অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব-১৩+১৪

0
581

#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-১৩

অন্ধকারে আচ্ছাদিত চারিপাশ। মাঝেমধ্যে বিকট আওয়াজে হয়ে আশপাশ ক্ষনের জন্য আলোকিত হয়ে ফের নিজের পূর্ব রূপে ফিরে আসছে। বৃষ্টি হচ্ছে বাহিরে তুমুল বেগে। আয়ন্তিকা গ্রীল হতে হাত বের করে বাহিরে দেয়। বৃষ্টির হীম কণা এসে তৎক্ষনাৎ তার হাত স্পর্শ করে। অন্যান্য সময় হলে আয়ন্তিকা খিলখিল করে হেঁসে দিতো কিন্তু বর্তমানে আয়ন্তি হাসলো না। তার মন বিষন্ন। চিন্তায় একটু খানি হয়ে গেছে।

সকাল হতে অহর্নিশের কোনো খবর নেই। সেই ভোর ছয়টায় বেড়িয়েছে তাকে বলে নিয়ে, কিন্তু এখন রাত ১২ টা বাজে অহর্নিশের ফেরার কোনো নামগন্ধ নেই। আজকাল অহর্নিশ পাশে না থাকলে তার কেমন ফাঁকা ফাঁকা অনুভূত হয়। তাদের সংসার এর বয়স যত বাড়ছে ততই মনে হচ্ছে আয়ন্তিকা অহর্নিশের প্রতি একটু আধটু করে দূর্বল হয়ে যাচ্ছে। হবেই না কেনো? একজন মেয়ে পার্ফেক্ট স্বামী চায় সর্বদা। আর অহর্নিশ কে নিঃসন্দেহে একজন পার্ফেক্ট স্বামী বলা যায়। এই যে আয়ন্তিকার পরিক্ষা গেলো কতটা সুন্দর ভাবে তাকে গাইড করেছে অহর্নিশ। তার ছোট ছোট আবদার পূরন করার চেষ্টা করেছে, মুখে না বললেও অহর্নিশ তা বুঝে গিয়ে তার অপূর্ণ ইচ্ছে পূর্ণ করতো। স্বামী হিসেবে তো সবাই এমনই একজনকে চায় সর্ব ক্ষনে,

কলিংবেলের শব্দ কর্ণগোচর হতেই আয়ন্তিকা দ্রুত পায়ে দরজার নিকটে চলে যায়। দরজা খুলতেই তার সামনে দৃশ্যমান হয় সিক্ত, আহত অহর্নিশ কে। চুল দিয়ে পানি টপটপ করে পড়ছে। কপালের কার্নিশে ব্যান্ডেজ। বাম হাতেও উঁকি দিচ্ছে শুভ্র রঙের ব্যান্ডেজ। আয়ন্তিকা বিস্মিত হয়! কাঁপাটে সুরে বলল,

-‘ আ..আপনার কি হয়েছে? ‘

অহর্নিশ নিজের সুস্থ হাতটা মাথায় গলিয়ে দেয়। আলত করে ঝাড়া দিয়ে পানিমুক্ত করার প্রয়াস চালায়। অতঃপর গহীন চোখে আয়ন্তিকার পানে দৃষ্টি দিয়ে বলল,

-‘ তেমন কিছু না। একটু আঘাত পেয়েছি। ‘

-‘ তেমন কিছু না মানে? আপনি কি আমায় বোকা মনে করেন হ্যা? নিশ্চিত মারামারি করেছেন। সত্যি করে বলুন অহর্নিশ, আপনার এই অবস্থা কি করে হলো।’

আয়ন্তিকার তেজী কন্ঠে ভড়কে যায় অহর্নিশ। মুখে সেই ভড়কানো আভাসটা তরতাজা হয়ে ফুটে আছে তবে মনে যেনো একটু প্রশান্তির ছোঁয়া মিললো। আয়ন্তিকা তাকে তার নাম ধরে ডেকেছে। তার ওপর একটু একটু করে অধিকার দেখাতে শুরু করেছে। বুঝে নিচ্ছে আস্তেধীরে নিজের অধিকার অহর্নিশের থেকে। আয়ন্তিকার কঠিন দৃষ্টি দেখে মৃদু হাসে সে। পরিশেষে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

