অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব-১১+১২

0
536

#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-১১

অহর্নিশ হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছে আয়ন্তিকার মুখশ্রীর দিকে। নিজেকে মনে মনে শ’খানেক গালি দেয় সে। তাৎক্ষনিক ভাবে সে নিজেকে আস্বস্ত করে আয়ন্তিকার উদ্দেশ্যে বলল,

-‘ মেয়েটার স্কেচ করেছি বলে এই না যে সে আমার প্রেমিকা হবে আয়ন্তিকা। এসব নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা করো সারাক্ষণ? ‘

প্লেটের ভাত প্রায় ফুঁড়িয়ে এসেছে,শেষ লোকমা ভাত আয়ন্তিকা অহর্নিশের মুখে দিয়ে দেয়। তবে এবার আয়ন্তিকা নিজ কথায় অটল থেকে বলল,

-‘ তাহলে মেয়েটার স্কেচ করেছেন কেনো?’
-‘ ও বলেছিলো তাই করেছি। ‘
-‘ বললেই করতে হবে। ‘

অহর্নিশ বিরক্তি নিয়ে বলল,

-‘ আয়ন্তিকা, সাফিয়া আমার ফ্রেন্ড হয়। রিকুয়েষ্ট করেছে তাই করেছি। তো? আর এই বিষয় নিয়ে কথা বলা বন্ধ করো। ‘

আয়ন্তিকা আর কথা বলল না। তার এই মূর্হতে ইচ্ছে হলো, ইশশ! অহর্নিশ যদি আর্ট না পারতো তবে কত ভালোই না হতো। সাফিয়ার স্কেচ করাতে তার খারাপ লাগছে। বড্ড বেশি খারাপ।

প্লেটের ভাত শেষ হওয়ার পর অহর্নিশের মন বিষন্ন হয়। আর ঠিক কবে সে আয়ন্তিকার হাতে খেতে পারবে কে জানে? এই মেয়ের হাতে যাদু আছে বলে মনে হলো তার। যেখানে মাংশ ছাড়া অন্য কোনো কিছু দিয়ে অহর্নিশ খেতে পারতো না সেখানে আজ সবজি দিয়ে ভাত অনায়েসে খেয়ে ফেললো মুগ্ধ হয়ে। অহর্নিশ আয়ন্তিকার হাতে টেনে এনে আয়ন্তি এর আঙুলে লেগে থাকা অবশ্যিষ্ট খাবার সন্তপর্ণে নিজের অধর যুগলের স্পর্শ করিয়ে গলধ্বিকরণ করে। আয়ন্তিকা শক্ত হয়ে বসে আছে। পরিশেষে সে নিজের ছো মেরে টান দিয়ে চলে যায় সেখান থেকে। অহর্নিশ নিচের ঠোঁট আঁকড়ে নেয় ! বিড়বিড় করে বলল,

-‘ লজ্জাবতী লাজুকলতা!’
.

অয়ন আজ প্রথমবারের মতো নামাজ পড়ছে। বাসায় এসেই সে কিছু ইসলামিক বই হতে নামাজ পড়ার নিয়মাবলী এবং সূরা মুখস্থ করে নিয়ে সে যোহরের নামাজ পড়া শেষ করেছে মাত্র। সারা হতভম্ব! তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এটা অয়ন। তবুও অয়ন নামাজ পড়ছে দেখে সে খুশিতে কেঁদে দেয়। অয়ন তা দেখে অস্থির হয়ে বলল,

-‘ সারা কাঁদছো কেন তুমি? শরীর কি খারাপ লাগছে?’

সারা চোখের কার্নিশ হতে পানি মুছে নিয়ে প্রতুত্তরে বলল,

-‘ ঠিক আছি আমি। কিছু হয়নি। কান্না করছি তো সুখে। তুমি নামাজ পড়ছো তা দেখে প্রচন্ড খুশি লাগছে। ‘

অয়ন স্নান হেঁসে সারার কপালে চুমু খায়। তার নিজেরও আজ বড্ড প্রশান্তি অনুভূত হচ্ছে নামাজ পড়ে। নামাজ এমন এক ইবাদত যাতে অংশগ্রহণ করলে যত চিন্তা, ডিপ্রেশন এ থাকুক না কেনো সব নিমিষেই দূর হয়ে যায়। মন ভালো করার অন্যতম উপায় নামাজ পড়া। এতে মন কোমল হয়। শান্তি আসে। সারাকে বুকে টেনে নিয়ে আলত করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় অয়ন। আজ নামাজ পড়ার কারণটা হচ্ছে অহর্নিশ। সে অশ্রুকণা বর্ষণ করিয়ে অহর্নিশের জন্য দোয়া করেছে। যাতে অহর্নিশ ঠিক হয়ে যায়। সময়ের আগেই সে শুধরে যায়।

.

