অবান্তর চিরকুট পর্ব-১০

0
318

#অবান্তর_চিরকুট (পর্ব-10)

♡আরশিয়া জান্নাত

“শুনুন মিস সিতারা, এমন হুটহাট আবদার করে বসবেন না প্লিজ। আমার ইচ্ছে ছিলনা বের হবার তবুও বাধ্য হয়ে এসেছি,,”

“আবদার করে কেউ যদি কিছু পায় তবে কি সে নিষেধাজ্ঞা মানবে?”

“এসব কথাবার্তা শুনতে চাইছিনা।”

“এতো বিরক্ত কেন কি হয়েছে বলুন শুনি?”

“কিচ্ছু হয়নি। কেন ডেকেছেন তা বলুন”

“নাহ আগে বলুন আপনার ঘটনা। তারপর আমি বলবো। এমন ভ্রু কুঁচকে বিরক্তমুখ করে রাখা কাউকে আমি কথাটা বলতে পারবোনা। তারচেয়ে আপনার মুড চেইঞ্জ করতে বলুন আগে।”

“ওকে বলতে হবেনা। আমি যাই টাটা।”

” আরেহ আরেহ শুনুন তো ”

“কি?”

“বাব্বাহ এতো ঝাঁজ? আগেরজনের প্রভাব নাকি জন্মগত?”

“স্যরি?”

“হেহে ইটস ওকে।”

“আপনাকে স্যরি বলিনি। বললাম কি বুঝালেন সেটা আবার বলতে”

“দেখি চলেন তো কোথাও গিয়ে বসি। খুব খিদে পেয়েছে,,”

“তো বাসায় চলে যান। এখানে বসে আছেন কেন?”

“উফফ এতো কথা না বলে চলেন বিরিয়ানি খাবো।”

সিতারা একপ্রকার টেনেই নিয়ে গেল রাফসান কে পাশের একটা রেস্টুরেন্টে। রাফসান খেতে না চাইলেও জোর করে খাওয়ালো। রাফসান এইটুকু বুঝে গেছে সিতারা নাছোড়বান্দা, সে যা বলবে তা করেই ছাড়বে।

“এবার বলুন এভাবে কয়দিন কাটাবেন?”

“কিভাবে?”

“আপনার সম্পর্কে আমি সব ইনফরমেশন কালেক্ট করেছি মি. রাফসান। আপনার এক্স ওয়াইফের নাম সাফওয়ানা ইসলাম। সে বর্তমানে যাত্রাবাড়িতে নতুন হাজবেন্ডের সঙ্গে আছে। আপনার ফ্যামিলি মেম্বার বলতে কেবল একটা ফুপী আছে যারা মোহাম্মদপুর থাকেন। আপনি কেডিএস গ্রুপে ফ্লোর ইনসার্চ হিসেবে জব করতেন, সেটা ছেড়ে তিনমাস লাপাত্তা ছিলেন। বর্তমানে খুব সাধারণ একটা কোম্পানির সুপারভাইজার হিসেবে আছেন। তাও পাঁচদিন ধরে অফিস মিস করছেন। সারাদিন বাসায় থাকে রাতে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ান। রিসেন্ট আপনার আরেকটা অভ্যাস গড়ে উঠেছে। রোজ রাতে ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে নিচে লাফ দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। কিন্তু কিছু একটার জন্য থেমে যাচ্ছেন প্রতিবার,,,,”

রাফসান হা করে তাকিয়ে রইলো সিতারার দিকে। এই মেয়ে কি গোয়েন্দা নাকি পুলিশ! সে এতোকিছুর খবর নিয়েছে কেন? তাকে ফলো করার কারণ কি! নাকি কোনো গ্রুপের সদস্য, সে কি কোনো ফাঁদে পড়ে গেল?? রাফসানের কপালে ঘাম জমতে শুরু করলো। সিতারা কে? কি চায় সে? তার তো বিশেষ কোনো সম্পত্তিও নেই ব্যাঙ্কেই যা ক’টা টাকা আছে। তবে কি সেজন্য?!

“মি. রাফসান চিন্তিত হবার কিছু নেই। আপনার অবস্থা দেখে আমার খুব হাসি পাচ্ছে।”

“কে আপনি? এতো সব তথ্য বের করার উদ্দেশ্য কি?”

