয়ের বয়স কম হলো না, তবুও এতদিনে তার এই অভ্যাস পাল্টায়নি। কিন্তু আজ, অভ্রর জন্য হলেও তিনি চুপ করে থাকতে পারলেন না। তমিজ উদ্দিনের মুখোমুখি হলেন। এবং বললেন,
-“আজকে আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবেন না। আপনি চোখ খুলে একটু বাস্তবতা দেখুন। শায়লার সঙ্গে জোরাজুরি করে আমার ছেলে কোনোদিনই ভালো থাকবে না। বিয়েটা কয়েক মাসের ব্যাপার না, সারাজীবনের ব্যাপার। আমি চাই না বুড়ো বয়সে আমার ছেলে এই ভেবে ভেবে আফসোস করুক যে, এমন এক বাবা-মা পেয়েছি জীবনে, যারা আমার সুখের মূল্যই দিতে জানলো না!”

শায়লা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। শিখা মেয়েকে এক ধমকে চুপ করিয়ে বড় চাচীকে বললেন,
-“ভাবী, আপনি দেখি গভীর জলের মাছ। নিজের পেটের সন্তান সব, আর আমার মেয়ে কিছু না? বিয়েটা আপনার কাছে কিছুই না?”
-“না, কিছু না, যদি না সেই বিয়ে কোনো সুখী জীবন নিয়ে আসতে পারে। শায়লাই কী ভালো থাকবে আমার ছেলের সাথে? অভ্র তো কোনোদিন শায়লাকে মেনে নিবে না। একসময় আপনার মেয়েই ত্যক্ত হয়ে অভ্রকে ছেড়ে চলে যাবে। তাহলে সেই একসময় টা এখন কেন নয়? কেন আপনারা কেউ বুঝতে চাইছেন না, অভ্রর ঘাড়ে শায়লাকে চাপিয়ে দেওয়া মানে, অভ্র আর শায়লার দু’জনের জীবনই নষ্ট করা। মাঝ খান দিয়ে পড়ন্তটাও ধুকে ধুকে মরবে…তিনটা জীবন নষ্ট করে আমরাই বা সুখে থাকতে পারব কী? তারচেয়ে যে যেভাবে সুখে থাকতে চাইছে, সেভাবেই সুখে থাকতে দেওয়া উচিত। আমরা যদি পরিবার হয়েও ওদের পাশে না দাঁড়াই, তাহলে কোথায় যাবে এই বাচ্চা দুইটা?”
-“ব্যস, অনেক হয়েছে তোমার লেকচার.. ভেতরে যাও তুমি। আর একটা কথাও না…” তমিজ উদ্দিন হুংকার ছাড়লেন। বড় চাচী ভেতরে ভেতরে ঘাবড়ে গেলেও বাহির থেকে নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করলেন।

শিখা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে উঠলেন,
-“তাহলে আমার মেয়ে যে অভ্রকে ভালোবাসে, সেটা? সেটা কিছু না?”
-“শায়লা কখনোই অভ্রকে ভালোবাসেনি শিখা। যদি বাসতো, তাহলে অভ্রকে সুখে থাকতে দেখে নিজেও সুখী হতো। ও বরং সব জেনেও অভ্রকে বিয়েটা করেছে। অভ্রর জীবনে জোরজবরদস্তি থাকতে চেয়েছে, অভ্র ওর সাথে সুখী না জেনেও…”

তুমুল সমালোচনার ঝড় বয়ে গেল উপস্থিত সকলের মধ্য দিয়ে। শেষে দেখা গেল, বড় চাচীর কথার সঙ্গে মিথুন উদ্দিনও সম্মতি দিয়েছেন। নিতুও তাদের পক্ষেই…
মাঝদিয়ে তমিজ উদ্দিন আর শিখা শায়লার সঙ্গেই অভ্রকে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আর খোকন উদ্দিন পড়েছেন দোটানায়। সে স্পষ্ট ভবিষ্যৎ দেখতে পারছে। সেখানে অভ্র বা শায়লা কেউ সুখী নয়, তবুও স্ত্রীর বিপক্ষে কিছু বলতে পারছেন না। শিখার মুখ ভালো না। সবার সামনেই একটা ঝারি টারি দিয়ে বসলে পরে খোকন উদ্দিনই লজ্জা পাবেন। তিনি শিখার হাত টানতে টানতে ঘরে নিয়ে দরজা আঁটকে দিলেন। শিখাকে ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে হবে। কেন শুধু শুধু তিনটা জীবন নষ্ট করবে? শায়লার জন্য আরও ভালো পাত্র পাওয়া যাবে তো…

