অবাধ্য প্রেম পর্ব-০১

0
1380

#অবাধ্য_প্রেম
#সূচনা_পর্ব
নন্দিনী নীলা

ক্যাম্পাসের মাঠে আমাকে কান ধরিয়ে দাঁড় করে রেখেছে সিনিয়র ভাইয়ারা। এটা আমার শাস্তি আর এই শাস্তিটা আমি পেয়েছি ক্যাম্পাসের এক বড় ভাইয়ের শরীরের রং দেওয়ার অপরাধে। আমার একমাত্র শাকচুন্নি বান্ধবীর গায়ে রং দিতে গিয়ে আমি ভুল করে এক সিনিয়র ভাই এর শরীরে রং দিয়ে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। আর সেই ভুল স্বরূপ আমাকে এখন তাদের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। কি একটা বিচ্ছিরি লজ্জাকর অবস্থা। আমার ক্লাসের পরিচিত-অপরিচিত সব বন্ধু বান্ধবীরা সবাই আমাকে দেখে টিটকারি মারা হাসি হাসছে। কারণ আমি হলাম ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু মেয়েটা যে সবাইকে নাকানি-চুবানি খাওয়াতে ব্যস্ত থাকি সব সময়। আর আজকে আমাকে সিনিয়র ভাইদের সামনে মাথা নত করে থাকতে হচ্ছে এটা দেখে ওরা তো খুবই মজা পাচ্ছে। ওরা আমার ওপর কখনোই শোধ তুলতে পারে নাই সবারই আমার ওপর একটা রাগ আছে। তো সেই রাগটা যেন সিনিয়দের শাস্তির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে। সব রাগ একসাথে খাটাচ্ছে। আমি ওদের দিকে একটু পরপর রাগি চোখে তাকাচ্ছি‌। আর ওরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে‌। খুব লজ্জা লাগছে ওদের।এবার বিশেষ করে যাকে আমি রং দিয়েছি তার দিকে তাকাচ্ছি ছেলেটা বাইকে শুয়ে আমার দিকে শয়তানি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে।

তার হাতে আছে ফোন তিনি আমার দিকে ফোনের ক্যামেরা ধরে আছে। আমি লাফ দিয়ে কান থেকে হাত নামিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলাম, ‘ ওই ওই আপনি আমার ভিডিও করছেন কেন?’

লোকটা আমার দিকে শয়তানি হাসি দিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘এটাই তো আসল মজা।’

ছেলেটার হাসির দেখে আমার গা পিত্তি জ্বলে উঠলো। এত বড় সাহস আমাকে সার্কাস বানিয়ে আবার ভিডিও করা হচ্ছে। সিনিয়র ছেলেটা তো ভারি শয়তান।

আমি ছুটে গিয়ে উনার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে গাছের দিকে ছুড়ে মারলাম আর সাথে সাথে ফোনটা ভেঙে 3 খন্ড হয়ে নিচে পড়ল। আর উনি এক চিৎকার দিয়ে উঠলো নিজের ফোনের এমন মর্মান্তিক অবস্থা দেখে। সবাই বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে‌। তার চোখটাও বড়বড় হয়ে গেছে। রাগান্বিত চোখে আমার মুখমন্ডলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আমার এমন সাহস দেখে তিনি হতভম্ব। আর আমি‌‌ তো মারাত্মক খুশি। খুশি নাচতে মন চাচ্ছে। চাইবে না কেন এতোক্ষণ আমাকে অপমান করার হ্যাঁ একটা শিক্ষা তো দিতে পারলাম।

আমি আফসোস স্বরে ফোনটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আহারে বেচারা ফোন। কে জানতো এই ফোনটা আজকে ইন্তিকাল করবে?’

আমার কথা শেষ হতে না হতেই কেউ যেন ঝড়ের গতিতে আমার সামনে এসে আমার বাম গালে থাপ্পড় মেরে বসল। আঘাত এতোটাই তীব্র ছিল যে আমার মাথাটা ঝনঝন করে ওঠে। আমি চোখ বন্ধ করে এক দিকে ঝুকে যায়। বাম হাতটা আপনা আপনি আমার গালি গিয়ে ঠেকে। মনে হয় লোহা দ্বারা আঘাত করা হয়েছে। কারো হাতে ও যে এত শক্ত থাকে আর এত শক্তি থাকে থাপ্পড় টা না খেলে হয়তো আমি বুঝতেই পারতাম না।

