অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো পর্ব-০১

0
860

#অপ্রেমের গল্পটা যেভাবে শুরু হয়েছিলো
#পর্ব-১

বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে বিয়ে হয়ে যাবার ঘটনা অনেক আছে কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে না গিয়েও বিয়ের ঘটনা বিরল। সেরকমই এক বিরল ঘটনা ঘটলো শিশিরের সঙ্গে। শুরু থেকে বলি। শিশির সেদিন বন্ধুদের সঙ্গে জম্পেশ পার্টি করে বাড়ি ফিরলো। ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় বারোটা। ঘরে ফিরেই দেখলো ওর ছোট ভাই তুষার সারা ঘরে পায়চারি করছে। শিশিরকে দেখেই তুষার ব্যস্ত গলায় বলল,

“বাবা ফোন করেছিল। এক্ষুনি যেতে হবে।”

শিশির হাই তুলে বলল, সাবধানে যাস।

“আমাকে না। আমাদের। মানে তুই ও যাবি।”

“আমি গিয়ে কী করব?”

“সে আমি কী জানি! বাবা তোকে নিয়েই যেতে বলেছে।”

শিশির অতোটা পাত্তা দিলো না। বলল,

“বাবাকে বলে দে যে আমার পেট খারাপ। খুব খারাপভাবে ডিসেন্ট্রি হয়েছে।”

তুষার কোনো কথা বলল না। বাবাকে ফোন করে বলল,

“হ্যালো বাবা, শিশিরের নাকি খুব খারাপ ভাবে ডিসেন্ট্রি হয়েছে।

শিশির লাফ দিয়ে উঠে বসলো। তুষার ফোন টা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“নে বাবার সঙ্গে কথা বল। ”

শিশির কটমট চোখে তুষারের দিকে তাকালো। ফোন কানে নিয়ে মিনমিনে গলায় বলল,

“হ্যালো বাবা?”

ফোনের ওপাশ থেকে বাবা গম্ভীর গলায় বলল,

“তোমার কী হয়েছে?”

শিশির আমতা আমতা করে বলল,

“না মানে… ওই কিছু না।”

“যাই হয়ে যাক না কেন, কাল সকালের মধ্যে এখানে যেন তোমাকে পাওয়া যায়।”

“আর্জেন্ট কিছু? ”

বাবা আগের মতোই গম্ভীর গলায় বলল,

“কেন তুমি কী খুব ব্যস্ত নাকি?”

“না না। ”

“তাহলে এরপর যা কথা বলব সেটা সাক্ষাতে বলব। আমাকে কী আরও ফোন করতে হবে?”

“না।”

শিশির ফোন টা কেটে তুষার কে জিজ্ঞেস করলো,

“ঘটনা কী?”

“আমি জানিনা। আমাকে যা বলা হয়েছে তাই করছি।”

“মা’কে একটা ফোন করে তো দেখতে পারিস?”

“করে লাভ নেই। মা’ও কিছু বলবে না।”

শিশির একরাশ বিরক্তি নিয়ে রেডি হতে গেল। রেডি হতে সময় নিলো পয়তাল্লিশ মিনিট। তুষার রেগে বলল,

“আজও তোর এতো সময় নিয়ে রেডি হতে হলো?”

শিশির জবাব দিলো না। ফ্রিজ থেকে কোল্ড ড্রিংকস এর বোতল বের করে বলল,

“এই যে বাপের চামচা বেশী ভ্যাজর ভ্যাজর করিস না। এরপর লেট হলে কিন্তু আমি কিছু জানিনা। ”

তুষার আর কথা বাড়ালো না। গাড়িতে উঠে বসলো। ওদের নিজেদের গাড়িটা বাবা, মা নিয়ে গেছে। এই গাড়িটা ভাড়ার গাড়ি। বাবাই ম্যানেজ করে দিয়েছে। বাবা, মা গেছে ওদের এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের বিয়েতে। আত্মীয় বললে ভুল হবে, বাবার ব্যবসা দেখাশুনা করেন শফিকুল নামের এক ভদ্রলোক। শফিকুল চাচার বড় মেয়ের বিয়েতে গেছেন। ওদের দুজনের যাবার কথা থাকলেও শেষ মুহুর্তে দুজনের কেউই আর যেতে পারলো না।

