অন্তর্দহন পর্ব-২+৩

0
763

#অন্তর্দহন_২_৩ 🍁
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি

শায়লার সঙ্গে অভ্রের যেটা ঘটেছে, সেটা নিছকই একটা এক্সিডেন্ট। অথচ তারই রেশ ধরে একেবারে অনুষ্ঠান করতে যাওয়া মানে সামাজিক,পারিবারিক দুটো দিকেই শায়লাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। আর এমনটা মরে গেলেও চায় না অভ্র। তার চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় টুকরো টুকরো অতীত,যেখানে পড়ন্ত চপল পায়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে… আর সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই দৃশ্য গিলছে। মনে পড়ে যায়, অনেকদিন আগের একটি ঘটনা… বড় ফুপির মেয়ের জন্য পাত্র দেখা হয়েছে। এবার পাত্রের বাসায় গিয়ে সামাজিক দেখা সাক্ষাৎের পালা। নিতু,পড়ন্ত,আর অভ্র বাদে বাকী সবাই গিয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। নিতু যায়নি, ওর পেট খারাপ বলে। আর পড়ন্ত যায়নি অভ্র যায়নি বলে.. এটা ওটা নানান ছুতো দিয়ে থেকে গিয়েছিল। তখন তাদের সম্পর্কটার কথা শায়লাও জানতো না, এইজন্যে মাঝখানে সেও বাগড়া সৃষ্টি করেনি। যাইহোক, অভ্রর হাতে তখন মোক্ষম সুযোগ। পরিবারের সবার ভয়ে পড়ন্তকে পারতপক্ষে বোনের চোখে দেখা লাগলেও, সেদিনটা পড়ন্তকে আগাগোড়া প্রেমিকার চোখে দেখেছে, প্রিয়তমার রূপে দেখেছে। পড়ন্ত বিকেলে দু’জনে হাত ধরাধরি করে ছাদে উঠে। জমিয়ে তোলে গল্পের আসর! বিনা বাধায় সেদিন পুরো বিকেলটা তারা গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছিল। গল্পেরই এক ফাঁকে অভ্র মজার ছলে বলেছিল,
-“আচ্ছা, ধর, আমি তোকে বিয়ে না করে অন্য কাউকে করে ফেলি যদি?”
-“একদম এখান থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেব। একবারও ভাববো না, হুহ!” রাগী রাগী চেহারায় বলেছিল পড়ন্ত।

অভ্রর হাসি পেয়ে গেল। সেই সঙ্গে চোখে জমলো জল। সে ছেলে মানুষ, তাকে তো কান্না মানায় না। পৃথিবী উল্টেপাল্টে যাক, তাকে শক্ত থাকতে হবে। কঠোর থাকতে হবে। কিন্তু কীভাবে থাকবে সে? মন চায় একজনকে, অথচ ভাগ্য লিখে রেখেছে অন্যজনকে। তমিজ উদ্দিনের সাথেও কথা বলেছিল অভ্র, ইনিয়েবিনিয়ে না, সাফ সাফই জানিয়েছিল শায়লাকে বিয়ে না করার কথা, ওটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ব্যতীত অন্যকিছুই তো নয়!কিন্তু উত্তরে তমিজ উদ্দিন বলেছেন,
-“এটা তোমার আগে খেয়াল হয়নি যে একটা মেয়েকে নিয়ে বাইরে যাচ্ছো, তাও এমন এক জায়গায় যেটা গ্রামোঞ্চলের মতোন। সেখানে তো যেকোনো বিপদ হতে পারে। তুমি মানা করে দিতে শায়লাকে, সে অন্য কাউকে নিয়ে যেতো, নইলে যেতো না। নিজে আগ বাড়িয়ে দায়িত্ব নিতে গেছো যখন, তখন পুরো জীবনেরই দায়িত্ব নাও। আর শোনো, বিয়েটা যেভাবেই হোক, ভাগ্যকে মেনে নিতে শেখো। এতে তোমারই ভালো। জীবনে সুখী হতে পারবে। এখন যদি তুমি শায়লাকে অস্বীকার করতে চাও, মেয়েটা অনেক বড় ধাক্কা খাবে। সে অলরেডি তোমাকে স্বামী হিসেবে মেনে নিয়েছে। উপরন্তু শায়লার মা আর আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছে ছিল, তোমাদের বিয়ে দেওয়া নিয়ে। সেটা যখন হচ্ছেই, তখন আমি কিছুতেই ভাঙতে দেব না মনে রেখো। এবার ঘরে যাও। সন্ধ্যায় তোমার গায়ে হলুদ।”
-“কী আমার বিয়েরে তার আবার গায়ে হলুদ!! উটকো যন্ত্রণা..” মনে মনে বিড়বিড় করলেও মুখে কিছুই বলতে পারল না অভ্র। তমিজ উদ্দিন কে শুধু অভ্রই না, এই বাড়ির সবাই যমের মতোন ভয় পায়। উনি সকলের হর্তাকর্তা কী-না!

সন্ধ্যের সময় তাকে লুঙি আর উদোম শরীরের উপর একটি গামছা জড়িয়ে মা-চাচীরা মিলে যখন ছাদে নিয়ে উঠল, তখন অভ্র ‘হা’ হয়ে শুধু দেখছিলই। স্টেজের কারুকাজ টা খুব চেনা চেনা লাগছিল তার কাছে। উমম… কোথায় দেখেছে? হ্যাঁ, পড়ন্ত দেখিয়েছিল! স্বপ্নে… সে বলেছিল,আর চোখের পাতায় অভ্র সাজিয়েছিল! ঠিক এভাবেই.. এভাবেই তো পড়ন্ত আর তার গায়ে হলুদের স্টেজের সাজ নির্ধারণ করে রেখেছিল পড়ন্ত! এই মেয়েটা কী তাকে কাঁদিয়ে মারবে? কেন পোড়া মনে বারবার আঘাত করছে? নাকি সে পড়ন্তকে কাঁদিয়ে মারছে? সারাদিনে একটিবারও দেখা হয়নি। সে নিজেই রুম থেকে বের হয়নি দেখা হয়ে যাবার ভয়ে। পড়ন্তর দীঘি টলমল চোখ জোড়া যদি সে দেখে ফেলে.. তখন নিজের অন্তর্দহনে নিজেকে পুড়ে মরতে হবে। একদিকে পরিবার, অপরদিকে ভালোবাসা… আফসোস, মানুষ এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়ালে পরিবারকেই বেছে নেয়। তাহলে ভালোবাসা কী? খুবই ঠুনকো মানসিক রোগের নামই ভালোবাসা?