-‘ সত্যিটা তুমি হজম করতে পারবেনা। তাই না বলাই শ্রেয় আয়ন্তিকা। কিছু কিছু সত্য গোপণ রাখা ভালো। ‘

আয়ন্তিকা মনোযোগী চাহনি দেয় অহর্নিশের মুখশ্রীর প্রতি। পরবর্তীতে চোখমুখে ফের কাঠিন্যতা টেনে এনে বলল,

-‘ হজম করতে পারবো কিনা ঐটা নিতান্তই আমার ব্যাপার। আপনি বলুন! খুন – টুন করে এসেছেন কাওকে?’

-‘ খুন করিনি কিন্তু করে ফেলতাম আরেকটু হলে।’
মৃদু হেঁসে বলল অহর্নিশ।

আয়ন্তিকা ভ্রুকুটি কুঁচকে নেয়। কৌতূহলি কন্ঠে সে বলল,

-‘ মানে?’

-‘ আমার এই আঘাতের কারণ সায়িদ। গ্রামের নিরিহ মেয়েদের যে ধর্ষণ করে নিজ মন খুশিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো টাকার এবং ক্ষমতার জোরে। তোমাকে বাজে ছুঁয়েছিলো। সেই সায়িদ! ওকে মেরেই ফেলতাম আজ। প্রথমত গালাগাল করে পালিয়ে যাওয়ার সময় আঘাত করলো। তার ওপর তোমায় নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালাগাল, বাজে কথা বলেছে। আমি আসলেই আজ ওকে খুন করে ফেলতাম। কিন্তু পারিনি সেটা করতে। বাবার ওয়াদা ভঙ্গ করতে পারিনি আমি। ‘

আয়ন্তিকা পাথর রূপ ধারণ করেছিলো। অতি কষ্টে সে অস্ফুটস্বরে বলল,

-‘ আপনি সায়িদকে কিভাবে চিনলেন?এসব কোথা কোথা থেকে জানলেন আপনি?’

-‘ তুমিই বলেছিলে। চার মাস আগে আমি তোমায় জরীয়ে ধরাতে তোমার জ্বর এসেছিলো মনে আছে? সেই দিনই রাতে জ্বরের ঘোরে সব বলেছিলে তুমি। ‘

কথা সমাপ্ত হওয়ার পর অহর্নিশ লম্বা পা ফেলে নিজের রুমে চলে যায়। আয়ন্তিকা সেদিকে তাকিয়ে একফোঁটা অশ্রু বিষর্জন দেয়। সায়িদের কথা মাথায় আসলে ঠিক থাকেনা সে। তার ওপর আজ অহর্নিশ আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে সায়িদের জন্য। এতে সে নিজেকেই দায়ী ভাবছে। আয়ন্তি মনে করে সে যদি সেদিন জ্বরের ঘোরে ওসব কথা না বলতো তাহলে আজ অহর্নিশ আঘাতপ্রাপ্ত হতো না। কিন্তু ঐ জা-নো-য়া-র সায়িদেরও তো শাস্তি পাওয়া দরকার ছিলো।

নিজেকে পূর্ণরূপে ধাতস্থ করে আয়ন্তিকা অহর্নিশের রুমের উদ্দেশ্যে পা এগিয়ে নেয়। রুমের সন্নিকটে এসে আলত চাপিয়ে রাখা দরজা হাত দিয়ে ধাক্কা দেয় সে। অতঃপর আয়ন্তিকা সুনিপুণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করে অহর্নিশ কে। অহর্নিশ নিজের শার্ট পাল্টে সবেমাত্র টিশার্ট পড়লো। তবে ছিপছিপ রক্তের দাগ আয়ন্তিকার চক্ষুর আড়াল হয়নি।

অহর্নিশ ঘাড় বাকিয়ে আয়ন্তিকা কে দেখে নিয়ে বলল,

-‘ কিছু বলবে?’