পাক্কা 5 মিনিট পর আমি দুনিয়াতে ফিরলাম। থাপ্পড় খেয়ে যে আমি কোন দুনিয়ায় চলে গিয়েছিলাম আল্লাহ তালায় জানে। আমি চোখ পিটপিট করে সামনে তাকাতেই এক মানুষরূপী রাক্ষস কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি‌। একটা সেই রাক্ষস যাকে আমি রঙ দিয়েছিলাম।এবং যার ফোনটা আমি এখন ভেঙে ফেলেছি। এতক্ষণ যাকে শয়তানি হাসি দিতে দেখেছি‌। মুখে ছিলো শয়তানি হাসিতে ভরা। এখন তাকেই আমার শক্তপোক্ত রাগী ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছে। তার চোখ দিয়ে যেন রক্ত ঝরছে। লাল টকটকে হয়ে আছে তার চোখ দুটো। ফর্সা মুখটা লাল টকটকে হয়ে আছে। কপালে রগ ফুলে উঠেছে মাই গড কি ভয়ঙ্কর বিচ্ছিরি দেখতে লাগছে।

আমি ঢোক গিললাম আস্তে ধীরে বুঝতে দিলাম না আমি তার এই রূপটাকে ভয় পেয়েছি। বুকে সাহস সঞ্চয় করে যথেষ্ট সাহসিকতার সাথে বললাম, ‘ আপনার সাহস তো কম না আপনি আমাকে থাপ্পড় মারলেন। আমি এখনই প্রিন্সিপালের কাছে বিচার দেবো আপনার নামে। যে আপনি মেয়েদের সাথে অসভ্যতামি করেন।’

এটা শুনেছেন ওড়নাটা টা আরো চড়ে উঠল। উনি ফট করে আমার গাল চেপে ধরে বলল, ‘কি বললে আমি মেয়েদের সাথে অসভ্যতামি করি? মেয়েদের সাথে আমি একটি অসভ্যতামি করেছি বলো! তোমাকে কি আমি এই ভরা মজলিসে জোর করে কিস করেছে বা..

উনার স্পর্শে আমার গা জিন জিম করে উঠল। আমি নিজে থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললাম, ‘আপনি তো ভারি বেয়াদব আর অসভ্য ছেলে! বারবার আমাকে টাচ করছেন কেন? আমি তো ভুল করে আপনার গায়ের রং দিছি তার জন্য আপনি আমাকে সবার সামনে অপমান করে কান ধরে দাঁড় করে রাখলেন। আবার সেটা ভিডিও করছেন। নিজের ভুলগুলো চোখে পড়ছে না। অথচ আমার একটা অনিচ্ছাকৃত ভুল কে আপনি ভুল বলে আমাকে এভাবে হ্যাঁ নাস্তা করছেন?’

‘অসভ্যতামি না করেই যদি অসভ্য হয়। তাহলে অসভ্যতামি করে অসভ্য বেয়াদব হব আমি। আর তুমি নিজেকে কি ভাবো মহারানী ভিক্টোরিয়া তোমার ভিডিও আমি করতে যাব কেন? আমি তখন ভিডিও কলে কথা বলছিলাম। তুমি সেটা কে ভুল বুঝেছ তাই আমি তোমাকে ক্ষেপানোর জন্যে ওইটা জাস্ট বলেছি‌। তুমি সত্যতা যাচাই না করেই কেন আমার ফোনটা ভেঙ্গে ফেললে? দুদিন আগে আমি এই ফোনটা কিনেছি কত টাকা দিয়ে জানো? তুমি আমার এতো টাকার ফোনটা এক নিমিষে শেষ করে দিলে?’

‘বেশ করেছি। আপনি আমাকে ক্ষ্যাপা বেন কেন? এমনিতেই সবার সামনে আমাকে মাথানত করিয়ে হাসির পাত্র বানিয়ে আপনার শান্তি হয় নাই। এখন আবার আমাকে খেপাতে আসছেন বেশ করেছি আমি।’

‘ওকে।’

বলেই উনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় আবার টাচ করতে আমি সরে যেতে চাই কিন্তু পারি না। কারণ উনি আমাকে আরেক হাত দিয়ে আমার হাত খামচে ধরে রেখেছে। আম ব্যথা পাচ্ছি । কিন্তু ছাড়াতে পারছিনা। সেই মুহূর্তে উনার দুজন বন্ধু এসে উনাকে টেনে হেঁচড়ে আমার সামনে থেকে নিয়ে যায়। আর উনি চিৎকার করতে থাকে।

উনার এক মেয়ে ফ্রেন্ড এসে আমাকে বলে, ‘ তুমি তো দেখছি খুব ফাজিল মেয়ে। নিবিড় এর দের লাখ টাকার ফোনটা ভেঙে ফেললে। নিবিড় কি যে করবে আল্লাহ ভালো জানে।’

আমি ভেংচি কেটে বলল, ‘ ওই ফোন এতো দামী। বললেই বিলিভ করবো পাগল তো আমি।’

‘ না করলে নাই। টেক কেয়ার।’

আমি বললাম, ‘আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না আপনার। আপনি আপনার বন্ধুকে সামলান আমার সাথে টক্কর নিতে আসলে এইভাবে নাকানিচোবানি খাবে। যত্তসব।’