এসব সাতপাঁচ চিন্তাধারা মাথায় উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভ্র পড়ন্তকে দেখতে পেল। তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু একটা করছে… আর করতে করতেই মাথা ঘুরে শুয়ে পড়ল পড়ন্ত। অভ্র চমকে উঠল। একটা হুলুস্থুল কান্ড বেধে গেল মুহূর্তেই। অভ্র দৌড়ে এগোলো। পড়ন্তকে একটাবার ছোঁয়ার আশায়… নাসরিন হায় হায় করে বিলাপ জুড়ে দিলেন। দাদীবু তটস্থ, একই দিনে দুই-দুইটা অশুভ কাজ কেন ঘটে গেল? তবে কী কারও নজর পড়ল এই সুন্দর বাড়িটির উপর?

অভ্র সবাইকে সরিয়ে দিয়ে ব্যতিব্যস্ত গলায় বলল,
-“দেখি, আমি ঘরে নিয়ে যাচ্ছি ওকে।”
পড়ন্তকে তুলতে যাবে, তখনি পেছন থেকে একটি কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
-“তুমি স্টেজে বসো গিয়ে… যাও।”
অভ্র পেছনে তাকিয়ে দেখল, তমিজ উদ্দিন দাঁড়িয়ে, গরম চাউনি। অভ্র গুটিয়ে গেল। পড়ন্তের বাবা মিথুন উদ্দিন মেয়েকে পাজাকোলে করে নিয়ে ঘরের দিকে ছুটলো। নাসরিনকে শোনা গেল, বলছেন,
-“সারাদিনে কিচ্ছু খায় নাই। অথচ কত জায়গায় দৌড়াইলো! ও অজ্ঞান হবে না তো কে হবে?”
অভ্রর বুকটা ভার হয়ে এলো ক্রমশ। পড়ন্ত সারাদিনে কিচ্ছুটি মুখে তুললো না? মেয়েটা… মেয়েটা জীবনে এগিয়ে যাক খোদা, আমাকে ভুলে যাক- মনে মনে প্রার্থনা করল সে। তাকে ধরে বসানো হলো শায়লার পাশে। পড়ন্ত অজ্ঞান হয়েছে,তা নিয়ে শায়লার ভেতর কোনো উৎকণ্ঠা নেই। সে খুশি, তার পাশে অভ্র এসে বসায়। অভ্র একবারও শায়লার দিকে তাকালো না। চোয়াল শক্ত করে বসে রইলো। নাক মোছার বাহানায় টিস্যু দিয়ে বারবার চোখ মুছতে লাগল। আর তাকে বারবার নুয়ে যেতে দেখে পাড়াপড়শিরা হাসাহাসি করল এই বলে যে, ছেলেও লজ্জা পাচ্ছে!

বারোটার ঘরে ঘড়ির কাটা এসে থামতেই পড়ন্ত জেগে উঠল। তার শিয়রের কাছে নাসরিন ছাড়া আর কেউ নেই। পড়ন্তকে চোখ মেলতে দেখে নাসরিন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
-“মা.. পড়ন্ত মা, তুই ঠিক আছিস?”
-“আছি আম্মু।” ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করল পড়ন্ত। তাকে বসতে সাহায্য করল নাসরিন। তারপর শুরু করলেন বকা… একেবারে ধুঁয়ে দিলেন পড়ন্তকে। এটাও বললেন, যদি ফের খাবারে অনিয়ম করে তবে চ্যালাকাঠ দিয়ে পিটিয়ে পিঠের ছাল বাকড়া তুলে ফেলবেন। পড়ন্ত একটি শব্দও উচ্চারণ করল না। নাসরিন থামলে সে শুধু প্রশ্ন করল,
-“আম্মু.. অনুষ্ঠান কী শেষ?”
-“হুঁ.. কিছুক্ষণ আগেই শেষ হইছে। এখন ওদিকটা গুছানো হচ্ছে। বিরিয়ানি খাচ্ছে সবাই। তোর জন্য নিয়ে আসি? খাবি?”
পড়ন্ত ফাঁকা ঢোক গিললো। তার অজ্ঞান হওয়া দেখেও কী করে পারল অভ্র গায়ে হলুদ মাখতে? এতটা পাল্টে গেল একদিনেই? পাষাণ! অবশ্য শায়লার মতো আগুন সুন্দরী পেলে তো শ্যামলাকে কালাই মনে হবে সবার কাছে! এ আর নতুন কী!

-“কীরে? আনবো বিরিয়ানি?”
-“না আম্মু, ওসব তৈলাক্ত খাবার ভালো লাগছে না। তুমি আমাকে সাদা ভাত দাও। সাথে একটু ভর্তা করে দিতে পারবে?”
-“এই রাতে ভর্তা ভাত খাবি?”
-“হুঁ.. ওই যে শুটকির একটা ভর্তা করো না তুমি.. পাঁচ মিনিটেই হয়ে যায় যে, ওটা বানিয়ে দাও। কয়টা খেয়ে ঘুমাই। শরীর ভাল লাগছে না।” বলে মিথ্যে হামি তুললো পড়ন্ত। নাসরিন হেসে ভর্তা বানাতে গেলেন। মায়ের হাতে বেশ আয়েশ করেই ভাত খেলো পড়ন্ত। তারপর শুয়ে পড়ল। ওর শরীর খারাপ দেখে নাসরিনও আজ মেয়ের সঙ্গেই ঘুমোলেন। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ, নিঝুম হয়ে উঠলেও ঘুম এলো না পড়ন্তের চোখ জোড়ায়। সে কাঁদছে.. নিঃশব্দে, একাকী, খুব সঙ্গোপনে… পাছে কেউ টের পেয়ে যায় তাই হা করে কাঁদছে। একটু শব্দ হলেও যে মা বুঝে যাবে! এই কষ্ট তার একার.. এখানে কারও ভাগ নেই.. কাউকে বুঝতে দিলেও চলবে না। ভালোবাসাটা যেমন তার একার ছিল, এবার কষ্টটাকেও একা মনে পুষতে হবে!