আয়ন্তিকা সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ায়।

-‘ কি বলতে চাও?’
আয়ন্তিকা ইতস্তত বোধ করে বলল,

-‘ আপনার ব্যান্ডেজ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে চেঞ্জ করা দরকার। ‘

অহর্নিশ ক্লান্তিমাখা কন্ঠে বলল,

-‘ ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করার মতো শক্তি আমার মাঝে অবশিষ্ট নেই আয়ন্তিকা। আমি এখন একটু ঘুমাবো, মাথা ব্যাথা করছে। ‘

-‘ ব্যান্ডেজ তবে আমি চেঞ্জ করে দেই?’

অহর্নিশ চমকে হাতের টাওয়াল টা মেঝেতে ফেলে দেয়। শুষ্ক ঢোক গিলে সে বোঝার চেষ্টা করে এই মাত্র সে কি শুনলো? সত্যি শুনলো তো?আয়ন্তিকা তার ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করে দিতে চাইছে তা তার বিশ্বাস হচ্ছে না। নিজেকে আস্বস্ত করে মৃদু হেঁসে অহর্নিশ বলল,

-‘ অবশ্যই। কাবার্ডে ফাষ্ট এইড বক্স আছে নিয়ে আসো। আমি ওয়াশরুম থেকে আসছি। ‘

-‘ আচ্ছা। ‘

আয়ন্তিকা ফাষ্ট এইড বক্স নিয়ে বেডে বসার ক্ষন বাদে অহর্নিশ ওয়াশরুম হতে বেড়িয়ে আসে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সে আয়ন্তিকার সামনে গিয়ে বসলো। টিশার্ট আলত করে উঁচু করে অহর্নিশ বলল,

-‘ জলদি করো ঘুম পাচ্ছে। ‘

-‘ আচ্ছা। একটু অপেক্ষা করুন। বেশি সময় লাগবে না আমার। ‘

আয়ন্তিকার কথ্যে অহর্নিশ মনে মনে বলল,

-‘ বছর খানেক সময় নিয়ে তুমি আমার ব্যান্ডেজ করো আয়ন্তিকা। আমার কোনো আপত্তি নেই এতে, তুমি যত সময় নিয়ে আমার ব্যান্ডেজ করবে ততবার তোমার কোমল, তুলতুলে হাত আমায় নতুন অনুভূতির প্রতি পরিচিয় করাবে। ‘প্রেম ‘ নামক অনুভূতির। যেই অনুভূতির সাথে পরিচিত হতে আমি মনেপ্রাণে চাই। কিন্তু সেই প্রেম অনুভূতি তোমায় ঘিরে না হলে তা আমার চাইনা। একটুও চাই না। ‘
________________

এলার্মের শব্দে তড়িৎ বেগে চোখ খুলে আয়ন্তিকা। পিটপিট করে তাকিয়ে ডান পাশে দৃষ্টি দিতেই সে দেখে অহর্নিশের ফোন। এলার্মের শব্দের উৎপত্তি সেখান হতেই। আয়ন্তিকা চটজলদি মাথা নিচু করতেই দেখে অহর্নিশ তার পা জরীয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। অস্বস্তিতে পড়ে যায় সে। কাল রাতে অহর্নিশের জ্বর আসাতে পরবর্তীতে আর নিজের রুমে যায়নি আয়ন্তিকা। অহর্নিশের রুমে বেডের ওপর বসে ছিলো। ভোরের একটু আগে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে। কিন্তু অহর্নিশ আর তার মাঝে বেশ ব্যাবধান ছিলো। কখন এসে তাকে জরীয়ে ধরলে কে জানে?’

