অপ্রিয় আশালতা পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0
414

#অপ্রিয়_আশালতা (অন্তিমের প্রথম পাতা)
প্রতিদিনের ন্যায় আজও সর্বশেষ টিউশনটা শেষ করে সন্ধ্যা মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরছিল আশালতা। তবে আজ শরীরটা বেশ দূ*র্ব*ল থাকায় বাসে চ*ড়ে বসেছিল। একে তো সিট খালি নেই তার ওপর আবার ঠে*লা*ঠে*লি করে দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছে। গ্রীষ্মের তা*প*দা*হে অ*তি*ষ্ট হয়ে আশালতার মন চায় ছুটে বাস হতে নেমে যেতে। হঠাৎ আশালতা তার কো*ম*রে কারো স্প*র্শ অনুভব করে। এই স্প*র্শ*কে খুব বা*জে উপাধি অনায়াসে দেয়া যাবে। অবস্থা যখন বেগতিক তখন আশালতা পাশ ফিরে লক্ষ্য করে এই কাজ তার বাবার বয়সী একজন লোক করছে। ওমনি তার শরীরে আ*গু*ন জ্ব*লে ওঠে। আশপাশে চোখ বুলিয়ে আশা লক্ষ্য করে আরও দুই তিনজন লোক ঠিক একই কাজ করে যাচ্ছে অন্য কিছু মেয়ের সাথে। চুপচাপ আশালতা তার হিজাব হতে দুটো পি*ন খুলে নিয়ে সুযোগ বুঝে পাশের বয়স্ক লোকটার হাতে গে*থে দেয়। ওমনি বাস ভর্তি লোকজনের মাঝে এক গগণ বি*দা*রী চি*ৎ*কা*র দিয়ে ওঠে লোকটা। সাথে সাথেই আশালতা পাশ ফিরে লোকটার বাম গালে একটা থা*প্প*ড় বসিয়ে দেয়।
-কোন পর্যায়ের অ*মানুষ তোরা? মেয়ের বয়সী মেয়েদের সাথে এমন বা*জে কাজ করতে রুচিতে বাধেনা? ঘরে তো মনে হয় মেয়ে আছে। তবে অন্যের মেয়েদের দিকে কেন এমন দৃষ্টি? তোর নিজের মেয়ের সাথে এমনটা হলে বাবা হয়ে তা সহ্য করতে পারতি? তোদের জন্য মেয়েরা রাস্তা-ঘাটে কোথাও-ই রে*হা*ই পায়না। কি শান্তি পাস তোরা এমনটা করে বল? ফুলের গায়ে টো*কা দিবি আর কা*টা*র ঘা খাবিনা তা হয়? একদম হাত কে*টে রেখে দেব। আর মেয়েরা তোমরাও বা কেমন? মেয়েদের স*হ্য ক্ষমতা বেশি তাই বলে কি সব স*হ্য করে নেবে? বারবার স*হ্য করো বলেই তো রাস্তা-ঘাটে এভাবে হে*ন*স্তা হওয়ার পরে আর মুখ ফুটে প্র*তি*বা*দ করার শব্দ খুজে পাওনা। রু*খে দাড়াতে শেখো আর কেউ টো*কা দেওয়ার সুযোগ পাবেনা। মেয়ে মানুষ ফুলের মতো হয়। তবে শুধু কোমলতার রূপ নিজের মধ্যে ধারণ না করে গোলাপের গায়ে যেমন কা*টা থাকে তেমন কা*টা*র মতো রূপও নিজেদের মাঝে ধারণ করো। কেউ দ*মা*তে আসলেই কা*টা বি*ধি*য়ে দেবে। ফু*স*তে ফু*স*তে আশালতা কথাগুলো বলে ওঠে।
মাঝ রাস্তাতেই বাস থামিয়ে নেমে যায় আশালতা। আশালতা হাটছে আর মুচকি মুচকি হাসছে । এতক্ষণে বোধ হয় বাসে তু*ল*কা*লা*ম লেগে গেছে। অ*মানুষগুলোকে হয়তো গ*ণ*পি*টু*নি দেওয়া আরম্ভ করে করেছে বাসের যাত্রীরা। মেয়েগুলোও বোধ হয় ফু*সে উঠেছে এতক্ষণে। হয়তোবা অনেকেই এখনো আশালতার কথার রে*শ কাটিয়েই উঠতে পারেনি!
কাঙ্ক্ষিত স্থানটায় আসতেই আজ আর প্রতিদিনের চেনা মুখটা এসে তার সামনে হাজির হয়নি। চোখের মণি ঘুরিয়ে এদিকে ওদিক কাউকে খুজতে আরম্ভ করে আশালতা।
-কি ম্যাডাম আজ কি একটু দেরি করে ফেললাম নাকি?
আচমকা সেই চির চেনা কন্ঠটা কানে এসে পৌছাতেই আশালতা চমকে ওঠে। নিজেকে ধা*ত*স্থ করে নিয়ে বলে ওঠে,
-আচ্ছা মিঃ কাব্য আমাকে একটু বলুন তো আপনি রোজ এই সময়ে কেন এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকেন?
-আমিতো আপনাকে দেখার রোজকার তৃ*ষ্ণা মেটাতে আসি। আপনার সাথে একটু কথা বলার লো*ভে এখানে আসি। সন্ধ্যার এই ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আপনার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাটার লো*ভে এখানে ছুটে আসি। তা আপনি বলুন তো, আগের মতো আমাকে দেখলে আর বি*র*ক্ত*বো*ধ কেন করেননা? আপনার চোখে-মুখে কেন সেই আগের মতো বি*র*ক্তি*বো*ধ ফুটে ওঠে না। (কাব্য)
কাব্যের কথায় থতমত খেয়ে আশালতা বলে ওঠে,
-তা আমি জানিনা। আপনি কেন আমার পেছনে সময় ন*ষ্ট করছেন? আপনার স্ট্যাটাসের সাথে একদম আমার যায়না কাব্য। আমার মতো এমন কালো ব*র্ণে*র মেয়েকে একদম আপনার সাথে মানায় না।
এবার কাব্য বেশ রে*গে যায়। হুং*কা*র দিয়ে বলে ওঠে,
-বোঝেন না কেন পড়ে আছি আপনার পেছনে? ভালোবাসি আপনাকে আমি। কিসের স্ট্যাটাসের কথা বলছেন আপনি? অর্থ-বি*ত্ত*র কথা বলছেন? উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়ার পরে আমার আব্বুর থেকে আমি কখনো এক টাকাও নেইনি। নিজের খরচ নিজে চালিয়ে আসছি। ছোটখাটো একটা চাকরি করে হালালভাবে কিছু অর্থ উপার্জন করি আমি। আর তা দিয়ে সাদামাটাভাবে চলি। ইচ্ছা আমার আপনাকে নিয়ে সাধারণভাবে ছোট্ট একটা সংসার সাজাবো। যেখানে সুখের বিপরীতে অন্য কিছুই থাকবেনা। আর কি বললেন আপনি কালো? আমার সাথে মানাবেনা? ইউ নো হোয়াট? আমার কাছে আপনি এবং আমার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দর নারী। কেন আমাকে একটু ভালোবাসতে আপনার ইচ্ছে হয়না? কি এমন দো*ষ আমার?