পরদিন বেশ আড়ম্বর করে না হলেও মোটামুটি আয়োজনে শায়লাকে অভ্রর স্ত্রী হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি দেওয়া হলো। অসুস্থতার বাহানা দিয়ে পুরোটা সময় ঘরের খিল এঁটে শুয়ে রইলো পড়ন্ত। যখন উচ্চ আওয়াজে গান বাজানো হলো, সে কানে হেডফোন গুঁজে নিজের পছন্দের গান শুনতে লাগল। একবার শুধু শুনলো, সবাই সমস্বরে বলছে, “আলহামদুলিল্লাহ”। পড়ন্ত তখন আর থামাতে পারল না নিজেকে। বিছানায় ঝাপিয়ে পড়ে হাপুস নয়নে কেঁদে গেল। অতিরিক্ত কান্নার ফলে সন্ধ্যের পর পরই গা কাঁপিয়ে ধুম জ্বর এলো পড়ন্তর। নাসরিন মেয়েকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে এসেও বারবার মেয়েকে দেখে যেতে লাগলেন। এদিকের ঝামেলা শেষ হলেই একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন বলেও মনস্থির করলেন। আটটার পর… দরজায় টোকা পড়লে নাসরিন গিয়ে খুলে দিলেন। শায়লা এসেছে।
-“পড়ন্ত কই চাচী? আমার বিয়েতে ওকে একবারের জন্যেও দেখলাম না!”
-“ওর শরীরটা অনেক খারাপ রে মা। ঘুমোচ্ছে.. যা ভেতরে।”
শায়লা ভেতরের রুমে এসে দেখলো পড়ন্ত কাঁথা গায়ে জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে। ওর কপালে হাত রেখে কিছুটা চমকে উঠল শায়লা। প্রচুর জ্বর।এই প্রথম পড়ন্তের জন্য শায়লার মন খারাপ হলো। আশাভঙ্গ হওয়ায় মেয়েটা ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। একদিনেই চেহারার দিকে তাকানো যাচ্ছে না। ফোলা চোখমুখ তার কান্নার সাক্ষী। আচ্ছা, কাউকে কাঁদিয়ে কেউ কী সুখী হতে পারে? শায়লা ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে গেল। সে নিজেই নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল,
-“আরে আমি তো কিছু করিনাই! ওর ভাগ্যে অভ্র নাই, তাতে আমার কী দোষ?”

নাসরিনের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে শায়লা বিদায় নিতেই ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে চোখ খুললো পড়ন্ত। শায়লার কণ্ঠ শুনেই সে ঘুমের ভান ধরেছে। বউ সাজে শায়লাকে দেখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। আচ্ছা, আজ তো তাদের বাসর রাত। যতই হোক, অভ্র নিশ্চয়ই শায়লাকে নিজের কাছে টেনে নিবেই নিবে! অভ্রর গালে কতশত চুমু খেয়েছে পড়ন্ত! আর আজ সেখানে শায়লা আদর করে দিবে! অভ্রর বুকে প্রায়ই মাথা রেখে হৃদযন্ত্রের ধুকপুকানি শুনত পড়ন্ত। অথচ আজ থেকে তা শায়লার দখলে চলে গেল। অভ্র ঠিক যেভাবে যেভাবে তাকে আদর করত, আজ শায়লাকে তার চেয়েও বেশি আদরে মুগ্ধ করে তুলবে!
হাপড়ের মতো বুকটা ওঠানামা করতে লাগল পড়ন্তের। এই কষ্ট, এই জ্বালা, কাকে বোঝাবে সে? পুরো পৃথিবীতে এমন কেউ কী নেই পড়ন্তের কষ্টটা বোঝার? তাকে স্বান্তনা স্বরুপ দুটো বাক্য বলার? কেউ কী নেই যার কাছে মন খুলে কাঁদা যাবে? পড়ন্তের চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করল আবার। অস্থির লাগছে প্রচুর। অন্তরে তোলপাড়… মনবাড়িতে কড়াঘাত চলছে। ভেতর থেকে কেউ চিৎকার করে কাঁদছে। না চাইতেও মন অভিশাপ দিচ্ছে,
-“তুমি সুখে থাকতে পারবে না অভ্র… একদম পারবে না।”
আবার অপর মন বলছে,
-“ছিঃ ছিঃ এসব বলিস না… যে তোর ছিলোই না,তাকে নিয়ে এসব ভাবনা বন্ধ কর। অল্প সময়ের আবেগে গা ভাসিয়ে আজ তার শাস্তি পাচ্ছিস। তুই তোর মতো ভালো থাক, তাকে তার মতো ছেড়ে দে। প্রকৃতির প্রতিশোধ বলে একটা কথা আছে!”

নাসরিন ঘরে ঢুকে চমকে গেলেন। পড়ন্ত পাগলের মতো কাঁদছে। তিনি একপ্রকার ছুটে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।
-“পড়ন্ত.. কী হইছে মা? কী হইছে তোর? বল আমাকে…”
-“কষ্ট হচ্ছে মা.. খুব কষ্ট হচ্ছে! আ…আমার দম টা…বন্ধ হয়ে আসছে মা… আ…আমার…” কথা সম্পূর্ণ করার আগেই মায়ের বুকে নেতিয়ে পড়ল পড়ন্ত। নাসরিন চমকের উপর চমক খেলেন।

