#অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো
#পর্ব-৭
বিন্তীদের বাড়িতে যাওয়ার আগে শিশির ভেবেছিল ওর দিনগুলো বোরিং কাটবে। একটা কিছু ছুতোয় ঢাকা চলে আসবে একদিন থেকেই। কিন্তু ওখানে এতো ভালো লাগলো! দুদিন হয়ে যাবার পর বিন্তী শিশির কে বলল,
“চাচী ফোন করেছিল। জানতে চেয়েছে আমরা কবে ফিরব। ”
শিশির কপাল কুচকে বলল,
“কী আশ্চর্য! একটা জায়গায় আসতে না আসতেই যাবার প্রশ্ন আসছে কেন! মা’য়ের আক্কেল টা কী। ”
বিন্তী ঠোঁট টিপে হাসলো। বলল,
“তাহলে চাচীকে কী বলে দেব?”
“বলো যে এখানে পার্মানেন্টলি থাকতে আসি নি। ফিরব। ”
বিন্তী নিঃশব্দে হেসে বলল, আচ্ছা।
বিন্তীদের বাড়ির সবাই যেন একটু বেশীই ভালো। বিন্তীর বাবাকে শিশির আগে থেকেই চিনে। মা, ভাই, বোন তাদের সঙ্গে আলাপ হবার পর শিশির মনে মনে বলল,
বিন্তী কিছুতেই এদের মেয়ে না। কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে। এরা ভালোমানুষ বলে মেয়ে পরিচয় দিয়ে বড় করেছে।
বিন্তীর মা অসুস্থ থাকলেও নিজের হাতে শিশিরের জন্য রান্না করছেন। নতুন নতুন পিঠে বানিয়ে খাওয়াচ্ছেন। পুকুর থেকে বড় মাছ ধরা হচ্ছে শিশিরের নাম করে। এতটা আদর যত্ন শিশির আজ পর্যন্ত কোথাও পায় নি। শিশিরের আত্মীয় স্বজন সংখ্যায় কম না। নানুর বাড়ির আত্মীয় স্বজন রা নানী মারা যাবার পর পর ই দূরের হয়ে গেছে। এখন শুধু গ্রামে একটা বাড়িই পড়ে আছে। সেখানে থাকার লোক নেই। আর বাবার ভাই, বোন যারা আছে তারা ঢাকায় থাকে ঠিকই কিন্তু দেখা হয় কালেভদ্রে।
এতো ভালোবাসা বহুদিন পর পেল। আর পেয়ে দু’হাতে মুঠো ভরে নিতে থাকলো।
খাওয়া দাওয়া ছাড়াও এখানে এসে ঘুরেফিরে দারুণ সময় কাটছে। ইমনের সঙ্গে হাটে, বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নৌকা করে নদীর ওপার যাচ্ছে। বঁড়শিতে মাছ ধরছে। শহুরে জীবনের খোলস থেকে বেরিয়ে মাটির কাছাকাছি এসে খুব উপভোগ করছে।
***
বাড়িতে আসার দুদিনের মধ্যে বিন্তী আর শিশিরের একবারও ঝগড়া হয় নি। প্রথম দিন রাতে ঘুমাতে যাবার সময় বিন্তী শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি খাটে ঘুমাও। ”
“আর তুমি?”
“আমি মেঝেতে বিছানা পেতে ঘুমাব। যদিও অভ্যাস নেই। কিন্তু আমাদের বাড়িতে এক্সট্রা ঘর নেই। ঐশির সঙ্গে ঘুমাতে গেলে মা আবার ত্যাড়া চোখে তাকাবে। ”
“তোমার কী রাতে লাফালাফি করার স্বভাব আছে?”
“মানে?”
“মানে হাত, পা ছোড়াছুড়ি করার স্বভাব না থাকলে খাটের ওই প্রান্তে ঘুমাও। ”
বিন্তী ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলো, সিরিয়াসলি? বাড়িতে তো এক ঘরে থাকবে না বলে দক্ষযজ্ঞ বাধালে।
“আরে এক খাটে ঘুমানো নিয়ে সমস্যা নেই। আমার তো তোমার রুমে থাকা নিয়ে সমস্যা। কারন আমার প্রাইভেসি লাগে। ”
“এতো প্রাইভেসি কেন লাগে?”
