অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-২১ এবং শেষ পর্ব

0
1098

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_২১ (অন্তিম পর্ব)

ইশারার চলে যাওয়ার পর গুটিসুটি পায়ে অরিদ্রের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো অর্ণ। তার ছোট্ট মনে হাজারো প্রশ্ন। ইশারার চলে যাওয়ায় সে বিষন্ন। অরিদ্রের কাছে যেতেই অরিদ্র অহনাকে কোল থেকে নামিয়ে অর্ণকে জড়িয়ে ধরলো।

‘বাবা তুমি কোথায় ছিলে? না বলে কোথায় গিয়েছো?’

অরিদ্রের প্রশ্নের উত্তর অর্ণ দিলো না। সে এখনো সম্মুখ পানে তাকিয়ে আছে। অর্ণের দৃষ্টি লক্ষ্য করে অরিদ্র সেদিকে দেখলো। রমণীর চলে যাওয়ার দৃশ্য তার হৃদয়কে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। রমণীকে কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে সে।

‘কে অর্ণ?’ (অরিদ্র)

‘মামণি।’ (অর্ণ)

অরিদ্র কিয়ৎক্ষণের জন্য থমকে গেলো। ইশারা এখানে? কিন্তু কেন? আবার চলেই বা গেলো কেন?

‘কে ছিলো অরিদ্র?’

আদৃতার কথায় অরিদ্রের ধ্যান ফিরলো। কিন্তু এখনো সে ইশারার যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে!

‘অরিদ্র! শুনতে পাচ্ছিস?’ (আদৃতা)

‘হুম।’

‘কে ও?’

‘ইশারা।’

‘ওহ্। এভাবে চলে গেলো কেন ও?’

‘সেটা তো আমারও প্রশ্ন। আপু তুই অহনাকে নিয়ে বাড়ি যা। আমি আর অর্ণ একটু পর আসছি।’

_________________

বাড়িতে ফিরে নিজেকে আর আটকাতে পারি নি। চিৎকার করে কেঁদেছি। কাঁদবো নাই বা কেন? আমার জীবনটা এমন কেন? আমার চাওয়া পাওয়া গুলো কেন পূর্ণ হয় না? কি অপরাধ আমার? আর সামলাতে পারছি না নিজেকে! পাগল পাগল লাগছে আমায়!

অনেকটা সময় নিজের সাথে যুদ্ধ করলাম। কিন্তু হেরে গেলাম! চোখের নোনাজলরা বাঁধ মানছে না। হঠাৎ খেয়াল হলো মায়ের কথা। মা তো ফাহাদ ভাইয়াদের বাসায়। গতকাল তনয়া নিয়ে গেছে। আজ স্কুল শেষে তাকে আনতে যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু আমি তো তা করি নি। বিচলিত হয়ে তনয়াকে কল করলাম। না চাইতেও আমাকে বিস্তারিত ঘটনার বিবরণ দিতে হলো। ফাঁকি দিতে পারলাম না!

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়িতে শোরগোল শুরু হয়ে গেলো। পুরো বাজার বাড়িতে উঠে এসেছে। তনয়া, ফাহাদ ভাইয়া, রুম্পি, রুদ্র স্যার, তরী, নিশান ভাইয়া, নির্ঝর, পূর্ণি, অর্পণ সবাই এসেছে। আমি হা করে তাকিয়ে আছি। আমার মন খারাপ বা বিষন্নতায় সকলের ছায়াই আমার পাশে থাকে। এই পাঁচটা বছর এদের শান্তনায়ই কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু বারবার তাদের সময় নষ্ট করার কোন মানেই হয় না। আমার জন্য এরা নিজেদের সময় কেন নষ্ট করবে? এদের কি কাজকর্ম নেই? এখন তো সবার সংসার আছে। নিজেদের কাজ কর্ম রেখে আমার কাছে বার বার ছুটে আসে কেন এরা?

‘আর কতক্ষণ এভাবে কান্না করবি ইশা?’ (তনয়া)

‘ইশা এবার থাম!’ (রুম্পি)

‘তোমার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে ইশারা। অরিদ্র বিয়ে করবে! ইমপসিবল!’ (রুদ্র)

‘দেখ যেই মানুষটা তোর বিয়ের খবর শোনার পর অন্য কাউকে ভাবতে পারে নি এই কয়টা দিনে সে বিয়ে করে ফেলবে? তোর মনে হয়?’ (তরী)

‘তোরা মাইয়ারা দুই লাইন বেশি বুঝোছ। একটা বার জিজ্ঞেস তো করতে পারতি তারে‌। না জিজ্ঞেস কইরাই আইছোস? আবার আবল তাবল কছ!’ (অর্পণ)

