অন্যরকম ভালোবাসা পর্ব-০১

0
1184

#অন্যরকম_ভালোবাসা 💓
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব::০১

একহাতে প্রেগনেন্সির রিপোর্ট অন্যহাতে ডিভোর্স পেপার নিয়ে তাকিয়ে আমি আয়ানের মুখে দিকে।। রক্তের ছাপ ছাপ দাগ শরীরে স্পষ্ট।। একটু আগে অজড়ো ধারায় বেল্ট দিয়ে পিটিয়েছে‌।। চিৎকার করে মার থামাতে বলেছি ,, কিন্তু আমার কথায় তিনি কর্নপাত করে নি।।সে তো মারতে ব্যস্ত ছিলো।। অবশেষে মারতে মারতে ক্লান্ত হয়ে বেডে মাথা চেপে বসে পড়লো।।আর অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।। এতোক্ষণে সবাই দরজার বাহিরে এসে হাজির হয়েছে ।।সবার কন্ঠে উদ্বেগ স্পষ্ট আর দরজা খোলার আকুতি।।আয়ান আমার দিকে তাকিয়ে ,, সামনে থাকা সোফায় জোড়ে লাথি দিলো ,, মুহুর্তেই সোফা উলটে গেল।। আর জোড়ে জোড়ে চেঁচিয়ে উঠলো…

— জাস্ট গো টু হেল।।যাও এখান থেকে ,, আমাদের মতো একদম আসার চেষ্টা করো না।।(আমাকে উদ্দেশ্য করে আয়ান) কি খাইয়ে বস করেছিস ওদের ,, আমার চেয়েও ওদের কাছে আজ তুই বেশি আপন হয়ে গেলি।।

ভয়ে আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে।।কথা বলার শক্তিটুকু খুঁজে পাচ্ছি না।। টেবিলের উপর রাখা এক গ্লাস পানি শেষ করে,,, গ্লাসটা জোরে চেপে ধরলো।।রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার হাত।।সেদিকে কোনো আক্ষেপ নেই তার ,,, তিনি শুধু আমাকে মারতেই ব্যস্ত।। তিনি হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন ,,আর আমি ভয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি ।।একহাতে আমার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে রক্তভেজা হাতে গাল চেপে ধরলো।।আয়ানের হাতে গেঁথে যাওয়া কাঁচের টুকরো এবার আমার গালে গেঁথে যাচ্ছে ।।চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।।

— একজনে হয়না তোর কয়জন লাগে।। কার সন্তান তোর পেটে জায়গা দিয়েছিস তুই।। এই সন্তানের বাবা কে??

বিয়ের ৪ মাস পরে এমন কথা শুনে চমকে গেলাম আমি।।কোনো একদিন তুলে এনে বিয়ে করেছিলো আমাকে ।। বলেছে ,, আমার অমতে কখনো আমাকে ছুঁবে না।। কিন্তু পরে তো নিজে থেকেই আমার কাছে এসেছে।। তখন ভেবে নিয়েছিলাম,, যখন সারাজীবন আয়ানের সাথেই থাকতে হবে ,, তাহলে নিজের জেদ ধরে বসে থাকা বৃথা।। সেই থেকে আমাদের মাঝে আর পাঁচটা স্বামী স্ত্রীর মাতো সম্পর্ক বিদ্যমান।।
আজ এমন করার কারণটা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।।।

— আয়ান বিশ্বাস করো এই সন্তান আমাদের ভালোবাসার চিহ্ন ।।ওর শরীরে তোমার আর আমার রক্ত বইছে ।।প্লীজ বিলিভ মি।।।( কাঁদতে কাঁদতে আমি)

আয়ান আমার কোনো কথা শুনলো না ।। দরজা খুলে হাত ধরে টানতে টানতে দুতলা থেকে নিয়ে এলো।। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার আগেই আয়ানের বাবা আজাদ আহম্মেদ গর্জে উঠলো….