অহর্নিশ একটু আধটু নড়েচড়ে উঠে। ঘুমুঘুমু কন্ঠে সে বলল,

-‘ এলার্ম টা অফ করে দাওনা আয়ন্তিকা। ঘুম পাচ্ছে আমার। এখন উঠতে চাচ্ছিনা। ‘

আয়ন্তিকা অস্বস্তি নিয়ে বলল,

-‘ আপনি আগে সরুন তো। ‘

অহর্নিশ চোখ খুললো। নিজের অবস্থান দেখে সে একটুও ভড়কালো না। বরং অহর্নিশ ঠোঁট বাকিয়ে হাসে আয়ন্তিকার অবস্থা দেখে। লাজুকলতা রূপে নতজানু হয়ে তটস্থ হয়ে আছে আয়ন্তিকা। অহর্নিশের আর ইচ্ছে হলোনা আয়ন্তি কে লজ্জা দেয়ার। নয়তো এবার সে ভয়ংকর কিছু করতো। অহর্নিশ তার হাত সরিয়ে নেয়। শীতল কন্ঠে বলল,

-‘ আমার ফোনটা একটু দাও তো আয়ন্তিকা। ‘

আয়ন্তিকা চটজলদি নেমে পড়ে বিছানা থেকে। পালানোর সুযোগই সে খুজছিলো। কিন্তু নিজ হতে দৌড়ে রুম থেকে বের হতেও সংকোচ কাজ করছিলো। টেবিলের ওপর থেকে অহর্নিশের ফোন হাতে তুলে নিয়ে ফোন স্ক্রিনে ভেসেথাকা ম্যাসেজটি দেখে সে থমকায়। ম্যাসেজটা এসেছে ‘Safu ‘ নিক নেম দিয়ে সেভ করা এক নাম্বার হতে।

আয়ন্তিকা আবার চোখ বুলায় ফোনে। স্পষ্টত লিখা
‘ আমাকে এতদিন বন্দী রেখে মানষিক টর্চার করেছো অহর্নিশ। এই শোধ আমি তুলবোই। কালকের মধ্যেই এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবো তুমি তখন বেচে থাকার পথ খুঁজে পাবেনা। ‘

চলবে…

#অন্তর্লীন_প্রণয়
সাদিয়া মেহরুজ দোলা
পর্ব-১৪

বর্ষার প্রথমাংশ! গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে শুকিয়ে যাওয়া নদী নালা এখন বর্ষার স্নিগ্ধ বর্ষণের কারণে পানিতে টইটুম্বুর। সজীবতা হারানো গাছপালা এখন বর্ষণের ফলে নির্মল রূপ ধারণ করেছে। আশপাশ সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে আয়ন্তিকা স্নান হাসে। বর্ষাকাল তার বড্ড প্রিয় মৌসুম। যত কষ্ট, দুঃখ এ সময়ে থাক তার মনে বর্ষার বর্ষণের মতোই তখন সেই দুঃখগুলো ধুয়ে মুছে যায়।

অহর্নিশ বাসা থেকে তার নিজস্ব মার্কেটে যাওয়ার উদ্দেশ্যে চলে যাওয়ার পরপরই সেই যে না খেয়ে, দুই ঘন্টা যাবৎ আয়ন্তিকা বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে ফিরে যাওয়ার নামগন্ধ নেই তার। আজ প্রকৃতিবিলাস করতে বেশ লাগছে তার। ইশ! কি সুন্দর করে প্রকৃতি সেজেছে আজ বর্ষার সাজে, দেখতে মারাত্মক লাগছে। কর্কশ শব্দধ্বনি কর্ণপাত হতে আয়ন্তিকা চটজলদি পিছন ফিরে! অহর্নিশ দাঁড়িয়ে ঘর্মাক্ত মুখশ্রী নিয়ে। ললাট হতে বিন্দু বিন্দু নোনা ঘাম বেয়ে পড়ছে। এতটা ঠান্ডা পরিবেশের মাঝে অহর্নিশের ঘেমে যাওয়ার কারণটা আয়ন্তিকা খুঁজে পেলো না। আর অহর্নিশ তার রুমেই কিভাবে?বাসার ভিতরে প্রবেশ করলো কি করে?