অহর্নিশ আয়ন্তিকার স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আয়ন্তিকার আসার কোনো নাম-গন্ধ নেই। কিন্তু স্কুলের বাকি স্টুডেন্টরা সবাই ইতিমধ্যে বেড়িয়ে গিয়েছে। অহর্নিশের অজান্তেই হটাৎ খুব বেশি চিন্তা এসে জরো হয় মন গহীনে। বারংবার নিভৃত হতে বলছে ‘ আয়ন্তিকা ঠিক আছে তো?’

অহর্নিশ আর অপেক্ষা করতে পারলো না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। অস্থির অস্থির লাগছে। আয়ন্তি কে যতক্ষণ পর্যন্ত নিজ সামনে সুস্থরূপে না দেখতে পারছে সে ততক্ষণ অব্দি অহর্নিশের ঝড় ওঠা মন শান্ত হবেনা কিছুতেই। দারোয়ান কে পুরো বিষয়টা খুলে বলে অহর্নিশ স্কুলের ভেতরে চলে যায়। আয়ন্তিকার ক্লাসরুম সহ পুরো স্কুল খুঁজে আয়ন্তি কে না পেয়ে অহর্নিশের ব্যাকুল অবস্থা। পরিশেষে সে ঠোঁট চেপে ধরে কান্না দমন করার প্রয়াস চালায়।তার কান্না পাচ্ছে কেনো? এত কষ্ট, বিরহ যন্ত্রণা কিসের কারণে?

পায়ের শব্দফালি কর্ণগোচর হতে অহর্নিশ পিছন ফিরে। আয়ন্তিকা আসছে তার দুইহাত রুমাল দিয়ে মুছে নিয়ে। অহর্নিশ আয়ন্তিকার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কর্কশ কন্ঠে উচ্চস্বরে বলল,

-‘ কই ছিলা তুমি?’

আয়ন্তিকা নতজানু অবস্থায় ছিলো। উচ্চ কন্ঠস্বর শুনে সে সামনে তাকায়। দেখতে পায় অহর্নিশের বিধ্বস্ত মুখশ্রী। চোখদুটো রক্তিম। ঠোঁটদুটো শুষ্ক অবস্থায় বহমান। দুই হাত সমান তালে কাঁপছে। আয়ন্তিকা চমকায়। প্রথমত অহর্নিশ কে এখানে দেখে এবং দ্বিতীয়য় অহর্নিশের এই নাজেহাল অবস্থা দেখে। আয়ন্তিকা কোমল কন্ঠে বলল,

-‘ ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি এখানে যে, আপনার এই অবস্থা কেন? আবার মারামারি করে এসেছেন?’

অহর্নিশ চোখ গরম করে বলল,

-‘ আমার কাজ মারামারি করা না। বারবার একই কথা বলো কেন ষ্টুপিড? ‘

পাংশুটে আকার ধারণ করে আয়ন্তিকার মুখশ্রীর গড়ন। সে ঠোঁট বাকিয়ে কিছু বলতে নিয়েও বলল না।এই লোকের সাথে আয়ন্তি আর বলবে না কথা। সবসময় সুচালো কথা বলে আঘাত করে তাকে। কেন, একটু মিষ্টি করে কি কথা বলা যায়না আয়ন্তিকার সাথে? অভিমান হয় তার। তাই সে মৌনতাকে এই সময়টার জন্য বাছাই করে নেয়।

আয়ন্তিকা কে চুপ দেখে দমন করা রাগ তীরতীর করে বেড়ে যায় অহর্নিশের। আয়ন্তিকা কখনোই তার প্রশ্নের জবাব গুলো সঠিক রূপে দেয়না। মাঝ পথে এসে নীরবতা পালন করা শুরু করে। একদম সাইলেন্ট! অহর্নিশের আফসোস হয়, এ কেমন মেয়ে কে বিয়ে করলো সে? পিচ্চি বাচ্চাদের বিয়ে করাটা প্যারা। আসলেই প্যারা! সেদিন তো অহর্নিশ বুক ফুলিয়ে আয়ন্তিকা কে বলেছিল টিনেজার দের বিয়ে করার সুবিধা অনেক। আসলে এদের বিয়ে করার কোনো সুবিধাই নেই। শুধু প্যারা আছে কপালে।