নাসরিন ভারী পর্দা টানিয়ে পুরো রুম অন্ধকারে ডুবিয়ে রেখেছেন আর হু হু করে চিকন সুরে কাঁদছেন। এবার এক এক করে সব অংক তার সামনে পরিষ্কার। অভ্রর গায়ে হলুদের দিন অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, বিয়ের দিন অসুস্থতার বাহানায় ঘরে দরজা আঁটকে রাখা, রাতের বেলা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে, ‘আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মা..’ বলে কান্না করতে থাকা,গ্রামে না যেতে চাওয়া, আর বারবার ‘তোমরা তো নিজেদের মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ায় ওস্তাদ’ বলার কারণটা তবে এই… ‘অভ্র’ যে তার মেয়ের প্রথম বেলার প্রেম, প্রথম বেলার আবেগ! কী করে চোখের সামনে অভ্রকে শায়লার সঙ্গে মিলিয়েছে পড়ন্ত, তা এক বিস্ময়! এর চেয়ে কঠিন কাজ বুঝি আর হয় না পৃথিবীতে!
অথচ সে মা হয়েও মেয়ের বুকের হাহাকার আর আর্তনাদটা শুনতে পাননি। মেয়েকে বুঝতে পারেননি। মন যে কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে ছিল পড়ন্তর তাও টের পাননি, উল্টো তাকে অন্যের গলায় ফের ঝুলিয়ে দেওয়ার পায়তারা করছিলেন!
যদি এই বিয়েটাও হয়ে যেতো, তাহলে কী হতো? পড়ন্তকে আগুনে ঠেলে দেওয়া হতো। আর পড়ন্ত,সে কী কোনোদিন তার বাবা-মাকে ক্ষমা করতে পারতো?

প্রেমঘটিত কোনো কারণে ডিপ্রেশনে চলে গেলে ব্যাপারটা আমাদের বাচ্চারা আমাদের বলতে পারে না! সামান্য আঙুল কেটে যাওয়ায় যে মেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলে, মনবাড়ি ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণায় সেই মেয়ে কী শক্ত হাতে সবকিছু সামাল দেয়! তাও একদক একাকী ভাবে! অথচ বাচ্চারা চুপচাপ থাকলে,দুনিয়ার রঙিন জীবনের উপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেললে আমরা তাকে ‘ঢং’ বলে অবিহিত করতে এতটুকুও দ্বিধা করি না! পৃথিবীর সব ছেলে-মেয়ে ভালো, শুধু আমাদের বাচ্চাদের পছন্দ করা ছেলেটি, অথবা মেয়েটি ভালো না… তারা যখন ডিপ্রেশনের দুয়ারে মাথানিচু করে একটু বাঁচার আশা খুঁজে বেড়ায়, আমরা তখন আরও উল্টাপাল্টা কথা বলে তাদেরকে বিষিয়ে তুলি…আর এজন্যেই প্রতিদিন একজন করে মানুষ সুইসাইডের মতো ভয়ংকর পথটি বেছে নেয়!