“আপনি তো কিছু বলেন না। তাই আমিই বের করেছি। ঢাকা শহরে কারো সম্পর্কে তথ্য বের করা কঠিন নাকি?”

“মানুষ এমনি এমনি কারো তথ্য সংগ্রহ করেনা।”

“সেটা অবশ্যই ঠিক। আমারো উদ্দেশ্য আছে আর সেটা বলতেই আপনাকে ডেকেছি।”

“কি সেটা?”

সিতারা কিছুক্ষণ থেমে বললো, আপনি আমায় বিয়ে করতে পারবেন?

রাফসান বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। সিতারা চারদিকে তাকিয়ে বললো, প্লিজ বসুন।

রাফসান বসে বললো, এইসবে মানে কি? কি চলছে আপনার মনে আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা।

“দেখুন আপনার সম্পর্কে যা জানার জেনেছি। আপনি চাইলে আমার সম্পর্কেও বলবো। আপনি এতো রিয়েক্ট না করে আমার সিচুয়েশনটা বুঝুন।”

“আপনার সিচুয়েশন বলতে?”

সিতারা রাফসানকে সবটা খুলে বললো। তাহজীবের সত্যিই গ্যারান্টি নেই, এখন হুট করে অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইলেও সম্ভব হবেনা। সে ঠিকই সেটা ভেঙেই ছাড়বে। এই মুহূর্তে রাফসানের চেয়ে বেটার অপশন আর কিছুই মাথায় আসছেনা তার।
সবটা শুনে রাফসান বললো, দেখুন আপনার পরিস্থিতি আমি বুঝতে পারছি কিন্তু আমি কিভাবে,,

“আপনার যেমন পাস্ট আছে আমারো আছে। আপনার মনের অবস্থা আমার চেয়ে ভালো কে বুঝবে মি. রাফসান?
আমি সেই মানুষটার জীবনে আর ফিরতে চাইনা, প্লিজ আমায় সাহায্য করুন।”

“আমাকে সময় দিন। আমি ভেবে জানাবো।”

রাফসান উঠে চলে গেল। সিতারা মাথানীচু করে বসে রইলো। রাফসান যদি না বলে দেয় কি করবে ও?
_________________

আকাশে পঞ্চমীর সরু চাঁদ দেখা যাচ্ছে। তার একটু পাশেই জ্বলজ্বল করে জ্বলছে একটা নক্ষত্র। রাফসানের মনে হলো, চাঁদটাও বুঝি সঙ্গী জুটিয়েছে! সিতারার সম্পর্কে তার ধারণা এই মেয়েটা খুব অদ্ভুত। মানুষকে অল্পতেই আপন করে নেওয়ার কিংবা বিশ্বাস করে ফেলার দারুণ ক্ষমতা তার। অবশ্য এর প্রমাণ তো সে প্রথমদিনই পেয়েছে। কিন্তু রাফসানের যে মনের অবস্থা এই সময়ে কাউকে জীবনে আনার কথা সে কল্পনাই করতে পারেনা। সিতারার মতো মেয়েকে কেউই রিজেক্ট করার কথা ভাববেনা, মেয়েটার পরিস্থিতি সত্যিই অনেক ক্রিটিক্যাল। নাহয় নিশ্চয়ই এমন কথা বলতো না। কি করবে কিছুই মাথায় আসছেনা। এ কেমন দোটানায় পড়ে গেল সে! না পারছে ইগ্নোর করতে না পারছে মেনে নিতে। সারাটা রাত তাঁর এই চিন্তাতেই কেটে গেল।



“বলছি কি সিতারার বিয়ের ব্যাপারে এবার ভাবা উচিত না বলো? এতোদিন তো ভেবেছি তাহজীবের সঙ্গে হবে। তাই আর বাইরে কোথাও বলিনি। এখন তো কথা বলতে হবে,বয়স তো আর বসে থাকছেনা!”

“সবে তো একটা যন্ত্রণার সময় পার করছে। ওকে একটু সামলে উঠতে দাও। তারপর নাহয় এ বিষয়ে আলোচনা করবো?”

“উফফ তোমার কি! তোমাকে তো কেউ কথা শোনায় না, আশেপাশের মানুষেরা কত কি বলে জানো?”