অহর্নিশ আড়ষ্ট হয়ে বলল,

-‘ নেক্সট যাতে ছুটি হওয়ার পর ওয়াশরুমে যেতে না দেখি মাইন্ড ইট? ওয়াশরুমে যাওয়ার হলে ছুটি হওয়ার আগে যাবে নয়ত না। চলো এখন! অনেক সময় নষ্ট করিয়েছো আমার। ‘

আয়ন্তিকা সামনের দিক ধরে হাঁটা শুরু করে। অহর্নিশ তার পিছু পিছু ধীর গতিতে হাঁটছে। গহীন হতে বলছে সে আজীবন চায় আয়ন্তিকার পিছন পিছন হাঁটতে। যখন দমকা হাওয়া এসে আয়ন্তির লম্বা চুলগুলো তার মুখে বাড়ি খাবে সেই মূর্হতটায় অহর্নিশ বুক ভরে মনোমুগ্ধকর শ্বাস টেনে নিবে। অহর্নিশ ভেবে পায়না তার এমন উদ্ভট চিন্তাধারার কারণটা। তবে এটা একটুখানি হলেও নিশ্চিত হলো যে সে দিনদিন আয়ন্তিকার প্রতি বিন্দু বিন্দু করে দূর্বল হচ্ছে। কিন্তু এমনটা হলে তো চলবে না।

গাড়ির সামনে এসে আয়ন্তিকা ফ্রণ্টসিটের দরজা খুলে ধপ করে বসে পড়ে। অতঃপর অহর্নিশ নিজে এসে বসে তার সিটে। আড়চোখে তাকিয়ে সে প্রচন্ড বিরক্তি প্রকাশ করে। অহর্নিশ তিক্ত কন্ঠে বলল,

-‘ সিটবেল্ট লাগানোর কথাটা কি তোমার চোখের মনিতে ফটোকপি করে লাগিয়ে দিবো আয়ন্তিকা? ‘

আয়ন্তিকা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায়। পরবর্তীতে চট জলদি সিটবেল্ট লাগিয়ে ক্ষ্যান্ত রূপে বসে। চেপে রাখা কথাগুলো দমন করতে না পেরে সে লম্বা শ্বাস টেনে বলল,

-‘ আপনি কি একটু ভালোমতো কথা বলতে পারেন না?সবসময় এতো তিতাযুক্ত কথা বলেন কেন? একটু কি সুন্দর ভাবে কথা বলা যায়না?’

অহর্নিশ তার ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে ব্যাবধান সৃষ্টি করে বলল, ‘ না যায়না! ‘

________________________

নাহিয়া আহমেদ ছাঁদে উঠেছে আজ প্রায় অনেক বছর পর। তিনি আগে কখনো ছাঁদে উঠতেন না। বিশেষ করে তার স্বামী উসমান যখন থেকে তার সাথে নেই। তবে আজ এসেছে সে এই ছাঁদে। তার প্রাপ্তির কথা বিশাল আকাশটাকে জানাতে।

ছাঁদে দাঁড়িয়ে ছিলোএকজন মধ্য বয়স্ক পুরুষ। নাহিয়া তার দিকেই এগিয়ে যায়। পাশে দাঁড়াতেই সে বলল,

-‘ কখন আসছস নুহাদ?’
-‘ একটু আগে আপা। ভালা আছো তুমি?’
-‘ আমি তো সবসময়ই ভালা থাকি। ‘

নাহিয়া একগাল হাসলো। নুহিদ তার বোনের হাসি দেখে তৃপ্তি পায়। অবশেষে বলা যায় তার বোনের কপালে সুখের সন্দাহ মিলেছে তবে। শান্তি আসে মনে নুহিদের। পরবর্তীতে সে গদগদ হয়ে বলল,

-‘ উসমান রে আর কতদিন আঁটকায় রাখতে হবে আপা?’
-‘ আর বেশিদিন না ধৈর্য ধর। আয়ন্তিকার বাচ্চা হইলেই তারে ছাইড়া দিবি। ‘
-‘ কিন্তু এসব কেন করতেছো আপা? আজ আমারে একটু সব খুইলা বলো তো। ‘

