অবশেষে পূর্ণতা পর্ব-০১

0
553

#অবশেষে_পূর্ণতা
#লেখক_আহম্মেদ_নীল
#সূচনা_পর্ব

-‘আমার হাসবেন্ড আতিক যখন দ্বিতীয় বিয়ে করে তখন আমার প্রেগ্ন্যাসির দুমাস চলছে। কিন্তু কেউ জানতো না যে আমি প্রেগন্যান্ট, এমনকি আতিকও জানতো না। আজ সকালেই টেস্ট করে জানতে পারি আমি মা হতে চলেছি।ভেবেছিলাম আতিক অফিস থেকে বাসায় আসলেই তাকে আজকে সারপ্রাইজ দিবো। কিন্তু আজ সে দ্বিতীয় বিয়ে করে আমাকে এত বড় একটা সারপ্রাইজ দিবে তা আমি একটিবারও কল্পনা করতে পারিনি। দরজা খুলতেই আতিক এর পাশে লাল শাড়ি পরিহিত একটা মেয়েকে দেখে আমার একটুও অসুবিধা হলো না এটা আতিক এর বিবাহিত করা দ্বিতীয় স্ত্রী। তবুও আতিককে বোকার মতো প্রশ্ন করেছিলাম,কে এই মেয়েটা.??

“আতিক আমার কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আমার সামনে দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করা বউকে হাত ধরে নিয়ে উপরে আমাদের রুমে নিয়ে যায়। আমি দরজায় হেলান দিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তারপরও একপ্রকার নিজের চোখে সবকিছু দেখার পর সবকিছু বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। একটু পর আমার সকল ভাবনার ঘোর কাটিয়ে আতিক একটা ব্যাক নিয়ে এসে কি জেনো একটা কাগজ বের করতে শুরু করলো। আমার মনের মাঝে কু ডাক দিলো।মনে হতে লাগলো,এটা আবার ডিভোর্স পেপার না তো.?? আমার ভাবনার সকল ছেদ করে আতিক বলতে লাগলো,এটা ডিভোর্স পেপার,আমি স্বাক্ষর করেছি,দয়াকরে তুমি স্বাক্ষর করে দাও,তারপর আমাকে মুক্তি দাও। ছলছল নয়নে আমি আতিতকে বারবার দেখছিলাম,আর ভাবছিলাম এই মানুষটা আমাকে এভাবে পর করে দিতে পারলো কেমন করে.?

-‘কি হলো.?স্বাক্ষর না করে দাড়িয়ে আছো যে কথাগুলো আমার দিকে ছুড়ে মারলো আতিক। একটু পর আতিক এর মা, মানে আমার শ্বাশুড়ি এসে বলতে লাগলো,বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা নেই যার,সে আর যাই হোক আমার ছেলের বউ হওয়ার কোন অধিকার রাখেনা । এই পাঁচটা বছর তো দেখলাম,কিন্তুু একটা বাচ্চাও জন্ম দিতে পারলো না। শ্বাশুড়ির হাজারো অপমান আর আতিক এর অসহ্যমূলক কথা শুনে আতিক এর হাত থেকে পেন আর পেপারটা নিয়ে স্বাক্ষর করে দিলাম। একটু পর দেখলাম সদরে নতুন বউকে গ্রহন করে নিলো আমার শ্বাশুড়ি। একটুও দ্বিধা করলো না।

‘অশ্রুভেজা নয়নে সেদিন শ্বশুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমার আসতে মন না চাইলেও একপ্রকার বাধ্য হয়ে চলে আসতে হয়েছিলো। আর না এসেই বা কি করার ছিলো। যে স্বামীর জন্য এতকিছু করতাম,আজ তো তার কাছেই আমি বোঝা হয়ে গেছি শুধুমাত্র একটা বাচ্চা দিতে পারছিলাম না বলে। তবে আমার ভাগ্য কতটা নিষ্ঠুর,আজ আমি মা হতে পেরেও কাউকে কিছু বলতে পারলাম না,আর বলবই বা কি করে,আতিক আমাকে তা বলার সুযোগি তো দিলো না। একটু পর একটা গাড়ি দেখে বাবার বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলাম।