তমিজ উদ্দিন নিজে এসে অভ্রকে তার রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে বাহির থেকে দরজার ছিটকিনি আঁটকে দিলেন। অভ্র রাগে ফেটে পড়ল তবে সেটা মনে মনে… শায়লা বিছানার মাঝখানে লম্বা ঘোমটা টেনে চুপচাপ বসে আছে দেখে অভ্রর মাথায় রক্ত চড়ে গেল। একহাত দিয়ে পাগড়ীটা খুলে ছুঁড়ে মারল অভ্র, তারপর উদ্ভ্রান্তের ন্যায় শায়লার ঘোমটা সরিয়ে তার দুই গাল চেপে ধরল। হিসহিসিয়ে বলল,
-“আমার স্ত্রী সাজার নাটক করবি না খবরদার। যদি করিস, আমার চে খারাপ কেউ হবে না। আমি খুন করে জেলে যাব দরকার পড়লে… তাও আমার স্ত্রীর জায়গা তোকে দেব না।”
শায়লা বলার চেষ্টা করল,
-“আমার লাগছে তো…”
-“তাই? লাগছে? তাহলে আরও লাগুক।” বলে গালের চাপ আরও শক্ত করল অভ্র। তারপর হঠাৎই বিমর্ষ সুরে বলল,
-“তুই তো জানতিস, পড়ন্তকে আমি কত্তটা ভালোবাসি! তবুও আমাদের আলাদা করে দিলি। নিজের স্বার্থে..”
শায়লা ঠেলে অভ্রকে সরিয়ে দিলো।
-“আমিও তো তোমাকে ভালোবাসি!”
-“তোর ভালোবাসাটাই সব? আমার আর পড়ন্তর ভালোবাসাটা কিছু না?”
-“ওসব অতীত… আর অতীত ভুলে যেতে হয়। আমি তোমার স্ত্রী, আমি তোমার সব কষ্ট মুছে দেব।” বলে অভ্রর গলা জড়িয়ে ধরবার চেষ্টা করল শায়লা। অভ্র তীব্র ধাক্কায় শায়লাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
-“একটা চড় মারলে কান টান সব ঘুরে যাবে বেয়াদব!! দূরে দূরে থাকবি আমার থেকে একদম… নইলে…” অভ্র তেড়ে এসে ঝুঁকে পড়ল শায়লার উপর। শায়লাকে চোখ দিয়ে গরম চাউনি ছুঁড়ে মারলো, শায়লা তো ভয় পেলোই না উল্টো অভ্রর গলা দু’হাতে জড়িয়ে তাকে নিজের উপর ফেলে দিলো। অভ্র কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার গালে শায়লার অধর স্পর্শ পেলো। শায়লা ঠোঁটের দিকেও নিজের ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে নিলো, কিন্তু তার আগেই শক্ত হাতের চড়ে তার মাথা ভন ভন করে উঠল। সে বিস্ফোরিত নয়নে অভ্রর দিকে তাকাল। অভ্র ততক্ষণে উঠে পড়েছে। এক হাতে গাল ডলছে। কিছু বলছে না তবে অগ্নি চোখে ক্ষণকাল শায়লার দিকে তাকিয়ে রইলো। সেই চোখের অর্থ, ‘আমার থেকে দূরে দূরে থাকিস, নইলে এরকম হাজারটা উপহার পাবি।’
কিছুক্ষণ পর অভ্র বাথরুমে ঢুকে গেলে শায়লা কাঁদোকাঁদো চোখে উঠে বসলো। সেই সঙ্গে অভ্রকে উদ্দেশ্য করে মনে মনে গালিও আওড়ালো কয়েকটি।

চলবে…
(সবাইকে গঠনমূলক মন্তব্য করার জন্য অনুরোধ করা হলো)

#অন্তর্দহন_৩
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি

ভোরের দিকে চাপা গোঙানির শব্দে নাসরিনের ঘুম ছুটে গেল। পিটপিট করে চোখ মেলতেই তিনি পুরোপুরি ভাবে অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন, বেলা ন’টার আগে না ওঠা মেয়েটা আজ ফজরের নামাযে মোনাজাত ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে, তবে পুরোটাই নিঃশব্দে৷ যদিও তার অজান্তেই একধরনের চাপা গোঙানির শব্দ পুরো ঘরময় ধ্বনিত হচ্ছে। নাসরিন তবু উঠলেন না। মটকা মেরে পড়ে রইলেন। এতক্ষণ যাবত পড়ন্তর কোনো শারীরিক অসুখ হয়েছে- এমনটা ভাবছিলেন তিনি, কিন্তু এখন চিন্তাধারার মোড় পাল্টে গেছে। তার মেয়ে জটিল কোনো মানসিক বিপর্যস্ততার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কী সেই বিষয়টি? পড়ন্ত তো বলছেও না! প্রেমঘটিত কোনো কারণ হলে বলার সম্ভাবনাও কম। আমার দেশের ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের সাথে এতটা ফ্রেন্ডলি আচরণ করতে পারে না চাইলেও! অজানা আশংকার ভয় মনে সবসময় দানা বেঁধে থাকে।

পড়ন্ত উঠছে। তাই দ্রুত চোখ মুদে ফেললেন নাসরিন। তার হঠাৎই ভীষণ কষ্ট হতে লাগল। মেয়েটা তার একা একা কষ্ট পাচ্ছে অথচ সে মা হয়েও কিছু কর‍তে পারছে না! কীইবা করবে সে? এই কষ্টের উৎপত্তি কোথায়, তাই তো জানেন না তিনি! রাতের আঁধার কেটে ধীরে ধীরে আলোকিত হচ্ছে চারপাশ। বড় জানালার পাশে দাঁড়িয়ে অবাক নয়নে দিনের শুরু দেখলো পড়ন্ত। মনে মনে প্রার্থনা করল,
-“ইয়া রব, অন্ধকার সরিয়ে যেভাবে আলো ফুঁটাও তুমি, ঠিক সেভাবেই আমার জীবন থেকে কষ্ট গুলো সরিয়ে দাও। যেহেতু সে আমার না, তাহলে তার জন্য আমার মনের হা-হুতাশ গুলো বিলীন করে দাও। আমি বাঁচতে চাই… একটা সুন্দর জীবন চাই।”