নাহিয়া তপ্তশ্বাস ফেললো। শুভ্র আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে সে বলল,

-‘ তোর দুলাভাই এর দ্বিতীয় বউ ছিলাম আমি। তার জন্য আমি কখনো তার ভালোবাসা পাই নাই। হেতি তার প্রথম বউরে অনেক ভালোবাসতো। দ্বিতীয় বিয়া করছে তো তার মায়ের চাপে পইরা আর নিজের বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য। আমি সবসময় তার কাছে একটু ভালোবাসা একটু মর্যাদা চাইতাম বাট সে আমারে মারধর করতো। গরুর মতো খাটাতো। মারতে মারতে আমার শরীর শেষ কইরা ফালাইছিলো।যন্ত্রণায় চিৎকার করতাম। কেও আসতো না। এমনেই যায় দিন। আমার রাগ হয়। অভিমান হয়। খারাপ কিছু করার নেশা চাপে।’

নুহিদ অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজ আপার দিকে দৃষ্টি দেয়,
তার বোন এতোটা কষ্ট করেছে এতোটা দিন ধরে অথচ সে তার কিছুই জানতো না।আর জানবেই বা কি করে? দেশের বাহিরে ছিলো সে। একমাত্র বোনের বিয়েতেও আসতে পারেনি। নুহিদ ক্রন্দনরত কন্ঠে বলল,

-‘ এসব কথা আগে বলোনাই ক্যান আপা? আমি ঐ উসমান রে মাইরা ফালামু। ‘

-‘ ভুলেও না। সবকিছু নষ্ট হইয়া যাইবো তাইলে।’

-‘ সবকিছু মানে?’

-‘ কইতাছি! তোর দুলাভাই তার সব সম্পত্তির একটা উইল করে। যেখানে সে তার সব সম্পত্তির ৬০% মালিক অহর্নিশ আর আয়ন্তিকার বাচ্চার নামে কইরা দেয়। অহর্নিশ আর আয়ন্তিকার দুজনের বিয়া হোক এটা সে আগে থেকেই চাইতো। আর অহর্নিশ আর আয়ন্তিকার জীবনের ঝুঁকি যাতে না হয় তাই আগে থেকে এই উইল করে। এতে করে কেও আয়ন্তিকারে মারার সাহস করবো না। আর না অহর্নিশ রে। উইল দেইখা আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। কারণ সে আমার নামে দেয়নাই কিছু। যদিও জানতাম এমনটা হবে। এত কষ্ট সহ্য কইরা তার সাথে সংসার করছি সম্পত্তি পামু তার লোভে। আমার মন মতো কিছুই হয়নাই। তারজন্যই তো তোরে কইলাম তারে কিডন্যাপ কইরা উঠায় নে। তারপর সবাইরে কইছি সে মরছে। তার কয়েক বছর পর যখন অহর্নিশ আইলো দেশে তারপর কইলাম উসমান রে কিডন্যপ করার কারণ। বিয়া দিলাম ওদের। এখন বাচ্চা হাতে না পাওয়া পর্যন্ত ছাড়ুম না তারে। ‘

নুহিদ বাহির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নাহিয়ার পানে তাকিয়ে বলল,

-‘ এরজন্যই বলছিলা তাইলে? তারপর সবার কাছে বিশ্বাস করানো উসমান মরছে। সবসময় এতো মানুষ দিয়ে নজর রাখা জমিদার বাড়ির ওপর যাতে পুলিশে না খবর দিতে পারে। ‘

-‘ হ। ‘

-‘ বাচ্চা পাইলে কি করবা আপা?’

-‘ বাচ্চা নিয়া দূরে চলে যাবি তুই। বাচ্চারে বড় করবি। উইল নিয়া যাবি তোর সাথে। উইল আছে আমার কাছে। বাচ্চার ১৮ বছর হইলে উকিল দেখাইয়া বাচ্চার থেকে সই নিয়া আমরা নিয়া যামু সম্পত্তি। ‘

_________________________

বাসায় আসা মাত্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে আয়ন্তিকা গোসলে করতে চলে যায়। নিজের কার্য সমাপ্তি শেষে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দৃশ্যমান হয় তার বেডে টান টান হয়ে শুয়ে আছে অহর্নিশ। দুই হাত কপালের নিচে ভাজ করা।

আয়ন্তিকা টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে গিয়ে বলল,

-‘ আপনি এখানে কেনো?’