— লজ্জা করে না,,, অসহায় একটা মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে।। সেদিন ,, ইশরার ইচ্ছে না থাকার সত্ত্বেও বন্দুক ঠেকিয়ে ,,তুলে নিয়ে গিয়ে জোড় করে বিয়ে করে নিলে ।।আর আজ মেয়েটা প্রেগন্যান্ট জেনে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছো।।তোমার ধারনা আছে,, ওকে কতো সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।।।
এই শিক্ষা দিয়েছি আমি তোমাকে।।

— বাবা তোমার আর মায়ের মাঝে ,,, দাদুভাই আর দিদার সাথে কোনো সমস্যা হয়ে আমি কিন্তু তোমাদের স্বামী স্ত্রীর মাঝে না গলাই না।।আর আমিও চাই না,,, আমাদের স্বামী স্ত্রীর মাঝে অন্য কেউ গলাক।। তাছাড়া আমি ওকে নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছি ,,তার ওর কোনো ক্ষতি হলে তার জবাবদিহি তোমাদের করতে হবে না।।( হাত দিয়ে আজাদকে থামিয়ে দিয়ে আয়ান)

— আয়ান (চেঁচিয়ে বললো আজাদ) ।।আজ যদি ইশরাকে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় ,,তাহলে আমি আমার বাড়িতে তোমার ছায়াও যেন না দেখি ,,মাইন্ড ইট।।

— বড্ড হাসাতে তুমি বাবা।। এটা তোমার বাড়ি নয় ,,দাদু ভাইয়ের ।।যদি সে বলে চলে তো চলে যাবো ।।(ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে আয়ান)

আর কেউ কোনো কথা বললো না।।আয়ান আবার আমার হাত ধরে মেইন দরজার সামনে এগিয়ে গেল।। তারপর লক খুলে আমাকে রেখে আবার লক করে দিলেন।।

ভেতর থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ পাচ্ছি,,হয়তো আমাকে নিয়ে কোনো কথা হচ্ছে।।এটা বেশ বুজে গেছি,, আমার আর ভেতরে যাওয়া হবেনা।। যেদিন আয়ান জোর করে এই বাড়িতে এনেছিলো ,, সেদিকে ইচ্ছে করছিলো ছুটে পালিয়ে যাই।। কিন্তু পারি নি পালাতে ।।আজ নিজ থেকে বের করে দিয়েছে ,, এখন যেতে ইচ্ছে করছে না।।সময় টা বরই অদ্ভত,, কতো পার্থক্য।।
প্রশ্ন হলো ,, রাত প্রায় ১২ টা ছুঁই ছুঁই।।এতোরাতে যাবো কোথায় ,, সেটা ভেবেই কুল পাচ্ছি না।।তাই দরজা গেসে সেখানে বসে পড়লাম।। আমার ভাবনার মাঝেই আবার দরজা খুলে গেল।। আয়ান এসেছে।।মুখে ফুটে উঠলো এক তৃপ্তিকর হাসি।। কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী রইলো না।।

— এখানে সাইন করো ,,আর বেরিয়ে যাও।।(পেন আর পেপার এগিয়ে দিয়ে)

— চিন্তা করবেন না ,,আমি কখনো আর আপনার জীবনে ফিরে আসবো না।।আমার মুখের কথাই যথেষ্ট,, সাইনের দরকার নেই।।

বলেই বেরিয়ে এলাম সেই বাড়ি থেকে।।আর পারছিনা আয়ানের পাগলামি গুলো মেনে নিতে।। আমি কি শুধু খেলনা যখন ইচ্ছে খেলবে ,, আবার প্রয়োজন শেষে ফেলে দিবো।।।আমি হাত বাড়িয়ে চোখের পানি মুছে নিলাম।। আঁচলটা তুলে ভালো ভাবে শরীরে পেঁচিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে হাঁটছি আর ভাবতে লাগলাম কালকের ঘটনা।।।।