সকাল সকাল মেয়ের ভার মুখ দেখে এর কারণ শিখা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারলেন। চুলোয় চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে তিনি শায়লার দিকে ফিরলেন। শায়লার শরীরে হালকা গোলাপী জামদানী। সুন্দর মানিয়েছে। ফর্সা শরীরে গোলাপের পাপড়ির ন্যায় লাগছে। শিখা মনে মনে আওড়ালেন, “মাশা-আল্লাহ।” তারপর বললেন,
-“কী রে? তুই এভাবে প্যাঁচার মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জামাই ওঠেনি?”
শায়লা সে কথার জবাব না দিয়ে অস্থির দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। শিখার মনে হলো, শায়লার চোখে পানি জমেছে। সেটাই লুকোনোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে মেয়েটা। শিখা এগিয়ে এসে মেয়ের কাঁধে হাত রাখলেন।
-“কী হইছে মা? আমাকে খুলে বল।”
শায়লা নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারল না আর। শিখার সামনেই কেঁদে দিল।
-“ও আমাকে মেনে নেয়নি মা।”
কথাটি শুনে শিখা মোটেও চমকালেন না বরং এটিই স্বাভাবিক। একটা দুর্ঘটনার বশবর্তী হয়ে বিয়েটা হওয়া, একদিনেই সবকিছু মেনে নেওয়া যায় না নিশ্চয়ই? সময়ের প্রয়োজন। সময়ই পারে সব সম্পর্ককে নতুন ভাবে জুড়ে দিতে, আবার ভেঙেও দিতে!
-“এতে এতো কান্নাকাটি করার কী আছে? আজ না মেনে নিছে, কাল নিবে। কাল না নিলে পরশু.. শোন, বিয়ে যখন হইছে, তখন মেনে নিতেই হবে। তুই ওকে সময় দে বুঝলি? তার সামনে সেজেগুজে থাকবি সবসময়। ওর খেয়াল রাখবি। হাসিমুখে কথা বলবি। দেখবি, তোর মায়াজালে অভ্র ফাঁসবে। এরকম ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করলে কোনোদিনই মেনে নিবে না। নে, চোখ মোছ এবার।”
শিখা নিজেই শায়লার চোখ মুছিয়ে দিলেন। তারপর চায়ের পানিতে চা-পাতি, চিনি, আর দুধ দিয়ে কিছুক্ষণ জ্বাল করে গাঢ় চা তৈরি করলেন। এক কাপ চা শায়লার হাতে দিয়ে বললেন,
-“এটা নিয়ে যা। খেতে না চাইলে জোর করবি না, রেখে চলে আসবি চুপচাপ। ওকে বুঝাবি যে তুই তাকে সময় দিয়েছিস নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য। একসময় না একসময় সে ফিরবেই তোর কাছে। বিয়ে ব্যাপারটাই এমন৷ আল্লাহর আলাদা রহমত থাকে এতে…”
শায়লাকে দেখে মনে হলো মায়ের কথায় সে অনেকটাই শান্ত হয়েছে। চুপচাপ চায়ের কাপ নিয়ে নিজেদের রুমের দিকে যাত্রা শুরু করলো।

বাহিরে ঝলমলে রোদ। উত্তপ্ত আবহাওয়া। সূর্যের রশ্মি জানালা ভেদ করে টাইলসের মেঝের উপর এসে আছড়ে পড়েছে। টাইলস চিকচিক করছে। দেখতে সুন্দর লাগছে। সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে অভ্র। পড়ন্ত যদি আজ তার জীবনে থাকত, তবে তার জীবনটাও এরকক চকমকে হতো! সুন্দর আর আকর্ষণীয় হতো! আফসোস… পড়ন্তকে সে হারিয়ে ফেলেছে। পরমুহূর্তেই নিজের চিন্তাভাবনায় বাঁধা দিলো নিজেই। পড়ন্তকে কেন হারাবে সে? পড়ন্ত কোথাও যায়নি.. বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে? শায়লাকে ডিভোর্স দিবে দরকার পড়লে। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল তখন অতিরিক্ত উত্তেজনায়। নইলে এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও পালিয়েও তো যেতে পারতো অভ্র! ইশ… চোর পালালে যে বুদ্ধি বাড়ে, এই তার বাস্তব প্রমাণ! এইজন্যেই গুরুজনেরা বলেন, বিপদের সময় উত্তেজিত না হয়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে।
দরজা দিয়ে কারও আগমনের উপস্থিতি টের পেয়ে অভ্র ভাবনার গতিপথের রাশ টেনে ধরল। আড়চোখে দেখল, শায়লা এসেছে। তার হাতে চায়ের কাপ। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই চা খাওয়াটা অভ্রর অনেকদিনের অভ্যাস। কিন্তু এতদিন এই চা-টা পড়ন্ত এনে দিতো। একদিনের ব্যবধানে সেটা শায়লার দখলে চলে গিয়েছে! বুক ফুঁড়ে আবারও একটি দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিশিয়ে দিয়ে ঝটপট উঠে পড়ল অভ্র। একটা টি-শার্ট গায়ে চাপাতে চাপাতে বাথরুমের দিকে এগোতেই শুনল, শায়লা বলছে,
-“তোমার চা..”
অভ্র না চাইতেও থামলো। শায়লার এসব বউ বউ আদিখ্যেতা একদম সহ্য হচ্ছে না।
-“একটা উপহার পেয়ে বোধহয় তোর মজা লেগে গেছে। তাই আরও উপহার চাইছিস!”
-“বারে! আমি কী করলাম?”
-“এই বউ হওয়ার নাটকটা করতে মানা করছিলাম না?”
শায়লার মেজাজ চটে গেল। এভাবে অপদস্ত হয়ে থাকা যায় না! বিয়েটা হয়েছে না যেন মাথা কিনে নিয়েছে অভ্র! যেটা বলবে সেটাই শুনতে হবে! সিরিয়ালের নায়িকার মতো এখন তার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে! কত্তো নাটক!!
মাথাটা জোর করে ঠান্ডা করল শায়লা। মা বারবার করে বলে দিয়েছেন, মেজাজ না দেখিয়ে বুদ্ধি দিয়ে কাবু করতে।
-“আচ্ছা, আমি চা রেখে চলে যাচ্ছি। আর শোনো, আমি মোটেও বউ হওয়ার নাটক করছি না। তুমি মানো বা না মানো, আমি তোমার বউই! আমি যদি আমার অধিকার চাই, তুমি কী না দিয়ে থাকতে পারবে? আমার তো এখানে দোষ ছিল না! শুধু একটা সম্পর্ক আমি ভাঙতে চাইনি তাই বিয়েটাকে মন থেকে মেনে নিয়েছি।”
-“অথচ আমার আর পড়ন্তর সম্পর্কটা ঠিকই ভেঙে দিয়েছিস!”
-“আমি ভাঙিনি। উপরে যিনি আছেন, উনি করেছেন। উনার হুকুম ব্যতীত একটা গাছের পাতাও নড়ে না, আর তো বিয়ে! উনিই তোমার কপালে আমাকে লিখে রেখেছিলেন। আর একটা কথা জানো তো, আমরা সবসময় ভুল মানুষকেই ভালোবাসি। যাকে পাবো না, তাকেই পাওয়ার জন্য মন বেহায়া হয়ে উঠে। মাথা ঠান্ডা হলে একটু ভেবে দেইখো, আসলেই তোমার এসব আচরণ পাওয়ার যোগ্য আমি কী-না! আমি কিন্তু কিছুই করিনি। ভাগ্যের উপর আমার বিন্দুমাত্র হাত নেই। তবুও যা হয়েছে তা মেনে নিয়ে তোমার মন ভালো করার চেষ্টা করছি। অথচ তুমি…! থাক, চা টা খেয়ে নিও ঠান্ডা হওয়ার আগে। তোমাকে তোমার মতো ছেড়ে দিলাম।” বলে একমুহূর্ত অপেক্ষা করল না শায়লা। বেরিয়ে গেল ঘর ত্যাগ করে। অভ্র হতভম্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইল। শায়লার কথাগুলো কানে বাজছে তার। আসলেই তো.. শায়লার কী আদৌও কোনো দোষ আছে? সেও যেভাবে চাপে পড়ে বিয়েটা করেছে, শায়লাও চাপে পড়েছিল। আর একবার বিয়ে হয়ে গেলে সেখান থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে চায় না, এমনটাই মেয়েদের সাইকোলজি। সম্পর্ক ভাঙতে প্রচুর ভয় আর জড়তা কাজ করে তাদের মনে। এই জন্যে কত মেয়েরা ভালোবাসা নেই, তবুও দায়বদ্ধতা মেনে নিয়ে যুগের পর যুগ হাসি মুখে সংসার করে যাচ্ছে! অভ্র ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে তার মন জানান দিলো, শায়লার মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলে যাস না সবকিছু। শায়লার দোষ নেই, অথচ সে কিন্তু একবারও কাউকে বলেনি এই বিয়েটা ভাঙার কথা! যদিও সে জানতো, তোর পোড়া মন একজনের অনুপস্থিতিতে পুড়ছে। তার সাথে খারাপ ব্যবহার না কর, ভালো ব্যবহারও করার দরকার নেই। নির্বিকার থাক। সময় সু্যোগ আর পরিস্থিতি বুঝে বাসায় বল যে শায়লার সাথে তোর যাচ্ছে না। তুই এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চাস। তারপর পড়ন্ত তোর.. শুধুই তোর। আজকে যে করেই হোক, পড়ন্তর সঙ্গে কথা বলতে হবে। অভ্র বিহনে পড়ন্ত নিশ্চয়ই ভেঙে পড়েছে…
কথাগুলো ভাবতেই অভ্র নিজের ভেতরে একধরনের ছটফটানি অনুভব করল। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ল ঘর ছেড়ে। উদ্দেশ্য, পড়ন্তকে খোঁজা…