মেয়েটা আমার কথা শুনে আর দাঁড়ালো না চলে গেল। এতক্ষণ আমার ক্লাসের যারা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল এবার তারা দৌড়ে পালিয়েছে। কারণ আমি ফোনটা ভেঙে নিজেকে খুবই সাহসী প্রমাণ করে ফেলেছি আরেকবার। ক্লাসের বাইরের কেউ জানেনা আমি কতটা ডেঞ্জারাস মেয়ে। কিন্তু ওরা তো খুব ভালোভাবে জানে কারণ ওদেরকে আমি এর আগেও কয়েকবার নাকানিচোবানি খাইয়েছি আজকে আমার এই পরিস্থিতি দেখে ওরা মজা লুটেছি। এর জন্য আমি ওদের জন্য কি কি করব সেই চিন্তাই ওরা ভয়ে পালিয়েছে। আমি হাসতে হাসতে মাঠের ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। হাসতে গিয়ে গালে ব্যথা অনুভব করলাম। ইস রাক্ষসটার হাত গন্ডারের শক্ত। এক থাপ্পড়ে আমার গালের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।

আমার দুই মাত্র বেস্টি দীপা আর লিলি।
দীপা এসেই আমার গালে হাত দিয়ে বলল, ‘ইস পাঁচ আঙুলের ছাপ ফুটে উঠেছে।’

আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে বললাম, ‘ সর আমার সামনে থেকে। একদম দরদ দেখাতে আসবি না। তোরা আমার কেমন বেস্টি? আমার বিপদের সময় তোরা তো সেই লুকিয়ে বসেছিলি।’

‘ কে বলেছে লুকিয়ে ছিলাম আমরা তো সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু নিবিড় ভাইয়ের সামনে আমারা কিছু বলার সাহস করতে পারিনি। এমনিতেই সিনিয়র ভাই কিছু বললেও আমরা কিছুই করতে পারতাম না উল্টা ফেসে যেতাম। এর জন্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম কি হয়? তোর সাথে বাড়াবাড়ি কিছু করার আগে তো তুই একটা বাড়াবাড়ি কাজ করে বসলি। আল্লাহ তাআলা জানে এর জন্য আবার কি বিপদ নেমে আসে তোর উপর।’

‘ তোরা কি আমাকে ভীতু ভাবিস? আজকে যেমন উনার ফোন ভেঙেছি। আবার যখন আসবে আমার সাথে লাগতে সেদিনও আমি…. থাক যখন কারটা তখনই করব। এখন আমার গালটা খুব ব্যথা করছে।’

লিলি বলল, ‘দাঁড়া বরফ নিয়ে আসছে দিলে ব্যথা কমবে। আমি দোকান থেকে একটা আইসক্রিম কিনে আনি।’
বলে লিলি চলে গেলে।

দীপা আমার হাত ধরে বলল, ‘ ছোঁয়া তুই ফোনটা কেন ভাংলি। এর জন্য যদি তোর কোন ক্ষতি চেষ্টা করে।’

‘দীপ তুই এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? ও আমাকে কিছু করার চেষ্টা করবে আর আমি কি চুপচাপ বসে আঙুল চুষবি নাকি। সোজা প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে চলে যাব।’

‘প্রিন্সিপাল স্যার নিবিড় ভাইয়াকে কিছু বলবেনা।’

‘ মানে?’

‘মানে এখানে যে এতো কিছু হলো কলেজের একটা স্যার কে ও দেখেছিস এদিকে আসতে?’

‘নাতো আমি ও ভাবছি। এত সবাই ভিড় করে আছে অথচ স্যার ম্যাম রা কেউ আসলো না ব্যাপার কি?’

‘এটাইতো কথা নিবিড় ভাই যেখানে আছে সেখানে যত ঝামেলা হোক না কেন কেউ আসবে না।’

‘হোয়াট কেন?’

‘কারণ এটাই তাদের ক্ষমতা! জোর যার মুল্লুক তার।’

‘ পেঁচানো কথা বাদ দে আমাকে সব ঘটনা খুলে বল।’

লিলি এসে আমার গালে বরফ ডলতে লাগল দীপা আর আমাকে কিছুই বলল না।

ক্লাসে আসতেই সবাই আমার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। ওদের কিছু বললাম না মন মেজাজ খারাপ আর তার মধ্যে স্যার চলে এসেছে।
ক্লাস শেষে আমি আর দীপা অটোতে করে বাসায় চলে আসলাম।
গেটের সামনে নামতে একটা বাইক আমাদের সামনে আসে আমি ভাড়া দেওয়ার আগেই রঙ ভর্তি পানি আমার মাথায় ঢেলে দেয়। আমি সহ আমার ব্যাগ টাকা সব ভিজে শেষ আমি এক চিৎকার দিয়ে সামনে তাকাতেই নিবিড়ের দুষ্টু চাহনি দেখতে পায়। আমি নিবিড় এর দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকাতেই নিবিড় নিজের কালি মাখানো হাতটা আমার কপাল থেকে সম্পূর্ণ মুখে ঘষে দেয়।

#চলবে…..