আশালতা ক্ষানিক সময় ক্লা*ন্ত চোখে কাব্যের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর গম্ভির কন্ঠে বলে ওঠে,
-বু*ক পকেটে যে প্রতিদিন বেলী ফুলের মালা নিয়ে ঘোরেন! তা যার জন্য নিয়ে আসেন তাকে কেন দেন না? সে তো প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকে কবে মিঃ কাব্য তাকে নিজ হাতে বেলী ফুলের মালা খানি হাতে মু*ড়ি*য়ে দেবে।
খুশিতে কাব্যের চোখ চিকচিক করে ওঠে। আ*হ্লা*দে গ*দ*গ*দ হয়ে বু*ক পকেট হতে মালা খানা বের করে আশালতার বাড়িয়ে দেয়া ডান হাতখানায় মু*ড়ি*য়ে দেয়। আশালতা মুচকি হেসে ডান হাতখানা দিয়ে কাব্যের বাম হাতের আঙ্গুল গুলো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয়। হাসিখুশি দুটো মানুষ নির্লিপ্তভাবে ব্যস্ত রাস্তা এক সঙ্গে পাড়ি দিতে আরম্ভ করে। মুখে তাদের কথা না থাকলেও মনে মনে যেন দুজনে কতশত গল্পে মুখোরিত হচ্ছে!