“শোনো সোফিয়া আমার মেয়ে যতদিন না চাইবে আমি ওকে এই বিষয়ে জোর করবোনা। এতে কে কি বলে আমার কিচ্ছু যায় আসেনা।”

“কিন্তু ,,,”

“কোনো কিন্তু না। গতবার তুমি আগ বাড়িয়ে আপার সাথে কথা বলেছিলে। আমি তখন কিছু বলিনি, তোমার উচিত ছিল এই বিষয়ে সিতারার সঙ্গে কথা বলা, ওদের সম্পর্কের অবস্থা না বুঝে হুট করে বিয়ের টপিক এনে মেয়েটাকে অপমান করানোর সুযোগ করে দিয়েছিলে তাহজীবকে। নাহয় আমার মেয়েকে রিজেক্ট করার স্কোপ ও পেতোনা। এবারো যদি তুমি এমন কিছু করো যাতে আমার মেয়ে ছোট হয় আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা এই আমি বলে দিলাম।”

সোফিয়া মন খারাপ করে উঠে চলে গেল। জহির সাহেব রাগের মাথায় সব বললেও ভুল কিছু বলেননি।

“বাবা আসবো?”
জহির সাহেব মাথা ঠান্ডা করে বললেন, হু আয়,
“তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে বাবা। তুমি কি ফ্রি আছো?”

“আমার মায়ের সামনে ব্যস্ততা দেখাবো? বল কি বলবি”

“বাবা, আমি এমন একজনকে চিনি যার এই পৃথিবীতে কেউ নেই, কিন্তু তার মনটা অনেক স্বচ্ছ। তার একটা অতীত আছে, ঠিক যেমন আমার আছে। সেই মানুষটাকে যদি আমি জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেই তুমি কি খুব রাগ করবে?”

জহির সাহেব মেয়ের চেহারার দিকে চেয়ে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করলেন। সিতারা তাঁর বাবার সামনে বসে বললো, বাবা আমি জানি আমার মানুষ চেনার ক্ষমতা নেই। আমি ভুল চয়েজ করি, তাই এবার আমি তোমায় জিজ্ঞাসা করছি। তবে বাবা আমি চাই তুমি এই বিষয়ে সিদ্ধান্তটা তাহজীব ভাইয়ার ফেরার আগেই নিবে। এই নাও তাঁর এড্রেস। তুমি চাইলেই দেখা করতে পারো কিংবা খবর নিতে পারো তোমার ইচ্ছেমতো।

জহির সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, তুই ভয় পাচ্ছিস সে ফিরে তোকে জোর করবে তাই এমন তাড়াহুড়োয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছিস?

“আমি জানি বাবা আমার কাছে আরো বেটার অপশন আছে। তোমরা চাইলেই আমার জন্য হাই কোয়ালিফাইড কাউকে আনতে পারবে। কিন্তু বাবা আমি এই মানুষটাকে চুজ করেছি কারণ আমার মনে হচ্ছে একমাত্র সে-ই পারবে আমার দুঃখ বুঝতে, আমাকে বুঝতে,আমাকে ভালো রাখতে।
বাবা আমি যাকে ভালোবাসতাম তাঁকে ঘিরেই আমার পৃথিবী ছিল, কিন্তু তাঁর পৃথিবীতে শুধু আমি ছিলাম না,,,,,,,,
বাবা তুমি একবার কথা বলবে? আমার বিশ্বাস তুমি নিরাশ হবেনা।”

“বেশ। আমি খোঁজখবর নিয়ে তোকে জানাচ্ছি।”

“বাবা সে কিন্তু ম্যারিড ছিল আর,,,, ”

“মানুষটা ভালো কিনা সেটা জরুরি। আর তুই যখন সবটা জেনেও আগ্রহী আমি এই ইস্যু তুলে বিড়ম্বনায় ফেলবোনা। তবে যদি আমি অন্য কোনো ত্রুটি পাই আশা রাখিস না।”

সিতারা হাসিমুখে বেরিয়ে গেল। মেয়ের চোখেমুখে প্রবল আত্মবিশ্বাসই বলে দিচ্ছে ছেলেটার বিষয়ে সে সম্পূর্ণ নিশ্চিত। অবশ্য তাঁর মেয়ের স্বভাবটাই এমন। কিন্তু এবার তিনি ছাড় দেবেন না। ভালোমতো খোঁজ নিয়ে তবেই এগোবেন।

চলবে,,,