অবান্তর চিরকুট পর্ব-১২

0
355

#অবান্তর_চিরকুট (পর্ব-12)

♡আরশিয়া জান্নাত

দার্জিলিং থেকে ফেরার দুইদিন পর সকালে ব্রেকফাস্ট করার সময় তাহজীব জানতে পারলো আজ সিতারার কাবিন হবে।
তাহজীব অবিশ্বাসী গলায় বললো, তাঁরার বিয়ে? কার সঙ্গে? হুট করে বিয়ের খবর মানে কি?
তাহজীবের মা ঠান্ডা গলায় বললো, গতসপ্তাহে তাঁদের আংটি বদল হয়েছে। তুই ছিলিনা তাই জানিস না। সিতারার জাঁকজমক করে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই বলেই সাদামাটা আয়োজন করা হবে।
তাহজীব কিছুটা উত্তেজিত গলায় বললো, কে এই ছেলে? নাম পরিচয় কি? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা?
আফসানা বিরক্তস্বরে বললো, তুমি এতো রিয়েক্ট করছো কেন? ওনার বয়স তো কম হয়নি, এখন বিয়ে করবে না তো কখন করবে?
তাহজীব কিছু বলতে গিয়েও বললোনা। ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে লাগলো। কোনোরকম খাওয়া শেষ করেই রুমে গিয়ে সিতারাকে কল করলো কিন্তু সিতারা রিসিভ করলোনা। সিতারার বাবা জহির সাহেব তাহজীবকে ফোন করে বললো, অযথা সিতারাকে ফোন করে ডিস্টার্ব করোনা।ও এখন ব্যস্ত আছে। আর শোনো বৌমাকে সঙ্গে করে আসতে ভুলোনা। বিকেলেই কাবিন হবে চলে এসো।
তাহজীব ফোন ছুঁড়ে ফেললো। রাগে তাঁর মাথার মগজ টগবগ করছে যেন।
“তোর এতো বড় সাহস তাঁরা। তোর ডানা গজিয়েছে না? আমিও দেখবো কি করে তোর বিয়ে হয়।”

হাতে মেহেদি দিয়ে বসে আছে সিতারা। ইসমা পাশে বসেই এটাসেটা বলছে, সিতারাও হাসিমুখে গল্পে সায় দিচ্ছে। ফাইজা এসে বললো, আপু তুমি রাফসান ভাইয়ার নামের অক্ষর লিখেছ?
ইসমা–হু লিখেছি। তোরে বলতে হবেনা।
ফাইজা–কই দেখি?
সিতারা– এই তো দেখ।
ফাইজা–অনেক সুন্দর। আপু তুমি এতো সিম্পল ভাবে বিয়ে না করলেও পারতে। আমার কত শখ ছিল জানো?
সিতারা– চিন্তা করিস না ইসমার বিয়েতে সব শখ পূরণ হবে।
তাহজীব– তা তোর বিয়েতে পূরণ করতে সমস্যা কি? এমনভাবে বিয়ে করছিস যেন পেট বাঁধিয়ে ধরা খাওয়ার ভয়ে আছিস!
তাহজীবের কথা শুনে ইসমার রাগে গা জ্বলতে লাগলো। আজেবাজে কথা বলা যেন ফ্যাশন তাঁর!
সিতারা হেসে বললো, পেট বাঁধাই আর যাই করি সে নিয়ে আপনার মাথাব্যথা কেন? বিয়ে তো হচ্ছেই সে তো আর মাঝপথে ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেনা।
–যাক তাহলে স্বীকার করলি দায়বদ্ধতা আছে।
— আপনার জন্য মাঝেমধ্যে আমার আফসোস হয়। কথার সঠিক অর্থ বোঝেন না নিজের মনমতো গড়ে নেন। যাই হোক ভাবীকে এনেছেন নাকি বাসায় আটকে এসেছেন? আপনিতো আবার অনুষ্ঠানে ভালোবাসার মানুষকে শো করতে চাননা,,,
আফসানা এমন ভাবে সেজেগুজে এসেছে যেন তাঁরই বিয়ে। ইসমা তখন ফিসফিস করে বললো, তোমার বেলাই যতো নাটক করতো। দেখো বৌকে কিছু বলার সাহস পায় না।
আফসানা– ওমা সিতারা আপি আপনি এখনো রেডি হননি? ব্রাইডাল মেকাপে কত টাইম লাগে জানেন? এখন শুরু না করলে লেট হয়ে যাবে তো!
তাহজীব বাঁকা করে হেসে বললো, তাঁরা সাজতে পারেনা,আর হেভি সাজ ওর স্কিনে স্যুট করেনা।
ইসমা ত্যাড়া করে বললো, কে বলেছে আপু সাজতে পারেনা? ওর মেকাপ আর্ট দেখেছেন? আসলে আপুর গাঁয়ের রং টাই এমন সাজার প্রয়োজনই পড়েনি কখনো। আর আমাদের দুলাভাইয়ের এই সাজহীন আপুকেই বেশি পছন্দ। তিনি বারবার করে বলেছেন সিতারার ইচ্ছেমতো সব হবে, তাঁর সমস্যা হয় এমন কিছুই যেন করা নাহয়। শাড়িতে সমস্যা হলে সেটাও পড়তে নিষেধ করেছেন। আপু যে কত্ত স্বামীসোহাগী হবে এখনই টের পাওয়া যাচ্ছে।
তাহজীব রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল।
____________________