নাশতার টেবিলে পারিবারিক মিটিং বসেছে। দাদীবু তিন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“আজকে যদি তোদের বাপ বেঁচে থাকতো, সে যে কী খুশি হইতো! আহারে… মানুষটা অকালেই চলে গেল আমাদের ছেড়ে।” মৃত স্বামীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে উনার গলার স্বর ভারী হয়ে আসে।
তমিজ উদ্দিন বললেন,
-“আম্মা, আপনে কাঁদবেন না। আব্বা নাই কে বলছে? উনি আমাদের সাথেই আছে আর সবই দেখে। উনি নিশ্চয়ই অভ্র আর শায়লার বিবাহবন্ধনে খুশি হইছে।”
খোকন উদ্দিন বললেন,
-“আম্মা, একটা কাজ করলে কেমন হয়? ওরা নতুন দম্পতি, অথচ আব্বার দোয়া পাবে না এটা কেমন কথা? তাই চলেন, আজকে সবাই মিলে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। দুদিন থেকে চলে আসলাম। আব্বার দোয়া নেওয়া হলো, গ্রামের সবাইকে মিষ্টিও খাওয়ানো হলো।”
তমিজ উদ্দিন খোকনের পিঠ চাপড়ালেন।
-“এটা তো খুবই ভালো কথা। এখন বাজতেছে নয়টা… বারোটার মধ্যে রওনা দিলে বিকেলের মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব।”
-“আমি দুইটা মাইক্রো ভাড়া করে ফেলি দ্রুত তাইলে…” বলে ব্যস্ত ভঙ্গিতে মিথুন উদ্দিন উঠে গেলেন। দাদীবু তিন বউকে ডেকে যথারীতি গোছগাছ শুরু করতে বললেন। দুপুরের খাবার বাহির থেকে কিনে নেওয়া হবে, তাই রান্নার ঝামেলা নেই। ঘরবাড়ি তালা দিয়ে সবাই যাবে।

খবরটা শুনে পাপন দুইটা লাফ মারলো। কতদিন উল্লাসীর চেহারাটা দেখে না! এবার গেলে নিশ্চয়ই দেখা হবে! পাপন দ্রুত নিজের জামাকাপড় গোছাতে শুরু করল। পড়ন্ত পাপনের রুমে এসে গোছগাছ দেখে একটু অবাক হলো। জিজ্ঞেস করল,
-“কীরে? কই যাবি?”
-“গ্রামে..”
-“ওমা! হঠাৎ?”
-“অভ্র ভাইয়া আর শায়লা আপুর বিবাহ উপলক্ষে… সবাই যাবে। দাদার দোয়া নিবে। আর গ্রামবাসীকে মিষ্টি বিতরণ করবে।”
মুহূর্তেই বুকটা ভার হয়ে এলো পড়ন্তর। নাসরিন ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরে এসে ঢুকে পড়ন্তকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“তোর কোন জামা গুলি নিবি? দেখে দে… সময় কম। আর পাপন, তুই গোসলে যা..”
পড়ন্ত নির্বিকার কণ্ঠে জবাব দিলো,
-“আমি যাব না মা।”
-“যাবি না মানে?”
-“যাব না মানে যাব না।”
-“সবাই যাবে, আর তুই একা বাসায় থাকবি?”
-“দরকার পড়লে থাকব। তবুও যাব না। আমার ভালো লাগছে না।”
নাসরিন রেগে গেলেন। কেন ভালো লাগছে সেই কারণ তো অজানা নয়। কোন না কোন ছেলের থেকে ছ্যাঁকা ট্যাকা খেয়ে মুহূর্তেই দেবদাসী বনে গেছেন! একটু গ্রামে গেলে হাওয়া বদল হতো, ভালো লাগতো, মনটাও হালকা হতো, তা না… উনি নাকি যাবেন না!
-“তুই যাবি, তোর বাপও যাবে। যা গোসলে ঢুক… আমার কথার উপর কথা বলবি না খবরদার।”
-“মা, অন্যের উপর নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতেই পারো তোমরা?”
-“মানে?”
-“এই যে.. আমি যাব না বললাম, তাও তোমার সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপিয়ে দিচ্ছো। আবার অভ্র ভাইয়ার বিয়েটাও তার সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে দিয়েছো৷ কেউ কী একবারও জানতে চেয়েছো অভ্র ভাই বিয়েতে রাজী কী-না?”
-“এক মিনিট, এখানে অভ্র আসছে কোথথেকে?”
-“কিছু না।” বলে উঠে দাঁড়াল পড়ন্ত। নিজের রুমের দিকে হাঁটা দিলো। নাসরিন হতবাক, পড়ন্তের আচরণ কিছুতেই তার মাথায় ঢুকছে না। পাপনও গোছগাছ থামিয়ে পড়ন্তের কথা শুনছিল। সে চলে যেতেই বলল,
-“মা, আপার না কী যেন হইছে। কেমন করতেছে, দেখো না। হাসেও না একটু। সারাক্ষণ এমন মুখে থাকে যেন কেঁদে ফেলবে।”
-“ওর ভূত আমি তাড়াবো মাথা থেকে। গ্রামে যেয়ে নেই আগে। তুই কাপড় গুছিয়ে গোসলে ঢুক..”
বলে নাসরিন চলে গেলেন। পাপন মৃদু নিঃশ্বাস ফেলল।