এখন এভাবে তাড়া দিয়ে নেবার ব্যাপার টা দুজনের কেউই অতোটা সিরিয়াসলি নিলো না। দুজনের কেউই বুঝতে পারলো না যে ওখানে ওরা গেলে ঠিক কী অঘটন ঘটতে পারে।

দীর্ঘ ছয়ঘন্টা জার্নির পর ওরা গন্তব্যে পৌঁছল। গ্রামের নাম দূর্গাপুর। দূর্গাপুর বাজারে শিশির দের গাড়িটা থামলো। বাবা এখানে এসে গাড়ি থামাতে বলেছে। তুষার ফোন করে জানালো যে ওরা পৌঁছে গেছে। মিনিট তিনেক পর অল্প বয়সী এক ছেলে এসে বলল,

“আপনারা কী শিশির আর তুষার ভাইয়া?”

শিশির গাড়ির ভেতর বসা ছিলো। নিজের নাম শুনে ছেলেটার দিকে তাকালো। ছেলেটা বেশী বড় না। কলেজে পড়ে বোধহয়। তুষার গাড়ির বাইরেই ছিলো। ও বলল,

“হ্যাঁ। বাবা পাঠিয়েছেন?”

“জি। আসলে আমাদের বাড়িটা একটু ভেতরে তো তাই চিনতে আপনাদের অসুবিধা হবে বলে পাঠিয়েছেন।”

“আচ্ছা। ”

ছেলেটা ড্রাইভারের পাশে বসলো। তুষার বলল,

“তোমার নাম টা কী? ”

“আমার নাম ইমন। আমি বিন্তী আপুর ছোট ভাই। ”

বিন্তী কে তুষার বা শিশির কেউই চিনেনা। শিশির যদিও ছেলেটার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছে না। ওর সকল মনোযোগ এখন মোবাইলের স্ক্রিনে। গতকাল ঝুম্পা একটা রিলস ভিডিও আপলোড করেছে। সেটায় লাইক কমেন্টের বন্যা বয়ে গেছে। সেটা দেখতেই ব্যস্ত। ঝুম্পার সঙ্গে ওর তেত্রিশ নম্বর ব্রেকাপ হয়েছে পরশু দিন। এখনো ও ঝুম্পার ব্লকলিস্টে আছে।

মিনিট দশেকের মধ্যে বাড়িতে পৌছে গেল। এই বাড়ির বড় মেয়ের আজ বিয়ে। বাড়িটাকে ভালো করে সাজানো হলেও মনে হলো বাড়িটা কেমন মরা মরা। যেন খুব খারাপ কিছু ঘটে গেছে। বিয়েবাড়িতে গান, বাজনা কিছু নেই। উঠোনের এক পাশে বাবুর্চিরা রান্নার ঝামেলা সামলাচ্ছে কিন্তু তাদের মধ্যেও কোনো তাড়া নেই।

ওরা বাড়ির সামনে এসেই দেখতে পেল বাবা, মা দুজনে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের মুখটা কালো হয়ে আছে। বাবার উপর যখন রেগে যায় তখন এই অবস্থা হয়। তুষার এসে মা’কে জিজ্ঞেস করলো,

“কী হয়েছে মা?”