খুব সাধারণ বললেও আত্মীয়স্বজন নেহাতই কম আসেনি। মোটামুটি একটা উৎসবমুখোর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তাহজীব শত চেষ্টা করেও বরের পরিচয় বা ঠিকানা কারো কাছ থেকে জানতে পারেনি। সকলেই যেন মুখে তালা মেরে বসে আছে। তাঁর মা তো এতে আরো এক ধাপ এগিয়ে, তিনি সাফ বলে দিয়েছেন “কোনোরকম সমস্যা যদি বাঁধিয়েছিস আমার সঙ্গে তোর কোনো সম্পর্ক থাকবেনা।”
এই প্রথম তাহজীবের নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। বেশ স্বাভাবিকভাবেই সিতারার আর রাফসানের কাবিন সম্পন্ন হলো। দু’মাস পর অনুষ্ঠান করে সিতারাকে নিয়ে যাবে এমন কথা থাকলেও রাফসানের ফুফু আজকেই সিতারাকে নিয়ে যাওয়ার দাবি করলেন। এতে কেউই দ্বিমত করলোনা,যদিও সোফিয়া কিছুটা নাখোশ ছিলেন। এখানের সবাই জানে পরে অনুষ্ঠান হবে কিন্তু নিয়ে গেলে তো আর সেটা হবার সম্ভাবনা কম।
সিতারাকে বিদায় দিয়ে তাহজীবের মা তার ভাইকে বললেন, শুধুমাত্র তাহজীবের উপর রাগ দেখিয়ে এমন সহায়সম্বলহীন ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিলি। দেখিস আবার পরে যেন ভোগান্তি না হয়।
জহির সাহেব বললেন, রাফসান একা থেকে যদি এই অবধি টিকে থাকতে পারে তবে এখন কেন পারবেনা? তাছাড়া আমার মেয়েও তো আছে প্রয়োজনে ওরা দুজন মিলে সব গড়ে নিবে। ভাগ্যের চাকা ঘুরতে কতক্ষণ?