আসুন পরিচয় দেওয়া যাক,
“আমি হলাম নুসরাত ফারিয়া। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। আমি যখন অনার্স ২য় বর্ষে পড়ি তখন আতিক এর সাথে আমার পারিবারিক ভাবে বিয়েটা হয়। কখনো বাবা-মায়ের বিপক্ষে যায়নি। তবে বিয়ের আগে বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো,আমার কোন ছেলেকে পছন্দ আছে কিনা। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্থ থাকার কারনে কখনো রিলেশন নামক জিনিসটা অনুভব করতে পারিনি। তাই বাবার পছন্দ করা আতিককে বিয়ে করি। বিয়ের এক দুই বছর পরও বাচ্চা না হওয়ার কারনে আমি আর আতিক সিদ্ধান্ত নিয়,আমরা ডাক্তারের কাছে যাবো। আর কি সমস্যা তা জানবো। আতিত প্রথমে না বললেও পরে আমার জোরাজুরিতে রাজি হয় ডাক্তারের কাছে যেতে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর সকল রকমের টেস্ট করে ডাক্তার জানায় আমাদের দুজনের ভেতর কোন সমস্যা নেই। আল্লাহ যখন বাচ্চা দিবে তখন বাচ্চা হবে। আমাদের দুজনের ভেতরে কোন প্রকার সমস্যা নেই। এই কথাগুলো যখন বাসায় এসে শ্বাশুড়ি মাকে বলেছিলাম,তখন থেকে শ্বাশুড়ি তার থেকে হাজারো রকমের কুট কথায় শুনিয়ে তার কানকে ঝালাফালা করে তুলে। এভাবে কেটে যায় আরো একটা বছর। এখন আতিকও আমার উপর রিতিমতো বিরক্তিকর হয়,অফিস থেকে প্রায় সময় অনেক রাত করে বাসায় ফিরে,রাতে খেতে বললে আমাকে ধকম দেয়।আবার অনেক সময় অফিস শেষ করে সে বাসায়ও আসেনা। আবার অন্যদিকে শ্বাশুড়ি আমার উপর হাজারো টর্চার করতে থাকে। বিয়ের পর আতিক এর হাতে পায়ে ধরে পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করি। প্রথমে সে রাজি না হলেও পরে একপ্রকার আমার আকুতি মিনতি করার কারনে সুযোগ দিয়েছে। সারাদিন কাজ শেষ করার পর রাতে একটু পড়ার সুযোগ পেতাম,ওতটুকুই করতাম। বিয়ের পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার পর আমার শ্বাশুড়ি আতিতকে দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা বলে। আতিক প্রথম রাজি না হলেও আস্তে আস্তে সময়ের সাথে সাথে আতিকও বদলাতে থাকে। আমি তাকে প্রতিটা রাতে বুঝাতাম,আল্লাহ চাইলে আমাদের বাচ্চা হবে। আমরা তো জানি আমাদের ভেতরে কোন প্রকার সমস্যা নেই। আমাদের দেশে অনেক পরিবারে এমন হয়। বিয়ের অনেক বছর পর বাচ্চা হয়,আমাদেরও একদিন বাচ্চা হবে দেখে নিও। আমাদের দুজনেরি তো অনেক ইচ্ছে, বাবা-মা হওয়া। প্রতিটি ছেলে যেমন বাবা হওয়ার তীব্র ইচ্ছে, ঠিক তেমনি প্রতিটি নারী তো চাই মা হতে।