মা গম্ভীর গলায় বললেন,

“এসেছো যখন তখন শুনবে। ”

শিশির বুঝতে পারলো না যে ঘটনা টা কী। বাবা এসে ও’কে বললেন,

“আগে আমার সঙ্গে চলো। ”

শিশির বিনাবাক্যব্যয়ে বাবাকে অনুসরণ করলো।

শিশির কে নিয়ে যাওয়া হলো এক ভদ্রমহিলার কাছে। ভদ্রমহিলা বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় ছিলেন। শিশির আর বাবাকে ঢুকতে দেখে উঠে বসার চেষ্টা করলেন। তার পাশে এক মেয়ে আর শফিকুল চাচা বসে আছে। শফিকুল চাচা উঠে দাঁড়ালেন। বাবা ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন,

“আমার বড় ছেলে শিশির। বিন্তীর সঙ্গে এর বিয়ে দিতে তোমাদের আপত্তি নেই তো?”

শিশির বজ্রাহত হলো। এসব কী শুনছে! ওর বিয়ে আর ও সেটা জানেই না। শিশির বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ভদ্রমহিলা কাঁদতে শুরু করেছে। শিশির তখনও দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো। পা দুটো মনে হচ্ছে জমে গেছে। শফিকুল বললেন,

“বাবারা অনেক পথ জার্নি করে আসছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিক। ”

শিশির কে যে ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো সেই ঘরে তুষার আর ওর মা আছে। শিশির আর্তচিৎকার করে বলে উঠলো,

“মা এসব কী হচ্ছে?”

“যা শুনেছো তাই। তোমাকে ওই মেয়েটাকে বিয়ে করতে হবে। ”

“কেন মা? আমি ওই মেয়েটাকে চিনিই তো না।”

শিশিরের মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“মেয়েটার বিয়ে হবার কথা ছিলো আজ। কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটায় মেয়েটার বিয়ে ভেঙে যায়। তাই তোমার বাবা চাইছেন তুমি বিয়ে করো। ”

শিশির হতভম্ব হয়ে গেল। এখানে এসে এরকম পরিস্থিতিতে পড়তে হবে জানলে ও জীবনেও আসতো না। শিশির মা’কে বোঝানোর চেষ্টা করে বলল,

“মা শোনো, এভাবে বিয়ে হয় না। যুগ পাল্টে গেছে। এখন আর সেই আগের যুগের মতো বিয়ে হয় না। বিয়ের আগে দুজন দুজন কে জানতে, চিনতে হয়। ”

শিশিরের মা গম্ভীর গলায় বললেন,

“এই কথাগুলো তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলো। তবে একটা কথা হলো বিন্তী মেয়েটা সবদিক থেকে তোমার চেয়ে ভালো। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো সাবজেক্টে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। অন্যান্য গুন তো বাদ দিলাম। শুধু যা একটু কম সেটা হলো ওর বাবার অতো টাকা নেই, যেটা তোমার বাবার আছে বলে তোমরা গোল্লায় গেছো। ”

তুষার এতক্ষন চুপচাপ ছিলো। এবার মাথা নিচু করে ফেলল।

***
কিছুক্ষন পর শিশিরের বাবা এসে শিশির কে জিজ্ঞেস করলেন,

“তোমার কী কোনো কমিটমেন্ট আছে? কোনো প্রেমিকা আছে?”

শিশির না বলল। ঝুম্পার সঙ্গে সম্পর্কের কথা বলে লাভ নেই। ঝুম্পাকে বিয়ে করলে বাবা ও’কে গুলি করে মারবে প্রথমে। তারপর ঝুম্পাকে এবং সবশেষে ঝুম্পার মা, বাবাকে। তাছাড়া ঝুম্পাও বিয়েশাদির নাম শুনতে পারে না তাই ও এই ব্যপারে সিরিয়াস না।

বাবা বললেন,

“তাহলে বিন্তীকে বিয়ে করতে আপত্তি কেন?”

শিশির আমতা আমতা করে বলল,

“বাবা আসলে এভাবে বিয়ে হয় না…

“তোমার মায়ের সঙ্গেও আমার এভাবে বিয়ে হয়েছিলো। ”

শিশির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মান্ধাতার আমলের সঙ্গে এখনকার যুগের তুলনা কী করে দিচ্ছে বাবা!