“এসব মুখে বলা সহজ। বাপের দিনের সম্পত্তি না থাকলে নতুন করে জোড়াবে সেই আশায় থাকা এখন খুব কঠিন। সবকিছুর যা দাম, যাই হোক তোর মেয়ে তুই যেখানে ইচ্ছে বিয়ে দিয়েছিস আমি বলার কে।”

“তুমি বলার কেউ না তা বলিনি আপা। তোমরা দোআ করো যেন ওরা ভালো থাকে।”

ইপ্সিতা সিতারাকে বেডরুমে বসিয়ে বললো, ভাবি আপনি যে কত লাকি বলে বোঝাতে পারবোনা। রাফসান ভাইয়ার মতো মানুষকে চুজ করাটা আপনার জীবনের বেস্ট ডিসিশন হবে দেখবেন। আমার বান্ধবীতো সেটা বুঝেনি আশা করি আপনি বুঝবেন।

রাফসানের মন আজ কেমন জানি অনুভূতিহীন। এই বিয়েটা সে কেন করেছে নিজেও জানেনা। যতো চেয়েছে সংসার ত্যাগ করে ভবঘুরে হবে ভাগ্য তাকে ফের সংসারে জুড়ে দিলো। সাফার স্মৃতিচারণ করাও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই! দুইটা ভিন্ন মানুষ যাদের জীবনে অন্য কেউ ছিল, আজ তাঁদের সন্ধি। অতীত আজ অবান্তর চিরকুট। নতুন জীবনটায় সবকিছু নতুন করে শুরু করার পথটা কি সহজ হবে? সে কি পারবে সাফার সব ভুলে সিতারাকে মনে জায়গা দিতে, কিংবা সিতারা কি পারবে তাহজীবকে ভুলে তাকে ভালোবাসতে?
এই প্রশ্নগুলোই ঘুরেফিরে মস্তিষ্কে হানা দিয়ে যাচ্ছে। মানুষের মন তো বদলাতে সময় লাগেনা। সময় হয়তো সব ঠিক করে দিবে।

“কি রে সারারাত কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি?”

“না এমনি দাঁড়িয়ে ভাবছি।”

নাঈম তাঁর কাঁধে হাত রেখে বললো, সাফার কথা ভাবছিস তাই না?

“সে তো সব ভুলে গেছে। আমি কেন ভুলতে পারিনা?”

“সে অন্যের সাথে আছে বলে তোকে মনে পড়েনা। এখন থেকে তোর ও মনে পড়বেনা দেখিস, মানুষ একা থাকলে পুরনো সব স্মৃতি ঘিরে থাকে। তুই এখন সেসব বাদ দে। তোর জীবনে সিতারার এমন নাটকীয় আগমন টা নিশ্চয়ই আল্লাহর লেখা তাকদির। এইদিকে আপাতত ফোকাস কর।”

“সাফার কি একটুও কষ্ট হবেনা যদি জানে আমি বিয়ে করেছি?”

ইপ্সিতা সেটা শুনে বললো, আপনি এখনো এসব ভাবছেন ভাইয়া? এমন সফটকর্ণার রাখলে তো চলবেনা। আপনি এখন অন্য কারো হাজবেন্ড, অতীতের কাউকে মনে রেখে তাঁর সঙ্গে অন্যায় করবেন না প্লিজ। এই হারটা আন্টি দিয়েছে, আপনার তো কোনো খবর নেই আজ যে নতুন বোকে কিছু গিফট দিতে হতো সেই খবর আছে?

রাফসান হেসে বললো, আমি অতোটাও ভোলামন না। মিস সিতারাকে অবহেলায় ফেলে রাখবো তা ভেবোনা।

রাফসান চলে যেতেই নাঈম বললো, সাফাকে বলেছিলে?

“হুম”

“কিছু বলেনি?”

“যা বলেছে তা বলার ইচ্ছে নেই”

“তোকে অন্য কারো হতে দেখা আমার জন্য কতোটা যন্ত্রণার ছিল আমি বলে বোঝাতে পারবোনা তারা! যে জীবনে তুই নেই সেই জীবন রাখার ইচ্ছেও আমার নেই। I quit….”

মেসেজটা দেখে শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল সিতারার। তাহজীব সত্যি সত্যিই কিছু করে বসে নি তো!

চলবে,,,,