-‘ছয় বছরের মাথায় আতিক আমাকে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করে। ভেবেছিলাম,কত বড় সারপ্রাইজ দিবো তাকে আজকে। হয়তো এই সারপ্রাইজ শুনে সে পৃথিবীর সবথেকে ভাগ্যবান মনে করবে,কিন্তুু সে আমাকে রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করে এত বড় সারপ্রাইজ দিবে আমি তা একটি বারের জন্যও ভাবতে পারিনি। গাড়িতে বসে বাবার বাড়িতে যাচ্ছি, আর আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু কনাগুলো গড়িয়ে পড়ছে। আমি শুধু বারবার নিজের পেটে হাত দিচ্ছি আর মনে মনে বলছি,আমার জীবন থাকতে আমি তোকে কিছু হতে দিবোনা। তোকে সঠিকভাবে মানুষ করে তুলবো,আর কেউ জানতেও পারবে না,এই সন্তান এর বাবা আতিক । আমার পরিচয়ে আমি তোকে বড় করে তুলবো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাস স্টেশন এ চলে আসলাম। আপা বাস স্টেশনে চলে এসেছি এবার নামুন, গাড়ি ওয়ালার কথা শুনে আমার সকল ভাবনার ছেদ ঘটলো। গাড়ি ওয়ালার হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে পাড়ি দিলাম বাবার বাড়ি। কয়েক কদম হাটার পর চিরচেনা বাবার বাড়ির গেটের সামনে হাজির হলাম।

‘আমাকে দেখে দাড়োয়ান চাচা বলতে লাগলো,মা তোমার এই হাল কেনো.? আর তুমি একা কেনো সাথে আতিক বাবাজি আসিনি.? চাচার কোন কথার জবাব না দিয়ে আমি চাচাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়,চাচা আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে,আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। একটু পর চাচা আমাকে ভেতরে নিয়ে যায়,মা আমাকে এমন অবস্থা থেকে কান্না শুরু করে দেয়।তারপর একে একে সকল ঘটনা বলতে থাকি। নিজের রুমে মনমরা হয়ে বসে আছি। কলিং বেল বাজতেই বুঝতে পারলাম,বাবা এসেছে। একটু পর মা দরজার খুলে দিলো। কিরে মা কখন আসলি.? আর আতিক কোথায়.? আমাকে আগে থেকে বলিস নি কেনো তোরা আসবি.? আমি কোন কথা না বলে বাবার কাছে গিয়ে বাবার বুকে মাথা রেখে নিজের মনকে আরো কিছুটা হালকা করে নিলাম অশ্রু কনাগুলোকে ফেলে। একে একে পুরো ঘটনা মা বলতে লাগলো।

-‘বাবা প্রথম আইনি ব্যবস্থা নিতে চাইলেও,বাবাকে বললাম, এসব করে কোন লাভ হবেনা। বাবাকে বলি ভালোভাবে আইনগতভাবে আতিতকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য। যাতে করে পরবর্তী আতিত বুঝতে পারে বাচ্চাটার প্রকৃত বাবা সে না।

পড়াশোনাটা কন্টিনিউ করি হাজারো প্রতিকূলতার মাঝেও।হাজারো কষ্ট বুকে নিয়ে আবারো শুরু করলাম স্বাধীনভাবে পড়াশোনা। ভার্সিটি যাচ্ছি অনেকদিন পর,আমাকে দেখে কিছু ছেলে বলতে লাগলো,এই দেখ মেয়েটার ফিগার কত সুন্দর। এমন হাজারো কথা প্রতিনিয়ত মেয়েদের হজম করতে হয়,তাই কোন প্রতিবাদ না করে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তখুনি পিছন থেকে আমাকে একটা ছেলে ডাকতে লাগলো,এই যে শুনছেন.??

‘পিছনে ফিরতেই দেখতে পেলাম একজন সুদর্শন যুবক।দেখতে লম্বা,ফর্সা আর বড় চুলে আবৃত কপালের ঠিক নিচ বরারবর লম্বা নাকের ওপর এক বিন্দু তিলক,যা পুরো মুখটাকে সুন্দর করে তুলেছে যার মায়াবী চোখে অগাধ খাদ। যা নিবির মায়াময়। যা দেখলে যে কেউ একপ্রকার চোখ ফেরাতে পারবে না,যাকে খোলাখুলি ভাবে বলা হয় ক্রাশ খেতে বাধ্য হবে। আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বলতে লাগলাম,আমাকে বলছেন.? আপনাকে ছাড়া কাকে বলছি,এখানে কি আপনি ছাড়া আর কেউ আছে.? আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম আমি আর ওই ছেলেগুলো ছাড়া আর কেউ নেই। আমি এবার চুপ করে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলাম আর ওনি আমার পাশে দাড়িয়ে কথাগুলো বলছে। ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে মাফিয়া টিমের একজন লিডার লিডার ভাব।