বিছানায় সোজা হয়ে শুয়ে নিজের চুল খাম*চে ধরে এক ভ*য়ং*কর দিনের স্মৃতি চারণে ডুব দেয় সাদ।

-ব্যাগ গোছাচ্ছো কেন লিনা? বিছানায় শুয়ে শুয়ে কথাগুলো বলে ওঠে সাদ।
মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে তুলে লিনা বলে ওঠে,
-যেই দিনটার জন্য এতদিন অপেক্ষা করে ছিলাম সেই দিনটা যে আজ চলে এসেছে সাদ। এই পেপারস গুলো দেখছো? তোমার সম্পত্তি আর টাকা-পয়সা যে এখন থেকে আমার নামে হয়ে গেছে সব প্রমাণ এখানে রয়েছে। মনে আছে আশা আর তোমার ডিভোর্সের পেপারসগুলোতে সাইন দিয়েছিলে? মানুষ তো একবার চেক করে দেখে কি লেখা আছে! ডিভোর্স পেপারে সাইন ঠিকই তুমি করেছো তার সাথে সব সম্পত্তি আর টাকা-পয়সা যে তুমি আমার নামে করে দিচ্ছো সেই সাইনটাও তুমি করে দিয়েছিলে এই পেপারে। সব প্রসেসিং করতে করতে এতোটা মাস লেগে গেল। আমাকে আবার লো*ভী ভেবো না! এই টাকা,সম্পত্তি কিছুই আমার জন্য ব্যয় করব না। সব চলে যাবে এ*তি*ম*খানাগুলোতে।কিভাবে তোমার এতদিনের স্থাপিত বিশ্বাসটাকে এক নিমিষেই ভে*ঙ্গে দিলাম তাইনা? আ*ফ*সো*স হচ্ছে? তোমার মতো পুরুষেরা কেন ছ*ল*না করার আগের ছ*ল*না*র প*রি*ণা*ম*টার কথা চিন্তা করেনা? আশালতার মতো সহজ-সরল মেয়েটাকে তুমি যেভাবে ঠ*কা*লে একটু বু*ক কাঁ*প*ল না তোমার? তোমার ওই বি*ষা*ক্ত মুখে কখনো আমার জন্য ভালোবাসা শব্দটা উচ্চারণ করো না সাদ। ঘৃ*ণা হয় আমার। প্রচুর ঘৃ*ণা হয়।