‘ইশা আপু তুমি অরিদ্র ভাইয়ার সাথে কথা বলো। সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’ (পূর্ণি)

সবার কথাগুলো কানে ঠিকই শুনতে পাচ্ছি কিন্তু কারো কথাই আমার ভালো লাগছে না। অরিদ্র হয়তো বিয়েই করে ফেলেছে নাহলে তার সাথের মেয়েটি কে? আর বাচ্চাটা কে? কিছুতেই নিজেকে শান্তনা দিতে পারছি না আমি। নিজেকে নির্বাক জীব মনে হচ্ছে।

‘ইশা এভাবে কাঁদিস না শরীর খারাপ করবে। দেখ তোর কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।’ (নির্ঝর)

‘আমারও মনে হচ্ছে তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে ইশারা।’ (ফাহাদ)

‘আচ্ছা তুমি তো তার সাথে কথা বলতে পারতে? কথা বললে না কেন? তাহলেই তো ব্যাপারটা ক্লিয়ার হতো।’ (নিশান)

‘এই মাথা মোটা মাইয়া দিয়া কিছুই হইতো না। ধুর।’ (অর্পণ)

‘হ, ঠিক। খালি জানবো প্যাচ কেমনে লাগানো যায়। কাজের কথা এদের দিয়া হইতো না।’ (নির্ঝর)

‘স্টপ!’ জোরে ধমক দিয়ে বললো রুম্পি। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘একদম কান্না করবি না। থাপ্পড় মেরে গাল লাল করে ফেলবো।’ রুম্পির এই রূপ আগে কখনো খেয়াল হয় নি। একদম রেগে লাল হয়ে আছে। রুম্পি রুদ্রের উদ্দেশ্যে আবার বললো, ‘আপনি বসে আছেন কেন? সব দোষ তো আপনার। এখনো নিজের বন্ধুকে ফোন করছেন না কেন? এটাও কি আমার বলতে হবে?’

রুম্পির ধমকে কিছুটা ঘাবড়ে গেল রুদ্র। চটজলদি পকেট থেকে ফোনটা বের করে নিলো। হঠাৎ করেই নিজের স্ত্রীর ভয়ংকর রূপ দেখে নিয়েছে সে। হয়তো দু বছরের বিবাহিত জীবনে এমন রূপ দেখার সুযোগ তার হয় নি।

‘আচ্ছা অরিদ্রকে এখানে আসতে বলি। আজই ব্যাপারটা ক্লিয়ার করে নিবো।’ (রুদ্র)

আর নিশ্চুপ থাকতে পারলাম না। নিজ চোখকে কি করে অবিশ্বাস করবো? চোখের নোনাজল মুছে বললাম, ‘প্রয়োজন নেই কোনো। আমি ভুল করছি না। বরং তোমরা সবাই ভুল করছো। আমি নিজ চোখে তাকে অন্য রমণীর সাথে দেখেছি। আর যদি সে তার স্ত্রী না হয় তবে কে সে? এটা কি করে মিথ্যে হবে?’

‘যদি সে আমার বোন হয়? বড় বোনের সাথে কথা বলা কি অপরাধ হবে ইশারা?’

সবার দৃষ্টি সম্মুখ দরজার কপাটের দিকে নিবদ্ধ হলো। অর্ণকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অরিদ্র। মানুষটার চোখে মুখে অস্থিরতা। তাকে দেখে চটজলদি চোখের জল মুছে ফেললাম। এতো সহজে আমি ধরা দেবো না।

‘শুনলাম আপনি নাকি বিয়ে করেছেন?’ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো পুরো সেনাবাহিনীর দল।

অরিদ্র হেসে বললেন, ‘সে রাজি থাকলে তো কত্ত আগেই করে ফেলতাম!’

‘তা আজকাল নাকি কোন মেয়ের সাথে চলাফেরা করছেন? আবার বাচ্চা মেয়েও নাকি আছে?’ (রুম্পি)

অরিদ্র শান্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। তিনি মুচকি হেসে অর্ণকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন। অর্ণ এবার আমার কোলে জায়গা করে নিলো।

‘তাই যদি হতো তাহলে কি এখানে একা আসতাম? তাকে নিয়েই তো আসা উচিত ছিলো!’

‘তা তো বটেই। এবার রাগিনীর অভিমান ভাঙাতে বলে ফেলুন তো কে সে?’ (তরী)

‘আদৃতা ফুপ্পি আর অহনা।’ সকলের দৃষ্টি এবার অর্ণের দিকে গেলো।

রুম্পি অর্ণকে কোলে নিয়ে বললো, ‘তোমার ফুপ্পি কি করে বাবা?’