নিজ প্রশ্নোত্তুর মন নিয়ে আয়ন্তিকা যখন তুমুল ব্যাস্ত ক্ষন পালন করছে ঠিক সেই সময়ে অহর্নিশ রুষ্ট কন্ঠে বলল,

-‘ খাওনি কেনো এখনো? কয়টা বাজে জানো? ‘

আয়ন্তিকা থতমত খায়। আখিঁপল্লব ছোট ছোট করে নিয়ে বলল,

-‘ আগে বলুন আপনি বাসায় কি করে আসলেন? দরজা তো লাগিয়ে রেখেছিলাম আমি। ‘

-‘ ডুপ্লিকেট চাবি ছিলো আমার কাছে। ‘

আয়ন্তিকা ঠোঁটযুগল গোল গোল করে বলল, ‘অহ!’

অহর্নিশ শার্টের হাতা দিয়ে ললাটের ঘাম মোছার প্রয়াস চালায়। পরবর্তীতে সে এগিয়ে যায় বেলকনিতে। ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

-‘ কি জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি? খাওনি কেনো এখনো? এতো অনিয়ম করে চলো কেনো?অসুস্থ হয়ে পড়লে কে দেখবে?’

আয়ন্তিকা হুট করে ভাবান্তর ছাড়া বলল,

-‘ কেনো আপনি! আপনি দেখবেন। ‘

কথা সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়ন্তিকা তার ওষ্ঠ যুগল চেপে ধরে। চোখ বড়সড় করে সে নতজানু হয় তৎক্ষনাৎ। কি বলল মাত্র সে? এটাই বা কেনো বলল মুখ ফস্কে? শুষ্ক চাহনিতে আয়ন্তিকা মাথা উঁচু করে নিয়ে অহর্নিশের দিকে অস্থিরতা পূর্ণ চাহনি দেয়। লাজুকলতা চাহনি নয়ন যুগলে চকচক করছে তার। অহর্নিশ তা বুঝতে পেরে নিজের স্বাভাবিকতা পূর্ণ রেশ বজায় রাখে। ভারী কন্ঠ বলল,

-‘ ডাইনিং এ এসো জলদি! এক মিনিট লেট হলে এসে কোলে তুলে নিয়ে যাবো। ‘

অহর্নিশ রুম হতে বেড়িয়ে যায়। অধরের কোণে মিহি হাসি। শীতলতা পূর্ণ হৃদয়। আয়ন্তিকার প্রতেকটা কর্ম তার কাছে মধুর লাগে। দিনকে দিন সে বেহায়া, বিলজ্জহীন হয়ে উঠছে আয়ন্তিকার জন্যেই। নিজ শক্ত, কঠোর মনটা আজ গলে যাওয়ার পথে। ধীর পানে হয়ে উঠছে তার হৃদয় শীতল, মাধুরতা পূর্ণ। অহর্নিশ বিড়বিড় করে বলল,

-‘ ইউ আর এ ম্যাজিকাল গার্ল আয়ন্তিকা! দিনকে দিন আমায় পরিবর্তন করে দিচ্ছো। নতুন অনুভূতি, নতুন ভালোলাগা, নতুন আসক্তির সাথে পরিচয় করে তুমি আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছো। এর জন্য তোমায় শাস্তি পেতে হবে। আরনাফ আহমেদ অহর্নিশের প্রেমময় শান্তি তোমায় পেতেই হবে।

.

আয়ন্তিকা নিজেকে প্রায় দুই মিনিট নিয়ে ধাতস্থ করে ডাইনিং রুমে যায়। তখনি তার দৃষ্টি আঁটকে যায় অহর্নিশের প্রতি। অহর্নিশ ডাইনিং টেবিলে বসে ফোনের মাঝে মগ্ন! চুল দিয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে কালো রঙের টিশার্টে। যার ফলে কাঁধ এবং চিবুকের টিশার্টের খানিক একাংশ সিক্ত রূপে রূপান্তর হয়েছে। আয়ন্তি সামনের দিকে পা এগোয়। অহর্নিশের পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়ে।ইচ্ছে হলো অহর্নিশ বলতে ‘ মাথা মুছে নিন ‘ কিন্তু তা আর হলো না সংকোচ এর কারণে।