এতক্ষণে শাড়ির আচল দিয়ে দুইবাহু আ*ষ্টে*পৃ*ষ্টে জড়িয়ে রাখার বাধন হালকা করে এক বাহু হতে আচল ছি*ট*কি*য়ে সরিয়ে ফেলতেই সারা দুই হাতে আর কাধের ওপরে লাল লাল কা*টা কা*টা দা*গ*গুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিজের মুখে কয়েকটা থা*প্প*ড় নিজেই বসিয়ে দিয়ে চুল এলোমেলো করে নেয় লিনা। সাদ কাঁ*পা কাঁ*পা কন্ঠে বলে ওঠে,
-কি করতে চাইছো তুমি লিনা?
-শুধু চুপচাপ দেখা যাও জান। বলেই ছুটে চি*ৎ*কা*র দিতে দিতে ঘর হতে বেরিয়ে একদম বাসার বাইরে বেরিয়ে আসে লিনা। চি*ৎ*কা*র করে কান্না করে করে আশেপাশের মানুষ জড়ো করে ফেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই। এতক্ষণে সাজেদা বেগম ও ছবি এসে বাইরে দাড়াতেই তাদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়। কি করছে লিনা এটা? কিছুক্ষণের মধ্যে উপস্থিত সকলে তেঁ*তে ওঠে, বাড়ির বউকে এভাবে সকলে মা*র*ধো*র করে কিভাবে? তবে কি আগের বউটাকেও এইভাবেই অ*ত্যা*চা*র করে বিদায় করেছে এরা? সাদের পরিবারের মাথায় আকাশ ভে*ঙ্গে পড়ে যেন। কাউকেই তারা শত বুঝিয়েও কু*লি*য়ে উঠতে পারেনা যে লিনাকে তারা একদম কোনো অ*ত্যা*চা*র করেনি। উপস্থিত সকলে পুলিশ ডাকার হু*ম*কি দিতেই লিনা কান্নার ভা*ন করে সকলকে মানা করে দেয়। সকলের সাহায্যেই ব্যাগপত্র নিয়ে সাদদের বাসা হতে বেরিয়ে আসে লিনা। সাদ প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত চুপ করেই দেখে গেল সব। যেন এটাই তার প্রাপ্য ছিল। সাজেদা বেগম বেশ বুঝে ফেলেন, লিনা যে ইনডিরেক্টলি আশালতার কাহিনীটাই নিজের মাধ্যমে সকলের কাছে ফুটিয়ে তুলে গেল!
বড় ছেলেটা ঠিকভাবে যোগাযোগ করেনা আজ কয়েকমাস। ছোট ছেলেটা তো প*ঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে রয়েছে। শেষমেশ লিনা সব সম্পত্তি কৌশলে কে*ড়ে*তো নিলোই তার ওপর সারা এলাকাবাসীর নিকট তাদের রূপটা তুলে ধরে গেল। ঠিক মতো তিন বেলা খাবারও জো*টে*না কপালে। এখন আ*ফ*সো*স করতে করতেই কপাল চা*প*ড়া*ন সাজেদা বেগম। মনে মনে একটা কথাই শুধু বিড়বিড় করে উচ্চারণ করেন, “তবে কি এটাই ছিল তাদের প*রি*ণা*ম?”

চলবে…

#অপ্রিয়_আশালতা (অন্তিমের শেষ পাতা)
সকল মান-অভিমানের পালা চু*কি*য়ে আজ দু’দিন হয়েছে নিজের বাড়িতে ফিরেছে আশালতা। মায়ের অনেক কান্নাকাটি আর মারজানার অবস্থা বেগতিক শুনেই ফ্যাক্টরি থেকে ছুটি নিয়ে মা আর ছেলেকে নিয়ে ছুটে চলে আসে আশালতা। মারজানা কেঁদে কেঁদে নিজের অ*ন্যায়ের জন্য বারবার ক্ষমা চেয়েছে আশালতা আর হাফসা বেগমের নিকট। আশালতা ও হাফসা বেগম হাসি মুখে মারজানাকে কাছে টেনে নেয়। বাড়ি ভর্তি সকলের মনে একজন সদস্য হারানোর তীব্র ভ*য় ক্ষানিক বাদে বাদে হা*না দিয়ে ওঠে।
আশালতার ছোট ভাবি বর্তমানে ছয় মাসের গর্ভবতী। বাড়িতে কিছুক্ষণ বাদে বাদে হয় মারজানাকে নিয়ে শো*ক অথবা নিপাকে নিয়ে আনন্দ ঝলকানি দিয়ে ওঠে। আশালতা এখন স্বাবলম্বী। কেউ আর তাকে ক*টা*ক্ষ করে দুটো কথা বলার বিন্দুমাত্র সাহস করে ওঠেনা।