অহর্নিশ আয়ন্তিকার হাত ধরে হেঁচকা টান মেরে নিজের বক্ষ পিঞ্জরের ওপর ফেলে। পরবর্তীতে সে তার একহাত আয়ন্তিকার গালে কোমল রূপে রেখে দিয়ে বলল,

-‘ বিকজ আই ওয়ান্ট টু লাভ ইউ। ‘

চলবে…

#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-১২

আয়ন্তিকার ভীতিগ্রস্ত মুখশ্রী। ভয়ে সে রীতিমতো কাঁপা কাঁপি শুরু করে দিয়েছে। বাকরুদ্ধতা তাকে গ্রাস করেছে তীব্রভাবে যার ফলস্বরূপ সে অহর্নিশ কে কিছু বলতেও পারছে না। অল্প বয়সি হলেও অহর্নিশের বলা বর্তমান কথাটির মূল অর্থ সে বুঝে গিয়েছে। যার দরুণ তার এই অবস্থা।

অহর্নিশ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আয়ন্তিকার দিকে। শেষে সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না। হু হুা করে হেঁসে দেয়। হাস্যরত অবস্থাতেই উঠে বসে পড়ে অহর্নিশ। বুকে হাত দিয়ে লম্বা শ্বাস নিয়ে সে বলল,

-‘ তোমার মাইন্ড কতো খারাপ আয়ন্তিকা, ছিহ্! নটি গার্ল! ‘

আয়ন্তিকা বুঝতে পারলো না অহর্নিশের কথাটি। বেকুব চোখে সে তাকিয়ে রইল ড্যাবড্যাব করে। তা দেখে অহর্নিশ প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে বলল,

-‘ লেট ইট বি! আই ওয়াস জোকিং।হায়ার ম্যাথ বই টা আনো। কাল এটার ওপর এক্সাম না? কিছু ম্যাথ করিয়ে দিচ্ছি। ‘

আয়ন্তিকা অকপটে জবাব দিলো,

-‘ দরকার নেই। আমি একাই করতে পারবো। ‘

-‘ জিজ্ঞেস করিনি তোমায় আয়ন্তিকা। এটা আমার আদেশ। আর তুমি আমার আদেশ পালন করতে বাধ্য। যাও জলদি বই আনো। ‘

অগত্য আয়ন্তিকা গাল ফুলিয়ে বই নিয়ে এসে বসে পড়ে বিছানাতে। অহর্নিশের পাশে। হাতের তোয়ালে পাশে রেখে দেয়। চুল দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে, তবে মুছতে ইচ্ছে হচ্ছে না আপাতত। সে মনোযোগী হয় বইয়ের পাতা উল্টাতে। আয়ন্তিকার হয়ত জানা নেই তার দিকে এক ঘোরলাগা গভীর পূর্ণ দৃষ্টি আবদ্ধ হয়ে আছে।

অহর্নিশ শুকনো ঢোক গিলে। দৃষ্টি চারপাশে দেয়। কেনো যেনো তার মনে হচ্ছে আয়ন্তিকার পাশে থাকার জন্য ওকে পড়াতে এসে বেশ মুশকিলে পড়েছে। কারণ এই যে আয়ন্তিকা কে ভয়ংকর সুন্দরী লাগছে। এখন তাকে ছুঁয়ে দেয়ার লোভ অহর্নিশ সামাল দিবে কি করে? কি করে? হাউ?কথা গুলো আওড়ানোর সময় কর্ণগোচর হয় আয়ন্তির নিচুস্তর কন্ঠ। ও মাত্রই বলল,

-‘ নিন এইযে বের করেছি। এই চাপ্টার গুলোই আছে। ‘

-‘ বই দাও আমার কাছে। ‘

নিজেকে সংযত করে অহর্নিশ বইয়ের মাঝে ডুব দেয়। কিছুক্ষণ চোখ বুলিয়ে নিয়ে সে ত্রিকোণমিতি এর অংক করানো শুরু করে। পুরো চাপ্টার শেষ হলে অহর্নিশ নিজ থেকে কিছু অংক আয়ন্তিকা কে তৈরি করে দেয় প্র্যাক্টিসের জন্য। চারটা অংক শেষে একটাতে এসে আঁটকে যায় আয়ন্তিকা। তা দেখে অহর্নিশ সুচালো কন্ঠে বলল,