”-আমার সকল ঘোড় কাটিয়ে ওনি ধমক গলায় বলতে লাগলো,,সুরেচ ছেলেগুলোকে ২ মিনিটের ভেতরে আমার পায়ের সামনে এনে হাজির কর। ওনার এমন চিৎকার শুনে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যাওয়ার মতো উপক্রম। একটু পর কয়েকজন মিলে আমাকে বলা খারাপ কথা ছেলে ৪ টাকে হাজির করলো অনেকগুলো ছেলে ওনার সামনে। তোদের সাহস হয় কেমনে করে মিস্টার নীল এর সামনে একটা মেয়েকে খারাপ কথা বলা.? তোরা কি ভুলে গেছিস নীল বলে ভার্সিটির বড় ভাইকে..? এর আগে অনেকবার শুনেছিলার মিস্টার নীল বলে একজন বড় ভাই আছে এই ভার্সিটির,যার কথা পুরো কলেজ উঠে বসে। আর ওনি নাকি অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করে,অন্যয় দেখলে ওনি নাকি নিজের ভাইকেও ছাড়ে না। তবে জানা ছিলো না ওনিই সেই নীল চৌধুরী।

‘ছেলেগুলো ওনার দুই পায়ে ধরে হাজারো আকুতি মিনতি করছে। কিন্তুু সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই ওনার। ওনার শরীর থেকে অনবরত ঘাম ঝড়ছে,আর চোখগুলো রক্ত জবার ফুলের ন্যায় ধারন করেছে,বোঝা যাচ্ছে ওনার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরন হচ্ছে, রাগে টগবগ করছে ওনার ভেতরটা। ওয়েট ওয়েট তোরা কি বলছিলি একটু আগে.? ওয়াও মেয়েটার দারুন ফিগার.? তোদের ঘরে কি মা-বোন নেই। ধরে নে তোদের নিজের বোনের দিকে যদি কেউ এমন কু নজরে তাকায় কিংবা, বলে ওয়াও দারুন ফিগার তখনও তোদের নিশ্চয়ই ভালো লাগবে। তোদের মতো কিছু বকাটে ছেলেদের কারনে আমাদের পুরো ইয়াং জেনারেশন এর ছেলেগুলোর বদনাম হচ্ছে। আমাদের পুরো পুরুষ জাতীর অসম্মান হচ্ছে।

-“ভাই,ভাই আমাদের ভুল হয়ে গেছে, প্লিজ আমাদের মাফ করে দিন কথাগুলো ওনার পা ধরে বলছে ছেলেগুলো আর এই দৃশ্য দেখছে পুরো ভার্সিটির ছেলে-মেয়ে । সবাই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছে নীল চৌধুরীর এমন সাহসিকতার প্রতিবাদ। একটু পর নীল চৌধুরী বললো,এই তোরা কার কাছে ভুল করেছি.?ছেলেগুলো এবার বুঝতে পারলো,আমার কাছে ক্ষমা চাওয়া ছাড়া তাদের আর শেষরক্ষা হবেনা। আপু আপু প্লিজ আমাদের মাফ করে দিন। আমি বললাম,আচ্ছা আপনারা আমার পা ছাড়ুন। একটু পর আমি ক্লাসের দিকে অগ্রসর হচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি,বাংলাদেশ প্রতিটি ভার্সিটিতে কিংবা কলেজে যদি এমন একজন সৎ প্রতিবাদী আর সাহসী যুবক থাকতো, তাহলে আমাদের মতো মেয়েরা কোন জায়গায়,অসম্মানিত আর ইভটিজিং এ স্বীকার হতো না।

দেখতে দেখতে পুরো দুইটা মাস পার হয়ে গেলো আমার,,

চলবে,,