কারো অবস্থান উপলব্ধি করে অহর্নিশ ফোন হতে মাথা তুলে। আয়ন্তিকা কে দেখে ফের মাথা নুইয়ে দৃষ্টি দেয় ফোনে! সাফিয়ার প্রেরণকৃত ম্যাসেজটি দেখছিলো সে। এই ম্যাসেজের স্বস্তা হুমকি তার কাছে তুচ্ছ মাত্র। ম্যাসেজটা কোথা হতে এসেছে তা জানার প্রয়াস চালাচ্ছিলো, কিন্তু ব্যার্থ অহর্নিশ! সকালে যে আয়ন্তিকা এই ম্যাসেজটি দেখেছিলো তা শতভাগ নিশ্চিত অহর্নিশ। কিন্তু এর পরিপ্রেক্ষিতে আয়ন্তিকা কেনো তাকে কিছু বলল না তা তাকে বড্ড ভাবিয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই আয়ন্তি তাকে ফোন এগিয়ে দিয়েছিলো। অহর্নিশ চিন্তিত হয় খানিক। আজ রাতে সে বাসায় থাকবে না। বাহির যেতে হবে! সেখানে আয়ন্তিকা কে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। একা থাকাকালীন সাফিয়া কিছু অঘটন না ঘটিয়ে ফেলে আয়ন্তিকার সাথে। কারণ তার আপাতত জানা নেই সাফিয়া কই লুকিয়ে আছে। ওকে খোঁজার ও সময় নেই অহর্নিশের হাতে।

তপ্তশ্বাস ফেলে ভাতের প্লেটটাকে টেনে নিজের সামনে আনে অহর্নিশ। ভাত মাখিয়ে আয়ন্তিকার মুখের সামনে তুলে ধরতেই প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকায় আয়ন্তিকা। তা দেখে মৃদু কন্ঠ অহর্নিশ বলল,

-‘ জলদি খাওয়া শেষ করো। আমার হাত থেকেই খেতে হবে তোমায়। সঠিক সময়ে খাবার না খাওয়ার শাস্তি এটা। ‘

আয়ন্তিকা কেঁপে উঠে। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,

-‘ আর এমন হবেনা প্রমিস। আমি নিজ হাতে খাই প্লিজ?’

-‘ না! আমার হাত থেকেই খেতে হবে তোমায়। বেশি ত্যাড়ামো করো না। থাপ্পড় লাগাবো কানের নিচে। ‘

আয়ন্তিকা কাঁদো চেহারা বানিয়ে চুপচাপ খাওয়ার পর্ব সমাপ্ত করে। অহর্নিশের হাতে খেতে তার নূনতম ইচ্ছে নেই। তবুও কোনোরকম খাবার গিলছে শুধু। অহর্নিশ তা দেখে মনে মনে হাসে! তার শান্তি লাগছে বড্ড বেশি প্রশান্তি এসে ঠেকছে মনে।

খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে অহর্নিশ আয়ন্তিকা কে মুখ ধুতে বলে নিজের রুমে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায়। তা দেখে আয়ন্তিকা ভ্রুকুটি কুঁচকে নেয়। অহর্নিশের এভাবে চলে যাওয়া তার নিকট স্বাভাবিক লাগলো না। তাই সে মুখ ধুয়ে নিয়ে অহর্নিশের রুমে যায়। আয়ন্তিকা দেখে অহর্নিশ বিছানায় কেমন ছটফট করছে। ভীতি নিয়ে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় আয়ন্তি। অস্থির কন্ঠে বলল,

-‘ ঠিক আছেন আপনি? এমন করছেন কেন?’

আয়ন্তিকার কন্ঠে অহর্নিশ নিজেকে নরমাল করার চেষ্টা করে। হুট করেই তার মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে। যা প্রতি মূর্হতে অসহনীয় পর্যায়ে যাচ্ছে। অহর্নিশ ব্যাথাতুর কন্ঠে বলল,