“বিন্তীর মতো মেয়ে তোমার বউ হবার কথা না। কিন্তু মেয়েটার কপাল খারাপ বলে হচ্ছে। যাইহোক তোমার আপত্তি থাকলে বলো। আমি মেনে নেব। সেক্ষেত্রে তোমার হাতে একটাই অপশন থাকবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে হবে। কারণ ইন্টারমিডিয়েট এর ওই সার্টিফিকেট দিয়ে তোমাকে কেউ চাকরি দিবে না। ”

শিশির এক সেকেন্ডেও দেরী না করে বলল,

“না না আমি ওই বিন্তীকেই বিয়ে করব। ”

“গুড। ”

বাবা চলে যাবার পর মা এসে বললেন,

“বিন্তীর সঙ্গে আলাদা করে কথা বলবি?”

“না। একবারে বাসর রাতেই কথা বলব। ঘোমটা খুলে তখন বিনী না ফিনীর থোবরা খানা দেখব। ”

শিশিরের মা চোখ পাকিয়ে বলল,

“অসভ্য! আর মেয়েটার নাম বিন্তী। ”

***
শিশির খেয়েদেয়ে বিছানায় একটু গড়িয়ে নিলো। ঝুম্পাকে একবার কল দেবার চেষ্টা করলো। না ব্লকলিস্টে আছে। অন্য আর কোনো চেষ্টা করলো না। সব শুনে ঝুম্পা যদি ও’কে বিয়ে করার জন্য লাফিয়ে ওঠে! তখন আরেক বিপদ। ঝুম্পার মতো মেয়েকে বিয়ে করার চেয়ে বুড়িগঙ্গায় ঝাপিয়ে পড়ে কালো পানি খেতে খেতে মরে যাওয়া ভালো। তারচেয়ে ওই বিনীই ভালো।

তুষার ছুটতে ছুটতে এসে বলল,

“শিশির ভাবীকে দেখে এলাম। চোখ টা আরেকটুর জন্য ঝলসে যায় নি। ”

শিশির হাই তুলতে তুলতে বলল,

“বাহ! ভালো তো। বিয়েটা তুই করে নিলেই তো পারিস। ”

“যাহ! আমার বড় হবে। ”

শিশিরের আড়াই বছরের ছোট তুষার। ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক সাপে নেউলে।

শিশির বলল,

“এইজ ডাজেন্ট ম্যাটার ব্রো। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া কে দেখেও শিখলি না। ”

“সিরিয়াসলি মেয়েটা সুন্দর। ”

“মেকাপের যুগে সবাই ই সুন্দর। ”

“তোকে বলে লাভ নেই। তবে মেয়েটার কপাল টা আসলেই খারাপ। ”

“হু। ”

“বিয়ে ভেঙে গেছে বলে বলছি না। তোর সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে বলে বলছি। ”

***
শিশিরের মা জোর করে দুজনের দেখা করার ব্যবস্থা করলো। শিশির বিন্তীর ঘরে ঢুকে দেখলো একটা হলুদ কাপড় পরে খাটের উপর বিন্তী বসে আছে। শিশিরের ঘরে ঢোকার আওয়াজ পেয়েও তাকালো না। মাথানিচু করে থাকায় শিশির মুখ টা দেখতে পেল না ভালো করে। শুকনো কাশি দিয়ে শিশির বলল,

“হাই বিনী। কেমন আছ?”

বিন্তী চোখ তুলে তাকালো। চোখের দৃষ্টি কঠিন। শিশির বিশ সেকেন্ড তাকিয়ে দেখলো।

বিন্তী বলল,

“আমার নাম বিন্তী।”

শিশির হেসে ফেলল। বাবা, মা, ভাইয়ের ভাষ্যমতে এই মেয়েটা অসম্ভব ভালো মেয়ে। অথচ নাম টা একটু ছোট করে ডাকায় চোখ দিয়ে রীতিমতো আগুন জ্বালিয়ে সবকিছু ভষ্ম করে দেয়ার জন্য প্রস্তুত।

চলবে..