-‘ কি ব্যাপার? বসে আছো যে, জলদি শেষ করো। ‘

আয়ন্তিকা মিনমিনিয়ে বলল,

-‘ এই ম্যাথটা পারছি না। ‘

খাতার দিকে তাকায় অহর্নিশ। পরবর্তীতে তীক্ষ্ণ নজরে আয়ন্তিকার দিকে তাকিয়ে সে বলল,

-‘ এটা পারছো না? সূত্র বসিয়ে করতে হবে এটা। সূত্র লিখো আগে। ‘

-‘ সূত্রটাই ভুলে গিয়েছি। ‘

অহর্নিশ ঠোঁট আঁকড়ে নিয়ে দৃষ্টিপাত দেয় আয়ন্তির মুখশ্রীতে। তৎক্ষনাৎ কিছু মনে করে সে মৃদু হাসে। কন্ঠ সুক্ষ্ম করে বলল,

-‘ ক্লাস ৯ এ কি করেছি? এতো সিম্পল একটা সূত্র মনে রাখতে পারো না? লাইক সিরিয়াসলি! ‘

আয়ন্তিকার অহর্নিশের কথার পরিপ্রেক্ষিতে রেগে যেতে বড্ড ইচ্ছে হলো। কিছু তার জাতীয়গত স্বভাব তাকে রেগে যেতে দিলো না। পর্বতসম অভিমান নিয়ে সে চুপ করে রইল। অপমানে তার চোখের কার্নিশে পানি এসে জমেছে তা বুঝতে পারলো স্পষ্ট রূপে।

অহর্নিশ আহত হয়। সে ভেবেছিলো আয়ন্তিকা রেগে যাবে। রেগে গিয়ে তাকে কঠিন কয়েক কথা শোনাবে। আর এর মধ্য দিয়ে সে রাগীরূপী আয়ন্তিকার সৌন্দর্যও মুখস্থ করে নিবে। আয়ন্তির ভীতিরূপে থাকে সৌন্দর্য, ক্রন্দনরূপে থাকে মায়া, অভিমান করলে সে চেহারা থাকে চুমু খাওয়ার আবদার। এইতো, সব ক্ষণের সর্ব রূপ অহর্নিশ মুখস্থ করে নিয়েছিলো। রাগী রূপটাই বাকি। ভেবেছিলো সে এই কথারা পরিপ্রেক্ষিতে সে তাও মুখস্থ করে নিবে কিন্তু তা হলোনা। হলো উল্টোটা!

অহর্নিশ নিজেকে ধাতস্থ করে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বলল,

-‘ এখন আর করার দরকার নেই ম্যাথ। একটু ঘুমাও মাত্র পরিক্ষা দিয়ে এসেছো বলে তাই হয়ত মাথা কাজ করছে না। ঘুমিয়ে পড়ো একটু। ‘

অহর্নিশ চটজলদি বেড়িয়ে পড়ে রুম থেকে। নিজেকে তার থাপ্পড় মারতে ইচ্ছে করছে। কড়া থাপ্পড়!
________________

শাফি উজমার নিকট এগোতে নিলেই উজমা চুপসে যায়। কাপুনি দিয়ে দূরে সরে বসে। ভীতিগ্রস্ত দৃষ্টি তার। গলা শুকিয়ে কাঠ। তা দেখে শাফি মলিন হাসে। এই মেয়েটা তাকে ভয় কেনো পাচ্ছে? হু? একটু ভালোবেসে তাকানে যায় না? দীর্ঘ কয়েক মাড ধরে এভাবেই উজমা তার দিকে ভীতি চাহনি নিক্ষেপ করছে। শাফি কাছে যেতে নিলেই তার ব্রেইনের নার্ভ দূর্বল হয়ে পড়ে। সেন্সলেস হয়ে যায় উজমা।

শাফি মেরে ফেলেনি উজমাকে। তার সাধ্যে হয়নি এই মিষ্টি মেয়েটাকে খুন করার। অথচ উজমার থেকে আরে কত সুন্দরী মেয়েকে সে অনায়াসে খুন করে ফেলেছে টাকার বদৌলতে। কিন্তু এই মেয়ে, উজমা! একে তার মেরে ফেলা সম্ভব হয়নি। উজমার বদলে সে অন্য একটা মেয়েকে মেরেছে। সেই মেয়েটাকে মারার নির্দেশ দিয়েছিলো একজন। তদ্রুপ মেয়েটাকে মারার পর সে উজমার পোশাক পড়িয়ে নাহিয়াকে ছবি পাঠিয়ে বলেছে সে মেরে ফেলেছে উজমাকে।এবং নাহিয়া আহমেদ তাই বিশ্বাস করেছে। বহুদিন যাবৎ নাহিয়ার সাথে শাফি কাজ করায় নাহিয়া তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে

শাফি উজমার সন্নিকটে এগিয়ে গিয়ে কোমল কন্ঠে বলল,

-‘ উজমা এদিকে আসো। ভয় পাইতেছো কেন আজিব? খাওনাই ক্যান? রেনু খালায় খাবার নিয়া কতবার আইছে তারে বারবার ফিরায় দিছো কেন?’

উজমা কাঁপা কন্ঠে বলল,

-‘ আ..আপনি ক..কে? আ..আমাকে এ..এখানে আঁটকে রেখেছেন ক..কেন? বাসায় যাবো। যেতে দিন দয়া করে। ‘

শাফি হুট করে রেগে গেলো উজমার কথায়। তার মোটেও এই কথাটি পছন্দ হয়নি। শাফি চিবিয়ে বলল,

-‘ যাওয়ার কথা কস ক্যান?কোনোদিন দিয়া কষ্ট দিছি হ্যা? খালি বাসায় যামু, বাসায় যামু করস! আরেহ্ বাসায় যাইয়া তো সেই বান্দির মতোই খাটবি তার থেকে যে এখানে রানির হালে রাখতাসি শান্তি লাগে না এতে?’

শাফির কথাগুলো তিক্ত লাগল উজমার নিকট। এতে করে সে ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে দেয়। শাফি বিরক্তি, রাগের সংমিশ্রণ নিয়ে চলে যায় রুম হতে বাহিরে।
__________________

ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে ব্যাবধান সৃষ্টি করে আয়ন্তিকা ভীতি নিয়ে চেয়ে আছে সামনে। বিছানার ওপর তার দৃষ্টি।ছোট ছোটো কোমল আঙুল গুলি থরথর করে কাঁপছে। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে গালের দিকে। বিছানার ওপর একটা তেলাপোকা নিজ মনে হাঁটাচলা করছে। আর দশটা মেয়ের মতোই আয়ন্তি ও তেলাপোকা কে প্রচন্ড রূপে ভয় পায়। ফোবিয়া আছে এক প্রকার বলা চলে। ঘুম থেকে উঠে নিজের পাশেই এই তেলাপোকার দেখা মিলে তার।

বিছানার তেলাপোকা উড়াল দিয়ে মেঝেতে এসে পড়তেই আয়ন্তিকা নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারে না। চিৎকার দিয়ে উঠে উচ্চস্বরে। অস্ফুটস্বরে সে ‘ অহর্নিশ ‘ বলে ডাক দেয়।
.

সবেমাত্র অহর্নিশ সেভ করতে নিয়েছিলো। উচ্চস্বরে আয়ন্তিকার চিৎকার শুনে হতবিহ্বল হয়ে তার গাল রেজার দিয়ে খানিকটা কেটে যায়। রক্ত তার নিজ নিয়মে গলগল করে ফিনকি দিয়ে বের হতে থাকে। কিন্তু অহর্নিশ সেদিকে পরোয়া না করে হাতের রেজার ছুঁড়ে ফেলে দৌড় মারে আয়ন্তিকার রুমে।

আয়ন্তিকার রুমের ভেতর প্রবেশ করে এক নির্দিষ্ট স্থান নিয়ে দাঁড়াতেই অহর্নিশ লক্ষ্য করে আয়ন্তিকা এর ভীতু চেহারা। কেমন থরথর করে কাঁপুনি দিচ্ছে, এক পাশে গুটিশুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। অহর্নিশ এবার ঠোঁট যুগল প্রসারিত করে চিন্তিত কন্ঠে বলল,

-‘ আয়ন্তিকা, কি হয়েছে? ‘

আয়ন্তিকা এবার পূর্ণ দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে অহর্নিশের দিকে। হিতাহিত জ্ঞান ফেলে সে দৌড়ে এসে তার দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে অহর্নিশ গলা। পা উঁচু করে নেয়। গলায় মুখ গুঁজে দিয়ে সে কাঁপা কন্ঠে বলল,