“এই তুমি এতো প্রশ্ন করছ কেন?”
বিন্তী আর কথা বাড়ালো না। বিছানা ঠিক করে মাঝখানে দূরত্ব রেখে শুয়ে পড়লো। শিশির লাইট অফ করে বালিশ ঠিকঠাক করে শুয়ে পড়লো। কিছু সময় চুপ থেকে বলল,
“বিন্তী ঘুমিয়েছ?”
“না। ”
“তোমার বাড়ির লোক খুব ভালো। তোমার মতো না। তুমি এরকম বদমায়েশ কিভাবে হলে?”
বিন্তী নিঃশব্দে হাসলো। বলল,
“কী জানি। ”
শিশির আর কথা বাড়ালো না। বিন্তী জিজ্ঞেস করলো,
“শিশির তোমার গার্লফ্রেন্ড আছে?”
“ছিলো। ঠিক ছিলো না, ছিলো আর আছের মাঝামাঝি। ”
“বুঝলাম না। ”
“মানে আমাদের মাসে দশবার করে ব্রেক আপ হয়। তাই বুঝতে পারছি না যে আছে বলব নাকি ছিলো বলব। ”
বিন্তী হেসে ফেলল। বলল,
“তাহলে আমাকে বিয়ে করলে কেন? আর তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না যে খুব একটা কষ্টে আছ। ”
“কষ্টে কেন থাকব। আরে সিরিয়াস কিছু না। না পেলে মরে যাব এই টাইপ প্রেম না। তবে পেলে মরে যেতাম এটা শিওর। ”
“তাহলে এটা আবার কেমন প্রেম। ”
“প্রেম কী না সেটাও জানিনা। সবার গার্লফ্রেন্ড আছে। আমার না থাকলে বন্ধুদের আড্ডায় প্রাস্টিজ থাকবে না তাই নামের গার্লফ্রেন্ড। ”
বিন্তী অবাক গলায় বলল,
“নামের গার্লফ্রেন্ড?”
“হ্যাঁ। সোশ্যাল মিডিয়ায় কাপল ছবি আপলোড করার জন্যও তো একজন কে দরকার। ”
বিন্তী শব্দ করে হেসে ফেলল। শিশিরও হাসলো। হাসি থামিয়ে শিশির বলল,
“এখন মনে হচ্ছে যে তুমি আঙ্কেল, আন্টির মেয়ে। ”
বিন্তীর হাসি থামছে না। থেমে থেমে হেসে উঠছে। শিশিরের ভালো লাগছে। বিন্তীকে এখন আর শত্রুপক্ষও মনে হচ্ছে না। কথা বলেও আরাম লাগছে। শিশির জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার প্রেম তো সিরিয়াস ছিলো তাই না?”
প্রশ্নটা করে শিশির জিব কাটলো। সেনসিটিভ টপিকে কথা বলা একদম উচিত হয় নি। বিন্তী বলল,
“তোমার প্রেমের গল্প শুনে মনে হচ্ছে আমারটাও সিরিয়াস ছিলো না। ”
বলে বিন্তী আবারও হাসতে শুরু করলো। শিশিরও হাসলো।
ওই রাতে দুজনে অনেকক্ষন গল্প করে কাটালো। সকালবেলা খেয়েদেয়ে শিশির বেরিয়ে পড়লো ঘুরতে আর বিন্তী মা বোন কে সাহায্য করছিল। বিন্তীর মা মেয়েকে নিয়ে ভয়ে ছিলেন। এরকম একটা বিয়েতে মেয়ে মানিয়ে নিতে পারবে কী না এই নিয়ে দ্বিধার শেষ ছিলো না। কিন্তু শিশির কে দেখে নির্ভার হলেন। ছেলেটা একদম মাটির মানুষ। যেভাবে সবার সঙ্গে মিশছে।
পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হলো একটা রাত কেটে যাবার পর। হেমন্তের মাঝামাঝি সময়ে রাতে বেশ ভালো শীত পড়ে। তাই পাখা চালানো দরকার হয় না। ঐশির ঘর থেকে বিন্তীর স্পষ্ট হাসির আওয়াজ নিজ কানে শুনে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছে।