নাসরিনও তো পড়ন্তকে সুইসাইডের দিকেই ধাবিত করছিলেন। অভ্রকে হারানোর শোকের পাশাপাশি যখন অন্য একটি ছেলের অর্ধাঙ্গিনী হয়ে অনাঙ্ক্ষিত জীবন যাপনের শোক পুরোপুরি ভাবে পড়ন্তকে গ্রাস করে নিতো, সে সহ্য করতে না পেরে হয়তো সুইসাইড বা এরচেয়েও ভয়ানক কোনো পথ বেছে নিতো! পড়ন্ত এইমুহূর্তে অভ্রর সাথে কোথায় আছে,তা নাসরিন জানে না, তা নিয়ে সে চিন্তিতও নয়। শুধু একটা ব্যাপারই তাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে, মা হয়েও মেয়ের সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু তিনি কেন হতে পারলেন না! পড়ন্ত যখন কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি কেন তাকে সঙ্গ দিতে পারলেন না। মেয়েটা কেন তার বুকে মাথা রেখে মনপ্রাণ খুলে কাঁদার অবকাশটুকু পেল না?

চোখের সামনে থেকে গাঢ় আঁধার ধীরে ধীরে কেটে চিকন একটা আলোর রেখা ধরা দিলো। পড়ন্ত পিটপিট করে চোখ মেলতেই কারো চাপা আওয়াজ শুনতে পেলো।
-“পড়ু.. এই পড়ু.. ডোজ বেশি হয়ে গেল নাকি!”
পড়ন্ত নাকমুখ কুঁচকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাতেই অভ্রর মুখমন্ডল টা তার রেটিনায় গিয়ে ধাক্কা খেলো। মুহূর্তেই মনে পড়ে গেল, তার সাথে ঘটা ঘটনাগুলো। তাকে অভ্র কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছে! ইন্না-লিল্লাহ…
পড়ন্ত ধড়মড় করে উঠে বসবার চেষ্টা করলে অভ্র একটা পানির বোতল তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
-“কুলি কর। মুখ দিয়ে গন্ধ বের হচ্ছে। তুই একদিন দাঁত না মাজলেই এই অবস্থা হয় নাকি?”
পড়ন্ত তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দিতে পারল না। তার হাত-পা ঈষৎ কাঁপছে। মাথার ভেতরটা ক্রমশ ফাঁকা ফাঁকা হয়ে আসছে।
কিংকর্তব্যবিমুঢ়ের ন্যায় পড়ন্তকে স্ট্যাচু হয়ে থাকতে দেখে অভ্র কপালে ভাঁজের সৃষ্টি করে ফের বলল,
-“কী হলো? ধর বোতলটা।”
পড়ন্ত বোতল ধরল না, পাল্টা প্রশ্ন করল,
-“কয়টা বাজে?”
-“উমম.. সাতটা।”
-“রাত?”
-“দিন! সকাল.. সারারাত তো মরার মতো ঘুমিয়েছিস। এত পানি ছিটালাম তাও উঠলি না। আমি তো ভয়ই পেয়ে গেছিলাম।” বলে আড়মোড়া ভাঙলো অভ্র, তার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি! সবকিছু ঠিকঠাক আছে। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল বোধহয়!
পড়ন্ত নিজেকে সম্পূর্ণ রূপে ধাতস্থ করতে গিয়ে নিজেকে রাগের আতিশয্যে আবিষ্কার করল।
দাঁত কটমট করে অসহায় গলায় পড়ন্ত বলল,
-“এটা কী করলে তুমি? আমাকে এভাবে কিডন্যাপ কেন করলে?”
-“তোর বাপের কাছে এখন টাকা চাবো। এক কোটি টাকা.. তারপর সেই টাকা দিয়ে আমি শায়লাকে নিয়ে পগারপার..”
হেয়ালি করে বললে অভ্র, পড়ন্ত চিৎকার করে উঠল,
-“কী…!”
-“কী আবার? তোকে কেন এনেছি জানিস না? আবার জিজ্ঞেস করিস কেন?”
-“তুমি জানো আমি বড় চাচীকে আমাদের ব্যাপারে সব বলে রাজী করিয়েছিলাম? উনি পারিবারিক ভাবে এই টপিক তুলবে, এমনটা বলছিলেন। আর তুমি কী করলে..” পড়ন্তর মুখটা কাঁদোকাঁদো হয়ে গেল। অভ্র টাশকি খেলো এবার।
-“বলিস কী! সত্যি বলছিস?”
-“তোমার মনে হচ্ছে আমি মিথ্যা বলছি?”
-“তাহলে আমাকে আগে বললি না কেন এই কথা?”
-“তোমাকে বলার জন্যেই তো ডাকছিলাম। কে জানতো, আমাকে বাইরে নিয়ে ‘ঘ্রাণটা জোস না’ বলে আমার নাকের ভেতর রুমাল ঢুকিয়ে দিবে তুমি?”
চিবিয়ে চিবিয়ে বলল পড়ন্ত। ভীষণ রাগ লাগছে তার। আশেপাশে তাকিয়ে জায়গাটা সঠিক ঠাহর না পেরে অভ্রকে বলল,
-“এটা কোথায়? কতদূর নিয়ে আসছো তুমি আমাকে?”
অভ্র ঠোঁট দিয়ে ‘চ’ কারান্ত একটা শব্দ উচ্চারণ করে মাথা দোলালো দুইদিকে। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল,
-“আরে ধুর… এটা আমাদের বাসার পেছনের রাস্তাটা… চোখ মেলে দেখ।”
-“অ্যাহ!” পড়ন্ত অবাক, পালিয়ে গিয়ে কেউ বাসারই পেছনের রাস্তায় আশ্রয় নেয় বলে জানা ছিল না মোটেও! তার উপর তারা আছে একটা গাড়ির মধ্যে। এই গাড়িটাই বা কার?
-“এটা কার গাড়ি?”
-“আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের। ধুরো.. কথা বলে মেজাজ খারাপ করিস না তো। আমাকে একটু ভাবতে দে…”
-“কী? কী ভাববে তুমি? আমাকে উঠিয়ে আনার আগে ভেবে রাখোনি যে এরপর কী করবে? আর এখানে আছো কোন আক্কেলে? যে কেউ দেখে ফেলতে পারে।”
-“পারবে না। প্রথমত, রাতের বেলা রাস্তাঘাটে তেমন কেউ থাকে না, কুকুররা অবধি ঘুমায়, সো আমি নিশ্চিন্তেই রাত কাটিয়েছি। দ্বিতীয়ত, গাড়িতে কালো কাঁচ দেওয়া। বাহির থেকে কেউ দেখবে না ভেতরে কী আছে। সাউন্ডও পাবে না। সবাই মনে করবে একটা গাড়ি এমনিই অবলীলায় পড়ে আছে।”