-‘ ত..তেলাপোকা ম..মেঝেতে। প..প্লিজ সরান ঐটা কে। ‘

অহর্নিশ থতমত খায়। মেঝেতে দৃষ্টি দিতেই সে দেখে কালো কুচকুচে এক তেলাপোকা উল্টো হয়ে পড়ে আছে। কিছুটা বোধগম্য হয় তার পুরো ঘটনা। এতে ও বিরক্তি প্রকাশ করে। বিরক্তিমাখা কন্ঠে বলল,

-‘ লাইক রিয়েলি আয়ন্তিকা? এই তেলাপোকা কে ভয় পাও তুমি? এরজন্যই এতো জোড়ে চিৎকার। ‘

আয়ন্তিকা জবাব দেয়না। ভয়ে সিটিয়ে আছে। অহর্নিশ খেয়াল করে আয়ন্তিকার অবস্থান। চোখ দুটো অনায়াসে তার বড় বড় আকার ধারণ করে। ঠোঁট কামড়ে হাসে অহর্নিশ। পরবর্তীতে সে সামলে বলল,

-‘ এভাবে বাঁদরের মতো ঝুলছো কেন?নামো! ‘

-‘ নাহ প্লিজ। আপনি আমাকে এই রুম থেকে নিয়ে যান। ‘

ভীতি কন্ঠে বলল আয়ন্তিকা। অহর্নিশ ফের ঠোঁট কামড়ে হাসে। তার এই মূর্হতে তেলাপোকা টাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। এবং সে তাই করে। ইশারায় তেলাপোকার দিকে তাকিয়ে ‘থ্যাংকস’ বলে বেড়িয়ে যায় রুম থেকে।
.
রুমে এসে আয়ন্তিকা নিজ থেকে লাজুকলতা রূপ ধারণ করে নেমে যায়। গুটিশুটি পায়ে সোফায় গিয়ে বসে পড়ে। অহর্নিশ সেদিকে একবার তাকিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। কাটা জায়গাতে ড্রেসিং করার দরকার। তারপর সেভ ও তো করা বাকি। কাল মন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যেতে হবে। পরিপাটি মতোন না গেলে চলে নাকি?

নিজ কার্য সমাপ্ত ঘোষণা করে অহর্নিশ রুমে এসে দেখে আয়ন্তিকা সোফায় হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে, মাথা এলিয়ে দিয়েছে দেয়ালে। রাত ১১ টা বাজে। একটু পর তারও বের হতে হবে। রাত হলে বেড়িয়ে পড়ে সে রাতের শহরে দুঃখমাখা গল্প শ্রবণ করতে। পুরো এলাকা ঘুরে সে রাস্তা ঘুমিয়ে থাকা মানুষদের নোট করে রাখে, রাতে যেই বাচ্চাগুলো খুদার জ্বালায় মায়ের নিকট কান্না করে তাদেরও মাথায় গেঁথে রাখে। পরবর্তীতে সকাল হলে নিজের দলের কিছু মানুষ দিয়ে টাকা, খাবার পাঠিয়ে দেয় তাদের নিকট। পরিচয় গোপণ রেখে। তবুও সেই অসহায় মানুষগুলো বুঝে যায় এগুলো সব অহর্নিশই দিয়েছে।

অহর্নিশ পড়নের জামা পাল্টে পরিপাটি হয়। তারপর এগিয়ে যায় ঘুমন্ত আয়ন্তিকার নিকট। আস্তে ধীরে কোলে তুলে নেয় আয়ন্তিকা কে সে। নিজের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে যেতে নিলে কি মনে করে অহর্নিশ নিজেও শুয়ে পড়ে আয়ন্তিকার পাশে। অপূর্ব সৌন্দর্যে ঘেরা আয়ন্তি কে দেখতে দেখতে বহুক্ষণ কাটিয়ে দেয়। ফজরের আযান কানপ আসলে অহর্নিশ হতভম্ব হয়। এত সময় পেড়িয়ে গিয়েছে?

অহর্নিশ আয়ন্তিকার নিকট এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-‘ ব্যাঘাত ঘটিয়ে দিলে তো আমার রোজকার রুটিনে। এমন ভয়ংকর সুন্দরী কে হতে বলেছে তোমায়? তোমার সৌন্দর্য যে আমার প্রতিক্ষণে তীব্র ভাবে গ্রাস করে তা অনুভব করতে পারোনা?’

অহর্নিশ সন্তপর্ণে চুমু খায় আয়ন্তিকার কপালে।

চলবে…

#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

#দ্র: রিচেইক করিনি।