_________________________

গত দু’দিন ধরে শরীরটা খারাপ ছিলো ।।কোনো কিছুই মুখের কাছে নিতে পারিনি।। সারাক্ষন মাথা ঘুড়তো আর বমি বমি ভাব হতো।। আমার অবস্থা দেখে আয়ান হসপিটালে নিয়ে চেক আপ করায়।।আজ রিপোর্ট আনতে হসপিটালে গিয়েছিলো।। আর সেই রিপোর্টই আমার কাল হলো।।তখন আমি ড্রয়িং রুমে বসা ।।সবার জন্য চা করেছি।।ধরপর করে বাড়ি ঢুকলো আয়ান ।।কিছু বোঝার আগেই হাত ধরে টানতে টানতে রুমে নিয়ে এলো ।। হাতে থাকা রিপোর্ট গুলো ছুঁড়ে মারলো আমার উপর ।। রিপোর্ট পজেটিভ দেখে দুফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়লো চোখ থেকে।। আপনাআপনি হাত চলে গেলো পেটে।।আমি মা হতে চলেছি ,, সেটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে।। কেউ আধো আধো গলায় আমায় মা বলে থাকবে।। হাটি হাটি পায়ে ঘর জুড়ে হাঁটবে।।
কিন্তু পরক্ষনেই আমার সেই আনন্দে এক রাশ নিরাশা নিয়ে আসে।।”” তোমার পেটের সন্তানের বাবা কে””?? প্রথমে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো ।। আমার উত্তর তো সে।।পরে আস্তে আস্তে তা বেল্টের রুপ ধারন করে।।

আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যে রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছি খেয়ালই করিনি।। গাড়ির হর্ন বাজতেই চোখ তুলে তাকালাম।। গাড়িটা আমার সামান্য একটু দূরে ,, তা দেখে সেখানেই জ্ঞান হারালাম।।একদিকে শরীরে অসহ্য ব্যাথা অন্যদিকে ভয়ে নিজেকে সামলানো ক্ষমতা আমার নেই।।

“আহহ” বলে লাফ দিয়ে মাঝরাতে উঠে বসলো ইশরা।।ঘামে পুরো‌ ভিজে গেছে সে।।ছয়মাস ধরে একই সব দেখে ।।বুকের মাঝে হাজার কষ্ট নিয়ে ঘুমিয়েছিলো ,, আজও মিস গেল না তার স্বপ্ন।।
রুমের চারদিকে অন্ধকার ছেয়ে আছে ।।এখনো ভোরের আলো ফোটেনি।। কিন্তু বাহিরে থাকা আলো এসে ঘরের সবকিছু আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে।।বেডের পাশে থাকা টেবিলে থাকা জগটা থেকে পানি গ্লাসে ঢেলে এক নিঃশ্বাসে খেয়ে ,, ফাঁকা গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে দীর্ঘশ্বাস নিলো।। চোখের দৃষ্টি সামনের দিকে স্থীর রেখে অন্ধকারের মাঝে হাতরিয়ে হাতরিয়ে লাল রঙের টেবিলল্যাম্প জ্বালালো ইশরা।। তারপর বেড থেকে নেমে এক পা একপা করে আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে ,, কাঁধ থেকে শাড়ির আঁচলটা খুলে নিচে ফেললো।। নিজেকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো ইশরা।।লাল লাইটের আলোয় সেদিনে বেল্টের দাগগুলো স্পষ্ট ভেসে আছে।।সাথে গায়ে থাকা হলুদগুলো লালের মাঝে রক্তিম রুপ ধারণ করেছে।। আগের তুলনায় পেট অনেকটা বেড়ে গেছে।।যেটা ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারীর স্বাভাবিক একটা বিষয়।। একটু আগে হলুদের অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এসে আর শাওয়ার নেয়ার হয়নি তাই ইশরার গায়ের চামড়া বড়দের মতো কুঁচকে গেছে।।একটা তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে কাবার্ড থেকে প্ল্যাজু আর টি শার্ট বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।।
বিয়ের ৪ মাস পর অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় যখন বাড়ি ফিরে আসে পাড়ার লোক প্রথমে সবই চুপ থাকলেও ।।পরে সবার বাজে কথার স্বীকার হতে ইশরাকে।।ইশরা চুপচাপ সবটা মেনে নিলেও ,, ইশরার বাবা মা রৌদ্র জুবায়ের আর তমোনা জুবায়ের মেনে নিতে পারে নি।।তাই অনেক কষ্টে ,,, রৌদ্র জুবায়েরের বাল্যবন্ধুর ছেলে
মেঘের সাথে আবার ইশরার বিয়ে ঠিক করে ।। ইশরার সাথে মেঘের বিয়ে ছোটবেলা থেকেই ঠিক ছিলো ।। মেঘ ইশরাকে ভালোবাসলেও ইশরা শুধু বাবার ইচ্ছেটা পূরন করতে বিয়ে রাজি হয়।।আর এবারও বাবার সম্মানে কথা ভেবে বিয়েতে রাজি হয় সে।।।