পড়ন্ত ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস বাতাসে ছেড়ে দিয়ে বলল,
-“এখন কী করবে তুমি? সবকিছু তো গুবলেট পাঁকিয়ে দিয়েছো।”
-“উঁহু.. কিচ্ছু নষ্ট হয়নি। এবার আরও কাজ সহজ হবে। মা যেহেতু আমাদের পক্ষে আছে, সো সবাইকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করবে আমি শিউর। আর আমরা এখন বিয়েটা করব। বিয়ে শেষে বাসায় উঠব। দরকার পড়লে আমি দুই বউ নিয়ে থাকবো। কী প্রবলেম তাতে?” বলেই পড়ন্তর দিকে চোখ ফেরাতে না ফেরাতে পড়ন্তর ছোট্ট হাত জোড়া ধাম করে একটা ঘুষি মেরে বসল অভ্রকে। অভ্র হতচকিত! পড়ন্তর দিকে তাকাতেই দেখল, সে হিসহিসিয়ে বলছে,
-“তোর একটাই বউ থাকবে, আর সেটা আমি। মনে থাকবে?”
ফাঁকা ঢোক গিলে অভ্র মাথা কাত করল,
-“মনে থাকবে।”
পড়ন্ত নিভলো। অভ্রকে ‘সরি’ বললে অভ্র ‘ব্যাপার না’ বলে সরে বসল। কিন্তু সত্যি, ঘুষিটা দারুণ শক্ত ভাবেই লেগেছে। ইশ! এখন দাঁত নাড়ালেও ব্যথা লাগছে! অভ্র ভয়ার্ত চোখে চিন্তায় মগ্ন পড়ন্তর দিকে একবার তাকাল।

চলবে…