বিকালে উঠানে কো*টা দিয়ে পেয়ারা গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালটা হতে পা*কা ডা*সা পেয়ারা পাড়ার চেষ্টা করছিল আশালতা। আচমকা কারো ভেজা কন্ঠে “আশা” ডাকটা শুনে চমকে পেছনে ঘুরে তাকায় সে। মুহূর্তের মাঝে শরীরের মধ্যে কা*রে*ন্টে*র গতিতে শি*হ*র*ণ বয়ে যায়। শরীর যেন হঠাৎ করে অ*ব*শ হয়ে আসছে আশালতার।
আশালতার সামনেই হুইল চেয়ারে বসে আছে সাদ। আর তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সাজেদা বেগম ও ছবি। প্রত্যেকেরই চোখ হতে জল উপচে পড়ছে। আশালতা কাঁ*পা কন্ঠে বলে ওঠে,
-আপনারা এখানে?
ইতোমধ্যেই আশালতার বাড়ির প্রায় সকলেই উপস্থিত হয়ে গেছে।
-আমাদের ক্ষ*মা করে দাও আশা। আমাদের ছেলেকে নিয়ে আবার ফিরে চলো তুমি। (সাদ)
-হ্যা মা তুমি আমাদের সাথে ফিরে চলো তোমার ছেলেকে নিয়ে। (সাজেদা বেগম)
-এক মিনিট! কার ছেলে বললে তুমি সাদ? (আশালতা)
-আমাদের ছেলে! ওইযে তোমার মায়ের কোলে রয়েছে। (সাদ)
-ওখানেই থেমে যাও সাদ। একদম আমাদের বলবে না। ও আমার শুধুই আমার ছেলে। বা*জ*খা*ই কন্ঠে কথাগুলো বলে ওঠে আশালতা।
মাথা নিচু করে নেয় সাদ।চোখে অথৈ জলরাশির আনাগোনা স্পষ্ট।
-আমাকে ক্ষ*মা করে দাও তুমি আশা। আমি নিজের ভু*ল বুঝতে পেরেছি। খুব ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছি। শিক্ষা পেয়েছি আমি আশা। আমি জানি তুমি আর ফিরবেনা। আমি ছেলেকে কখনো তোমার থেকে কে*ড়ে নিতেও চাইবো না। ওর ভরণপষ*ণ বহন করার মতো সামর্থ্যও আমার নেই। সাদ আজ নিঃ*স্ব। পা*প যে বাপকেও ছাড়েনা আশা। হারে হারে টের পেয়েছি আমি তা। আমার একার কথা বলব না। পুরো পরিবার ধরেই পেয়েছি বলতে পারো। শরীরের য*ন্ত্র*ণা আর মনের য*ন্ত্র*ণা দুটো এক হয়ে আমাকে এখন তিঁলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে আশা। নিজেকে আজ পা*গ*ল পা*গ*ল মনে হয়। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও। আমি অনেক ক*ষ্ট দিয়েছি তোমাকে। অনেক অ*ন্যায় করেছি আমি। যার আসলেই ক্ষমা হয় না। (সাদ)
-হ্যা আশা তুমি আমাদের ক্ষমা করে দাও। আমি অনেক অ*ন্যায় করেছি। একজন মা হয়ে আমার ওমন অ*ন্যায় করা আসলেই উচিত হয়নি। কোনো মায়ের কাছেই তার সন্তানের য*ন্ত্র*ণা ,ক*ষ্ট সহ্য হয়না। গলার মাঝে কা*টা*র মতো বি*ধে থাকার মতো অনুভূতি হয়। আমার সন্তানদের এত ক*ষ্ট দেখে আজ আমি উপলব্ধি করতে পারছি তুমি ঠিক কতোটা ক*ষ্ট পেয়েছো। আমি তোমার কত বড় ক্ষ*তি করেছি তার প*রি*ণা*ম আমি পদে পদে ভোগ করছি। আমাদের তুমি ক্ষমা করে দাও। তুমি ক্ষমা না করলে হয়ত ম*রেও শান্তি পাব না আমি। (সাজেদা বেগম)
তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে আশালতা বলে ওঠে,
-আশালতা মনে রা*গ,ক্ষো*ভ, ক*ষ্ট কিছুই পুষে রাখেনা। আমি আপনাদের অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। আমার জন্য আর আমার সন্তানের জন্য দোয়া করবেন।
সাদ আর তার মা বোন করুণ দৃষ্টিতে আশালতার দিকে তাকিয়ে থাকে। মনের মাঝে তাদের গত কয়েকমাস হতে যে আফসোস আর অনুতপ্ততার ঝ*ড় বয়ে চলেছে তা হয়তো সারাজীবনে আর থামবার নয়। এই আফসোস,অনুতপ্ততা এবং অ*ন্যায়ের প*রি*ণা*মে*র বো*ঝা হয়তো বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে আজীবন ভর। তাদের কানের মাঝে আজীবন একটা বাক্যই ঝনঝন করে বাজতে থাকবে, “পা*প বাপকেও ছাড়েনা।“