-‘ মাথা ব্যাথা করছে! ‘

অহর্নিশ চোখ বন্ধ করে নেয়। আয়ন্তিকা কিছু ভেবে নিয়ে তোয়ালে হাতে করে অহর্নিশের মাথার কাছে বসে। সিক্ত চুলগুলোকে আস্তেধীরে মুছে দেয়ার চেষ্টা করে। কার্য সমাপ্ত হতে আয়ন্তি উঠতে নিলে তৎক্ষনাৎ অহর্নিশ এসে তার পায়ের ওপর মাথা রেখে দুহাত দিয়ে পা জরীয়ে ধরে। অতঃপর আড়ষ্ট কন্ঠে বলে,

-‘ একটু মাথা চেপে দাও না আয়ন্তিকা। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে আমার। ‘

আয়ন্তিকা বাকরুদ্ধ! মুখে কিছু বলল না। বিমূঢ় হয়ে চেয়ে রইল শুধু। একবার মনে করলো অহর্নিশ কে ধাক্কা মেরে সরিয়ে চলে যাবে রুম হতে কিন্তু পরবর্তী তে দায়িত্বের খাতিরে আলত করে হাত রাখে মাথায়। ঘন, কালো চুলগুলোকে আস্তেধীরে টেনে দেয়। অহর্নিশ চোখ বন্ধ করেই মৃদু হাসে!

___________________

সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে সকাল হতেই জমিদার বাড়িতে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে নুহিদ। নাহিয়ার সামনে বসে সে ঢগঢগ করে পানি খেয়ে গলা সিক্ত করে। নুহিদের এ অবস্থা দেখে নাহিয়া ভ্রুকুটি কুঁচকে নিয়ে বলল,

‘ তোর এই অবস্থা ক্যান? কি হইছে?সকাল সকাল এহানে আইছস যে। ‘
‘ আপা তোমার সাথে জরুরি কথা আছে। ‘
‘ কি জরুরি কথা? ক!’
‘ আপা তুমি কইছিলা আয়ন্তিকার বাচ্চার ১৮ বছর হইলে তুমি সম্পত্তি পাবা। কিন্তু আপা তুমি অতদিন বাচবা? এসব ছাইরা দেও আপা। আমার সাথে দুবাই চলো। অনেক ভালো রাখমু তোমারে। ‘
‘ আয়ন্তির বাচ্চার ১৮ বছর হইলে আমি বাঁচুম না জানি। কিন্তু তোরা তো বাঁচবি। তোরা পাইলেই হইল, আমার লাগবোনা! আর চাইলেও এসব ছাড়ন যাইব না। ‘

বোনের কথায় চোখ ভরে আসে নুহিদের। কিন্তু শেষোক্ত কথাটা শুনে সে প্রশ্নাত্মক চাহনি দিয়ে বলল,

‘ মানে? ‘
‘ মানে হইতাছে এই সম্পত্তির জন্য অনেক কিছু করছি আমি। উজমারে মারছি! উজমা হইতাছে আমাগো বাসায় যে থাহে। এতিম মাইয়াডা। ও। ওরে মারতে হইছে। উজমা সব জাইনা গেছিলো গা। অহর্নিশ রে বলতে গিয়া ভয়ে অজ্ঞান হইয়া যায় অয়। অহর্নিশ উজমারে ধরলে তা দেখে ফেলে আয়ন্তিকা। ভুল বুঝে তখন অহর্নিশ রে। তারপর ভবিষ্যতে আর জানি কিছু না জানে কেও তাই শাফিরে দিয়া উজমার কিডন্যাপ করাইয়া মাইরা ফেলাই। তারপর… ‘

নুহিদ চমকে বলল,

‘ তারপর? তারপর কি আপা?’

‘ তারপর আমি আর্নিয়ারে আমার সাথে যুক্ত করি। অর ব্রেনওয়াশ করে বলি আমারে সার্পোট দিলে অরেও সম্পত্তি দিমু। এরজন্য আর্নিয়াও অন্ধ হইয়া আমার লগে কাজ করে। কারণ উসমান অর নামে অল্প সম্পত্তি দিছিল। আর্নিয়া এসবে জরিত তা একদিন কা আফিমা জাইনা যায়। তারপরই তো অগো ছাড়াছাড়ি হয়! আফিম তালাক দেয় আর্নিয়া রে। তবুও আর্নিয়া আমার লগে কাজ করে। অহর্নিশের সাথে আয়ন্তিকার বিয়া দেয়ার সব পদ্ধতি ওই বলছে। ‘

সবকিছু শুনে নুহিদ বিস্মিত! এতকিছু হয়ে গিয়েছে, তা কল্পনা করতে পারেনি সে। সামান্য এক সম্পত্তির কারণে একজনের প্রাণ গেলো, একজনের সংসার নষ্ট হলো। আরেকদিকে আরো দু’জনের প্রাণ ঝুঁকি। লোভ মানুষকে কোথায় নিয়ে ঠেকায়!