____________________

ঘড়ির কাঁটা ১১টা ছাড়িয়ে ১২টা ছুঁই ছুঁই।। সূর্যের আলো মাথার মাঝ বরাবর।।কাঠফাঁটা রোদে বাহিরে বের হওয়াই দায়।। কিন্তু তার পরোয়া না করেই রৌদ্র জুবায়ের নিজের মেয়ের বিয়ের সব তোরজোর করছে।।তার ইচ্ছে ছিলো ,, বিরাট করে আয়োজন করে এলাকার সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়ানোর ।। শুধু মেয়ের বারন শুনে তাকে থেমে যেতে হয় ।। মেয়ের বর্তমান অবস্থাও তার মাথায় হানা দেয়,, অনেক কষ্ট করে বিয়েতে রাজি করিয়েছে ইশরাকে।।মতের অমত হলে যদি আবার বিয়ে ভেঙে দেয় তখন।।তাই ছোট করেই বিয়ের ব্যবস্থা ,, কিন্তু কমতি রাখেনি কোনো অংশে।। এদিকে তমোনা জুবায়ের অনবরত দরজায় নক করে যাচ্ছে ,, কিন্তু দরজা খুলছে না ।।আর না ভেতর থেকে আওয়াজ আসতে।।তার ইচ্ছে করছে ঠাস ঠাস করে ইশরার গালে লাগিয়ে দিতে ।। কিন্তু সেটা নিছক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।।বিরক্তি নিয়ে আবার নক করতেই দরজা খুলে গেল।। বিনা বাক্যে দরজা খুলে দিয়ে মাকে ভেতরে আসার জায়গা দিয়ে দরজার কাছ থেকে সরে আসলো ইশরা।। তমোনা জুবায়ের রুমে ঢুকে টেবিলের উপর খাবার রাখতেই ,, হরমুর করে রুমে ঢুকলো কয়েকজন মেয়ে।।বিয়ের গয়না ঘাঁটি ,, শাড়ি রেখে তারাও বিনা বাক্যে বেরিয়ে গেল।। তিনি এগিয়ে ইশরাকে টেনে বেডে বসিয়ে দিয়ে ,, মাথার টাওয়াল খুলে চুলগুলো মুছিয়ে দিলেন।। খাবার হাতে নিয়ে এক লোকমা তুলে মুখে দিলেন ,, আর বললেন!!!

— দেরী করে শাওয়ার নিয়েছিস মানলাম,, চুলগুলো তো একটু মুছতে পারতিস।।পার্লারের মেয়েরা এলো বলে।।

ইশরা দুই লোকমা খাবার খেয়ে ,,,, টেবিলের উপর রাখা পানি ভর্তি গ্লাসটা তুলে সামান্য একটু গলা ভিজিয়ে নিলো।।বেড থেকে নেমে ফ্লোরে বসে তমোনা জুবায়ের কোলে মাথা রেখে প্রশ্ন ছুড়লো….

— মা আমার সাজতে একদম ভালো লাগে না।। কালকে হলুদে সেজেছিলাম প্রচুর মাথা ব্যাথা করছিলো।।তুমি নিজের হাতে আমায় সাজিয়ে দিতে পারবে না।
হালকা করে।।।(করুন সুরে ইশরা)

মায়ের মনে নাড়া দিয়ে উঠলো ।। একবার তো তার ভাবা উচিত ছিলো,, মেয়ের বর্তমান অবস্থা।।

চলবে..🎀🎀
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন,, ধন্যবাদ)