আশালতা বুঝে গেছে লিনা তাকে যা বলেছিল গতবছর তা আসলেই সে ঘটিয়ে গেছে। আশালতা পেছন ঘুরে উঠান হতে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে করতে বলতে আরম্ভ করে,
-আশালতার প্রতি বহু মানুষের বহু ক্ষো*ভ থাকলেও আশালতা কারো প্রতি কোনো ক্ষো**ভ পু*ষে রাখেনা। আমি এই আশালতা একদিন তোমাদের সামনে সমাজের সকল অসহায় মেয়েগুলোকে বি*দ্রো*হী তৈরি করে দাড় করিয়ে দেব। তাদের প্রাপ্য সম্মান,স্বাধীনতা দিতে তোমরা বা*ধ্য হবে। একে একে সকল নারী তাদের সাথে হওয়া অ*ন্যায়,তাদেরকে প্রতিনিয়ত করা অ*ত্যা*চা*রের বি*রু*দ্ধে রু*খে দাঁড়াবে। হ্যা তোমাদেরকেই বলছি হে সমাজের নি*ষ্ঠু*র মানুষগুলো। হ্যা আমিই বলছি, তোমাদের অপ্রিয় আশালতা!
বইয়ের শেষ পাতাটির শেষ লাইন পড়া শেষ করে বইটা ব*ন্ধ করে নেয় আদিব। কিছু মুহূর্তের জন্য চোখ বুঝে নেয় সে।
আদিবের লেখা “অপ্রিয় আশালতা” বইটি প্রকাশিত হয়েছে একমাস হলো। এর মাঝেই সকল সাধারণ মানুষের মনে দা*গ কে*টে গেছে বইয়ের প্রধান চরিত্র “আশালতা।“ সাধারণত লাইব্রেরিতে একটা শুনশান পরিবেশ বজায় থাকলেও আজ সকলে নিয়ম ভ*ঙ্গ করে প্রতিদিনের ন্যায় লাইব্রেরির এককোণের টেবিল চেয়ারে বসে থাকা শা*ন্ত*শি*ষ্ট ছেলেটাকে ধরে বে*ধে নিয়ে গোল হয়ে বসেছে। বায়না ধরেছে তারা, আদিবের আজ সকলকে বইটা পড়ে শোনাতেই হবে। সকলের বায়না মোতাবেক একটু আগে পড়েও শোনালো আদিব।
হঠাৎ কারো প্রশ্নে পুনরায় চোখ খুলে তাকায় আদিব।
-আচ্ছা লেখক সাহেব, ইনি কি আমাদের ঢাকার সেই নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার ও সমাজ সেবিকা মিস আশালতা?
পাঠকের প্রশ্নে মুচকি হেসে জবাব দেয় আদিব,”জ্বী। “
আরেকজন প্রশ্ন করে ওঠে, “আশালতা কি তার লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছিলেন?”
-হ্যা অবশ্যই পেরেছিলেন। যদি না পেরেই থাকেন তবে কেন তার পরিচয় সম্বন্ধে সঠিকভাবে অবগত হবার জন্য তার নামের আগে “নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার ও সমাজ সেবিকা” উচ্চারণ করেছিলেন?
উপস্থিত পাঠক/পাঠিকার মাঝে এক উ*ৎ*ফু*ল্ল*তা ছড়িয়ে পড়ে।