.
পর্দার আড়াল হতে সরে যায় অয়ন এবং অহর্নিশ। নাহিয়া এবং নুহিদের সম্পূর্ণ কথোপকথন তারা দুজন শুনেছে। আগে থেকেই প্লান করা ছিলো এখানে আসবে তারা। আসার সাথে সাথেই যে এত তাড়াতাড়ি সব সত্য তাদের সামনে উপস্থাপিত হবে ভাবেনি কেও। অয়ন মাথায় হাত দিয়ে কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

‘ ভাইরে ভাই! এটা তোর দাদী নাকি কুটনার ভান্ডার? এত প্যাচ এই বুড়ির মধ্যে আল্লাহ! এই বুড়ির এক পা তো কবরে অলরেডি তাও এতো শয়তানি যায় না মাথা থেকে। এরে আমার গলা চেপে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করতাসে দোস্ত। বাপড়ে! কি বুড়ির বুড়ি এইটা। মাবুদ, রহম করো! ভাই জলদি এই চিপা থেকে বের হ। আমার মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালা লাগবে। আগুন বের হইতেছে মাথা থেকে। ‘

অহর্নিশ অয়নের কথা কর্ণপাত করলো না ঠিক মতন। চোয়াল শক্ত করে সে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। তার দাদীর মাঝে এতোটা খারাপ দিক রয়েছে তা জানা ছিলো না। কিন্তু তার বোন? আর্নিয়া! সে কেনো গেলো এর মাঝে? ব্রেনওয়াশ করেছে বলে কি সব ভুলবে? আর্নিয়ার হিতাহিত জ্ঞান কি লোপ পেয়েছে?
বোনের জন্য কষ্ট লাগে অহর্নিশের। রুষ্ঠ কন্ঠে সে বিড়বিড় করে বলল,

‘ নাহিয়া আহমেদ, আপনাকে যদি জ্যান্ত কবর না দিয়েছি তাহলে আমার নাম অহর্নিশ না। সব কিছুর শাস্তি আপনাকে কড়ায় গন্ডায় দিতে হবে! ‘

ভাইব্রেশনে থাকা ফোন হটাৎ করে কেঁপে ওঠাতে হুঁশ ফিরে অহর্নিশের। পকেট হতে ফোন বের করার পর দেখে স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ‘ Nahid ‘ নামটি। এই সময়ে নাহিদের কল দেখে ভ্রুকুটি কুঁচকে নেয় সে। পরবর্তীতে আয়ন্তিকার কথা মাথায় আসতেই সে ফোন রিসিভ করে চটজলদি। অতঃপর ওপাশ নাহিদ ভীতি কন্ঠে বলল,

‘ অহর্নিশ ভাই, সর্বনাশ হয়ে গেছে! সাফিয়া আপনার বাসায় ঢুকে গেছে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে। ভাবি বাসায় একা তো ভাই! সাফিয়ার হাতে ছুড়ি ছিলো একটা। একটু আগে ভাবীর চিৎকার শুনছি অনেক জোড়ে। তারপর আর কোনো সারা শব্দ পাইনি। বাসার ভেতরে যেতে নিছিলাম দরজা বন্ধ। দরজা ভাঙতে নিলে দারোয়ার চোর ভেবে মাইর দিয়ে বের করে দিছে। আপনি তাড়াতাড়ি আসেন ভাই! ভাবী খুব বিপদে আছে। ‘

চলবে…

#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা

[ গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায়। ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিলে খুশি হবো। ]