পড়ন্ত যাবে না যাবে না করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে তৈরি হতে হলো মিথুন উদ্দিনের ধমক খেয়ে। মাকে যতটা অভয় করে, বাবাকে ঠিক ততটাই ভয় করে সে। নাকেমুখে কেঁদেকেটে তৈরি হয়ে গাল,মুখ ফুলিয়ে লম্বা বারান্দায় এসে দাঁড়াল পড়ন্ত। মাথার উপর উত্তপ্ত সূর্য, লম্বা কিরণ দিচ্ছে। গরমে গা টা চিট চিট করছে। রোদের উত্তাপে গা ঘেমে উঠছে। থাকা যাচ্ছে না। পড়ন্ত ঘরের উদ্দেশ্যে যাবে, পেছন ঘুরে তাকাতেই থমকে গেল। অভ্র দাঁড়িয়ে… সেই চিরচেনা মুখ, চিরচেনা চোখ,নাক,ঠোঁট… হালকা দাড়িতে ভরে আছে থুতনি… তবুও একটা সূক্ষ্ণ পার্থক্য আছে। পড়ন্তের অবচেতন মনে পার্থক্যটা ধরা পড়ল। অভ্রর চোখ দুটো আগে ওকে দেখলে আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়ত, আর আজ বিষন্ন, খানিকটা লাল বর্ণের। কান্না আঁটকে রাখলে এরকমটা হয়। পড়ন্ত ঢোক গিলে নিজেকে সামলালো। অভ্র কিছু একটা বলবে- বুঝতে পেরে পড়ন্ত নিজ থেকে পরিবেশ টাকে সহজ করে দিলো। মুখে কৃত্রিম হাসি ফুঁটিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
-“অভ্র ভাইয়া! তুমি এখানে?”
অভ্র চমকালো। পড়ন্তের টোনটা ভালো ঠেকছে না। তবে কী অভ্রকে মন থেকে পুরোপুরি ভাবে মুছে দিয়েছে সে?
-“আশেপাশে তো কেউ নেই। ভাইয়া ডাকছিস কেন?”
-“আজব তো! তুমি আমার বড় ভাই.. আমার কাজিন, তোমাকে ভাইয়া বলব না তো কী বলব?”
-“দেখ পড়ন্ত…”
-“হুম বলো ভাইয়া, শুনতেছি।”
অভ্র অসহায় চোখ করে তাকাল। তার ভীষণ ব্যর্থ আর অপদার্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। একটি মেয়ে ঠিক কোন পর্যায়ে এসে নিজের ভালোবাসার মানুষকে ইগনোর করার চেষ্টা করে, তা কী বোঝাতে হয়?
-“ভাইয়া ভাইয়া করবি না তো। আমি তোর ভাই? বল… ভাই?”
পড়ন্তের বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে নিজেকে যথেষ্ট শক্তভাবে সামলালো। এতটা শক্তি আর সাহস তার মধ্যে কোথা থেকে উদিত হলো, কে জানে!
-“এসব ফালতু আলাপ বাদ দিয়ে কী বলবা বলো। আমার কাজ আছে।”
-“ইগনোর করছিস?” অভ্রর কণ্ঠটা অভিমানী শোনায়।
-“ইগনোর? তোমাকে ইগনোর কেন করব আমি? যার প্রতি মানুষের অধিকার থাকে, তাকে ইগনোর করা যায়। তোমার প্রতি আমার কোনো অধিকারই নেই!”
-“এভাবে বলিস না… যেটা হইছে, পুরাটাই গণ্ডগোল। তুইও ভালো করে জানিস, তোকে ছাড়া কাউকে ভাবতেও পারি না আমি।”
-“তাহলে শিখে নাও। আর আমাকে ভাবা ভুলে যাও। তোমার জন্যেই মঙ্গল।”
-“তুইও আমাকে ভুল ভাবছিস?” বিষন্ন কণ্ঠ।
পড়ন্ত স্বাভাবিক স্বরেই উত্তর দিলো,
-“তুমি আমার এমন কে হও যে তোমাকে ভুল ভাববো! আমি?”
-“কেউ হই না, না?”
-“দেখো পুরোনো জিনিস মনে রাখার মতো মেয়ে আমি না। ইট কিন্তু নরম মাটি দিয়ে তৈরি হয়। অথচ সেটাকে পোড়ালে কতটা শক্ত আর কঠিন হয়ে উঠে, তুমিও জানো। আশা করি, আর ভেঙে বলতে হবে না।”
-“আমার জন্য তুই পুড়েছিস। আর এখন আমাকেও পোড়াচ্ছিস। শোন পড়ন্ত, আমি তোকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছি, সেসব মিথ্যা না। এখনো কিচ্ছু হয়নি। আমি শায়লাকে ডিভোর্স দিবো। তারপর তোকে…” বাকি কথা শেষ হওয়ার আগেই পড়ন্ত হাতের ইশারায় অভ্রকে থামতে বলে নিজে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল,
-“এক মিনিট, এক মিনিট… বিয়েটা একটা খেলা তোমার কাছে। তাই না?”
-“তুই কী চাইছিস আমাকে বল তো! তোকে ভুলে শায়লাকে নিয়ে সুখের সংসার করি?” অভ্র অধৈর্য্য হয়ে উঠল।
-“আজ নাহয় কাল, শায়লা তোমাকে জিতে নিবে। আমি জানি.. আমাকে বোঝাতে এসো না। আমি অনুভূতি মাটি চাপা দিয়েছি। সেই মাটি খুঁড়তে এসো না প্লিজ.. আমার সামনে না এলেই বরং ভালো। আমি হোস্টেলে সিট পেলেই চলে যাব। ততদিন তুমি আর তোমার শায়লা আমার থেকে দূরে দূরে থাকো। আমার মেজাজ যদি একবার খারাপ হয়, তামাম দুনিয়া ফাতা ফাতা করে ফেলব। শান্ত আছি, শান্ত থাকতে দাও।”