-আচ্ছা আপনি কিভাবে মিস আশালতার সম্পর্কের এতো কিছু জানলেন? তিনি কি আপনার কিছু হন? “
বড় একটা শ্বাস টেনে নিয়ে পুনরায় চোখ বন্ধ করে নেয় আদিব। পরক্ষণেই ঝটপট চোখ খুলে নিয়ে হাসি মুখে বলে ওঠে, “সকলের সেই অপ্রিয় আশালতাই আমার মা।“
উপস্থিত সকলের মন টা*ন*টা*ন উ*ত্তে*জ*না*য় ছেয়ে যায়। সকলের দিকে তাকিয়ে আদিব এক প্রশস্ত হাসি টানে ঠোঁটে। আড়চোখে লাইব্রেরির সদর দরজার দিকে তাকাতেই অতি প্রিয় দুজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠোঁটের কোণের হাসি আরও প্রশস্ত হয়ে যায় সতের বছরের যুবকের। চেয়ার হতে উঠে সদর দরজার দিকে এগোতে নিলেই সকলে এক সাথে আদিবের দিকে একটা প্রশ্নই ছু*ড়ে মারে, “লেখক সাহেব আসল কথা না জানিয়ে কোথায় ছুটছেন? বাস্তবেও কি মিঃ কাব্য আছেন? আশালতার সাথে কি কাব্যের মিল বাস্তবেও ঘটেছে? নাকি কাব্যের অস্তিত্ব শুধু গল্প পর্যন্তই সীমাবদ্ধ?”

আদিব চলার গতি থামিয়ে দিয়ে লাইব্রেরিতে উপস্থিত সকলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
-তা নাহয় আপনারা এই মুহূর্তে বাস্তবে স্বচক্ষেই দেখে নিন!
আদিব পুনরায় চলতে আরম্ভ করে। ধীর পায়ে হেটে সদর দরজার সামনে উপস্থিত আশালতা আর কাব্যের দিকে এগিয়ে যায়। উৎসুক পাঠক ও পাঠিকারা বি*স্ফো*রি*ত নয়নে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। কাব্য গলা খা*কা*রি দিয়ে বলে ওঠে,
-বাস্তবেও সকলের অপ্রিয় আশালতা কাব্যের সবচেয়ে প্রিয়। কাব্য অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে তার মায়াবতীকেই পেয়েছিল। হ্যা বাস্তবেও মিল ঘটেছে আপনাদের কাব্য ও আশালতার।

আশালতা কাব্যের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ওঠে। সকলে সেই থেকেই নির্নিমেশ এই তিনজন মানুষের দিকেই তাকিয়ে আছে। সবার চোখের সামনে এক দুঃ*খি*নী মেয়ের ল*ড়া*ই ও সং*গ্রা*ম করে সমাজের বু*কে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কাহিনী খানাই ভাসছে। ভাসছে অতি সাধারণ এক মেয়েকে উ*ন্মা*দের মতো ভালোবাসা কাব্যের প্রতিচ্ছবি। ভাসছে আশালতাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠে দাঁড়ানো সকল নারীর বি*দ্রো*হী ও সং*গ্রা*মী প্রতিচ্ছবি।
ধীর পায়ে আশালতা,কাব্য ও আদিব লাইব্রেবির সীমানা হতে বেরিয়ে আসে। তাদের গন্তব্য এখন কিছু হাত দূরে অবস্থিত আইসক্রিমের স্টলটা। ছেলের বায়না রাখতেই যে সব দরকারি কাজ ফেলে আশালতা ও কাব্যের এখানে ছুটে আসা! আশালতা সারাটা পথ ছেলের হাতের বইটার মলাটের দিকেই তাকিয়ে থাকে। সেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা বইয়ের নামটাই তার চোখকে বারবার আকর্ষণ করছে। আশালতা বিড়বিড় করে নামটা পড়ে ওঠে, “অপ্রিয় আশালতা।“

~সমাপ্ত
আফিয়া অন্ত্রীশা

[ভু*ল-ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। ]