‘ফুপ্পি তো বিদেশ থাকে। চাচ্চু আসার দুদিন আগে ফুপ্পি এসেছে। আঙ্কেল আর অহনাও এসেছে। আমি আর অহনা খেলি।’

সবার দৃষ্টি এবার আমার দিকে। নিজেও অবাক হচ্ছি। কি করে তাকে আমি তার বোনের সাথে জুড়ে দিলাম? আমার মগজটা কি সম্পূর্ণ গেছে? উফ! কি করলাম আমি?

‘আমি আগেই কইছি এই মাথা মোটাটা দুই লাইন বেশি বুঝে। দেখছোছ এবার?’ (অর্পণ)

‘তা বটে। এখন তো সব মিটমাট হলো। এবার তোর ধারণা পাল্টেছে ইশা?’ (তরী)

‘পাল্টাক আর না পাল্টাক ভাইয়া পাল্টায়া দিবো। এবার চল। তাদের সমস্যা তারা সমাধান করুক।’ (অর্পণ)

ঘরটাকে জনমানবশূন্য করে একে একে বেরিয়ে গেলো সবাই। এখন শুধু অরিদ্র আর আমি।

‘কেমন আছেন ইশারা?’

লোকটার কথায় গা জ্বলে যাচ্ছে। ‘যুগ যুগ পর এসে জিজ্ঞেস করবেন কেমন আছি, কি করছি, আর আমি তো আপনার সেইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে থাকবো তাই না? আপনার ইচ্ছে হলে কাছে থাকবেন আবার ইচ্ছে মতো দূর করে দিবেন। আমি খেলনা পুতুল নাকি? কে বলেছে আমায় ভালোবাসতে? আবার কে বলেছে দূরে সরাতে? আপনার ইচ্ছেই সব! বেশ তাজ্জব ব্যাপার তো!’

গড়গড় করে কথাগুলো বলে ফেললাম। অরিদ্র হাসতে লাগলেন। বললেন,

‘ইশারা আপনার কাছে থেকে আপনার অবহেলা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই তো সরে গেছি। আপনিই তো বলেছিলেন আপনাকে যাতে আপনার মতো ছেড়ে দেই!’

‘ওহ্ তাই তো। তা আবার আসলেন কেন?’

‘তাহলে কি চলে যাবো? আমি চলে গেলে আপনি খুশি হবেন ইশারা?’

‘যান মানা করেছে কে? আপনার জন্য তো তা আর অসম্ভব না। আপনি আমায় ভুলে তো থাকতেই পারবেন! এ আর নতুন কি!’

‘ভুলতে যদি পারতাম তবে আর ফিরে আসতাম না ইশারা! অন্য কাউকে আগলে নিতাম।’

তার আহত কণ্ঠস্বর। আর কিছু বলতে পারলাম না আমি। নিরবতায় ছেয়ে গেলো।

কিয়ৎক্ষণ পরে হঠাৎ তিনি আমার সামনে হাত এগিয়ে দিলেন। মিষ্টি হেসে বললেন, ‘আজও কি ফিরিয়ে দিবেন ইশারা? আজও কি আমায় খালি হাতে ফিরতে হবে?’

চোখ দুটো টইটম্বুর হয়ে গেলো। এবার কি ফিরিয়ে দিবো?
না আজ তাকে ফিরিয়ে দিলাম না। আজ তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস হলো না। তার হাত দুটো শক্ত করে জরিয়ে ধরলাম। তিনি পরম যত্নে আমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন।

‘আমায় ভালোবাসেন ইশারা?’

মলিন মুখখানা নিয়ে আমার উত্তরের অপেক্ষায় আছেন তিনি। আমি মিষ্টি হেসে বললাম, ‘অনেক বেশি।’

তিনি এবার আমায় শক্ত করে জড়িয়ে নিলেন। আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘ভালোবাসি ইশুবতী।’

তার মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা শুনে আমার হৃদকুটিরে এক শীতলতা বয়ে গেলো। তার সাথে পথচলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হচ্ছে। তাকে শক্ত করে জরিয়ে বললাম, ‘প্রথম প্রেমে আমি অপূর্ণ হলেও আপনি আমার #অপূর্ণতায়_পূর্ণতা অরিদ্র। আপনাকে অনেক অনেক ভালোবাসি।’

অরিদ্র মুচকি হাসলেন। তার বুকেই হয়তো আমার বসতি।এর মাঝেই নিজের পূর্ণতা খুঁজে নিলাম। শুরু করলাম জীবনের নতুন অধ্যায়। 💙

সমাপ্ত।