পড়ন্ত চলে যেতে নিলে অভ্র হাত ধরে ফেলল। অগ্নি চোখে তাকাল পড়ন্ত। দৃষ্টি দিয়ে যেন বলছে, ‘হাত ছাড়ো।’ অভ্র ছাড়লো না, আরও শক্ত করে চেপে ধরল। একজন ভালোবাসা পেতে চাইছে নতুন করে, আরেকজন ভালোবাসা ভুলতে চাইছে সম্পূর্ণ রূপে… কী হবে এই দুইজনের ভবিষ্যৎ?

-“হাতটা ছাড়ো।” শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠতেই অভ্র আরেকটু এগিয়ে এসে গোয়ারের ন্যায় বলল,
-“ছাড়ব না।”
-“আমার মেজাজ অত্যধিক গরম হচ্ছে। রাতে একজন আর দিনে আরেকজন নিয়ে থাকার শখ হইছে নাকি?”
-“তুমি এসব কী বলছো পড়ন্ত!! আমি শায়লাকে… ছিঃ!”
পড়ন্ত হাসল অল্প একটু।
-“হাত ছাড়ো, যেতে দাও।”
-“ছাড়ব না, বললাম তো।” অভ্রও এবার দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
-ছাড়বে না?”
-“না।” কথাটি মাটিতে পড়ার আগেই গালে তীব্র থাপ্পড়ের অনুভবে চকিতে পড়ন্তের দিকে তাকাল অভ্র। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।পড়ন্ত তাকে চড় মারল! এমনটা কী কোনোদিনও কল্পনাতেও ভেবেছিল অভ্র?
পড়ন্ত হিসহিসিয়ে বলল,
-“আমি যেটুকু আঘাত পেয়েছি, তার তুলনায় এটা খুবই কম। নিজের স্ত্রীর হাত ধরে টানাটানি করো গে যাও… ভুলেও আমাকে আগুনে ডোবাতে আসবে না। ইটস এ ওয়ার্নিং।” বলে পড়ন্ত চলে গেল। অভ্র গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল বোকার মতো। সে এসেছিল কী করতে,আর হলো কী! এখন তো নিজেরই অভিমান জমছে পড়ন্তের উপর। তবে কী এখানেই তাদের সম্পর্কের সমাপ্তি?

দুটো মাইক্রো ভাড়া করা হয়েছে। সবাই মাইক্রোর সামনে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পড়ন্ত এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার গায়ে সাদা রঙের থ্রিপিস, তাকে দেখতে স্নিগ্ধ লাগছে। অভ্র একনজর তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। এখনো পড়ন্তের দেওয়া থাপ্পড়ের দৃশ্যটা চোখের সামনে ভাসছে। অভিমানী হচ্ছে মন। অথচ দীর্ঘ বছরের ভালোবাসার স্বপ্ন গুলো এক নিমিষে ভেঙে দেওয়ায় পড়ন্ত কতটা অভিমানী হয়ে উঠেছে, তা কী আদৌও বুঝতে পারবে অভ্র?
পড়ন্তের পাশে এসে শায়লা দাঁড়াল। পড়ন্ত ফিরেও তাকাল না। শায়লা নতুন বউয়ের মতো করে সেজেছে। বিয়ের পর থেকে কেউ তাকে শায়লা বলে ডাকছে না। সবাই ‘অভ্রের বউ, অভ্রের বউ’ বলে বলে মুখে ফেনা তুলছে। বিষয়টা একজন প্রেমিকার কাছে কতটা যন্ত্রণার তা বোঝার ক্ষমতা বোধকরি ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারও নেই!

শায়লা গা ঘেঁষে দাঁড়াল এবার৷ ফিসফিস করে ডাকল,
-“এই পড়ু..”
পড়ন্ত চোখা চাউনিতে তাকাল। সাড়া প্রদান করল না। তার মেজাজ এখন অল্পতেই গরম হয়ে যায়৷ সবকিছু কেমন অসহ্য আর বিস্বাদ লাগে। ছ্যাঁকা খেলে মানুষ বোধহয় কাঠখোট্টা হয়ে উঠে!
-“আমরা যে গাড়িটায় যাবো, ওটাতেই তোর জন্য সিট রেখেছে চাচ্চু। তুই ওটাতে না গিয়ে অন্যটায় যাস কেমন? দেখ, অভ্র আমার স্বামী। তোদের একত্রে কাছাকাছি থাকা আর ঠিক না৷ যত থাকবি, ততই কষ্ট পাবি। শিয়ালের সামনে মুরগী রাখলে শিয়ালের স্বভাব তো খারাপ হবেই, কী তাই না?”
গা জ্বলে উঠল পড়ন্তের। শায়লার দিকে ফিরে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি ছুঁড়ে দিল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-“ভালোবাসার দখল ছেড়ে দিতে পারছি, আর সামান্য একটা সিটের দখল ছেড়ে দিতে পারব না?”
শায়লা চুপসে গেল। মাথা ঝাকিয়ে অন্যত্র চলে গেল। পড়ন্তর বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। বাতাসে কেউ বিষ মিশিয়ে দিয়েছে বোধকরি…

চলবে…