***
চার দিনেও যখন শিশির রা ফিরছে না তখন তুষার এলো। এসে দেখলো শিশির এখানে বেশ আনন্দেই আছে। তুষার কে পেয়ে শিশিরের আনন্দ আরও দ্বিগুন হলো। দুই ভাই মিলে পুকুরে একদিন মাছ ধরতেও নেমেছিল।
আশেপাশের আত্মীয় স্বজন, প্রতিবেশীদের আদর, আপ্যায়ন সবকিছুই হাসিমুখে গ্রহন করলো শিশির। যারা বিন্তীর ভবিষ্যৎ ভেবে চিন্তায় মরে যাচ্ছিলো তারাও শিশির কে দেখে ভারী অবাক হলো।
দুদিনের বেড়ানো দশদিনে গিয়ে ঠেকলো। শেষমেস শিরিনের ধাক্কাধাক্কিতে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিলো। শিশির সবাইকে কথা দিলো যে ডিসেম্বরের শেষের দিকে ও আবারও আসবে পিকনিক করতে। বিন্তী না এলেও ও আসবে।
আসার আগে বিন্তীর মা শিশিরের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“বিন্তীকে দেখো রেখ।”
শিশির অপ্রস্তুত হয়ে গেল। একটু হাসার চেষ্টা করলো। শিশিরের চুপসে যাওয়া মুখ টা বিন্তীর চোখ এড়ালো না। আসার সময় বিন্তী কানে কানে বলল,
“আমি নিজের খেয়াল নিজে রাখতে পারি। সব মায়েরাই নিজের মেয়ে জামাইদের এই কথা বলে। রিলাক্স হও। ”
শিশির বিন্তীর দিকে গভীর চোখে তাকালো। ওর মনে তখন অন্য ভাবনা। না বিন্তী সেটা বুঝবে না।
***
ঢাকায় ফেরার পরের দিন শিশির বিন্তীর ঘরে গেল। বিন্তী বলল,
“কিছু বলবে?”
“থ্যাংকস। ”
“কেন?”
“আমাকে জোর করে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবার জন্য। ”
“আমি জোর করে নিয়ে গেলাম কই। তুমি না গেলে তো আর ধরে বেঁধে নিয়ে যেতে পারতাম না। ”
শিশির ইতস্তত করে বলল,
“তুমি আমার ঘরে থাকতে পারো। ”
বিন্তী ভারী বিস্মিত হলো। বলল,
“শরীর ঠিক আছে?”
শিশির অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বলল,
“না এই কয়দিন থেকে মনে হলো যে তুমি অতোটাও ডিস্টার্বিং না। ”
বিন্তী হেসে বলল, ওহ। আমি ভাবলাম আমাদের বাড়িতে গিয়ে ভালো লেগেছে বলে খুশি হয়ে গিফট দিচ্ছো।
শিশির মাথা চুলকে বলল,
“না গিফট এনেছি। ”
বিন্তী আবারও অবাক হলো। বলল,
“তুমি আমার সঙ্গে এত ভালো করে কথা বলছ কেন শিশির?”
“আগে বলো গিফট দেব কী না?”
“হ্যাঁ দাও। ”
শিশির বেরিয়ে গেল। মিনিট খানেকের মধ্যে একটা ডায়েরি এনে বিন্তীকে দিলো। বিন্তী উল্টেপাল্টে দেখলো। শিশির বলল,
“ভালো স্টুডেন্টরা নিয়মিত ডায়েরি লিখে। তোমারও নিশ্চয়ই অভ্যাস আছে। ”
বিন্তী মাথা নেড়ে বলল, থ্যাংক ইউ । খুব ভালো হয়েছে। আমি নিয়মিত লিখব।
শিশির চলে যাবার পর বিন্তী ডায়েরি টা খুলল। ওর ডায়েরিতে লেখার অভ্যাস নেই। কখনো ভালোও লাগে নি। আজ ই প্রথম লিখবে। কলম টা হাতে নিয়ে বিন্তী লিখলো,
“শিশির আমি দিনলিপি লিখতে পছন্দ করি না। তবে তোমার ডায়েরি তে তো একটা কিছু লিখতেই হয়। কী লেখা যায় বলো তো! তোমার আমার গল্প? হ্যাঁ সেটা লেখা যায়। ”
বিন্তী হেডিং এ বড় অক্ষরে লিখলো,
‘অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো ‘
চলবে….